[২০০৯ সালে সাহিত্যে নোবেল পান জার্মান-রোমানিয়ান লেখিকা হার্টা মুলার। তিনি ১৯৫৩ সালে রোমানিয়ার ট্রান্সিলভেনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। রোমানিয়ায় সংখ্যালঘু জার্মান সম্প্রদায়ের লোক ছিল তাঁর পরিবার। সেই সময়কার সমাজতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রের বিরোধিতা করায় চাকুরিচ্যুত হন তিনি। তাঁর মা দীর্ঘকাল শ্রমশিবিরে বন্দি ছিলেন। তাঁর প্রথম বইয়ের নাম ‘লো ল্যান্ডস’। ভাষার কাব্যিকতার জন্য তাঁর লেখনী বিশ্বজুড়ে খ্যাতি লাভ করেছে। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয় মুলারের প্রথম ছোটগল্পের বই ‘নিয়েদেরুনজেন’(নাদিরস)। এ গল্পগ্রন্থকে অনেকটাই মুলারের রোমানিয়ান জীবনের আত্মকথা বলে মনে করা হয়। মুলারের বিখ্যাত কাজের মধ্যে রয়েছে ২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘দ্য হাঙ্গার অ্যাঞ্জেল’ উপন্যাসটি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন মার্কিন নাট্যকার ফিলিপ বোম। ২০১৪ মার্কিন প্যারিস রিভিউতে প্রকাশিত হয়েছিল। চিন্তাসূত্রের জন্য ভাষান্তর করেছেন অজিত দাশ]
ফিলিপ বোম: আপনি নিটজকিডোর্ফের একটি কৃষক পরিবারে ছিলেন?
মুলার: আমার দাদা অনেক জমির মালিক ছিলেন। বিভিন্ন মালামালের দোকানও ছিল তাঁর। তিনি একজন শস্য বণিকও ছিলেন। প্রতিমাসে ব্যবসায়িক কাজে ভিয়েনা যেতেন।
ফিলিপ: শস্য মানে তো মূলত গমের ব্যবসাই ছিল?
মুলার: মূলত গম ও ভুট্টা। আমি যে বাড়িটিতে বড় হয়েছি, সেখানে চারতলা উঁচু একটি শস্যঘর ছিল। পরে ১৯৪৫ সালে আমাদের সব কেড়ে নেওয়া হলো। এরপর সেই ঘরটি ফাঁকাই পড়েছিল।
ফিলিপ: মালামালের দোকানগুলোর কী হলো?
মুলার: সেই দোকানগুলোতে অনেক রকমের পণ্য ছিল। সমাজতান্ত্রিকরা সব কেড়ে নেওয়ার আগে আমার মা ও দাদি সেখানে কাজ করতেন। তারপর আমরা যৌথ খামারে চলে গেলাম। আমার দাদা বিষয়টিকে সহজে মেনে নিতে পারেননি। কেননা তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয়কে এক নিমেষেই সমাজতান্ত্রিকরা কেড়ে নিয়েছিল। এ কারণেই দাদা সেই রাষ্ট্রটিকে বিশ্বাস করতেন না। এরপর সমাজতান্ত্রিকরা তাঁকে রোমানিয়ার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। দাদাকে অস্ট্রিয়ানদের সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পাঠানো হয়েছিল। তাঁকে একটি ঘোড়াও দিয়েছিল। যুদ্ধে মৃত সৈনিক ও তার ঘোড়ার জন্য একটি সনদ পূরণ করতে হতো। দাদার মৃত্যুর খবর এসেছিল। আমাদের একটি ফর্ম পূরণ করতে হয়েছিল।
ফিলিপ: তারা আপনার দাদার সব জমি কেড়ে নিয়েছিল এবং তাঁকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিল। কেননা তিনি একজন ধনী কৃষক ছিলেন?
মুলার: আমি এ বিষয়ে লিখেছি যে, আমার দাদা একজন ধনী কৃষক ছিলেন। সবকিছু কেড়ে নেওয়ার পরও তারা তাঁকে একজন শোষক হিসেবে উপাধি দিয়েছে।
ফিলিপ: আপনারা পরিবারের সবাই কি জার্মান ভাষায় কথা বলেন?
মুলার: জার্মান গ্রামবাসীরা জার্মান ভাষায় কথা বলে। হাঙ্গেরি গ্রামবাসীরা হাঙ্গেরি ভাষায় কথা বলে, সার্বিয়ান গ্রামবাসীরা সার্বিয়ান ভাষায় কথা বলে। প্রতিটি দলের আলাদা আলাদা ভাষা, ধর্ম, ছুটির দিন ও পোশাক আছে। এমনকি জার্মানিতেও প্রতিটি গ্রামে আলাদা আলাদা উপভাষা আছে।
ফিলিপ: জার্মান উপভাষা ছাড়াও আপনার পরিবার কি উচ্চ জার্মান ভাষায় কথা বলতে পারে?
