কোথা থেকে শুরু করা যায়? তার কথা কিভাবে শুরু করা যায়? কোনো উপক্রমণিকার কি প্রয়োজন আছে? নাকি কোন ভনিতারই দরকার নেই! খুব অনাড়ম্বরে শুরু হোক না তার কথা, সমস্যা কী?
মেয়েটা নিখাদ মায়াবি। বাক্যটায় কোনো অতীত বা ভবিষ্যৎ ইঙ্গিত করতে পারছি না। কারণ ওর বর্তমান খবরাখবর আমি জানি না। কালেভদ্রে ফেসবুকে সার্চ করে ওর টাইমলাইন একটু দেখি। এতে ওর বর্তমান খবর ঠিকঠাক মতো পাওয়া যায় না। পেলেও স্বচক্ষে দেখা বা অনুভবের স্বাদটা মেটে না। কারণ ওর ফ্রেন্ডলিস্টে আমি নেই। রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে তীর্থের কাকের মতো বসে আছি বেশ কটা বছর। কোনো সদিচ্ছা-বিবেচনা নেই। কার্যত ও আড়ালেই যাপন করছে ওর নিজস্ব জীবন। নির্ঝঞ্ঝাট নির্জলা উন্নত জীবনযাপন। এই সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ওর কথা একাকি ঘরে ভাবলেও বিপদ। চতুর্দিকে নিষেধাজ্ঞার খড়গ বসানো। মনে হয় অসংখ্য সি সি ক্যামেরা মাছির চোখের মতো ঘরময় ঘুরছে। যেন চরম নিষিদ্ধ এক ভাবনা এটি। ওর কথা ভাবা মানেই ঠিক একটা খুনের অপরাধ। ফাঁসিও যেন বড়োজোর তার প্রাথমিক শাস্তি। এমনি ঘোরবিরোধী সময়ে সাদামাটা দিন যায় আমার। কি যেন একটা দমকা হাওয়ার ধাওয়া ঘাড়ে লাগে প্রায়ই। পেছনে তাকাই। ভাবি তার চুলের ঢেউ থেকে বুঝি উৎসারিত এই ঢেউ। আঁতিপাঁতি করে খুঁজি। পাই না।
ওর জাবর কাটা স্মৃতি উগরে-উগরে আবার খাই। মুছে ফেলা মেমোরি আবার রিলোড করি মাথায়। ভাল্লাগে। একটা চোখ হেসে হেসে চলে যায়। চোখটা আমার চোখের দেড়গুণ তো হবেই। তখন আমার প্রিয় নায়িকা শিল্পা শেঠই হওয়ার কারণ ছিল ওর চোখ আর হাসি। এ কারণে ও একইসঙ্গে খুশি ও রাগ করতো আমার ওপর।
যা-ই হোক,ওর সম্পর্কে বেশি বাড়িয়ে বলছি না। বাড়িয়ে বলাটাই ওর জন্য বরং কম হবে। ও হ্যাঁ, খুব ভালো চোখে কাজল দিতে পারত সে। একদম তলোয়ারের মতো বাঁকা করে। অথবা খালের ওপর কোনো পেট উঁচু সিমেন্টের সেতুর মতো করে। পাখির লেজের মতো মাঝেমাঝে কাজলরেখাকে আড়াআড়ি করে দিয়ে কত কত বিকাল-সন্ধ্যা বিলীন করে দিতো আমার!যেন ঝিম ধরা লাটিমের একাগ্রতায় পেয়ে বসত আমাকে নিমেষে।
ওর সম্পর্কে আর একটু বলি। ব্যস, আর একটু। ওর গায়ের রঙ বার্নিশ করা কাঠের মতো ছিল। কাঠে যেমন গাছটির বয়স নির্ণয়ের জন্য ঢেউ ঢেউ আঁকাবাঁকা রেখা থাকে তেমন কোনো দাগ ও ছিল না ওর শরীরে। হালকা বাদামি পশমগুলো ধানচারার মতো ফুটে থাকতো ওর ত্বকে। আর কি মিষ্টি গাইতে পারত মেয়েটা! তুমুল সব গান।
একবার খালিদের একটা গান আমাকে শুনিয়েছিল। সরলতার প্রতিমা! গানটা গাওয়ার সময় মনে হয়েছিল এই গানটা ও ছাড়া আর কেউ কোনোদিন গায়নি। ওই গানটা যেন আমাকে শোনানোর জন্যই শতবর্ষ ধরে কেউ একজন লিখে আসছিল। এ রকমই নান্দুনিক সব ফিচারে ভরা ছিল সে।
এবার আপনাদের মুল্যবান ধৈর্যটুকু আর হারাতে দেব না। নিজের কথায় চলে আসি। তখন আমি সবেমাত্র ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজে। দিনরাত একটাই চিন্তা মাথায়। কোনো মেয়ে মানুষের খপ্পরে পড়ি না কেন? সবাই পড়ে, কালো-সাদা-মেটে সব ছেলে প্রেমে করে মেয়েদের সঙ্গে। তবে আমিই কেন শুধু শুধু অবিচার সইব? পড়ালেখা করে বেশ বিদ্যাসাগর তো হয়েছি!এখন তবে একজন শকুন্তলার ব্যবস্থা হোক। দিন যায়।
২.
