এক.
এখনো রাত শেষ হয়নি। ডাক্তার বলেছিল, মাথাব্যথাটা ঘুম না হওয়া থেকে। তখনই ইকবাল সাহেবের মনে হলো, ঠিকই তো! কতরাত ঘুমাতে পারেননি। আগে রাতে খুব ভালো হতো। একঘুমে রাত শেষ। সূর্য ওঠার আগে তার ঘুম ভেঙে যেত। ভোররাতে উঠে ফজরের নামাজ পড়ার লোক ইকবাল সাহেব না। তিনি উঠতেন একটু হাঁটার জন্য। ঘণ্টাখানেক দ্রুত হাঁটতেন। তিনি ডায়াবেটিকসের রোগী। হাঁটা ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। জীবনের এতটা পথ পাড়ি দিয়ে আজকের পর্যায়ে এসেছেন। অর্থবিত্ত হয়েছে। নিজে ভালো ঘরে বিয়ে না করতে পারলেও ছেলেদের ভালো ঘরে বিয়ে করিয়েছেন। মেয়েরা বিদেশে পড়তে পেরেছে। সেখানেই বিয়ে-থা করে সেটেলড হয়েছে; অবশ্য সেটা ইকবাল সাহেবের মতেই। যতটুকু জানেন, ছেলেমেয়েরা যার-যার অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত, ভালো আছে। চার হাজার টাকা নিয়ে পথে নেমেছিলেন। বাবা কোত্থেকে জোগাড় করে দিয়েছিলেন এই টাকা, ইকবাল সাহেব তখনো জানতেন না। এখনো জানেন না। বাবা দিনমজুর ছিলেন, পঞ্চাশ টাকায় ক্ষেতে হাজিরা দিতেন, ছেলেমেয়ের মুখে ডাল-ভাত তুলে দিতে দিতে সে টাকা দিনে দিনেই হাওয়ায় মিলিয়ে যেত। বাবার কাছে চার হাজার টাকা কোত্থেকে এসেছে, আজও ইকবাল সাহেব ভেবে পাননি। সেই চার হাজার টাকা নিতে গিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক ফেল করা ছাত্রটি দেখেছিল, বাবার হাতে কালো-কালো দাগ। ফোস্কা পড়ে আছে কয়েক জায়গায়। সেই টাকা, ব্যবসায় নামলেন, তাও আবার শাক-সবজির ব্যবসা। আস্তে আস্তে পরিবর্তন হতে লাগলো সময়। যেদিন একমুঠো টাকা নিয়ে বাবার হাতে তুলে দিয়ে ইকবাল সাহেব বলবেন, বাবা, তোমার টাকা জলে ফেলিনি। সেদিন গিয়ে দেখলেন, বাবার খাঁচা শূন্য। পাখি উড়ে গেছে। বাবার হাসি মুখ আর দেখা গেল না। দাফন কাফন শেষ হলে বাবার বন্ধু শুক্কুর মুন্সী ইকবাল সাহেবকে ধরে কেঁদে ফেললেন, বাপরে তোর বাপেরে তো চিকিৎসা করাইতে পারলাম না। টাকার টানাটানি ডাক্তার কবিরাজের কাছে গেল না। আমার হাত খালি, দশটাকাও হাতে ছিলো না। কইলাম তোরে খবর দিতে। তোরেও জানাইলো না। বড় অভিমানী আছিল তোর বাপ।