মুলার: আমার দাদা পারতেন। ব্যবসায়িক কারণে তিনি সেটা রপ্ত করেছিলেন। কিন্তু আমার দাদি উপভাষাই জানতেন। তাঁরা অবশ্য সঠিক হাঙ্গেরীয় ভাষা বলতে পারতেন। যখন দাদা , দাদি বড় হচ্ছিলেন, তখন আমাদের গ্রাম অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সম্রাজ্যের অধীন ছিল। আর এই অঞ্চলে হাংরেরীয়রা জোরপূর্বক সে ভাষা এবং সংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়েছিল। ফলে তাদের হাংগেরিয়ান স্কুলে পড়াশোনা করতে হয়েছে। এরপর সমাজতন্ত্রের হাতে চলে গেল। তাদেরও অনেক বয়স হয়ে গিয়েছে। ফলে রোমানিয়ান ভাষা আর শেখা হলো না।
ফিলিপ: আপনার স্কুলজীবন কেমন ছিল?
মুলার: প্রথমে খুব কষ্ট হয়েছিল। কেননা লিখিত জার্মান ভাষা থেকে উপভাষাগুলো অনেকটা আলাদা। উচ্চারণে একইরকম হলেও কিছুটা ভিন্ন। যেমন ‘ব্রেড’কে উচ্চারণ করতে হতো ‘ব্রুট’। আর এটাই আমি ঠিকমতো পারতাম না। যেমন ‘ব্রেড’কে আমি উচ্চারণ করতাম ‘ব্রেট’। আর এটাই আমাকে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগাতো। এই ভাষা কি সত্যি আমার নিজের ভাষা কি না, তা আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে হোচোট খেতাম। আমার প্রায়ই মনে হতো এগুলো অন্য মানুষের ভাষা। আর আমি সেগুলোকে ধার করে শিখছি। এই বিষয়গুলো আমাকে প্রতি মুহূর্তে নাড়া দিত এবং মনে করিয়ে দিত যে, আমি একজন সংখ্যালঘু। আমি সবসময়ই নিজেকে জার্মান সংখ্যালঘু হিসেবেই ভাবতাম। সরকারিভাবে আমাদের সংখ্যালঘু হিসেবে বিবেচনা করা হতো না বরং জার্মানসহবাসী হিসেবে ধরে নেওয়া হতো। রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের সব অধিকার দেওয়া হলেও আমার কাছে বিষয়টি অদ্ভুত লেগেছে। লোকজন প্রায় তিনশ বছর ধরে এখানে বসবাস করছে।
ফিলিপ: অনেকটা নিজের দেশেই অতিথির মতো, তাই নয় কি?
মুলার: পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমাকে বলেছিল, ‘ভুলে যেও না তুমি রোমানিয়ান রুটি খাও’। আমি বলেছি ‘আমাদের পূর্ব পুরুষের সবকিছুই ছিল। আমার দাদার সব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তা না হলে আমাদের রোমানিয়ান রুটি খেতে হতো না।’ আমার এরকম প্রতিউত্তর তাদের সবসময়ই রাগান্বিত করেছে। তারা এও বলেছে, যদি আমি রোমানিয়ান জনগণকে পছন্দ না করি, তাহলে পশ্চিমে আমার ফ্যাসিস্ট বন্ধুদের সঙ্গে যেন চলে যাই।
তখনকার সময়ে পুরোহিত পাওয়া খুব কঠিন ছিল
ফিলিপ: যখন থেকে কৃষক-শ্রমিক দলের ওপর রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা প্রসারিত হয়েছে পরিস্থিতি আরও তিক্ত হয়েছে।
মুলার: এরপর থেকে কৃষকরা আর নিজেদের জমিতে আবাদ করতে পারেনি। সেই জমিগুলো চলে গেল যৌথ মালিকানায়। আমার মাকে সেই জমিগুলোতে কাজ করতে হয়েছিল যেগুলো একসময় আমাদেরই ছিল। সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার পর দাদি যখন মাকে প্রশ্ন করতেন ‘আজ কোন জমিতে কাজ করতে গিয়েছিলে?’ মা তখন অন্য জমির কথা বলতেন। দাদি নানারকম প্রশ্ন করতে থাকলে মা খুব কষ্ট পেতেন এবং উত্তর দিতে চাইতেন না।
ফিলিপ: গ্রামের সবাই কি ক্যাথলিক ছিলেন?
