রবীন্দ্রনাথ দেখিতেছি কোটেশনে মুখ রগড়াইতেছেন। তিনি মানুষ হইতে চাহিয়াছিলেন, আমরা তাহাকে ঠাকুর বানাইয়া ছাড়িয়াছি। এখন কাকে তাহার মাথায় পটি করিতেছে। ঠাকুরের গায়ে কুকুর ঠেং তুলিয়া যা করার, করিয়া চলিয়াছে। প্রতি মোড়ের মাথায় রিকশা স্ট্যান্ডের গায়ে আমাশাক্রান্ত বাঙালি যেমন কপালে হাত ঠুকিয়া শনি দেবতাকে বলিতেছে দুঃসময়টা পার করিও হে ঠাকুর, তেমনি মূর্তি গড়িয়াছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। বাঙালির হাঁচিতে-কাসিতে-বিবাহে-শ্রাদ্ধে তাহাকে টানিয়া স্বর্গ হইতে নামাইতেছে। চুরি হইলেও তিনি আমাদের নোবেল ঠাকুর। আমরা তাহাকে মাদুলির ন্যায় ধারণ করিয়াছি। তবে সবুজ উদ্ভিদের ন্যায় রবির কিরণে সালোকসংশ্লেষ আত্তীকরণ করিতে পারিলে ভাল হইতো। ক্লোরোফিলের মতো আমাদেরও কোনো সজীব সজীবতার জন্ম হইয়া উঠুক। বাজারে নতুন বৌঠানের (কাদম্বরী দেবী) সহিত রবির প্রেমের বেশ মার্কেট ভ্যালু আছে। কাব্যকাহিনি লেখা চলে। রবীন্দ্রনাথকে পুঁজি করিয়া কিছু লোক ভাঙ্গাইয়া খাইতেছেন। তার প্রেমে পড়া কবিতাগুলো আমাদের প্রেমের লাইফলাইন হইয়াছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্রনাথ বারোয়ারির মণ্ডপে লোক দেখানো ফ্যাশনে দাঁড়াইয়াছে। অথচ তাহার গভীর নিগূঢ় দর্শন কেবল শান্তিনিকেতনি একটি বিশেষ নারীসুলভ প্যাটেন্ট ভঙ্গিতে আটকাইয়া রহিল। পৌরষদীপ্ত হইলো না। বাংলা ভাষা ও বাঙালি আর সোজা হইয়া দাঁড়াইতে পারে না। এঙ্কাইলোজিং স্পন্ডাইলাইটিসে (Ankylosing spondylitis) ভুগে রবীন্দ্রনাথকে ট্যাগ(বস্তাপচা উদ্ধৃতি, বাঁধা বুলি) করিয়া চলিতেছে। “মানুষের ইতিহাসটাই এই রকম। তাকে দেখে মনে হয় ধারাবাহিক। কিন্তু আসলে সে আকস্মিকের মালা গাঁথা। সৃষ্টির গতি চলে সেই আকস্মিকের ধাক্কায় দমকে দমকে যুগের পর যুগ এগিয়ে যায় ঝাঁপতালের লয়।”(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: শেষের কবিতা)
যাহারা গানে কবিতায় রবীন্দ্রনাথকে নিজের মতো করিয়া পরিবেশন করার কিঞ্চিৎ চেষ্টা করিয়াছিলেন, তাহাদের প্রবল সমালোচনার মুখে পড়িতে হইয়াছে। কেনই বা হইবে না? রবীন্দ্রনাথ যে কিছু লোকের বাপকেলে সম্পত্তি হইয়া উঠিয়াছিল বিপণি ব্যবস্থায়। মাটিতে বসিয়া হাত জড়ো করিয়া গুরু প্রণাম নিবেদনের পর আমরা যে বিশেষ রাবীন্দ্রিক উচ্চারণ ও ভঙ্গিমায় গান গাহিতে ও শুনিতে অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছি। তাহার অনর্থ হইলে আর রক্ষে থাকিত না। একদল রবীন্দ্র অনুরাগী রেরে করিয়া উঠিতেন। ১৯৫১ সালের ভারতের কপিরাইট আইন অনুসারে, ২০০১ সাল পর্যন্ত ভারতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশিত করতে হইলে বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতির অনুমোদন প্রয়োজন হইতো। ১৯৫৭ সালে বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতি দেবব্রত বিশ্বাসের ‘তুমি রবে নীরবে’ গানটি প্রকাশের অনুমতি দিতে অস্বীকার করিলে, দেবব্রত বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় প্রকাশিত স্বরলিপি দেখাইয়া গীতবিতান-এ গানের পাঠের ভুল নির্দেশ করিয়াছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎশিষ্য শান্তিদেব ঘোষ এই ব্যাপারে দেবব্রত বিশ্বাসের দেওয়া তথ্য সমর্থন করিলে বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতি গানটি প্রকাশের অনুমতি দেয়। ১৯৬৪ সালে দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া ‘মেঘ বলেছে, যাব যাব’ ও ‘এসেছিলে তবু আস নাই’ গান দুটি প্রকাশের অনুমতি দিতে বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতি অস্বীকার করে। ১৯৬৯ সালে তাঁর ‘পুষ্প দিয়ে মারো যারে’ ও ‘তোমার