ইয়া মাইলখানেক লম্বা লম্বা লোহার পাইপ দিয়ে বালু এনে মহল্লার প্রায় সবাই নিজেদের ডোবা-নর্দমাগুলো ভরে ফেলছে ড্রেজারে। সেই নামার জলাভূমি দিয়ে দূরদুরান্ত থেকে স্টিমারে আসছে বালু। যেন হিড়িক পড়েছে বালু ভরাটের। বাদ যায়নি বড়বাড়ির ডোবাও। এখানে ৭-৮ দিন ধরে বালু ফেলা হচ্ছে। আমরা যারা পরীক্ষা দিয়ে গুষ্টি উদ্ধার করেছি বলে মনে করছি, তারা তো খুশিতে আটখানা। কারণ অন্তত কয়েকদিনের জন্য হলেও জুতসই সময়ে এ রকম একটা খেলার সাময়িক মাঠ পেতে যাচ্ছি আমরা। ওখানে নতুন বালুতে নতুন মাপে ক্রিকেট,ফুটবল,কোনো কিছু বাদ যাবে না।
এসব ভাবছিলাম আর লোহার পাইপের ওপর দিয়ে হাঁটছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে স্টিমারের কাছাকাছি এসে পড়েছি। কি অবাক ব্যাপার!পাইপে পাইপে এত ঘরবাড়ি ডিঙিয়ে পথটাকে টেনেটুনে প্রায় সোজা করে খালের ধারে প্রায় স্টিমারের কাছে চলে এসেছি! টের বলতে কিছুই পেলাম না।
কিন্তু জীবনের পথটা সেবার খুব করে বেঁকে যায়। সেই ফিরতি বাঁকা পথে একদম খেই হারিয়ে ফেলি আমি।
নতুন বালু এখনো শক্ত হয়নি ভালো করে। এরই মধ্যে আমরা ধুমসে খেলে যাচ্ছি। খেলতে খেলতে পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়। আর আমি পরীক্ষায় ভালো করে ফেলি। খুশি খুশি লাগে।
কিন্তু ঝামেলা শুরু হয়। আন্ধার গিঁট লাগে একটা। আব্বা একদিন এসে আমাকে বলেন, হাতে তার অত টাকা নেই যে, আমাকে আরও পড়াবেন। পড়তে চাইলে ছাত্র পড়াতে হবে। ঘরে হোক আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে হোক। আমাকে পড়াতে হবে!এ রকম অবস্থায় আমি ভাবনায় পড়ি।
ভাবছি আর পথ হাঁটছি। মনসুর আলির বাড়ির সরু গলিটা পার হয়ে কেবল বড়বাড়ির গলিতে ঢুকেছি, তখনই একটা মহিলার গলা শুনতে পাই। বাসার গেটে মহিলা ও তার মেয়েবয়সী একজন দাঁড়িয়ে আছে। আমি ফিরে তাকানোয় ভদ্রমহিলার গলার স্বর একদম নেমে গেলো। ইশারা করে আমাকে কাছে যেতে বললেন। আমি কিছুটা অবাক হয়ে কাছে যাই। মহিলা আমার পূর্ব-পরিচিত। দুই-একবার এলাকায় মহিলা মেম্বার পদে তার পোস্টার ঝুলতে দেখেছি গলির মোড়ে,বাজারের ইলেকট্রিক পোলে। তাই আমি একটু ভয় পেয়ে যাই। আন-ইজি ফিল করতে থাকি। মহিলার দিকে তাকানো ছাড়া আর কোনো দিকে তাকাতে পারছিলাম না