যাত্রাদলে ওর নাম প্রেমকুমার। আসল নাম আবদুল কদ্দুস। সাং সাগরদিঘি, উপজেলা, ঘাটাইল, জেলা, টাঙ্গাইল। যেমন দরাজ কণ্ঠ, তেমনি নায়কোচিত চেহারা। সারা যাত্রামঞ্চ মাতোয়ারা- প্রেমকুমারের সুর, ‘আমি তোমার শাহজাদা গো।’ যেন সুরের মোহজাল বিস্তার করে আছে। পিন পতন নীরবতায় প্রেমকুমার দাপিয়ে বেড়ায় সারামঞ্চ। দর্শককুলের দৃষ্টি, অনুভূতি, মুখায়বের ভাষা অন্যরকম এক জগতে বিরাজ করে। লাস্যময়ী নায়িকা সন্ধ্যারানীর মিহি সুর দর্শক গ্রহণ করতে পারে না। রাত শেষে ওরা একটি মাদকতাময় সুরের ভাঁজে ভাসতে থাকে। নিউ জোৎস্না অপেরার জনপ্রিয়তা মূলত প্রেমকুমার ওরফে আবদুল কদ্দুসের জন্য।
‘নিউ জোৎস্না অপেরা’র মালিক চারুচন্দ্র মহালনবীশ। বয়স যাট পেড়িয়ে গেছে বছর তিনেক আগে। সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী। ইস্ত্রি করা ধুতি-পাঞ্জাবি পরেন। কপালে চন্দনের তিলক। মাথার চুল বিন্যস্ত। বিবেকানন্দের মতো পুরুষ্ট মুখ। চেহারায় চাকচিক্য আছে। কালো চশমার আড়ালে ব্যক্তিত্বের ছাপ। নাটক, যাত্রাপালা নিয়ে তার বিস্তর পড়াশোনা। ‘মা-মাটি-মানুষ এবং ক্রীতদাস’ পালার জন্য দু’বার রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন। সময়ের দিক দিয়ে প্রায় চার দশকের কাছাকাছি যাত্রাশিল্পের সঙ্গে জড়িত।
তাঁকে নিয়ে মিডিয়া কভার কম নয়। মহালনবীশ বাবুর এ সম্মানপ্রাপ্য। রাষ্ট্রপতি থেকে মালির চালার কছরউদ্দিন তাঁকে চেনেন। সাকিন মানিকগঞ্জের ঘাটলাবাঁধায়। পূর্বপুরুষ কেউ যাত্রার সঙ্গে জড়িত না। চারু বাবুরও হওয়ার কথা ছিল না। ফুরফুরে তরুণ কলেজে পড়ে। হঠাৎ করে উধাও। কানু বাবুর গোল্ডেন অপেরা’র রাধা বনিকের জন্য সেই যে ঘর ছাড়া আর ফেরা হলো না, পড়াশোনা না! রাধা বণিকের বিশল্যকরণী তাবিজ নিয়ে প্রেম, অপেরা দিয়ে শুরু। কিন্তু তিনি যাত্রাদলে থাকেননি। সংসার শুরু করেছেন। এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে গড়ে তুলেছেন আরেক সাম্রাজ্য। এতদিন পর ছেলে তারাচন্দ্র মহালনবীশ ঢাকা মেডিক্যালে থার্ড ইয়ারে পড়ে। কন্যা মনিমালা মহালনবীশ নাট্যকলা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। চারু বাবুর ধারণা, রাধা না থাকলে তিনি জলে ভেসে যেতেন!
বিবাহিত জীবনে রাধাদেবী স্বামীর যাত্রদল নিয়ে কোনো অশান্তি করেননি। রাধাদেবী চারু বাবুকে চেনেন। মানবিক মানুষ। যাত্রার জন্য প্রাণপাত। রাধাদেবী ঢাকায় থাকেন। চারুচন্দ্র মহালনবীশ ‘নিউ জোৎস্না অপেরা’ নিয়ে সারাদেশ ঘুরে বেড়ান। যাত্রাপালা মৌসুমি। বাংলাদেশে এখন সর্বত্র যাত্রাপালা চলছে। চারু বাবু তাঁর প্রতিটি পালায় মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে চান। গান হলো যাত্রাশিল্পের প্রাণ। মানুষ রাত জেগে, টাকা খরচ করে, দেখতে আসে। পালাকার হিসেবে দায় আছে না? জ্বি, চারু বাবু এগুলো বিশ্বাস করেন। কজের ক্ষেত্রে তার ছাপ থাকে। তাই তাঁর পালা মানেই-উপচানো ভিড়। রাতশেষে সুরের ভাঁজে ভাঁজে সুখ থাকে।