বাবা মারা গেলেন বিনা চিকিৎসায়। অথচ আজ, এই ত্রিশ বছরের ব্যবধানে ইকবাল সাহেব ধনী থেকে আরও ধনী হয়েছেন। টাকার কুয়ো থেকে টাকার পাহাড় বানিয়েছেন। টাকার নেশায় যেন তাকে পেয়ে বসলো দিনের পর দিন। নিজের দিকে তাকানোর সময় কই। সময় নেই। তবে সংসারে একেবারে বেখেয়ালি ছিলেন না। ছেলে মেয়ে ঠিকই মানুষ হয়েছে। স্ত্রী শাহেলা একাই সব সামলেছেন। অফিসে, বাসায়, বন্ধুদের আড্ডায় ইকবাল সাহেব সবসময় হাসিমুখে থাকেন। তাকে দেখে সবাই ঈর্ষা করে। এখনো করে, তার মতো কেউ সুখী নেই। ঝামেলা নেই। ছেলেমেয়েরা মানুষ হয়েছে। টাকা পয়সার কমতি নেই। এখন ইকবাল সাহেবের বয়স হয়েছে। তিনি খাবেন, নামাজ পড়বেন, ঘুমাবেন, গল্প করবেন। এ বছর ইকবাল সাহেবের বয়স ষাটের কাছাকাছি পৌঁছেছে হয়তো। সঠিক বয়সটা কত, তা নিজে জানেন না। জানার ইচ্ছেও ছিল। এখন মরে গেছে। বয়স হয়েছে সত্যি; এ বয়সে মানুষ খায়-দায় ঘুমায়, তাও সত্যি; কিন্তু ইকবাল সাহেবের প্রতি ঈশ্বর যেন অবিচার করেছেন জীবনের প্রতি পদেপদে। রক্তকে ঘাম করে টাকা বানালেন, বাড়ি করলেন, এসি থাকল রুমে কিন্তু পছন্দের খাবার খেতে পারেন না ইকবাল সাহেব। ডায়েবেটিক নামের রোগটা সব স্বাদ-আহ্লাদ সেই কবেই মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে গেছে। মিষ্টিজাতীয় কিছুই খেতে পারেন না তিনি। কি আশ্চার্য! জীবনে কোনো কিছু কখনো তিনি চুরি করেননি, একমাত্র মিষ্টি ছাড়া। এই ঢাকা শহর ছাড়িয়ে, মেঘনা ছাড়িয়ে, আরও উত্তরে, আরও পাড়াগাঁয়ে, যে গ্রামের নাম পাইককান্দি, সে গ্রামের বাজারে খালেক ভাইয়ের মিষ্টির দোকান। রসগোল্লা। এই বস্তুটার প্রতি স্কুল-কলেজ জীবনে কী কারণে এত লোভ ছিল, ইকবাল সাহেব ভেবে পান না। মাসে দুই-একদিন পাঁচ টাকা দিয়ে মিষ্টি কেনা হতো। জীবনটা গিয়ে থাকত যেন রসগোল্লার ভেতরে। যে মাসে টাকা জুটতো না, সে মাসে খালেক ভাইকে ফাঁকি দিয়ে একটি রসগোল্লা মুখে পুরে দিতেন। খালেক ভাই কখনো টের পায়নি ব্যাপারটা। তবে এই চুরির ঘটনা বেশি নেই। পাঁচ-সাত বার। এখন এই বয়সে এসে মনে হয়, খালেক ভাই হয়তো জানতেন তার মিষ্টি কে মাঝে মাঝে উধাও করে! হয়তো টের পেতেন, কিন্তু কিছু বলতেন না। কিন্তু এখন বছরে এক-আধটা মিষ্টি হয়তো চেখে দেখতে পারেন। বেঁচে থেকেও খাবারের বাছ-বিচারে ইকবাল সাহেব যেন মৃত।
বুড়ো বয়সের কাজের মধ্যে খাওয়া যেমন ইকবাল সাহেবের কপালে নেই, তেমনি ঘুমও নেই। আশ্চর্য, বাবা প্রায়ই মারতেন, মা বকা দিতেন সেই স্কুল বেলায়। পড়তে গিয়ে চিউনিতে বসে এশার আজানের আগেই ঝিমুতে থাকতেন। কখন ঘুমিয়ে পড়তেন তা টেরই পেতেন না। অথচ সামনে বই হা করে খোলা। রোজার দিন তারাবির সেজদাহে গিয়ে কতদিন ঘুম এসে গেছে নিজের অজান্তেই! ঘুমের জন্য পড়তে পারতেন না। ফলস্বরূপ পরীক্ষায় বছরের পর বছর ফেল। মাস্টাররা ডাকতেন, এই আদুভাই, পড়া তো পারিসই না জানি, বল তো তুই আর কতদিন এভাবে চলবি?