মুলার: অন্যান্য জার্মান এবং হাঙ্গেরীয় গ্রামের মতই ছিল। আমার পরিবার অতটা ধার্মিক ছিল না। এছাড়া গ্রামের কোনো আচার-অনুষ্ঠানের জন্য কেউ পুরোহিতের প্রয়োজন বোধ করতো না। কেননা তখনকার সময়ে পুরোহিত পাওয়া খুব কঠিন ছিল। যারা ছিল তাদের অনেক কষ্টেই জীবনযাপন করতে হতো। অধিকাংশ পুরোহিতই খুব মদ্যপান করতেন। নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়টিকে বড় করে তোলার কোনো প্রবণতাই তাদের মধ্যে ছিল না।
ফিলিপ: গির্জায় প্রার্থনা মূলত কোন ভাষায় হতো? জার্মান না কি লাতিন?
মুলার: জার্মান ভাষায়। পুরোহিত বলতেন, ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান। তার মানে তিনি ঘরের দরজা থেকে শুরু করে টেবিল, চেয়ার এবং গাছের মধ্যেও বিরাজমান। আমি তখন ভাবতাম এই সবগুলোই বোধহয় আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। ঈশ্বর হয়ত আমার ভেতরেই বসবাস করেন এবং ভেতর থেকে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। এটা অনেকটা ভূতুড়ে ব্যাপার এবং ভয়ের জন্ম দেয়। শিশুকালে এই বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে নিলে অনেক ভীতি তৈরি হয়। আমি যাই করি না কেন, সবসময় এই বোধ মনে হয় যে, ঈশ্বর আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে।
আরেকটা বিষয় নিয়ে গির্জায় বলা হয়ে থাকে, মৃত ব্যক্তিরা স্বর্গে বসবাস করেন। আমি তাই আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘ দেখি হয়ত সেই ব্যক্তিগুলো মেঘের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করছে। ভাষণের সময় পুরোহিত যখন যিশুর রক্ত এবং শরীর নিয়ে কথা বলে এবং মদ্য পান করে আমার কাছে বিষয়টিকে পাগলামি মনে হয়। কেননা আমি প্রতি সপ্তাহে এক থেকে দুইবার মুরগি কেটে থাকি। তখন অনেক রক্ত বের হয়। আর মনে হতো পাদ্রির পানপাত্রে মদের পরিবর্তে সেগুলো রক্ত এবং সে রক্ত পান করছে। এখনো আমি যখন কোনো গির্জায় যাই, দেখি বিশাল আকৃতির একটি মেরির মূর্তি, মাথায় রঙিন আবরণ এবং মূর্তিটির লাল হৃদপিণ্ডটি জামার ওপর দিয়ে বেরিয়ে আছে। একবার দাদির সঙ্গে গির্জা গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম মেরির হৃদপিণ্ডটি দেখতে তরমুজের মতো। হৃদপিণ্ডে কালচে রক্তের ফোটাগুলোকে মনে হয়েছিল তরমুজের বীচির মতো।
ফিলিপ: তখন দাদি কী উত্তর দিলেন?