১ নভেম্বর থেকে তেইশ দিনব্যাপী সাগরদীঘি স্কুল মাঠে পালার আয়োজন করেছে স্থানীয় ক্রীড়া সংঘ। দল খরচে পর টাকা আধাআধি ভাগ হবে স্কুল এবং ক্রীড়া সংঘের। এর মধ্যে যোগ হয়েছে জুয়ার পট। পালা কমিটির যত না আগ্রহ, তার চেয়ে বেশি আগ্রহ পুলিশ প্রশাসনের। রাতভর জুয়ার পটে লাভ-লোকসান আর সন্ধ্যারানী-প্রেমকুমারের মন মাতানো গান আর ডায়ালগ।
চারু বাবু বলেন, দেখুন, মানুষ হিসেবে আমি বড়ই ভাগ্যবান। রাধার মতো বউ পেয়েছি! না চাইতেই অনেক সুযোগ তৈরি হয়ে থাকে। আমার চিন্তা নেই। তারাই ঘর থেকে দর্শক টেনে বের করে আনে। আমার কাজ, চুক্তি অনুযায়ী দলের সদস্যদের প্রাপ্য টাকা বণ্টন করে দেওয়া। তারা চারটে ভাতের মুখ দেখে। আমিও। আমার মতো রাধাপ্রেমিক, শিল্পীদের যে অর্থ বিলাই, তাতে আমার কোনো লাভ নেই। ওটা তাদের প্রাপ্য। আমিও রাধার গান শুনে হাজার হাজার টাকা দিয়েছি। পরে ওই টাকা দিয়ে দল গড়েছি। আমি অনুভব করি, যারা পাঠ গান, তাঁরা সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। দেবীকে কষ্ট দেওয়া যায়! আমি জানি, মধ্যরাতের এসব জুয়াড়ি আর নেশাখোরের টাকা কোথায় যায়? দরকার কী? তারা কষ্ট পেলে তো ‘নিউ জোৎস্না অপেরা’রুগ্ন হয়ে যাবে। এক সময় ইন্তেকাল করবে।
রাতজাগা পালার পাত্রপাত্রীরা সূর্যের আলো দেখে দুপুরের পর।
দুপুরের খাবারের পর চারুচন্দ্র মহালনবীশ পান চিবুতে চিবুতে সন্ধ্যারানীকে বলেন, কিরে রাজকন্যা, আমার প্রেমকুমার তো মানুষের মুখে-মুখে। তুই তো দেহি চিকন সুরের টেলায় বাঁশি হইয়া যাইতাছস?
কি যে কও দাদাঠাকুর! সুরের মোহে মোহন মেম্বার গত রাইতে পাঁচ হাজার টাকা দিছে। নাগর আমার কয় টাহা পাইছে?
চারু বাবু উচ্চস্বরে হাসেন।
ঠিক কইছ রাজকন্যা, প্রেমকুমার মেয়া না পুরুষ।
কি যে কও দাদা, যৌবন কি আর আছে? মেয়াডার ঠাণ্ডা জ্বর!
ডাক্তার ডাকতে হইব, তুই মেয়ার কাছে যা। ব্যবস্থা করতাছি।
চারু বাবু তৎক্ষণাৎ ডাক্তার আনতে লোক পাঠায়।
আবদুল কদ্দুস ওরফে প্রেমকুমারকে বলে, সন্ধা তোমার নায়িকা। বড় বউন। ওর মেয়ার জ্বর, খেয়াল রাখবা। আর ওই জায়গাটায় টানি দিবা, ‘আমি তোমার স্বপ্ন গো।’
প্রেমকুমার এবার নিয়ে দ্বিতীয়বার অবাক হয়। বাবু কেন বারবার সন্ধ্যাদির সঙ্গে সম্পর্কের কথা বলে? সন্ধ্যাদি বিবাহিতা। একটা কন্যাসন্তান আছে। সে হিন্দু, ও মুসলমান! আবদুল কদ্দুসের একধরনের ঘোর কাজ করে। বাবু তো ফালতু কথা বলে না। বাবু ‘নিউ জোৎস্না অপেরা’র প্রতিটি মানুষ নিয়ে ভাবে।
বিবেকের পালা গায় মৃণাল ভৌমিক। সে চারু বাবুকে বলে, চারুদা, গত রাইতে ভালা গাই নাই। গলায় ঠাণ্ডা ঢুকছিল।
ঠিক কইছ, শীত একটু বেশি পড়ছে।
চারু বাবু জানে, মৃণাল ভৌমিক জাত আর্টিস্ট। ভুল ধরতে পায়। পালা শেষে তাঁর অতৃপ্তি থেকেই যায়। মৃণাল ভৌমিক চারুচন্দ্রের প্রিয়। প্রতি রাত নিজেকে তুলে ধরার প্রবণতা আছে।
তোমাকে একশ টাকা বকসিস জোৎস্না অপেরার পক্ষ থেকে।
হঠাৎ মৃণাল ভৌমিক শিশুর মতো কাঁদতে থাকেন। কেন কী কারণে কেউ জানতে পারে না।
ঠিক এ সময় তাঁবু থেকে মুখ বের করে রানীরূপী পুষ্পিতা সান্যাল। আর যায় কোথায়! চারু বাবুর মেজাজ সপ্তমাত্রায়।
হারামজাদিকে আমি শিল্পী বানাতে পারলাম না। ও মাগীই রয়ে গেল।
পুষ্পিতা একটু ঢংয়ের সুরে বলে, কেনরে ঠাকুরপো, তোমার খেদমত কম হইছে। মঞ্চে তো আমি রানীই!
