সাহিত্য মনের শৈল্পিক অভিব্যক্তি। তা স্বতঃস্ফূর্ত ও অবারিত। আরোপিত নয়। এই নির্জলা একটি বিষয়ের ওপরে আলোচনা বা সমালোচনা একটু স্পর্শকাতর ব্যাপার বটে। একই গ্রন্থ বা বিষয়ের ওপর একের অধিক আলোচনা হলে তা বিচ্ছুরিত হবে আলাদা আলো ও রঙে। এখানে দৃষ্টিভঙ্গি রুচি ও পছন্দ প্রাধান্য পায়।
সত্যিকার সাহিত্য-ব্যক্তিত্বই প্রকৃত সাহিত্য সমালোচনা করতে পারেন। পুঁথিগত বিদ্যা নিয়ে, ভার ভারিক্কি নিয়ে পাণ্ডিত্য প্রকাশ করা সহজ। এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিশ্লেষণ ও পাঠোদ্ধার কঠিন। শুধুই সমালোচক যারা, তাদের উদাহরণ বোধ করি এমন কোথাও পড়েছিলাম—সমালোচনার খাতিরে যারা সমালোচক, তারা নিজেরা গাড়ি চালাতে জানেন না। অথচ গাড়ি যারা চালান, তাদের চালানোর ব্যাপারে পরামর্শ দিতে কমতি করেন না। যারা হয়তো জীবনে লেখেননি একটি কবিতা বা গল্প, তারাই সমালোচনা করেন নানাদিক নিয়ে। লেখার ভালো দিক এড়িয়ে প্রথমেই বসে যান ব্লেড হাতে। ওখানেও বসিয়ে নেন ক্ষুর। তাই যতদূর আমরা ভাবি না কেন, তাদের তথাকথিত সাহিত্য সমালোচনা থেকে সমকালীন সাহিত্যের প্রকৃত চিত্র পায় না উত্তর কাল।
কবি ও প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ নূরুল হক তার প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ ‘সাহিত্যে দশক বিভাগজন ও অন্যান্য’-এর ‘গদ্যকথন’-এ বলছেন: ‘কবি-সাহিত্যিকের খণ্ডিত পরিচয় দিয়ে, কিংবা বিশেষ শ্রেণীর লেবেল পরিয়ে দিয়ে সমালোচকেরা আত্মপ্রশান্তি পান হয়তো, কিন্তু সাহিত্যিক তাতেই বিব্রতবোধ করেন। সঙ্গত কারণে একজন কবি কিংবা একজন সাহিত্যিকের সামগ্রিকরূপ নিয়ে আলোচনা করা উচিত। খণ্ডিত কালসীমার পরিসরে কোনও সাহিত্যআন্দোলন গড়ে ওঠে না। অথচ নিজেকে একটি বিশেষ কালখণ্ডের বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন অনেকে। বিষয়টা সাহিত্যের পথে মঙ্গলজনক নয়।’
বইটিতে মোট ২০টি প্রবন্ধ রয়েছে। ১৬০ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি যেমন কলেবরে সুপুষ্ট, তেমনি বিষয়-বৈচিত্র্য, গাম্ভীর্য ও সূক্ষ্ম আলোচনায়ও ঋদ্ধ। সাহিত্যের নানাদিক আলোকপাতের জন্য লেখককে ভ্রমণ করতে হয়েছে বিশ্বসাহিত্যের অলিগলিও।প্রতিটি প্রবন্ধ নিয়ে এখানে আলোচনা সম্ভবপর হয়ে উঠবে না ঠিকই, তবে বিশেষ বিশেষ প্রবন্ধের ওপর আলোচনার চেষ্টা থাকবে। কারণ, পাঠক সত্যিকার রসাস্বাদন করতে পারবেন মূল প্রবন্ধগুলো আদ্যোপান্ত পাঠের পরই।
বইয়ের অন্দরে যাওয়ার আগে লেখক সম্বদ্ধে একটু বলে নেওয়া ভাল। মোহাম্মদ নূরুল হক মূলত কবি। ‘মাতালনদীর প্রত্নবিহার’ ও ‘স্বরিচত চাঁদ’ কাব্যের স্রষ্টা তিনি। তিনি মূলত কবি হলেও তার আলোচনা শুধু কবিতার ওপরেই সীমাবদ্ধ নেই, প্রাধান্য আছে। ছোট-ছোট বাক্যে রয়েছে কাব্যিকতা ও প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতি। এতে তার গভীর পাঠ-সমৃদ্ধির দেখা মেলে। যা একজন আলোচকের পয়লা যোগ্যতা। নিজে কবি হওয়ায় আলোচ্য কবিতার মরমে প্রবেশ করে করে উপমা, গঠন, বিষয় ও শৈলী’র শিখর স্পর্শ করতে পেরেছেন। আর এগুলো তিনি সম্ভব করেছেন তার কবিতাপ্রেম, স্বচ্ছ অথচ গভীর গদ্যভঙ্গির জন্যে। ঠাসবুনটে কোনো কোনো অংশই হয়ে উঠেছে এক একটি মন্থিত কবিতাংশ।