মুলার: তিনি বলেছিলেন তুমি ঠিক বলেছ কিন্তু এ কথা আর কাউকে বলবে না। কিন্তু তিনি একটু ভয়ও পেয়েছিলেন। আমি সবসময় ভাবতাম হয়ত আমার জন্য বড় কোনো অভিশাপ অপেক্ষা করছে। পুরোহিতরা ধর্মীয় বিধিনিষেধের দিকে অনেক গুরুত্বারোপ করতেন। আমরা কখনোই গির্জায় সেজে যেতাম না। কেননা পাদ্রি আমাদের বলছিলেন লিপস্টিক মাছির রক্ত দিয়ে তৈরি করা হয়। আর শিশুদের জন্য এটা অনেকটা ভীতিকর। মতে সেখানে সবকিছুই নিষিদ্ধ করা হয়। আর এটাকে মিলিয়ে দেওয়া এভাবে যে ঈশ্বর তোমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। সেই গ্রাম আর গির্জাটিই ছিল আমার তখনকার পৃথিবী।
একা একা নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলতাম
ফিলিপ: এবং শেষমেশ স্বীকারোক্তি।
মুলার: এটাই তো পাগলামি। তুমি স্বীকারোক্তির জন্য যাবে এবং তোমার পাপের একটি তালিকা তৈরি করবে। তোমার ভাবনা, তোমার দেখা কিংবা শোনা এই সবকিছুকেই খুব বড় করে দেখা হয়, যদি না সেটা খারাপ হয়। তুমি দেখছ রাস্তায় দুটো কুকুর সঙ্গম করছে, খামারের মুরগিগুলো সঙ্গম করছে এবং সেগুলো তোমাকে আকর্ষিত করছে। করতেই পারে। কিভাবে একজন মানুষ প্রতিটি মুহূর্ত গুনে গুনে নিজেকে সঠিক পথে পরিচালনা করবে? আর হিসাব রাখবেই বা কী করে, সে কতগুলো খারাপ কাজ করেছে? পুরোহিত তোমাকে জিজ্ঞেস করবে তুমি কতবার মন্দ কাজ করেছ? আর দেখো লোকজনও কত চমৎকারভাবে মিথ্যে বলার সুবিধা নিচ্ছে। ধরো আমি বলব, আমি বিশটি খারাপ কাজ করেছি। তুমি বলবে পঁচিশটি খারাপ কাজ করেছ। তুমি খুব বেশি একটা সংখ্যা বাড়াবে না। কেননা অন্যের চেয়ে তোমার সংখ্যা যেন অনেক কম থাকে, সেই চেষ্টা করবে। তোমার স্বীকারোক্তির মাধ্যমে কোনো মানসিক মুক্তির চেয়ে বরং তুমি মিথ্যে বলে আরও যন্ত্রণায় ভুগতে থাকবে। কেননা তোমার কাছে আর কোনো পথ নেই। পুরোহিতের নিকট মিথ্যে বলা মানে তুমি ঈশ্বরের নিকট মিথ্যে বলছ- তাহলে কী হবে? ধর্মগ্রন্থকে গুরুত্বসহকারে নিলে তোমাকে অনেক সমস্যার সন্মুখীন হতেই হবে। এটা মানুষের স্বাভাবিকতাকে দমন করার একটা অদ্ভুদ প্রক্রিয়া। অদ্ভুত প্রক্রিয়া বলছি এই কারণে- তোমাকে কোনো প্রতীয়মান শাস্তি পেতে হবে না-কেননা ঈশ্বর কিছুই বলে না, সে কখনো তোমাকে দর্শন পর্যন্ত দেয়নি কিন্তু সে আবার সর্বত্র বিরাজমান থেকে তোমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। আর তুমি এটা ভেবে মরছ যে, পাপ করলে কিছু একটা শাস্তি তো পাবেই। আর এ কারণেই ঈশ্বরে বিশ্বাস আমার কাছে ভীতিকর এবং পীড়নমূলক মনে হয়। যা কিনা ব্যক্তির স্বাধীনতাকে পুরোপুরি বাধাগ্রস্ত করে।
ফিলিপ: আপনার বাবা-মা কি খুব শাসন করতেন?
মুলার: তা অবশ্য করতেন। তবে এটা স্বাভাবিক ছিল। আমি সবসময়ই ঘরের কাজে সাহায্য করেছি। প্রয়োজনে মাঠেও কাজ করেছি। গোয়ালঘর থেকে গরুগুলোকে নদীর তীরে নিয়ে যেতাম এবং সারাদিন নদীর তীরে কাটাতাম। আমাদের ছয়টি গরু ছিল। হাঁটতে হাঁটতে কখনো গান গাইতাম। কিন্ডারগার্টেনে থাকার সময় একটি গান শিখেছিলাম। একা একা নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলতাম।
ফিলিপ: আপনি গাছের নতুন নামকরণ বিষয়ে লিখেছিলেন।
মুলার: গাছের নামকরণ বিষয়টি একটু জটিল। কৃষকের নামগুলো সুন্দর। কেননা তারা সেই গাছটির সঙ্গে দিন রাত কাটিয়ে থাকে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক নামগুলো অনেক কঠিন। তবে আমি বার্লিনে কিছু মালিকে দেখেছি। যারা ফুল চাষ করেন কিন্তু একটা সামান্য গাছের নামও জানেন না।
ফিলিপ: আপনি গাছের নামকরণ করেন কিভাবে?