এক থাপ্পড় দিয়া দাঁত ফেলে দেব। বদদের মতো কথা বলে। হারামজাদি।
রাগ করো না ঠাকুর পো, আজ রাতে আমি তোমার সঙ্গে থাকব।
তোর নষ্টামি রাখ। আমার যাত্রাজীবনে তোর মতো ফাজিল একটিও পাই নাই। বদ।
দেখ ঠাকুর পো, বদ কইও না, তুমি যদি বদ হও, তাইলে আমিও বদ, রাধা বৌদি কি আর তোমার সঙ্গে পারে?
তোরে কইছি। যা।
পুষ্পিতার প্রতি চারু বাবুর পক্ষপাত আছে। একটু ছিনালি না করলে শান্তি পায় না। আর এমনভাবে বলে যেন ওর সঙ্গে পিরিতের সম্পর্ক। চারু বাবু ভাবে বলুক। পুষ্পিতা স্টেইজ ফিটিং। মঞ্চে ওকে রানীর মতো দেখায়। পেটের থলথলে চর্বি- প্রসাধনীর গুণে আরও লোভনীয় হয়ে ওঠে।
অনেক দর্শক চারু বাবুকে বলে, রানী মাল একখান। আমার তো রানীর সঙ্গে দেশান্তরি হতে ইচ্ছে করে! আমি কিছু শুনি না, দেখি। আমি রানী বুক আর পেটের দিকে তাকিয়ে থাকি।;
এসব নিয়ে চারু বাবু ভাবে না। কত রকম পাগল আছে দুনিয়া! সে নিজে ওই রকম। নইলে রাধার জন্য সমাজ সংসার ত্যাগ করল ক্যামনে? বড় দাদা দুঃখ করতে করতে মরেই গেল।
ওর দিলাম পড়বার! ছাত্র ভালো। বংশে শিক্ষা কম। ওর হবে। ও কিনা যাত্রাদলের মেয়া বিয়া কইরা ছেড়ির সঙ্গে যাত্রাদল করল।
শুধু যখন চারুচন্দ্র মহালনবীশের যাত্রাপালা, মা-মাটি-মানুষ-এর জন্য রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার নেয়, তাই দেখে বড়দা বলেছিল, ওর সম্মান আছে। কিন্তু ওর তো, জজ-ব্যারেস্টার হওয়ার জন্য জন্ম হয়েছিল।
চারু বাবু কিছু হতে চাননি। শুধু রাধা বনিকের প্রেমিক হতে চেয়েছিলেন। এ কথা পুষ্পিতাসহ দলের সবাই জানে। তাই কেউ সুবিধা পাওয়ার জন্য চারু বাবুর কাছ ঘেঁষে না। সবার মাঝে রাধা বৌদির আলাদা সম্মান আছে। যা একটু-আধটু তা ওই পুষ্পিতার আছে। চারু বাবুর সঙ্গে ঠাকুর পোর সম্পর্ক। এ সম্পর্ক নিয়ে কেউ রসিকতা করে না। জানে, দাদা বাবু মমতাবান মানুষ। পুষ্পিতার দুঃখ আছে। স্বামী পরিত্যক্তা। প্রথম যৌবনে স্বামী দ্বারা নির্যাতিতা। চারু বাবু ওকে বেঁচে থাকার সাহস জুগিয়েছেন। নিজ হাতে গড়ে তুলেছেন পুষ্পিতাকে। পুষ্পিতা এখন নামি শিল্পী। চিত্রালীতে ওর সাক্ষাৎকার ছাপিয়েছে। পুষ্পিতাই মাঝে মাঝে বলে, ঠাকুরপো, যৌবনডারে ছুঁয়েই দেখলা না। কত রস ছিল। জগতের কেই বুঝল না।
চারু বাবু মিটমিট করে হাসে। গতবার পালা গাইতে গিয়েছিল সাতক্ষীরায়। একদিন মধ্যরাতে চারু বাবুর খুব জ্বর। মঞ্চে পালা চলছে। ওই পালায় পুষ্পিতার পাঠ ছিল না। চারু বাবু তাঁবুতে লেপের নিচে জ্বরে কাঁপছিলেন। গভীর মমতায় পুষ্পিতা শিয়রে বসে জলপট্টি দিচ্ছে। হঠাৎ পুষ্পিতার কি যে হলো, চারু বাবুকে জড়িয়ে ধরে বলে, আজ তোমাকে বুক জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকব।
চারু বাবু তখন জ্বরের বিকারে আধা অচেতন। তারপরও অনুভব করে পুষ্পিতা ওকে জাগিয়ে দিতে চাইছে।
বলছে, ঠাকুরপো, আমারে ছিঁড়ে খাও। আমার অনেক কষ্ট।
প্রচণ্ড জ্বরের মধ্যে চারু বাবু পুষ্পিতাকে বঞ্চিত করতে পারেননি। খুব স্বল্পসময়ের জন্য। তারপরও পুষ্পিতা বলে, কতকাল জগৎজোড়া খিদা নিয়া আছিলাম, আমার ওতেই চলবে। মালিক তো খুশি!
দুদিন পর চারু বাবুর জ্বর ছাড়লে পুষ্পিতা উধাও। পরদিন মাধব-মালঞ্চ পালা। পুষ্পিতা পরীরানী। গাইবে কে? মহাবিরক্তি নিয়ে চারু বাবু অথই জলে হাবুডুবু খাচ্ছে। পুষ্পিতার প্রতি কোনো রাগ না দেখিয়ে মৃণাল ভৌমিককে বলে, পুষ্পিতার কী কোনো নাগর আছে?