তখন। হঠাৎ করে মনে পড়ে—ভদ্রমহিলা তো দূরের কেউ নন। পরিচিত। বেশ কদিন আগেও আমাদের ঘরে ভোট চাইতে এসেছিলেন। কথায় কথায় জানতে চেয়েছিলেন আমার কথা। ভালো রেজাল্টের কথা শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন আর ভরসা দিয়েছিলেন। সেই আন্টি তাহলে আমাকে ডাকলেন। আমি ভাবি। একটু সাহস আসে। এবার তার মেয়ের দিকে তাকাই। আবছা তাকাই। ঘোর লাগে সব কিছুতে। চোখ-মুখ-নাক সব ঘোলা মনে হয়। মুহূর্তের জন্য হলেও দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে পারছিলাম না। ফলে ফের আন্টির কথায় আমি মনোযোগ দেই।
আবার মেয়েটির দিকে তাকাই। এবার একটু স্পষ্ট করে তাকানোর চেষ্টা করি। মেয়েটিকে তো এলাকায় কখনোই দেখিনি। মেম্বার আন্টির মেয়ে হলে তো স্থানীয় হিসেবে অনেকবার মহল্লায় দেখা বা অন্তত মুখ চেনার কথা। কই, কখনো তো দেখিনি না কি অন্য কোনো আত্মীয়ের বাসায় ছিল এতদিন?
ভাবতে ভাবতে খুব সুন্দর,শান্তির,মনোরম আর আনন্দের একটা প্রস্তাব পাই আন্টির। তার মেয়েটাকে পড়াতে হবে। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র—এ কথা আন্টি ওইদিন আম্মার কাছ থেকে জেনেছিলেন। তাই নিজের মেয়েও বিজ্ঞানের ছাত্রী হওয়ায় তিনি আমার কথা হয়ত ভেবে রেখে খুঁজছিলেন।
সেদিন তাই সবকিছুই ওই বড়বাড়ির গলির মোড়ে হঠাৎ মিলে গেল আমার। একবারে জুতসই মিলে গেল। আব্বার কথা মনে পড়ল। তাকে আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না ভেবে ভালো লাগলো। ভালো লাগলো মেয়েটির কথা ভেবে। খুব বড় চোখ,উজ্জ্বল শ্যামলা ত্বক। ব্যস,এ টুকুই ছিল আমার প্রথম দর্শনের সীমানায়।
৩.
তখনকার বিকেলগুলোতে আশিক বানায়া আপনে টাইপের গানগুলো বাজত। এর-ওর বাড়ির ছাদ-ঘর-বারান্দা থেকে ভেসে আসত না কি সুরের সেই জাদুকর গানগুলো। ১৭-১৮ বয়সের কি যে উত্তাপ, আমি নিজেই টের পেতাম তখন।
কানে এসে সহজেই তীর লাগত আরও নানান ধরনের। চোখের তীর, কানের তীর—সব ধরনের তীর। আতিফ আসলামের গান, বাপ্পার গান, তাহসানের গান এসে এলোমেলো করে দিচ্ছিল সব। এ রকমই অস্থির সময়ে আমি সত্যি সত্যি একদিন মাস্টার হয়ে গেলাম। যেন-তেন মাস্টার নয়,একদম লাল চামড়ার চশমা পড়ুয়া বিজ্ঞ মাস্টার। আমার মুখের চামড়ায় তখনো কিছু ব্রনের দাগ উৎকীর্ণ ছিল, যেন তারা পুরোপুরি ভিটে মাটি থেকে ভাঙা ঘর তুলে নেওয়া হয়নি সে রকম।