মুলার: বলা যায় আমি আমার নিজের মতো করে একটি নাম দিয়ে দেই। আসলে আমি যখন সেই গাছটির খুব কাছাকাছি থাকি কিংবা সেটাকে বেড়ে উঠতে দেখি তখন বুঝতে পারি, ওরা জানে কিভাবে বাঁচতে হয়, যেটা আমি জানি না। আর এই ফাঁকা জায়গাটাকেই আমি অতিক্রম করতে পারি না। প্রাকৃতিক দৃশ্যের ক্ষেত্রেও সে রকম। আমি কখনো কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে সেটাকে বাহবা দেই না। আমি শুধু পর্যবেক্ষণ করি। সেগুলো কত গভীর যে আমাকে হারিয়ে যেতে বাধ্য করে। অনেকেই হয়ত পাহাড় চূড়ায় উঠে তার নিচের উপত্যকা দেখে মুগ্ধচিত্তে বলবে কত সুন্দর! কিন্তু আমি যত প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখি, তা আমাকে গ্রাস করে নেয়। আর ভাবি সেই বিশাল সৌন্দর্যের মাঝে আমি একটি নগন্য পিঁপড়ে মাত্র। শৈশবে মাঠের পর মাঠ, বিস্তৃত প্রান্তর আমার মধ্যে একরকম ভীতির জন্ম দিয়েছিল। মাঠের পর মাঠ নিজেদের সবুজ শস্যভূমি ছিল, কোনো দিগন্ত নেই। অথচ সেই ভূমিই একদিন কেড়ে নিয়েছে সমাজতান্ত্রিকরা।
ফিলিপ: আপনার ‘দ্য হাঙ্গার এনজেল’ বইটিতে একটি অধ্যায় আছে- লিওকে কোলখোজ অঞ্চলে কাজের জন্য পাঠানো হয়েছিল। সে সবুজ মাঠের প্রান্ত ধরে হাঁটছিল। লিও তখন ভাবছে- ‘হাওয়া যেন প্রবলভাবে আমাকে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে আর বিস্তৃত ক্ষুধিত প্রান্তর আমাকে গ্রাস করে নিচ্ছে ধীরে ধীরে।’
মুলার: বিস্তৃত প্রান্তর আমার মধ্যে সবসময়ই ভীতির জন্ম দিয়েছে।
ফিলিপ: আপনি কি শহরের পরিবেশে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন? কিংবা যদি বলি শহরের পরিবেশও নিপীড়নের একটি ভিন্ন চিত্র?
মুলার: শহরে সরকারি গুপ্তচরদের একরকম ভীতি তো আছেই। সেখানে কিছু গাছ আছে। আমি সবসময়ই বলে এসেছি এই গাছগুলোর ক্ষমতাবানদের সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে। তারাও একপ্রকার রাষ্ট্রকে বঞ্চিত করছে। যেমন ধরো ‘অ্যারবোরভিটাই’ কিংবা ‘ফায়ার’। সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের সামনে জীবন্ত বেড়া হিসেবে কাজ করে। সেখানে অবশ্য সমাজতান্ত্রিক ফুল ও রয়েছে।
ফিলিপ: আমরা যখন পোল্যেন্ডে ছিলাম, তখন কখনোই নিজেদের কোনো অনুষ্ঠানে লাল জারবারা ফুল ব্যবহার করিনি। কেননা সেগুলো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানেই একমাত্র ব্যবহৃত হতো।
মুলার: যখনি কোনো উচ্চপদস্থ সমাজতান্ত্রিকের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কিংবা সমাধি দেওয়া হয়, তখন গ্লাডিওলাস কিংবা জারবারা ফুলের ব্যবহার হয়। এসব ফুল একারণেই ব্যবহার করা হতো, সেগুলো দীর্ঘক্ষণ সতেজ থাকে। কিন্তু আমি সবসময় সেইসব ফুল পছন্দ করি, যেগুলো অল্পক্ষণ সতেজ থাকে। যেমন লিলি, ডালিয়া, পেন্সিস, ফ্লক্স। এগুলো নিজেদের মন্দকাজে ব্যবহার হতে দেয় না। ঠিক একই রকম বলা যায় মানুষের ক্ষেত্রে-যে মানুষগুলো মন্দ কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়, তাদের চরিত্রগুলো মন্দত্বকে দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারে। আর যারা মন্দত্ব ধরে রাখতে পারে না তাদের মন্দ কাজে বেশিদিন ব্যবহার করা যায় না। যে ফুলগুলো খুব কম সময়ের জন্য ফুটে থাকে, সেগুলোই হলো ক্ষমতাহীন মানুষের প্রতীক। তুমি লক্ষ করবে মানুষ দীর্ঘদিন যদি একনায়কন্ত্রের মধ্য বসবাস করে, তাহলে কিছুটা হলেও সে খাপছাড়া হয়ে যায়।
ফিলিপ: সব কিছুই তখন নির্ধারণ করে দেওয়া হয়?