উদাহরণ :
‘কবিতা বুদ্ধির দীপ্তি, প্রজ্ঞার জৌলুস, চিন্তার সৌকর্য এবং আবেগের সংহত ও পরিশীলিতরূপের বিবর্তনেরই মিথষ্ক্রিয়া। অবয়ব সৃজিত হয় ছন্দ, অলঙ্কার, ভাষা ও প্রকরণের যথার্থ ও অনিবার্য পরম্পরায়। শুধু বুদ্ধির দীপ্তি ও প্রজ্ঞার অনুশাসনে কবিতার স্বতঃস্ফূর্ত ভাব, চরিত্র ও প্রাণচাঞ্চল্যের সর্বস্ব হরণ করে। বস্তুসত্যের যৌক্তিক ব্যাখ্যার প্রশ্নে কাব্যসত্য আপাতত ক্লিশে হয়ে আসে; কিন্তু শুদ্ধতম অনুভূতি ও অন্তরের আহবানকে মর্যাদাপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত করতে চিন্তার পরিশীলিত রূপের সঙ্গে হৃদয়াবেগের সংহত রূপকে অস্বীকার করা যায় না।’ (কবিতার অবয়ব ও আন্তঃসংগঠন প্রক্রিয়া)
প্রবন্ধগুলোয় লেখক সাহিত্য আলোচনার সামগ্রিক রূপ তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। সাহিত্য-চর্চার জন্য যা প্রয়োজন সেগুলো উঠে এসেছে আকর্ষণীয়ভাবে। এখানে প্রাসঙ্গিক একটা শব্দ ব্যবহার করতে ইচ্ছে হয়, ‘সার্বভৌম’। তিনি সার্বভৌম প্রাবন্ধিক হিসেবেই পরিগণিত হওয়ার যোগ্য। ‘কবিতার নেপথ্যকথা’ থেকে শুরু করে ‘কবির তপস্যা ও কবিতার সৃজনক্রিয়া’, ‘কবিতা পাঠের অনুভূতি ও বিস্ময়’ জাগিয়ে আমাদের নিয়ে চলেন, ‘বৃত্তাবদ্ধের স্বার্থচিন্তা ও মতাদর্শের দ্বন্দ্ব’ দেখাতে। ‘কাব্যসত্য ও পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তিক অন্বেষা’র ছলে চিনিয়ে দেন ‘মানবমনের অনন্ত জিজ্ঞাসা ও কবিতার শত্রু-মিত্র’ কে। অবারিত করেন, ‘রূপসীবাংলা ও বালিকাআশ্রম: নিসর্গের অহঙ্কার-প্রাণের ঐশ্বর্য’কে। এভাবে ‘গদ্যের বিষয়বস্তু ও ভাষাশৈলী’র পথ বেয়ে উপসংহারে আসেন ‘সাহিত্যে দশক বিভাজন’-এর মাধ্যমে।
‘কবিতা বুদ্ধির দীপ্তি, প্রজ্ঞার জৌলুস, চিন্তার সৌকর্য এবং আবেগের সংহত ও পরিশীলিতরূপের বিবর্তনেরই মিথষ্ক্রিয়া। অবয়ব সৃজিত হয় ছন্দ, অলঙ্কার, ভাষা ও প্রকরণের যথার্থ ও অনিবার্য পরম্পরায়। শুধু বুদ্ধির দীপ্তি ও প্রজ্ঞার অনুশাসনে কবিতার স্বতঃস্ফূর্ত ভাব, চরিত্র ও প্রাণচাঞ্চল্যের সর্বস্ব হরণ করে। বস্তুসত্যের যৌক্তিক ব্যাখ্যার প্রশ্নে কাব্যসত্য আপাতত ক্লিশে হয়ে আসে; কিন্তু শুদ্ধতম অনুভূতি ও অন্তরের আহবানকে মর্যাদাপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত করতে চিন্তার পরিশীলিত রূপের সঙ্গে হৃদয়াবেগের সংহত রূপকে অস্বীকার করা যায় না।’