শেষের গানের’ গানদু-টির প্রকাশের অনুমতি বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতি দেয় নাই। বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতি দেবব্রত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গানে অতিনাটকীয়তা, অতিরিক্ত বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারের অভিযোগ আনিয়াছিল। ১৯৭০-৭১ সালে দেবব্রত বিশ্বাস বেশ কিছু গান রেকর্ড করেন। কিন্তু তার কয়েকটিকে বিশ্বভারতী পুনরায় অনুমোদন দিতে অসম্মত হন। বিরক্ত হয়ে দেবব্রত বিশ্বাস স্থির করেন তিনি আর রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করিবেন না। বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুচিত্রা মিত্র অবশ্য লিখিয়াছেন যে, দেবব্রত বিশ্বাসের কোনো গান বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতি বাতিল করে নাই। ঈশ্বরী জানেন জল কতটা ঘোলা হইয়াছিল।
বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুবিনয় রায় বলিয়া ছিলেন; ”কবির জীবদ্দশায় তৎকালীন গুটিকয়েক ‘ওস্তাদীভাবাপন্ন’ গুণীজন তাঁর সামনেই…তাঁর গান গাহিবার সময় অল্পস্বল্প আলাপ বিস্তারের ব্যবহার করতেন। তাতে বাহ্যিকভাবে হয়তো তিনি কখনো আপত্তি প্রকাশ করতেন না। শোনা যায় হিন্দিভাঙা গান সম্পর্কে গায়কের সুরুচি অনুসারে সংযত ও সংক্ষিপ্ত আলাপ বা বিস্তার তিনি কোনো কোনো সময় অনুমোদনও করেছেন। কিন্তু সধারণভাবে বলতে গেলে এইসব বাহাদুরি তিনি কখনোই সমর্থন করতেন না।”
রবীন্দ্রনাথের যেকোনো পর্যায়ের গান রচনা নৈপুন্যে, কথা সুরের সমন্বয়ে কাব্যমাধুর্যেও ভাবগভীরতায় এতই সমৃদ্ধ ও এতই সম্পূর্ণ যে, এর মধ্যে আলাপ-বিস্তার তানকর্তব্যের অবতারণা নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক ও নিছক বাহুল্য বলিয়া মনে করেন সুবিনয় রায়।
ফিউশন না কি কনফিউশন আজও রবীন্দ্রসঙ্গীতের রিমেক লইয়া দুই বাংলাতেই এই বিতর্ক চলমান রহিয়াছে।
যেমন চণ্ডীপাঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর একটি বহুল প্রচলিত প্রকাশভঙ্গি কিংবদন্তী হইয়া উঠিয়াছে।(আগে ভাষ্য অংশ পাঠ করা হতো স্বাভাবিক কথ্যভঙ্গিতে। সুরে নয়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তাঁর নিজস্ব ধারায় চণ্ডীপাঠ করছিলেন সুরেলা কণ্ঠে।) তেমনি রবীন্দ্রসঙ্গীত একটি বিশেষ ভঙ্গি ভাবধারা অব্যাহত রাখিয়া চলিতে হইবে এমনটাই আরোপিত হইয়া বসিয়াছে। না হইলেই অরাবীন্দ্রিক।
উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই ছিলেন সমসাময়িক যুগের একজন বিশিষ্ট গায়ক। স্বামী বিবেকানন্দ নিয়মিত জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে যাতায়াত করিতেন এবং সেখানে একাধিক রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখিয়া নানা পারিবারিক অনুষ্ঠানে, ব্রাহ্মসমাজের উৎসবে, এমনকি দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে রামকৃষ্ণ পরমহংসের সামনেও তা পরিবেশন করিয়াছিলেন। ঠাকুর পরিবারে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ার প্রথাও তাঁর সমসাময়িককালেই শুরু হইয়াছিল। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাহানা দেবী, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, শান্তিদেব ঘোষ প্রমুখ রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ শিষ্যেরা ছাড়াও, পঙ্কজকুমার মল্লিক, কুন্দনলাল সায়গল, কানন দেবী প্রমুখ শিল্পীরা রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করিয়া তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করিয়াছিলেন। পরবর্তীকালে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, সুবিনয় রায়, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, সাগর