মুলার: রাষ্ট্র তখন তার পক্ষ এবং বিপক্ষ নিয়ে ভীষণ মাত্রায় সচেতন হয়ে ওঠে। এমনকি একটি সমুদ্র সৈকত নিয়েও। আমি ভেবে দেখি সূর্যও কিভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে? কেননা তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতা নিকোলাই কৃষ্ণ সাগর সৈকতে একটি বাড়িতে অবস্থান করতেন বলে পুরো সমুদ্র সৈকতটিকে তিনি ঘেরাও করে রেখেছিলেন। যখন তিনি সেই বাড়িতে থাকতেন না তখনো সৈকতে সাধারণ মানুষকে প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না। সূর্যও কিভাবে তাকে এত চমৎকার সূর্যদোয় দেখার সুযোগ করে দিয়েছে?
কিন্তু আমি মনে করি এটা নিপীড়নের একটা সাধারণ চিত্র। মানুষ যখন দুর্দশাগ্রস্ত হয়, তখন তার চারপাশও যেন নিশ্চুপ হয়ে সে দৃশ্য দেখে। প্রকৃতি সবসময়ই মানবজাতির নিপীড়নগুলো নির্লিপ্ত হয়ে দেখে এসেছে।
ফিলিপ: একভাবে বলা যায় প্রাকৃতিক বিশালতা আমাদের জাগ্রত করে যেভাবে ফায়ার গাছের শাখাগুলো ‘দ্য হাঙ্গার এনজেল’ বইটিতে লিওকে জাগ্রত করেছিল।
মুলার: একবার অসকার পেস্টিওরের সঙ্গে দক্ষিণ টিরলে আমি বলেছিলাম, মানুষ কেন এই ফায়ার গাছগুলোকে খ্রিস্টমাসের সময় বাড়িতে নিয়ে আসে। এই গাছগুলো একেবারেই বিরক্তিকর। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলছিলেন, এই গা নিয়ে কোনো কটূক্তি আমি করতে চাই না। কেননা যখন আমি ক্যাম্পে ছিলাম, অনাহারে মৃত এবং হতাশ হয়ে পড়ছিলাম, তখন এই ফায়ার গাছটিইই আমাকে প্রয়োজনীয় উষ্ণতা দিয়েছে এবং সভ্যতায় গিঁট দিয়ে রেখেছিল। তুমি হয়ত বড়দিনে বিশ্বাস নাও করতে পারো, কিন্তু এই গাছটিকে বিশ্বাস করতে পারো।
বস্তুর একটা নিজস্বতা আছে
ফিলিপ: আর এটাই ঘটেছিল ‘হাঙ্গার এনজেল’-এ। লিও প্রথমে ক্যাম্পে ফায়ার গাছের পাতা ছিড়ার চেষ্টা করেছে। কেননা লিও দেখেছে ক্যাম্পের প্রহরীরা পাতা দিয়ে ঝাড়ুর কাজ করে থাকে। এবং সে বলছে, আর সেই তিনদিন ছিল খ্রিস্টমাস কেননা ফায়ার গাছের বৃক্ষ কক্ষে নিয়ে আসা হয়েছিল। এটা একটা আকর্ষণীয় বাক্য ছিল। আপনি ফায়ার গাছের একটা প্রয়োজনীয় ব্যাবহার দেখিয়েছিলেন। এবং ধর্মীয়ভাবে ফায়ার গাছকে যেভাবে বৈদ্যুতিক তার এবং সুতা দিয়ে সজ্জিত করা হয় সেটার পুনর্গঠন করেছেন। আর এই উপলব্ধিটিই আপনার শিশুকাল থেকে ছিল, যখন আপনি অভিজ্ঞতার আলোকে সেই শব্দগুলোকে আবিষ্কার করেছেন। আর এই শব্দগুলোই বলা যায় বর্তমান পৃথিবীর জন্য খাপছাড়া।
মুলার: আর এই খাপছাড়া বিষয়টিই আমাকে আরও স্পষ্টবাদী করে তোলে।
ফিলিপ: পাশাপাশি ভাষা ও বস্তুর মধ্যেও একটা খাপছাড়া বিষয় থেকে যায়।
মুলার: শব্দগুলোর একটি নিজস্ব সত্যতা আছে আর সেগুলো তৈরি হয়, তার উচ্চারণের ভেতর দিয়ে। কিন্তু কোনো শব্দ পুরোপুরি কোনো বস্তুকে প্রকাশ করতে পারে না; কেননা বস্তুর একটা নিজস্বতা আছে। যা শব্দের নিজস্বতা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।
ফিলিপ: আপনি ভাষার সীমাবদ্ধতা নিয়েও লিখেছেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ সত্তাকে ভাষা দিয়ে কখনো পরিপূর্ণ রূপে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তাই সম্ভবত এটা বলা ঠিক হবে যে, আপনি মূলত বস্তুকে শব্দের পেছনে এবং তার অন্তর্বর্তী সত্যটি দিয়েই প্রকাশ করতে চান। আর এটা হচ্ছে নীরবতা। ‘হাঙ্গার এনজেল’-এ আরেকটি দৃশ্য আছে এ রকম, লিওর দাদা তাদের একটি বাছুরের চোখে চোখ মিলিয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল এবং সেখানে একটি বাক্য ছিল ‘চোখের তৃষ্ণা’।
মুলার: আসলে এটা তৃষ্ণাকেই বোঝানো হয়েছে। আমি শব্দের জন্য তৃষ্ণার্ত নই কিন্তু তাদের নিজেদের একটি তৃষ্ণা আছে। তারা সেটাই ধারণ করতে চায় কিংবা প্রকাশ করতে চায় আমি যে বিষয়ের অভিজ্ঞতা নিয়েছি। আর আমি এটাই নিশ্চিত করতে চাই তারা সেগুলোকে প্রকাশ করছে।
ফিলিপ: লেখার আগে কি বাক্যগুলো আপনার মাথায় খেলা করে?