না দাদা। সে আপনাকেই নাগর মনে করে।
গম্ভীর কণ্ঠে বলে, ভুল।
নাচনেওয়ালি প্রিন্সেস জরিনাকে পরীরানী সাজিয়ে পালা শেষ করে। দর্শক জরিনার বুক ঝাঁকুনিতেই মশগুল। তারপরও চারু বাবুর পুষ্পিতার জন্য হাহাকার অনুভব করেন। নিজকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করান। বঞ্চিতা নারীর কামনায় সায় দেওয়া ঠিক হয়নি। ও কি মনে কষ্ট পেয়েছে? পেতে পারে! ওর যৌবনের ভ্রমর তো চারু বাবু না। হয়তো জ্বালা নিয়ে পালিয়ে গেছে। আহারে দুঃখিনী নারী! চারু বাবুর চোখ জলে ভরে যায়। পুষ্পিতার জন্য থোক থোক মমতা জড়ো হতে থাকে। বুক আনচান করে।
চারু বাবুর মনে হয়, অভিভাবক হিসেবে- ওর বিয়ে নিয়ে ভাবা উচিত ছিল। তারপর একদিন চারু বাবু পুষ্পিতাকে খুঁজে বের করেন।
কিছু বলার আগেই পুষ্পিতা বলে, ঠাকুরপো আমি রাধা বৌদিকে অপমান করেছি। আমি ঠিক করিনি। এই মুখ দেখাব কী করে!
চারু বাবু ভাবেন, পুষ্পিতা ঠিক বলেছে, আমিও তো রাধাকে অপমান করেছি।
তারপর পরম মমতায় পুষ্পিতাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, আমিও এ মুখ রাধাকে দেখাই কী করে।
এই প্রথম চারুচন্দ্র মহালনবীশের জীবনকে অর্থহীন মনে হয়। এতদিন ধরে তিল-তিল করে গড়ে তোলা বিশাল পরিচয় ঝাপসা হয়ে আসে।
পুষ্পিতা আবারও চারুবাবুর হাত ধরে ‘নিউ জোৎস্না অপেরা’য় ফিরে আসে। শুধু রাধা বৌদি কখেো বেড়াতে এলে, পুষ্পিতা ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যায়। পরীরানীর পাঠ গায় প্রিন্সেস জরিনা।
হঠাৎ করে পুষ্পিতা ছিনালী করল কেন? চারু বাবু অনেকক্ষণ বেশ রসিয়ে রসিয়ে পান খান আর ভাবেন। তারপর নিজ তাঁবুর ক্যাম্প খাটে দিবানিদ্রার জন্য চলে যান।
শীতের পড়ন্ত বিকেল। দুটোর পর আর বেলার সঙ্গে পারা যায় না। অন্ধকারের দিকে দৌড়াতে থাকে। পাশের তাঁবুতে থাকে প্রেমকুমার আর দিলীপ বাবু। বয়সের বিস্তর ব্যবধান, কিন্তু প্রেমকুমার কোনোরূপ অস্বস্তি অনুভব করে না। বরঞ্চ দিলীপ দাদা তোতা পাখির মতো প্রেমকুমারকে ডায়ালগ মুখস্থ করায়। দিলীপ বাবুর ধারণা, ডায়ালগ মুখস্থ থাকলে যেভাবে ইচ্ছে থ্রো করা যায়। এই টেকনিক চারু বাবুর পছন্দের। আবদুল কদ্দুস দলে এসেছে আজ এক বছর হলো। নতুন। তৈরি করে নেওয়ার দায়িত্ব মূলত দিলীপ বাবুকে দিয়েছে চারু বাবু। ফিমেল আর্টিস্টরা তাড়াতাড়ি ধরতে পারে। পুরুষদের দেরি হয়। বর্তমানে ‘নিউ জোছনা অপেরার মূল আর্টিস্ট আবদুল কদ্দুস ওরফে প্রেম কুমার। আবদুল কদ্দুস এইট পাস। সংসারে মা ছাড়া কেউ নেই। আর আছে দরাজ কণ্ঠ। নায়কসুলভ চেহারা। চারু বাবুর ওতেই পোয়াবারো।
আজান পড়ার পরপর চা নিযে আসে পুষ্পিতা। টোস্ট বিস্কুট চা টেবিলে রেখে বলে, কিগো ঠাকুর পো শরীর খারাপ। টিপে দিতে হবে?
না। মাথাব্যথা। কেউ কি আপনজন আছে, সোহাগ করবে?
কেন? আমি!
তোর ওই সময় আছে?
কেন ঠাকুর পো, হঠাৎ এ কথা ক্যান?
ও সব তুই বুঝবি না। তোর দরকার নাগর!
তুমি বারবার এ কথা কও ক্যান? আমার কি মাগীদের মতো খাই-খাই স্বভাব?