অনেক গল্প আছে এমন। ভুরি-ভুরি এ রকম রোমান্টিক গল্প হয়ত আমরা পড়েছি, দেখেছি। আমার এই গল্পটাও ওই ভুরি-ভুরি অনেকগুলোর মধ্যে একটি। একদম আলাদা নয়,আগের মতোই—পরের মতোই। সব সময়ের মতোই। কিন্তু গল্পটা সময়ের মতো ছিল না। বরং সময়টা গল্পের মতো ছিল। মেয়েটা গল্পের মতো ছিল না,গল্পটাই মেয়েটার মতো ছিল। সুন্দর। মেদহীন।
অনুহা বেশ ভালো ছাত্রী। এটা টিউটর হিসেবে আমার কাছে ভালো খবর। আরও জানতে পারি যে সে ছোটবেলা থেকেই নারায়ণগঞ্জে নানাবাড়িতে মানুষ। এইখানে প্রায় নতুন মানুষ। নতুন সব গল্প। নতুন লাগে সব কিছু। জোয়ারের নতুন পানিতে নতুন পোনার মতো অনুভূতি আমাদের। দুই বছরের ব্যবধানের দুইটা মানুষ। আমি পড়াই ও পড়ে।
আমার ইংরেজির উচ্চারণে ও থমকে যায়। বুঝে কি না বুঝে জানি না,বেশ প্রশংসা করতে থাকে আমার। একদম ঠিক যেন নিজের পড়া আমি করছি মনে করে আমি ওকে পড়াতে থাকি। দিনগুলো যেতে থাকে। ধীরে ধীরে ওদের পরিবারে আমি বেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠি। অতিরিক্ত পরিমাণে নিয়মিত হয়ে পড়ি। গ্রামার বই—কেমন নলেজ, ম্যাথ—সব পড়াতে থাকি ওকে। মাস খানেক যাওয়ার পর বুঝতে পারি—পড়াশোনা একটু বেশি দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে ওর। মানে গণেশটা ঠিক উল্টে যাচ্ছে। পড়ার চেয়ে আমার দিকে ওর মনোযোগ বেশি বোধ হলো। তখন খানা-খন্দকে ভরা রাবিশের রাস্তাও মহাসড়কের মতো মসৃণ মনে হতো আমার কাছে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এশা অবধি আমি ওকে পড়াতাম। সব বিষয়। আর আমরা সারাক্ষণ ছুতো খুঁজতাম কিভাবে আরও অনেকক্ষণ পড়ার টেবিলে থাকা যায়।
পড়ার টেবিলটা বোবা বস্তু। না হলে ও কখনোই চুপ থাকতো না। একদিন কি একটা পড়ার বিষয়ে ধমক দেওয়ায় ছাত্রী আমার কেঁদে ফেলেছিল। তারপর কি ঝড় রে বাবা। ভাঁজ করা যায় এমন পড়ার টেবিলটা কি অপারগ নীরব ছিল সেদিন!ওর কলার থোড়ের মতো চোখ দুটা টকটকে লাল হয়ে গিয়েছিল। হাতের দশ আঙুল দিয়ে মুখটা ঢাকতে গিয়েও লুকাতে পারেনি লালচোখ। ছোট বাচ্চাদের মতো অভিমান জমিয়ে জমিয়ে ঠোঁট-নাক-গাল ফুলিয়ে পাকা আমের মতো অবস্থা করেছিল। ইশ! সে কি মুহূর্ত !