মুলার: না এ রকম কিছু হয় না। কিন্তু যখন আমি লিখি, তখন সবকিছু যেন চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাই। আমি বাক্যগুলোকে আগে দেখি। তারপর যেন শুনতে পাই। আমি কখনো কখনো আবৃত্তি করে পড়ি।
ফিলিপ: সবকিছুই কি আবৃত্তি করে পড়েন?
মুলার: সবকিছুই। যদি শব্দগুলো সঠিকভাবে কানে আওয়াজ না তুলতে পারে, তাহলে বাক্যটিকে আমার অসমাপ্ত মনে হয়। মনে হয় কিছু না কিছু গোলমাল হয়েছে। যখন সবকিছু একটা ছন্দে বাজতে থাকে তখন মনে হয় সঠিক হয়েছে। আর একটা পাগলামি এই যে বাক্যগুলো যত পরাবাস্তব চিত্রকল্প তৈরি করে, ততই যেন বাস্তবতার দিকে ধাবিত হয়। না হলে যেন মনে হয় কাজ করছে না। অনেকের হয়তো এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। কিন্তু পরাবাস্তব বিষয়গুলোকে বাস্তবার সঙ্গে মিলিমিটার পরিমাণে হলেও মিলিয়ে নিতে না পারলে তা আবার পুরোপুরি খাপছাড়া হয়ে যাবে। পরাবাস্তব তবেই আবেদন রাখবে, যখন তা বাস্তবে রূপ নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করবে। অর্থাৎ এটা বাস্তব নয় পুরোপুরি অথচ বাস্তবতাকেই প্রকাশ করতে পারে, এমন করেই তৈরি করতে হবে।
ফিলিপ: আপনি লেখায় খুব বেশি সংশোধন করেন?
মুলার: ভাষা জানে কিভাবে কোন জায়গায় তাকে সম্পূর্ণ প্রকাশ করতে হবে। আমি নির্ধারণ করে নেই যে, আসলে আমি কী চাই। তারপর সে অনুযায়ী ভাষা তৈরি হয়ে যায়। তবে ভাষাকে সংহতভাবেই প্রকাশ করতে হয়। আমি খুব ধীরে গতিতেই সেটা করি। যেকোনো লেখার ক্ষেত্রে দীর্ঘসময় নিয়ে থাকি। আমি একটি বই বলা যায় বিশবার কিংবা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে সংশোধন করি। প্রথমে আমি প্রয়োজনীয় তথ্য জোগাড় করে সকল ভাবনা দিয়ে লিখতে শুরু করি। পরবর্তী সময়ে আবার সেখান থেকে কিছু অংশ রেখে দেই, কিছু অংশ বাদ দিয়ে দেই। এভাবেই ক্রমাগত পরিবর্তন পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে প্রস্তুত করি। দেখো আমাদের ভাষা আমাদের জীবন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমিই বা কে সেটাকে ঠিক করার কিংবা সংহত করে প্রকাশ করার? সত্যি কথা বলতে কি কোনো কিছুকে বিকল্পভাবে প্রকাশ করার কোনো উপায়ই নেই। তারপরও আমি ভাষার মাধ্যমে একটা ভিন্ন কিছু তৈরি করার চেষ্টা করেছি। যদি আমি ভাগ্যবান হই, তাহলে এই ভাষা একটি নতুন বাস্তবতা তৈরি করবে। তবু আমি বলব এটা একটা কৃত্রিম প্রক্রিয়া।
ফিলিপ: লিওর খ্রিস্টমাস গাছ কিংবা স্টকহোমে আপনি যা বলেছিলেন যে, লেখালেখি আসলে বিশ্বাসের কোনো বিষয় নয় বরঞ্চ এটা বঞ্চনা করতে পারার সততা যেজন্য জন্য প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়।