বিয়ে করেছিলেন হাতে দুই পয়সা যখন আসতে শুরু করেছে, তখন। বয়স তো কম হয়নি। শাহেলার সঙ্গে বিয়ে যেদিন, মানুষ উত্তেজনায় বাসর ঘরে জেগে থাকে। বড়জোর শোনা যায়, মেয়েরা কখনো কখনো ঘুমিয়ে থাকে কিন্তু ছেলেরা যে বাসর ঘরে নতুন বউয়ের সঙ্গে বাক্য বিনিময় না করেই ঘুমিয়ে পড়ে, তা বোধহয় ইকবাল সাহেবই প্রথম করেছিলেন। আশ্চর্য, মনে মনে কত রঙে সাজিয়েছিলেন বাসর। শায়েলাকে কী কী বলবেন, তাও ঠিক করে রেখেছিলেন। কিন্তু সারা দিনের ক্লান্তিতে এমন ঘুম ধরলো, তিনি জাগলেন পরদিন বেলা দশটায়! শায়েলা সংসার জীবনে কতবার হাসতে হাসতে এই খোটা দিয়েছেন তাকে! আর সেই ঘুম কাতুরে মানুষটার ঘুম আসে না চোখে! ঈশ্বর তো দারুণ খেলছেন তাকে নিয়ে। ঈশ্বর যেন চিরশত্রু তার। যেদিন টাকা হলো, আরাম করে খাবেন, কয়েকদিন পর ডায়াবেটিক হলো অতপর পছন্দের খাবার বন্ধ। মশার কামড়ের জীবন থেকে যেবার বাড়ি করে এসি লাগিয়ে ভেবেছিলেন, যাক এবার একটু নিশ্চিন্তে ঘুমানো যাবে! কই, কোথাকার নিশ্চিন্ত! ঘুম যেন চোখ থেকে উঠে গেছে। রাতের পর রাত জেগে থাকেন। শাহেলার বয়স হয়েছে। তিনি ঘুমায়: মাঝে মাঝে টের পায় ইকবাল সাহেব হয়তো ঘুমাননি। ইকবাল সাহেব অবশ্য ব্যাপারটাকে ঢেকে রাখতে চান। স্ত্রী কিছু বললে বলেন, না এমনি জেগে আছি। এখনি ঘুমিয়ে পড়ব। ডাক্তার বললেন, ভালো করে ঘুম দেন মাথাব্যথা ভালো হয়ে যাবে। ইকবাল সাহেব মিনমিন করে বলেছিলেন, আর কতবার বলব ডাক্তার, আমার তো ঘুম আসে না। ডাক্তার যে ওষুধপত্র দিলেন, তাতে ঘুম আসার কথা। অথচ, সন্ধ্যায় ওষুধ খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লেন, ভেবেছিলেন এখনি ঘুম এসে পড়বে। কিন্তু, ব্যাপারটা হলো উল্টো, আগে যা-ইবা রাতে এক আধঘণ্টা ঘুমাতেন, আজ সারারাত একফোটাও ঘুম আসেনি। এখন জেগে জেগে কত কথাই না ভাবছেন। শাহেলা ঘুমিয়ে আছেন। আরামছে ঘুমাচ্ছেন। ইকবাল সাহেবের কেমন যেন হিংসা হয়। মনে হয় শায়েলার ঘুমটা ভাঙিয়ে দেন। শাহেলার দিকে এক পলক তাকিয়ে ইকবাল সাহেব বিছানা ছাড়লেন। একটু হাঁটতে বের হবেন। হঠাৎ মনে হলো, গ্রামে একবার যাই না কেন! বাবার হাতে গড়া ভাঙাচোরা একটুকরো বাড়িটা দেখে আসি। মায়ের কবরটার এখন কী হাল হয়েছে, কে জানে! ঠিকঠাক করা দরকার। গ্রামে গেলে হয়তো তার ভালো লাগবে। দুপুরে এ কথা শুনে শায়েলা আপত্তি করলেন না। অনেকদিন পর ইকবাল সাহেবের মনে যেন একটু প্রশান্তি নামলো।
দুই.