‘কবির তপস্যা ও কবিতার সৃজনক্রিয়া’ বাংলা সাহিত্য শুধু নয় বিশ্ব-সাহিত্যের দিকপালদের কাব্যভাবনা ও উদ্ধৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। এতে কবির সাধনার ধরন ও সৃজনশৈলীর পথরেখা নির্দেশিত। এই যে সাধনা, এই যে সত্যের মুখোমুখি কবির অবস্থান তা কুসুমাস্তীর্ণ নয়। সত্যের মতো কঠোর যে হিমালয়ের মতো সামনে এসে দাঁড়াতে চায়। এখানে কবিগুরু সম্পর্কে বলছেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথ বলেছিনে, ‘সত্য যে কঠিন, তাই কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’। রবীন্দ্রনাথ আকস্মিক চমক দেখানোর জাদুকর নন। কঠিনকে ভালোবেসে নিরন্তর পরিচর্যায় হয়ে উঠেছেন বিস্ময়কর। দেশ-কালের সীমা ছাড়িয়ে পরিণত হয়েছেন সর্বজনীন। এ সত্য ছন্দমুক্তির তপস্যা করার স্মরণ রাখা বাঞ্ছনীয়।’ এমন মূল্যায়ণ করেই থেমে যাননি লেখক। লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ যে অর্থে জীবনশিল্পী, সে অর্থে নেরুদা, হুইটম্যান এবং নজরুলও। চণ্ডীদাস, বায়রন, শেক্সপিয়র, সাঁত্রে, গোর্কিও। মানুষকে অস্বীকার করে তাদের সাহিত্যের ঐশ্বর্যপূর্ণ সৌধ গড়ে ওঠেনি। সমগ্র রবীন্দ্রসাহিত্যে, শেক্সপিয়রর শ্রেষ্ঠ ট্রাজিডিগুলো, সফোক্লিসের ট্রাজিডি কিং ইডিপাসেও মানবাত্মার জয় ঘোষিত।’ কবিতা কখন কবিতা হয়ে ওঠে—এ সম্পর্কে সুজিত সরকারের উদ্ধৃতি টেনেছেন, ‘শব্দ দিয়ে রচিত হয়েও যা শব্দকে অতিক্রম করে যায়, তাই কবিতা। শব্দের সীমানা অতিক্রম করার এই ক্ষমতাই হলো ব্যঞ্জনা।’ প্রবন্ধে টি এস এলিয়ট-এর উক্তি, ‘শিল্পের আবেগকে নৈর্ব্যিক্তিক হয়ে উঠতে হবে।’ কখন একটি কবিতা সত্যিকার কবিতা হয়ে ওঠে, সোমত্ত হয় সে বিষয়ে লেখকের এই লাইনটি তুলে দেওয়ার প্রয়াস পাই: ‘আবেগের সংহতি, যুক্তিবোধ ও যুক্তিহীনতার শৃঙ্খলা যখন প্রজ্ঞাশাসিত পথে অনুগমন করে, তখনই কবিতা সম্পন্ন হয়ে ওঠে।’
‘কবিতা পাঠের অনুভূতি ও বিস্ময়’ প্রবন্ধে লেখকের নিচের লাইনগুলো স্বতঃসিদ্ধ সত্যে প্রতিভাত হয়: ‘একটি কবিতায় গুণের চেয়ে দোষের পরিমাণ খুঁজে বের করার মধ্যে গবেষক জীবন সার্থক হয়ে উঠতে পারে; কিন্তু তাতে কবিতার রস-উপলদ্ধ হয় না। কবিতার উদ্দেশ্য আবিষ্কারের ভেতর পাণ্ডিত্য থাকতে পারে; প্রেম থাকে না। প্রেম-বিবর্জিত কবিতাপাঠে কবিতা সম্ভ্রম হারায়, হৃদয়কে আলোড়িত করে না।’—এমন মন্তব্যের পর লিখেছেন, ‘কোনও ক্রমপরিবর্তনমান শিল্প-প্রপঞ্চ সম্পর্কে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজের প্রতি প্রশ্নশীল হওয়া জরুরি। যে প্রশ্নের উত্তর নিজের মন দিতে অপারগ, সে প্রশ্ন প্রকৃতিকেও করা অনুচিতি।’ প্রবন্ধের অনত্র বলছেন, ‘বিস্ময়বোধ জাগিয়ে তোলাই কবির প্রধান কীর্তি। বিস্ময়েরই আরেক নাম কবিতা। তাই শত বছরের ব্যবধানেও এক কবির চেতনার সঙ্গে অন্য কবির চেতনার কী অবিশাস্য মিল! কবি যখন একা থাকেন, তখনই নিজের ভেতর সম্পন্ন মানুষকে আবিষ্কার করেন। তখন পুরুষ কিংবা নারী আর সাপেক্ষ পদ থাকে না। থাকে না অন্যেও মুখাপেক্ষিও। হয়ে ওঠেন স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সার্বভৌম।’