নারে! শরীরের দরকার। তোর দোষ নাই। গনগনা আগুন।
ঠিক কইছো। তাই। চা খাও।
পুষ্পিতা চা রেখে চারু বাবুর তাঁবু থেকে বের হতেই হ্যারিকেন আর মশার কয়েল নিয়ে সন্ধ্যা রানী ঢোকে।
কোম্পানির শরিফুল কাকা ডাক্তার নিয়া আইছিল। পোলারে দেইখা অষুধ দিছে। পোলা ঘুমাইতাছে। জ্বর ছাড়ছে।
দুর্গা দুর্গা বলেন চারু বাবু।
চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন, কিরে সন্ধ্যা, সবকিছু ঝুইললা গেলে চলব, কেমনে বেটি বেটি লাগে। প্রেমকুমারে ধইরা রাহন লাগবো। কাঞ্চা বয়স! ফুস কইরা উইড়া যাইতে পারে।
দেহনা স্টেইজে ও আমারে জড়াইয়া ধরে না। শরীরের জ্বালা ওঠে। ওর নাগে পাঠ গাইয়া মজা নাই।
তোর যে কী সুখ আমিই এতদিন বুঝি না। আর ও তো তিনদিনের ছোকড়া। ওরে যৌবনের রস খাওয়া।
ঠিক এ সময় শরিফুল মৃধার গলা শোনা যায়।
বাবু আছেন তো? আউজ দারোগা সাব আসবো, তারে খুশি করন লাগবো। ঝুমুর একজন চাই।
দাদা চুক্তিতে নাই। তারপরও সন্ধ্যারে কইয়া রাহেন। পালা গাওয়া সময় মৃণাল বাবুর তাঁবুতে দারোগারে যেন নিমন্ত্রণ করে। আর কোনো অসুবিধা?
না না। অসুবিধা নাই। সন্ধ্যারে একদিন আমারে দিবেন।
ও বুঝ সন্ধ্যার, আমার না।
কী কন দাদা। আপনি অধিকারী। আপনার হুকুম তো সব!
না দাদা, আমি ওইভাবে দল চালাই না। ওদের মতামত বড়। আমার শিল্পীরা ঠকবে ক্যান?
তা ঠিক। আমি সন্ধ্যারে ম্যানেজ করমু।
শরিফুল মৃধা হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যা আড়াল থেকে সব শোনে। কিছুই বলে না। পান চিবুতে চিবুতে চারু বাবু লেপের নিচে আশ্রয় নেন।
যাত্রাদলের ফাঁকফোকর চারু বাবুর নখদর্পণে। ওরাও দুটো পয়সা পেলে ক্ষতি কী?
সাগরদিঘি, মালির চালা, গুপ্তবৃন্দাবনজুড়ে এখন কেবলি প্রেমকুমার বন্দনা। মূলত প্রেমকুমারের জন্য নারী দর্শকের উপচেপড়া ভিড়। পালা শেষে প্রেম কুমার এখন নিমন্ত্রণ খেয়ে বেড়ায়। কছর মেম্বারের ছোট বউ তো প্রেমকুমারের জন্য দিওয়ানা। মেম্বার স্ত্রীর মন রক্ষা করে।
খাওয়া-দাওয়া শেষে মেম্বারের স্ত্রী বলে, দাদা, আপনার জন্য আমি সংসার ত্যাগ করব।
প্রেম কুমার ভাবে কি সর্বনাশ কথা! ওর রোমকূপ কাঁটা দিয়ে ওঠে।
বৌদি, অমন অমঙ্গলের কথা বলবেন না। সংসার কি ভাঙার জন্য?
মেম্বারের বউ মন্ত্রমুগ্ধের মতো জবাব দেয়, না।
রাত দশটার দিকে খাবার খেয়ে চারু বাবুর এক পাইট বাংলা সেবন না করলে চলে না।
নিয়মিত। রাধা ছাড়ানোর চেষ্টা করেছে। পারেনি। শীতের রাত। বাংলা সেবনের পর চারু বাবুর ফিলিংস চলে আসে। ঝুমর দলের ক্যাচড়া ছেড়িদের গালি-গালাজ করে। টুক-টাক রং-ঢং করে। শুধু পাইটের বোতলটা বহন করে পুষ্পিতা। এর ব্যতিক্রম হলেই চারুবাবুর মাথা গরম। পুষ্পিতা চারু বাবুকে বোঝে।
দাদা বাবু, ক্যাচড়া গো দিকে চোখ ক্যান? ওগো রসই আহে নাই। রসে টইটুম্বর গো নাগর দেহে না।
ঠিক কইছো। সব রস রাধা খেয়ে নিয়েছে। আমি এখন বেলুন।
না। তুমি আমার ঠাকুর পো। চাইলে সব দিমু।
চারু বাবু হা হা করে হাসেন।
মাগীর বাইর কত?
তুমি আমারে কত দিছো?
ক্ষেমতা নাই।
না থাকলো! কুশাইলের ছোবড়া খামু।
ক্যান?
তুমি যে রশিক নাগর।
রাধা তোকে খুন করবো।
পুষ্পিতা চারু বাবুর ঠোঁট কামড়ে বলে, ঠাকুর পো, দিদি দেবী, আমারে খুন কইরা পাপিষ্ঠা হবে ক্যান?
তুই যে আমারে চাস?
তাই!