সেন, ঋতু গুহ, গীতা ঘটক প্রমুখ রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করিয়াছেন। তাঁহাদের অনুপ্রেরণায় লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, কিশোর কুমার প্রমুখ বিশিষ্ট বলিউড-শিল্পীরাও রবীন্দ্রসঙ্গীত গাহিয়া ধন্য হইয়াছেন। বাংলা আধুনিক ও চলচ্চিত্রের গানসহ অন্যান্য ধারার সঙ্গীত শিল্পীরাও রবীন্দ্রসঙ্গীত আজো গাহিয়া চলিয়াছেন। পূর্ব পাকিস্তানের স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ওয়াহিদুল হক, কলিম শরাফি, সনজীদা খাতুন প্রমুখ শিল্পীরা বাংলাদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে বিশেষ জনপ্রিয় করে তুলিতে বিশেষ ভূমিকা লইয়াছেন। বর্তমানে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, অদিতি মহসিন, মিতা হক, পাপিয়া সারোয়ার সাদী মহম্মদ প্রমুখ বাংলাদেশি শিল্পীরা এবং মনোজ মুরলী নায়ার, মণীষা মুরলী নায়ার, মোহন সিং, বিক্রম সিং, স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত, লোপামুদ্রা মিত্র, শ্রাবণী সেন, শ্রীকান্ত আচার্য, পীযূষকান্তি সরকার প্রমুখ ভারতীয় শিল্পীরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করিয়াছেন। বাবুল সুপ্রিয়, শান, কুমার শানু, অলকা ইয়াগনিক, সাধনা সরগম, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি প্রমুখ বলিউড-শিল্পীরাও এখন নিয়মিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংকলন প্রকাশ করিয়া চলেন। এমত অবস্থায় রবীন্দ্রসঙ্গীত যে তাহার আবহমান ধারা অব্যাহত রাখিতে পারিবে, তাহা আর জোর দিয়ে বলা যাইতেছে না। শিল্পের ধর্মই তো সৃজন। সংমিশ্রণ বির্বতন এতো হইবেই। সংরক্ষণশীলদের কৌলীন্য খোয়া যাইবেই এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। তবে উচ্চকটির রবীন্দ্রপ্রীতি যত পথপ্রান্তে নামিয়া আসিবে রবীন্দ্রনাথ ততই সাধারণের হইয়া উঠিবেন আশাকরা যায়। নিজ সাহিত্যকর্ম নিয়ে তাই তিনি বলেছিলেন, ‘জীবনের আশি বছর অবধি চাষ করেছি অনেক। সব ফসলই যে মরাইতে জমা হবে তা বলতে পারি না। কিছু ইঁদুরে খাবে, তবু বাকি থাকবে কিছু। জোর করে বলা যায় না, যুগ বদলায়, তার সঙ্গে তো সবকিছু বদলায়। তবে সবচেয়ে স্থায়ী আমার গান, এটা জোর করে বলতে পারি। বিশেষ করে বাঙালীরা, শোকে দুঃখে সুখে আনন্দে আমার গান না গেয়ে তাদের উপায় নেই। যুগে যুগে এ গান তাদের গাইতেই হবে।’
রবীন্দ্রনাথ; ঠাকুর হইতে চাহে নাই আমরা তাহাকে ঠাকুর বানাইয়া ছাড়িয়াছি। আপনায় স্থাপিয়াছ, জগতের দেবতারে নহে। কবি গুরুর পাশে আপনার ছবি সাঁটিয়া যাহারা লিখিয়া রাখিয়াছে লহ প্রণাম তাহারা কি একথা জানেন? তাহারাও কি একথা জানেন, যাহারা কোনো এক ভিক্ষুকের মুখে রক্তকরবীকে অক্তকবরি শুনিয়া নাক সিটকাইয়া ওঠেন পঁচিশে বৈশাখে। মেলচ্ছের মুখে রবীন্দ্রনাথ শুনিয়া যারা জাত গেল ভাব প্রকাশ করেন, তাহারাও
রবীন্দ্রনাথকে কতটুকু বোঝেন? চৌমাথার মোড়ে প্রত্যেক ক্রসিংয়ে কর্কশ যান্ত্রিক বাদ্যযন্ত্রের সহিত রবীন্দ্রনাথ মিলাইয়া যাইতেছেন।
শান্তিনিকেতন আজ চরস সেবনের আড্ডা হইয়া উঠিয়াছে। এমন রবীন্দ্রপ্রীতি দেখিয়া স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আর মর্ত্যলোকে ফিরিয়া আসিবেন বলে মনে হয় না। সোনার তরীরে কাঁধে করিয়া বহন করিয়া চলিলাম বাহন করিতে পারিলাম না।
ক্ষমা করিবেন রবীন্দ্রনাথ; এইবার জন্মাইলে দয়া করিয়া আর কবিতা লিখিবেন না…গান গাহিবেন না। আপনি রাখাল হইতে চাহিলে আমরা বুঝিব কৃষ্ণ কানাই। আপনি ভিক্ষুক হইতে চাহিলে আমরা বলিব হরিশচন্দ্র!
আপনার আমরা মূর্ত গড়িব; মুরোতি ধরিব না।
মন্তব্য