এভাবে পড়াতে থাকি আমি। ভালো আর বুদ্ধিমতি ছাত্রী হওয়ার কারণে ওকে পড়াতে বেশ সুবিধাই হতো আমার।
ওদের পরিবারটা আমাকে অবাক করত। ওর ট্যাক্সি চালক বাবা খুব বেশি কাজে মনোযোগী ছিলেন বলা যাবে না। কিন্তু ওর মা সংগ্রামী ছিলেন। আমি মাঝে-মাঝে হিসাব মেলাতে পারতাম না। জনপ্রতিনিধিত্ব করার মতো এত খরুচে হওয়ার সুযোগ ওদের ছিল না।
যাই হোক—আমার কথার ফাঁকে হালকা বলে নেই।
এরই মধ্যে আমি ভার্সিটি ভর্তির ব্যাপারে উঠেপড়ে লেগে যাই। নানান বইটই-কোচিং শিট ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করি। রাজধানী ও অন্যান্য বিভাগীয় ক্যাম্পাসে গিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার ধুম পড়ে যায় সেবার। টিউশনির টাকাগুলো কাজে লাগিয়ে মা-বাবার স্বপ্নটাকে জিইয়ে রাখার লোভ করি। অনুহা আমার এইসব কর্মকাণ্ডে–দিনযাপনে আরও তীব্রভাবে সেঁটে যায়।
তিনচার মাস কাটে। আমি ঢাকার বাইরে পড়তে যাব, এমনটাই চূড়ান্ত হয়ে গেল। কিচ্ছু করার নেই। অনুহা বিপাকে পড়ে। ও ভাবতেই পারেনি যে, আমাকে ঢাকার বাইরে পড়তে যেতে হতে পারে। ওর দিন খারাপ যায়। আমারও। এ রকম অবস্থায় ও আমাকে একটা শার্ট গিফট করে একদিন। হালকা নিল রঙের ওপর ছোপ ছোপ শেডের ছাপ। আমার ক্রমপ্রসারমান কাঁধে বুকে খুব সুন্দর করে এঁটে গিয়েছিল সেটা।
এরপরে দিনগুলো সুখের ছিল না আমাদের দুজনের কারোরই। আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার এক দেড় বছর পার করে ফেলেছি। ঢাকায় মাসতিনেক পরপর আসি। ভেকেশানে ঢাকায় আসলে একদম ঘুড়ির মতো হয়ে যাই।
ফাঁকে ফাঁকে অনুহা সকাল বেলা এসে আমার ঘরে ঢুকে। কলেজের কি যেন একটা কাজ। অনুরোধ করে তার সঙ্গে কলেজে যাওয়ার জন্য। যাই। টেস্ট একজামে খারাপ করায় একটু সাক্ষীটাক্ষী টাইপের কিছু দিয়ে বন্ড সই দিয়ে আসি। অনুহা আমাকে বলে— স্যার, তুমি তো আজব মানুষ, আমাকে একদম ভুলেটুলে সারা। তুমি কি পাল্টে গেলে?
আমি আকাশ থেকে পড়ি। বলে কি মেয়ে! এমনিতেই ওর সম্বোধনের ভঙ্গিটার জন্য ওকে আরও আপন লাগত। স্যার বলে তুমি তো কথা চালানো, এ এক অদ্ভুত সুন্দর ডাক যেন। আমি বলি–তুমি তো বেশ কাটাচ্ছ সময়। নতুন বন্ধুবান্ধব। কলেজের দুটা বছর তো বেশ কাটিয়ে দিলে। শুনলাম জুয়েল নামের একটা ছেলে তোমার ক্লাসমেট তোমাকে গিফট দিচ্ছে, ঘোরাঘুরি করছ। মডেল টেস্ট, কোচিং ফাঁকি দিয়ে এদিক-ওদিক দেদারসে আড্ডা দিচ্ছ। এ জন্য রেজাল্ট খারাপ করেছ,দুই সাবজেক্টে তোমার মার্কস ফল করেছে। আর তুমি আমাকে বলছ আমি তোমাকে ভুলে গেছি। ভালোই তো মশকরা করতে শিখছ।
অনুহা লজ্জা পেয়েছিল। সেই মুহূর্তে আমার কথাগুলো মুখ দিয়ে বের হবার জন্য একদম প্রস্তুত ছিল না। ওর এই লজ্জাটা আমার ভালো লেগেছিল। কারণ আমি জানতাম অসম্ভব ইচ্ছাগুলোর কোনো অভিভাবক থাকে না। ওগুলো বরাবরই বেওয়ারিশ হয়। তাছাড়া ওরই বা কী দোষ! মিষ্টি মেয়ে। ওর মাথায় বুদ্ধির চাষাবাদ সবসময়। সুন্দর চোখ-হাসি-চাহনি সব ছিল অপহৃত হওয়ার মতো। ওইসব জুয়েল-টুয়েল দের কী অন্যায়? বয়সটাই তো অভ্যাস পাল্টানোর, পোশাক বা মানিব্যাগ পাল্টানোর মতো। তাই আমি আর ওকে কিছু বলি না। কারণ সম্পর্ক বলবৎ রাখার মতো অলঙ্ঘনীয় কোনো চুক্তি আমাদের ছিল না। অনুহা আর আমি তাই বাস্তবে পা ফেলি।
এরই দুইমাস পর অনুহার হঠাৎ একটা চাকরি হয়। আমি খোঁজ করি ও ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে কি না কিন্তু ও আমাকে ওর চাকরির খবর দেয় কেবল। আমি হতাশ হই। অবাক হই। এত ব্রাইট ব্রেনের মেয়ে পড়াশুনাটা তো একদম বন্ধ করতে পারে না, তাই না? উচিত না।
ওর জব এপ্লিকেশানটাও আমি লিখে দেই। অন্য আরেকজন ছেলেবন্ধুর হেল্পে জবের বাকি কাজটা এগিয়ে নেয় ও। জবটা ওর ভালোভাবেই হয়ে যায়। এয়ারলাইন্সে জব। রিসেপশানে বসবে।
আমি কষ্ট পাই কি পাই না ঠিক বুঝতে পারি না।
৪.