চারু বাবু আবারো লেপের নিচে সেঁটিয়ে যেতে থাকেন। পাইট শেষ হয় রাত সোয়া এগারোটার দিকে। বারোটা এক মিনিটে ঝুমুর দলের বন্দনাগীত দিয়ে শুরু হবে পালা। দর্শকদের আহাজারি, খিস্তি-খেউর, নাচ চলবে আরও এক ঘণ্টা। মূল পালা রাত একটার পর।
রাত সাড়ে এগারোটার দিকে মেকাপ নিয়ে ঝুমুর এলো চারু বাবুর কাছে। নাচ! কে গাইবে! নাচের ধরন কী? সব নির্দেশনা দেবেন চারু বাবু। ঝুমুর দলের মনিমালা দেখে চমকে যান চারু বাবু। বাহ! পরী লাগতাছে মাগীরে। প্রোমটারে সব বুঝিয়ে দিয়ে মনিমালাকে বলেন, জ্বালা ধরাইলি। কাছে আয়। বলেই ওর উড়নি নিচে হাত বাড়িয়ে দেয়।
জিনিস সুন্দর। খায় কেড়া?
কী কও দাদা, তুমি খাওনা দেইখ্যা। খাওনের মানুয়ের অভাব আছে?
চারু বাবু নেশার ঘোরে মনিমালাকে নিয়ে কতক্ষণ হাতাপিতা করেন।
যা, পাঁচটা খেইচ্চা নাচ মারিস।
দেহ না পাবলিক ক্যামনে বাইগুন লইয়া আহে।
চারু বাবু মুছকি হাসেন। মনিমালাও হাসে।
কিছুক্ষণ পর প্রেম কুমার আসে। বিনয়ের সঙ্গে পা ছুঁয়ে বলে, দাদা আশীর্বাদ কইরো, আইজকা মাধব!
চারু বাবু প্রেম কুমারের মাথায় হাত বোলান।
তোরে নিয়া আমি ভাবিনারে?
তয় কারে নিয়া ভাবো?
পুষ্পিতা।
ধুর দাদা, তোমারে নেশায় পাইছে।
শালারপো কয় কিরে? আমি মাতাল!
না তুমি মাতাল হবা ক্যান? মাতাল আমি।
ঠিক কইছোস। তুই মাতাল কৃষ্ণ। যা তোর হবরে পাগলা।
প্রেম কুমার আবারো চারু বাবুর পা ছুঁয়ে বেরিয়ে যেতেই বাজানদাররা মধ্যরাতের পৃথিবী খান খান করে জেগে ওঠে। ঠিক তখন পুষ্পিতা ঢোকে চারু বাবুর তাবুতে। রানীর পোশাকে পুষ্পিতাকে রানীর মতো লাগছে। লেপের নিচে চারু বাবুর থলথলে পেটের ওপর হাত রেখে বলে, ঠাকুর পো, বেশ আরামেই আছো। শীতে হাত জমে যাইতাছে।
ওফ! মাগীর হাত ঠাণ্ডা গো? আইজ তুই তো আর পুষ্পিতা না, রানী হয়ে গেছিস। যা মনে রাখিস।
পুষ্পিতা আরও কিছুক্ষণ খুনসুটি করে চারু বাবুর সঙ্গে।
মাগী ঠাণ্ডারে। যা। দারোগা আইবো, আবার তার নাগে হুতই না?
ঠাকুরপো, পচা কতা কয় না? পাগল।
যা।
পুষ্পিতা বেরিয়ে যেতেই চারু বাবু লেপের নিচে মুখ লুকান। হারানকে ডাকেন। হারান মঞ্চকর্মী।
পালার আগে ডাইককা দিস।
তারপর চারু বাবুর লেপের নিচে ঢুকে যায় ঝুমুর দলের সবচেয়ে আর্কষণীয় নাচনেওয়ালী সবিতা রানী। বয়স ষোল। যাত্রামঞ্চে পাঠ না থাকলে চারু বাবুর বুকের ভেতর ঢুকে আশীর্বাদ নেয়। সবিতা রানী ফাজিল টাইপের মেয়ে। এই নিয়ে দুই সিজন ‘নিউ জোছনা অপেরা’য়। দাদা বাবুকে ওর পছন্দ। বদ না! জড়িয়ে ধরে পালা শুরুর আগ পর্ষন্ত ঘুমায়। সবিতা ওই সময়টুকু চারু বাবুকে জড়িয়ে ধরে থাকে। পৃথিবীর কারও সাহস নেই এ সময় চারু বাবুকে ডিসটার্ব করে।
সবিতা রানী বলে, দাদা অত্যাচার করে না। আমি করি। বুইড়া মাল তো জাগবার চায় না। নিজে জাগি, দাদারে জাগাই না। যে দেবতার যে ভোগ!
এই সময় যাত্রামঞ্চে ঝুমুর দলের খেমটা নাচ চলছে। মনিমালা তো দর্শককুলের মধ্যমণি হয়ে উন্মাতাল। বাজানদারদের ড্রাম আর বাঁশির সুর, দর্শকদের শীৎকার ধ্বনিতে মঞ্চমুখরিত। সাগরদিঘির ঐতিহাসিক যাত্রামঞ্চে চলছে প্রিন্সেস জরিনার শেষ ঝুমুর নাচ। মঞ্চে বেগুন, ফুলানো কনডমে ভরে গেছে। নাচের ঠেলায় ভারী করে তুলছে কামার্ত অসংখ্য যুবকের শিস ধ্বনি।
ঠিক এই সময় সবিতা রানী ডাকে, পালা তো শুরু হবো।
ঘুমজড়িত কণ্ঠে চারু বাবু বলেন, হোক। তুই আরেকটু হাতাইয়া দে। মাল বাইর কইর না। আমি আছি ক্যা?