কয়েকদিন আগেও ইকবাল সাহেব ঘুমহীন রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলেন জীবনটা এই বয়সে এসে কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। ঘুম যেন তার তাবৎ সুখ কেড়ে নিয়ে গেছে। মাথাব্যথা অসহ্য লাগছে। এতটাই অসহ্য ইকবাল সাহেব ভাবলেন এভাবে জীবন টেনে নেওয়ার মানে নেই। কী দরকার! তারচেয়ে ভালো মরে যাই না কেন। ডাক্তার কিছু ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল খেতে। প্রতিরাতে একবার খেতে হয় ঘুমের ওষুধ। ইকবাল সাহেবের হঠাৎ মনে হয় তার কাছে ঘুমের দু’পাতা ট্যাবলেট আছে। একসঙ্গে দুপাতা ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে কেমন হয়? চিরনিদ্রায় ঢলে পড়বেন না হয়। তবু তো ভালো। জীবন থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। ঘুমের ট্যাবলেটগুলো সেদিন থেকে পকেটে পকেটে রাখেন ইকবাল সাহেব। যন্ত্রণা অসহ্য মনে হলে একগ্লাস পানিতে গুলে সবগুলো খেয়ে ফেলবেন। হয়তো তারপর গ্রাস করে নিবে মৃত্যু…। কিন্তু আজ গ্রামে ফিরে যেতে যেতে ইকবালে সাহেবের আত্মহত্যার ধারণাটা পাল্টে গেল। মন যেন হঠাৎই বদলে গেল। বাস থেকে নেমে রিকশায় উঠতে উঠতে পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে তিনি পরখ করে দেখেন, না ট্যাবলেটগুলো আছে পকেটে। রিকশায় তার পাশে বসা শাহেলা। অথচ হাসিমুখে বসে থাকা ইকবাল সাহেবের মনে কী ভয়ঙ্কর চিন্তা চলছে, তা হয়তো তিনি একটুও আঁচ করতে পারেননি। শাহেলা ইকবাল সাহেবকে আনমনা দেখে বললেন, দেখেছো, তোমাদের গ্রাম কত বদলে গেছে! সব বদলে গেছে। ইকবাল সাহেব সচকিত হয়ে চারদিকে তাকালেন। রিকশা তার চিরায়ত গতিতে চলছে। হ্যাঁ, গ্রামটা আর আগের মতো নেই। সেখানে খাল ছিল, পরে সাঁকো ছিল, তারও পরে কালভার্ট হলো, এখন তার কিছুই নেই। গ্রামের প্রতিটি অলিগলিই পাকারাস্তা দখল করে আছে। পাইককান্দি বাজারের দুই-চারটি দোকানের জায়গায় এখন চল্লিশ-পঞ্চাশেক দোকান। বাজারের নামও পরিবর্তন হয়েছে। পাইককান্দি সুপার মার্কেট! ইকবাল সাহেব আশ্চার্য হন। বাড়িতে যাওয়ার পথে মনে মনে খালেক ভাইয়ের দোকানটা খোঁজেন। প্রিয় মিষ্টির দোকান। না নেই। এ বাজারে তো এখন কোনো টিনের দোকানই নেই। কিছুটা হতাশ হলেন যেন। নিজের বাড়ির সামনে এসে ইকবাল সাহেবকে আরও থমকে থমকে যেতে হয়। দুই বিঘা জমির ওপর দাঁড়ানো বাড়িটাতে তিনি জীবনের অর্ধেক সময় কাটিয়েছেন, কত স্নেহ, মায়া