অটোয়া শহরের শেষ প্রান্তের দিকে একটা ঢালু পথের সুন্দর একটা ছবি। একটা মেয়ে রোদচশমা পড়ে ছবির ঠিক সামনে। কি সুন্দর হাসি তার! সমুদ্রে-পাহাড়ে তার ভুবনভোলানো রূপ। মোবাইলের স্ক্রিন থেকে যেন আমার চোখ সরে না। ভেতর থেকে হাহাকার আসতে থাকে আমার। মনে হয় চুপসে যাই কোনো এক ফাঁকে। কোনো এক অজানা কাঁপুনি লাগে মাথা থেকে হৃদপিণ্ড হয়ে পায়ের পাতা পর্যন্ত। তারপরও স্ক্রল করে ওর টাইমলাইন দেখতে থাকি স্বাভাবিক হয়ে। পোশাক-আশাকে কি পরিবর্তন! দুর্দান্ত সব নৈসর্গিক দৃশ্য।
হঠাৎ চোখ স্থির হয়ে যায় আমার। মেয়েটার স্ট্যাটাসে চোখ বোলাতে বোলাতে একটা পোস্টে ফেবিকলের মতো আটকে যাই চোখে। লেখা:
ও স্যার, তুমি কেমন আছ? কতদিন দেখি না! তুমি ভাবছ কেন তোমার রিকু আমি একসেপ্ট করি না, তাই না? এটা আমি তোমাকে কখনোই করব না। তার কারণ ও বলব না কোনোদিন। এই পোস্টটা তোমার জন্যই পাবলিক করেছি জানি তুমি প্রতিদিন আমাকে চেক করো। এখানে এই নীল জলরাশি তো তোমার চেয়ে কোমল নয়! এই অন্টারিওর বাতাসে তোমার ছোঁয়া পাই না। কোনো কাজে দূরের শহর নভা স্কটিয়া কিংবা আলবারটা যেখানেই যাই না কেন, সবখানেই সরল হাসি হীরার মতো দুর্লভ। জানো স্যার? এখানে আমি ঘড়ির মতো মেপে মেপে চলি,তুমি যে আমার ছবিগুলো দেখছ, এগুলো মাস শেষে আধ ঘণ্টার লাফালাফি ছাড়া আর কিছু না। আর তোমরা ওখানে বসে বসে কী যে ভাবো আমাদের!এইখানে গ্রিনকার্ডের একটা সবুজ কুৎসিত ভূত আমাদের কাঁধে বসে থাকে অহর্নিশ। সরাতে পারি না, তোমাদের এখানে আসতেও পারি না। মেয়েমানুষ। বয়স তো তুমি জানোই। বিয়েটা পর্যন্ত করতে পারলাম না। ওহহো ভালো কথা, যে জন্য স্ট্যাটাসটা দিতে বসলাম, সেটাই লিখলাম না। তোমার সেই ফ্যাকাশে নীল শার্টটার একটা স্পেয়ার বাটন এইখানে সঙ্গে করে আমি নিয়ে এসেছিলাম । তোমাকে জানাইনি তখন। শেষবার আমি তোমাদের বাসায় যাওয়ার দিন হ্যাঙ্গারে রাখা শার্টটা থেকে কেটে রেখেছিলাম তোমার আড়ালে। ভেবেছিলাম শার্টটা তো তোমার কাছেই থাকবে। তোমার প্রিয় শার্টের একটা বোতাম না হয় এটলিস্ট আমার কাছে থাকুক। তাতে কি এমন ক্ষতি হবে পৃথিবীর! নিচে বোতামটির ছবি দিয়ে দিলাম। স্যার ভালো থেকো।