‘কবিতার নেপথ্য কথা’ গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধগুলোর একটি। কবিতা পরিপূর্ণ অবয়ব লাভ করার আগে তার ভাব, ভাষা, গঠন ও প্রকৃতি কেমন হয় তা সত্যিই কৌতূহলের বিষয়। কবি মাত্রই এক অনিবার্য অন্তঃদহনের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করেন। ক্ষণিক কোনো দৃশ্য বা অনুভব এমন সুষম আকারে ধরা দিতে পারে মানসপটে যে তা তখনই আকৃতি পায় মনোলোকে। কাগজে অক্ষরবিন্যাস হয়ে আসাটাই যা বাকি। এমনও জানতে পারা গেছে যে কোনো কোনো কবিতা দেখতে পান কবি মনের চোখে। আবার কিছু কিছু বিষয়ের ওপর নিবিষ্ট সাধনা এনেই গড়ে তুলতে হয় পঙক্তির পর পঙক্তি। এর পরও কবিতার কিন্তু সর্বজনীন সংজ্ঞা নিরূপন দুরূহ। প্রবন্ধকার যেমন বলেছেন, ‘কবিতা সম্পর্কে প্লেটোর Poetry is ‘inspired madness’. এবং Matthew Arnold Gi ‘a criticism of life’ কিংবা জীবনানন্দ দাশের ‘কবিতা অনেক রকম’ কোনো সংজ্ঞাই সার্বজনীন নয়।’ তার মতে, ‘কবিতা একান্ত উপলব্ধি ও উপভোগের বিষয়। ভোগ করার মতো স্পৃশ্য শরীর এর নেই। তাই ভোগের প্রশ্নে কবিতা অনঙ্গ। সে অনঙ্গ শিল্পের পথে একাকী রাতখচিত সময় কাটান কবি। কবির অনিদ্রা কবিতার সৃজন মুহূর্তের পূর্বাভাষও।’ এরপর তার মূল্যায়ণ, ‘জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মানুষ যেমন নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে শেখে, তেমনি কবিও প্রতিটি কবিতা সৃষ্টির পূর্বমুহূর্তে এক অলৌকক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকেন। সবাই সে সৃজন যন্ত্রণা থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারে না। যিনি পারেন তিনি কবি।’
সাহিত্যে দশক বিভাজন’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন সাহিত্য আবহমান কাল ধরে চর্চার বিষয়। একে কোনো দশকীয়া ক্ষুদ্রবৃত্তে রেখে আলোচনা করা যায় না। লেখক তার প্রবেন্ধর প্রথম লাইনেই পরিষ্কার করে বলেছেন দশকীয়া সাহিত্য আলোচনার কুফল। বলেছেন, ‘বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের একটি বিষফোঁড়া—দশকীয়া বিশ্লেষণ। এটি যেমন সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি সৃষ্টিশীলতার অন্যান্য বিভাগের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধক। মহাকালের হিসাবের খাতায় শতকই যেখানে গৌন, দশক সেখানে অতি তুচ্ছ বিষয় মাত্র। বিভিন্ন লেখকের উদ্ধৃতি সহযোগে লেখক দেখিয়েছেন, দশকপ্রীতিতে মূলত তারা আক্রান্ত, যারা মেধাহীন, পরিশ্রমভীতু ও স্টান্টবাজ।
‘বৃত্তাবদ্ধের স্বার্থচিন্তা ও মতাদর্শের দ্বন্দ্ব’ প্রবন্ধটি মোহাম্মদ নূরুল হকের প্রতিনিধিত্বকারী প্রবন্ধ বলে মনে হয়েছে। নাতিদীর্ঘ এই আলোচনায় তিনি সমসাময়িক সাহিত্য পরিমণ্ডলের অনস্বীকার্য বাতাবরণের বাতায়ন অবারিত করেছেন। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের সাম্প্রতিক আবহের ইঙ্গিত এসেছে সুস্পষ্টভাবে। তার কথায়: ‘একজন কবির খণ্ডিত পরিচয় কোনো সুফল বয়ে আনে না। বরং কবির পাঠক বলয়ের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে।’ এরপর তিনি বিস্তারিত আলোচনার পর লিখেছেন, ‘মতান্ধের মতবাদে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কবিতা।’ তার গভীর পর্যবেক্ষণ, ‘বর্তমানে বাংলাদেশে প্রগতিবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী ও মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী দলে বিভক্ত সাহিত্যসমাজ।’