ধুর মাগী, মাল থাকলে তো বাইর হব? জড়াইয়া ধর।
চারু বাবু যখন বিছানা থেকে সবিতারে ছেড়ে দেন, তখন মঞ্চের কাজ করে কর্মীরা। চারু বাবু মাফলার, সুয়েটার, উলেন মোজা, পামসু পরে গায়ে দামি কাশ্মিরি শাল জড়িয়ে উইংসের পেছনে আড়াআড়ি চেয়ার পেতে বসেন। হারান সুগন্ধি তামাক সাজিয়ে সৌখিন পিতলের হুক্কার নল এগিয়ে দিয়ে বলে, বাবু তামাক!
চারু বাবু হুক্কায় ফুসফুস করে কয়েক টান দিয়ে বলেন, আগুন ভালা কইরায়া জ্বালাইয়া দে।
হুক্কায় নিঃশব্দে টান দিতে দিতে মঞ্চের পাত্রপাত্রীদের পাঠ গাওয়া উপভোগ করেন। একটি কথাও বলেন না। শুধু মধ্য বিরতিতে তাঁবুতে ফিরে আরেক পাইট শেষ করে সুগন্ধি জর্দা দিয়ে পান খান। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে সবিতাকে ডাক দেন।
মাগী বোঝেও না। ঠাণ্ডা বিছানা গরম কইরা রাখবি না?
সবিতা হঠাৎ করে উদয় হয়ে বলে, তোমার বিছনা গরম করতে আমার শরীল জ্বালা ধরে।
সবিতা রানী আবারও চারু বাবুকে জড়িয়ে ধরে দুই রানের আড়ালে আশ্রয় খোঁজে।
সবিতারে তোর বুকের মইধ্যে যত গরম!
সবিতা কথা বলে না। ওর চোখ ভরে ঘুম আসে। ও ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকে।
ঘুমাস ক্যান? নাচ শেষ হইলে আমারে ডাইক্কা দিস।
ঘুম জড়িত কণ্ঠে সবিতা বলে, দিমুনি।
কেনোদিন ডাক দেয়, আবার কোনোদিন দুজনেই ঘুমিয়ে যায়। কখন পালা শেষ হয়, চারু বাবু জানেন না। দীর্ঘ সময় ঘুমানো চারু বাবুর অভ্যাস। ঘুম ভাঙে সকাল গড়িয়ে গেলে। যাত্রাদলের শিল্পীরা তখন গভীর ঘুমে।
ঘুম থেকে উঠে গরম জল দিয়ে স্নান করেন। মাছের ঝোল দিয়ে গরম ভাত খান। রোদে বসে হিসাব-নিকাশ করেন। কেরানিকে হুকুম দেন, গত সপ্তাহের শিল্পী বেতন পরিশোধ করার জন্য। যাত্রা কমিটির সঙ্গে দায়-দরবার করেন।
তিনটে সাড়ে তিনটের দিকে আবারো নানা ব্যঞ্জন দিয়ে ভাত খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেন। এই বিছানায় শুয়ে রাজ্যের কাজ সারেন। তারপর ঘুমিয়ে যান। ঘুম ভাঙে রাত নামার পর। ঠিক এই সময় বাইরে মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, সাগরদিঘির ঐতিহাসিক যাত্রামঞ্চে আজকের যাত্রা, মা-মাটি-মানুষ। প্রেসিডেন্ট পুরস্কারপ্রাপ্ত এই পালা অভিনয় করেছেন ট্র্যাজেডি কিং প্রেম কুমার। আর মা’র ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, দুঃখিনী নারী পুষ্পিতা সান্যাল। আর আছে এক ঝাঁক ডানাকাটা পরীর ঝুমুর ঝুমুর নৃত্য। আপনারা আমন্ত্রিত।
আজ উনিশ দিনব্যাপী চলছে সাগরদিঘি ঐতিহাসিক যাত্রামঞ্চে চারুচন্দ্র মহালনবীশের নিউ জোছনা অপেরার যাত্রাপালা। আর তিন দিন পর শেষ হবে। তাই সব কিছুতেই ভাঙনের সুর। সবার মন খারাপ। স্থানীয় আয়োজকদের অফুরান উচ্ছ্বসিত আলাপন চারু বাবুর দলের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ। চারু বাবুর মন খারাপ থাকে। আয়োজকরা আরও ক’দিন সময় বাড়াতে বলে। কিন্তু আটাশ তারিখ থেকে গোপালপুর যাত্রামঞ্চে চারু বাবুর চুক্তি রয়েছে। অগ্রিম টাকা নেওয়া আছে। তারাও সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। উপায় নেই।
বাকি তিন দিন মঞ্চে দশর্কের উপচানো ভিড় ছিল। চারু বাবু হিসাব রাখেন। তিন দিনের টাকাতো তার আয়ের সঙ্গে চুক্তি ছিল। আয় বেশি হয়েছে।
বাইশ তারিখ বড় দারোগা আসে চারু বাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।
চা খেতে থেতে দারোগা বলে, দাদা, আপনার কারণে আমার আয় ভালো। তাই ভাবলাম, গুরুকে না দিয়ে হজম করি কী করে? তাই আপনার জন্য হাজার দশেক নিয়ে এলাম। বোঝেন তো পুলিশ জাত!