জমা আছে এ বাড়িটাকে ঘিরে। আজ সে বাড়িটা দেখে ইকবাল সাহেবের বুক খা-খা করে উঠলো। গ্রামের সবকিছু পরিবর্তন হলেও বাড়ি যেন মুমূর্ষু থেকে মুমূর্ষুতর পর্যায়ে চলে গেছে। ঘরের দরোজাটা হা করে খোলা। মানে ঘরে কি এখনো কেউ থাকে? কে থাকে? দুই-একজন মানুষ জমেছে ইকবাল সাহেবকে দেখে। তারাই ব্যাগ, জিনিসপত্র নামিয়ে দিচ্ছে। ইকবাল সাহেব খোলা দরোজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েন। খোপ-খোপ দুটি রুমের মতো। এখনো আছে। বেড়া ভেঙে নুয়ে আছে। মাকড়শার জালে ঘর ভর্তি। ঘরের ভেতর ঝাটা পড়েনি দশ বছর হবে। দ্বিতীয় খোপটাতে ঢুকে ইকবাল সাহেব থমকে দাঁড়ান। একজন মাঝবয়সী মহিলা শুয়ে আছেন মাটিতে। এলোমেলোভাবে বাসনকোটা জামা কাপড় ছড়ানো। ভেবে পেলেন না কে ইনি, তাদের বাড়িতে থাকছে। তাও এই দরিদ্রদশা। মহিলা ঘুমাচ্ছে বেঘোরে। ইকবাল সাহেব যে এসেছেন তিনি সেটা হয়তো টের পাননি। ইকবাল সাহেব পেছনে তাকিয়ে দেখেন তার পেছনে কিছু উৎসুক মানুষ। তিনি কাউকে চিনতে পারলেন না। চেনার চেষ্টা করলেন। তখনি দেখলেন, একটা বিশ-পঁচিশ বছরের যুবক, এদিকেই আসছে। ইকবাল সাহেব চোখ কচলিয়ে আবার তাকালেন যুবকের দিকে। কি ব্যাপার ভুল দেখছেন না তো? খালেক ভাই। সেই মিষ্টি দোকানদার খালেক ভাই। আশ্চর্য, খালেক ভাই এখনো আগের মতোই আছেন। এ কী করে সম্ভব! ত্রিশ বছর পরও খালেক ভাই তাগড়া জোয়ানই রয়ে গেলেন! ইকবাল সাহেব আনন্দিত হয়ে বললেন, খালেক ভাই না? খালেক ভাই? যুবক কাছে এসে তার হাত ধরলো। বলল, কাকা, আমি খালেক ভাই নই। আমি তার ছেলে। মালেক। লোকে বলে আমি নাকি বাবার মতো দেখতে। ইকবাল সাহেব যেন একটু লজ্জা পেলেন। তিনি শাহেলার দিকে একবার আড়চোখে তাকালেন। শায়েলা নির্বিকার। এতে তার উৎসাহ নেই। মালেক বলল, কাকা, আম্মা আপনাকে নিয়ে যেতে বলছে। আসেন। ততক্ষণে আপনার ঘরটাকে ঝাড়মোছ দিয়ে ঠিকঠাক করা যাবে। ইকবাল সাহেব আর শায়েলা চললেন মালেকের সঙ্গে। পাশেই খালেক ভাইয়ের বাড়ি। খালেক ভাইয়ের কী খবর, কে জানে? হঠাৎ করেই ইকবাল সাহেব মালেককে বললেন, ঘরে যে মহিলাকে দেখলাম শুয়ে আছে…। মালেক হাসে। বলে, কাকা, আপনি চিনবেন না। পাগলি একটা। মাসখানেক হলো সে এখানে থাকে। কেউ পাগলির ঠিকানা জানে না! ইকবাল সাহেব মনে মনে হতভম্ব হয়ে গেলেন, তার বাপের ভিটা এখন পাগলের বাসা? মাথাব্যথাটা হঠাৎ করেই আবার বেড়ে গেল। চারদিক কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে…
তিন.