এমন পযবেক্ষণের পর তিনি দেখিয়েছেন মতবাদ কী করে সমাজ অধপতনের দিকে ধাবিত করে। লিখেছেন, ‘ধার্মিক মাত্রই মৌলবাদী বা প্রতিক্রিয়াশীল নন। আস্তিক্যবাদী দর্শনের সঙ্গে আধুনিকতাবাদের সম্পর্ক কি সাংঘর্ষিক? তাহলে খ্রিস্টি ধর্মাবলম্বী ও ঐতিহ্যের অনুসারী টি এস এলিয়ট কী করে আধুনিক কবি হন? কিংবা লিও টলস্টয়?’ অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন, শিল্পসাহিত্য ও জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে মতবাদ দুর্বলদেরই হাতিয়ার। মেধাবীরা মতবাদকে এড়িয়ে চলেন।
‘সাহিত্যে দশক বিভাজন’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন সাহিত্য আবহমান কাল ধরে চর্চার বিষয়। একে কোনো দশকীয়া ক্ষুদ্রবৃত্তে রেখে আলোচনা করা যায় না। লেখক তার প্রবেন্ধর প্রথম লাইনেই পরিষ্কার করে বলেছেন দশকীয়া সাহিত্য আলোচনার কুফল। বলেছেন, ‘বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের একটি বিষফোঁড়া—দশকীয়া বিশ্লেষণ। এটি যেমন সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি সৃষ্টিশীলতার অন্যান্য বিভাগের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধক। মহাকালের হিসাবের খাতায় শতকই যেখানে গৌন, দশক সেখানে অতি তুচ্ছ বিষয় মাত্র। বিভিন্ন লেখকের উদ্ধৃতি সহযোগে লেখক দেখিয়েছেন, দশকপ্রীতিতে মূলত তারা আক্রান্ত, যারা মেধাহীন, পরিশ্রমভীতু ও স্টান্টবাজ। তার মতে, ‘যারা সারাজীবন হয়তো একটিও কালোত্তীর্ণ কবিতা, উপন্যাস, কিংবা ছোটগল্প লিখতে পারেননি, কিন্তু কবি কিংবা কথাশিল্পী হিসেবে সহজে আত্মপ্রচারের সুযোগ নিতে ও পেতে চান, তারাই দশকবিভাজনে অতি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। মূলত দশকবিভাজনে আগ্রহী তারাই, যারা সাহিত্যের নানা বাঁক ও প্রবণতা শনাক্তিতে অসমর্থ। সমকালীন সাহিত্যরুচির উত্তাপ উপলব্ধিতে ব্যর্থরাও জনরুচি সাহিত্যরুচিকে একই গ্লাসে গুলিয়ে পান করার পক্ষে।’
প্রবন্ধটির শেষ অংশ প্রণিধানযোগ্য। পুরো বইয়ের নির্যাস স্থিত এই ক’টি লাইনে: ‘আত্মপ্রসাদের কর্মযজ্ঞে দশকবাদী বনসাঁইরা আত্মরতিতে ভুগলেও সে-আত্মর তি অচিরেই আত্মগ্লানিতে পরিণত হয়। তখন প্রকৃত মহীরুহ সমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। অতএব কালের বিবর্তনে,বিকৃতির ধুলোর আবরণ মুছে গেলে, দশকভিত্তিক সংকলন ও গদ্য থেকে বাদপড়া কিংবা সেখানে অবমূল্যায়িত হওয়া কবি-লেখকরাই যে কালের বিচারে শ্রেষ্ঠ’র আসনগুলো অলঙ্কৃত করবেন, সে-ব্যাপারে সন্দেহ কী!’