চারু বাবু উচ্চস্বরে হাসেন। সুগন্ধি জর্দা দিয়ে পান খান।
চারু বাবু বলে, মাগী খুশি করেছে তো?
কি যে কন দাদা। আপনি হলেন জহুরি!
অদ্য শেষ রজনী। পালা দেইখ্যা যান।
না দাদা, দেখতে পারব না। তবে রাত দশটা পর্ষন্ত থাকব।
থাকেন। অদ্য শেষ রজনী। ঝুমুর লাগলে পল্লাৎকে বললেই হবে।
দারোগা বের হয়ে যায়।
শালা বদ। কষে গাল দিয়ে পাইটের কথা বলতে যাবে এ সময় মৃণাল ভৌমিক হন্তদন্ত হয়ে বলে, বাবু, পুষ্পিতা আর প্রেমকুমার লাপাত্তা!
চারু বাবু অবাক হলো না। শুধু মুখে খিস্তি তুলে বলে ওঠেন, শালার শেষ খারাপ।
সন্ধ্যা বলল, পুষ্পিতা তো কিছুই নেয় নাই। প্রেম কুমারও না।
সবিতা পাইট নিয়ে আসে। চারু বাবু নির্বিকার। প্রতি রাতের মতো পাইট খান আর সবিতাকে গালি গালাজ করতে থাকেন।
মৃণাল ভৌমিককে বলে, ফয়সাল, সন্ধ্যারে দিয়া পালা চালাও। বাজানদার-ঝুমুররা খেইচ্চা মারবা। অদ্য শেষ রজনী।
ফয়সলের চেহারা ভালা। গলায় তোলবার পারে নাই?
দরকার নাই। জোরে কইতে কবা।
দারোগা আবার এলো।
কী শোনলাম দাদা?
ঠিক। ওরা রাধা-কৃষ্ণ। আমি কী করব?
কোনো আইনি সাহায্য?
দরকার কী? ক্ষিধা। আগুন!
তাহলে?
মানুষ তো! পাপ-পুণ্যি দিয়া আমি কি করমু? ওরা নিজেরাই হাওয়া।
দারোগা পাইটে গলা ভেজাতে ভেজাতে বলে, মাগীর এত রস?
চারু বাবুর মেজাজ চড়ে যায়।
এই দারোগা বাবু, পেন্নাম নিন। মাগী বলবেন না। পুষ্পিতা আপনার মতো ফাও খায় না। রাইতকে রাইত জাইগগা ভাতের ট্যাহা কামায়। যান দারোগা বাবু, আমার মন খারাপ।
পাইটের ঘোরে বলে, স্যরি দাদা, আমি শালা সত্যি পুলিশ! মানুষ হতি পারি নাই। স্যরি। ঝুমুরে যাই।
বদমাইশ। চারু বাবু লেপের নিচে মুখ লুকান।
সবিতা চারু বাবুর পা টিপে দিতে থাকে। কিছুক্ষণ পর চারু বাবু বলে, সবিতা যা ঘুমা গা। অদ্য শেষ রজনী।
সবিতা চলে যায়। লেপের নিচে চারু বাবুর নিঃশ্বাস ক্রমশ বড় হতে থাকে। এত বছর পর নিজকে পরাজিত মনে হয়। পুষ্পিতার জন্য এত মমতা জমা ছিল! আহ! দুঃখিনী নারী। প্রেম কুমারের প্রতি মমতা কম। ওতো সেদিন এলো। পুষ্পিতা কতদিন ধরে আছে। মমতা জুড়ে আছে। ওর ক্ষিধায় আমি তো কেউ না। ও প্রেম কুমারকে যোগ্য মনে করেছে। চোখে জোনাক আলোর বল ঘুরতে থাকে। কতদিন পর আজ হঠাৎ ক্লান্তি চলে আসে! চারুচন্দ্র মহালনবীশ ভাবেন, পরাজিত মানুষের কোনো কাজ থাকে না। পুষ্পিতার মুখ মনে পড়ে। রাধা বনিক পিছে দাঁড়ায়। রাধা দেবী বুড়ি। ক্ষিধা নাই। পুষ্পিতা ছেড়ি। ক্ষিধা আছে। আমার আছে ভাতের ক্ষিধা। রাধা বনিক ছুড়ি থেকে বুড়ি পর্ষন্ত হেঁটে আসে। মনে হয়, রাধা বউ। সিঁদুরের লাল বউ। পুষ্পিতা শুধুই নারী। চারু বাবু ঘোরের মধ্যে বলতে থাকেন, প্রিয় রাধা, কৃষ্ণ, কৃষ্ণ বলে কাটায় জীবন। অদ্য শেষ রজনী।
মন্তব্য