খালেক ভাই বিয়ে করেছেন, এ কথাটা জানতেন। কিন্তু ভাবিকে দেখা আর হয়নি। ইকবাল সাহেব স্বাভাবিকভাবেই তাকে চিনলেন না। তাদের বসতে দিয়ে ভাবি নাস্তা করে আনলেন। কিন্তু ততক্ষণে ইকবাল সাহেব কষ্টে ছিলেন। তিনি বারবার খালেক ভাইকে খুঁজছিলেন। খালেক ভাই কোথায়? বলতেই ভাবির মুখ যেন কিছুটা মলিন হলো। তারপর বললেন, উনি তো…। আপনার কথা কত বলতেন। বলতেন, ইকবাল কিন্তু মেধাবী ছিল। পরীক্ষায় ফেল করলে কী হবে। আপনি নাকি খুব রসগোল্লা পছন্দ করতেন। ইকবাল সাহেব হেসে বললেন, ভাবি, পছন্দ মানে, পয়সা হাতে না থাকলে চুরি করেও খেতাম। হা হা হা। হাসতেই গিয়েই মাথার পেছনের দিকটা দপ দপ করে উঠলো। মাথাব্যথাটা সারছে না। ইকবাল সাহেবের মুখ বিকৃত হয়ে গেল কিছু মুহূর্তের জন্য। রাতে ঘুমাতে না পারলে এই ব্যথা সারবে না হয়তো। ইকবাল সাহেব নিজের অজান্তেই তার পাঞ্জাবির পকেটে আবার হাত বুলালেন। ট্যাবলেটগুলো আছে। পড়ে যায়নি। তার মাথায় আবার আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর চিন্তাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। তবু তিনি হাসিমুখে নাস্তা খেতে লাগলেন। মনে মনে ঠিক করলেন রাতে ভয়ানক কিছু একটা করবেন হয়তো।
ইকবাল সাহেবদের ঘর ঠিক হয়ে গেল। মালেক কাজের ছেলে। দু’দিনেই সে ঘরটা ঝকঝকে করে তুলেছে। ভাঙাচোরা সারিয়ে ফেলেছে। ইকবাল সাহেব ঠিক করে এসেছিলেন গ্রামে সপ্তাহ খানেক থাকবেন। মালেক বলেছে, তাদের ঘরেই যেন ইকবাল সাহেবরা খান। তিনি রাজি হলেন। তৃতীয় দিন ইকবাল সাহেবের খুব ভালো কেটে গেল। মালেকের সঙ্গে বাজারে গেলেন। স্ত্রীর কাছে গোপন রেখে মিষ্টিও খেলেন। রাতে শাহেলা খাবার খেয়ে শুতে গিয়ে বললেন, আমার কাছে ঢাকার চেয়ে পাইককান্দিই ভালো লাগে। শহরে কেউ নেই। ছেলে-মেয়েরা সব দূরে দূরে। ইকবাল সাহেব কী কী যেন বললেন। তারপর কখন যে দু’জনই ঘুমিয়ে পড়লেন কেউই বলতে পারবেন না। রাতে যে একটা ঘটনা ঘটে গেছে ইকবাল সাহেবকে কেন্দ্র করে, তা শাহেলা টের পেলেন পরদিন দুপুরে। যখনই ঘটনাটা টের পেলেন, তখনই বুকটা ধক করে উঠলো। তিনি হন্যে হয়ে ইকবাল সাহেবকে খুঁজতে লাগলেন। মালেককে দিয়ে খবর পাঠালেন বাজারে। অবশেষে বিকেলের দিকে ইকবাল সাহেব হাসিমুখে বাড়ি ফিরলেন। তার লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরার স্টাইল দেখলে কেউ বলবে না ইকবাল সাহেব কোটিপতি মানুষ। ইকবাল সাহেব এসেই বললেন, আমি আর শহরে ফিরছি না। তুমি কি খেয়াল করেছ গতকাল রাতে আমার গাঢ়ঘুম হয়েছে? শাহেলা কপট গম্ভীর গলায় বললেন, সেজন্যই খুঁজছি তোমাকে। দেখলাম শুধু ঘুমাচ্ছোই না, নাকও ডাকছো। তোমার ইনসমিনিয়া ভালো হয়ে গেছে দেখছি। ইকবাল সাহেব স্ত্রীর চোখে চোখ রেখে বহুদিন পরে হাসলেন। কোনো কথা বললেন না। কোনো কথা মাথায় আসছে না তার। মালেক কোথায় যেন যাচ্ছিল। তিনি মালেককে ডাক দিলেন। মালেক বাড়িটা ভালো করে মেরামত করো। হয়তো আর ঢাকা ফিরব না।
ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে গ্রামে। মাগরিবের আজান হচ্ছে। সন্ধ্যার পরিবেশ যে এত আনন্দময় হতে পারে আজ এমন মুহূর্তের মুখোমুখি না হলে ইকবাল সাহেব হয়তো বুঝতে পারতেন না। শাহেলা দেখলেন, তার ষাটে পা দেওয়া স্বামী হা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে পৃথিবী মুগ্ধতা, মুখে প্রশান্তি সান্ধ্য রেখা ছুটছে…