‘কবিতার অবয়ব ও আন্তঃসংগঠনপ্রক্রিয়া’ প্রবন্ধে বলেছেন, কবিতার আকার বা গঠন কোনো নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলে বিচার করা সম্ভব নয়। কবিতা দুই থেকে দুই হাজার লাইনেরও হতে পারে। ভাব ও বক্তব্য প্রকাশের ধরনই বেঁধে দেয় এর অবয়ব-কাঠামো। লেখক বলছেন, ‘কবিতা হয়ে উঠার জন্য মৌলিক অনুষঙ্গ,ছন্দ-ভাষা যথোপযুক্ত অলঙ্কার অনিবার্য।’ আবার ‘মানবমনের অনন্ত জিজ্ঞাসা ও কবিতার শত্রু-মিত্র’ উপভোগ্য একটি প্রবন্ধ। প্রিজমের মতো নানাদিকে আলোক-বিচ্ছুরণের মধ্য দিয়ে আবছায়া থেকে আভাময় করা হয়েছে কবিতার বৈরিতাকে। এখানে কবিতার শত্রু হিসেবে ধর্ম, সমাজ, তত্ত্বপ্রচারক, সাম্প্রদায়িক মনেবৃত্তি, অসাহিত্যিক মনোবৃত্তি, রাজনীতি, এক সময়ের রাজা-বাদশাহ, এমনকি কবি ও উপকবির দিকেও অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়েছে। মনের জিজ্ঞাসা উপস্থাপিত হয়েছে ঐতিহাসিক অনন্য এক উদাহরণের মাধ্যমে : ‘মানবমনের অস্ফূট প্রশ্নের উত্তর জমা থাকে সংবেদনশীল মানুষের কাছেই। প্রশ্নশীল চারিত্র্য কি মানুষকে শিল্পী করে তোলেনি? যে বেদনাবোধ থেকে সফোক্লিস কিং ইডিপাস লিখে মানবজাতিকে অনন্ত দুঃখের কাহিনী শুনিয়েছিলেন, সে মর্মযাতনার মূলেও মানবাত্মার অনন্তজিজ্ঞাসা উপস্থিত।’
প্রিয় পাঠক, এই বৃহৎ কলেবরের বইটির আলোচনার সময় নিজে কোনো কথা বলা থেকে যথাসম্ভব বিরত থেকেছি। শুধু আলোচ্য বিষয় মৃদু উন্মোচনের অভিপ্রায়ে লেখকের উদ্ধৃতির আগে আগে বলেছি দুকথা। বিশটি প্রবন্ধের বিস্তৃত ভূমিতে বিচরণও এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয় কোনোমতেই। মাত্র আটটি প্রবন্ধের মর্ম থেকে লেখকের লেখনীর মনন-চিত্র উদ্ভাসিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
সাহিত্যে দশক বিভাজন ও অন্যান্য
মোহাম্মদ নূরুল হক
প্রাপ্তিস্থান: রকমারি ডটকম
মূল্য: ২০০টাকা