মুলার: অবশ্যই এটা তোমাকে নিপীড়ন করতে পারে। যখন মানুষ ভাষার সৌন্দর্যের কথা বলে, সেটা কোথা থেকে আসে? আর এ সত্যটাই ভাষা আমার ভেতর তৈরি করে। আর এ কারণেই আমি লিখি। কিন্তু তা আবার কখনো কখনো আঘাত দেয়। তাই আমি কখনো কখনো লিখতে ভয় পাই। বিস্ময়ের ব্যপার যে আমিই লেখালেখির কাজে নিয়োজিত হয়েছি। ভাষা তৈরি করার দায়িত্ব নিয়েছি। তবে এটা ঠিক তুমি পূর্বে যা বলেছ, লেখালিখের অর্ধেকটাই হলো নীরবতা। যা বলতে চাইছি দেখা যায় তা আর পুরোপুরি বলা হলো না। তা যেন চোখের সামনে ভাসছে অথচ তুমি ভাষায় সেটাকে আবদ্ধ করতে পারছ না। তুমি নিস্তব্ধ হয়ে শুধু অনুভব করছ।
কিছু কিছু নীরবতা ব্যক্তিকে ঠিকই প্রকাশ করে
ফিলিপ: আর এই নীরবতা শুধু শব্দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বাক্যের মধ্যেও। ‘দ্য ল্যান্ড অব গ্রিন পামস’ বইয়ে আপনি লিখেছেন- ‘কোনো কিছুকে ভাষায় প্রকাশ করা আমাদের ততটাই ক্ষতি করে, যতটা ক্ষতি পা দিয়ে মাড়ালে সবুজ ঘাসের হয়ে থাকে। নীরবতাও ঠিক একই কাজ করে।’
মুলার: নীরবতাও একপ্রকার ভাষা। একই রকম। এটাও ভাষার একটি মৌলিক উপাদান। আমরা সবসময়ই নির্ধারণ করে থাকি কী বলব আর কী বলব না। তাহলে কেন একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির কথা বলব? এটা একটি সহজাত প্রবণতা। আর এই নীরবতার মানেও এই নয় যেকোনো কিছুকে লুকিয়ে রাখছি আর কোনোকিছুকে ভাষা দিয়ে প্রকাশ করছি। এটা পুরোপুরি ব্যক্তিনির্ভর। সবাই তো আর একইভাবে বর্ণনা করবে না। একেকজনের দৃষ্টিকোণ একেকরকম। এমনও দেখা যাবে দুজন ব্যাক্তির একইরকম দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু প্রকাশের দিক থেকে আবার দুজনই আলাদা। কেউ পুরো বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করছে আবার কেউ করছে না। আমি পনের বছর বয়সে যখন প্রথম শহরে গিয়েছি সেখানকার মানুষদের দেখে বিস্মিত হয়েছি। বেশিরভাগ লোকজনই প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে। আর মানুষজন যেভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে তা আমার কাছে দানবীয় মনে হয়েছ। তখন থেকেই আমি লক্ষ করেছি নীরবতাও হলো যোগাযোগের আরেকটি মাধ্যম। তুমি তাকিয়েই অনেক কিছু বলে দিচ্ছ। বাড়িতে আমরা পরিবারের সবাইকেই খুব ভালো জানি এবং সবসময় দেখা যায়, কেউ কারও সঙ্গে ততটা কথাও পর্যন্ত বলি না। আমি সেখানে অনেক নীরবতা লক্ষ করি। কিছু কিছু নীরবতা ব্যক্তিকে ঠিকই প্রকাশ করে।
ফিলিপ: আপনি কি গ্রামের বাড়ির কথা বলছেন?
মুলার: আমি মূলত সেই সময়ের কথা বলতে চাইছি, যখন সমাজতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র ছিল। সে সময়ে তুমি চাইলে, যা খুশি তা বলতে পারবে না। তখন নীরবতা খুব জরুরি ছিল। তোমাকে সবসময়ই হিসাব কষে নির্ধারণ করতে হবে, কতুটুকু বলতে হবে। একদিকে তুমি বেশি কিছু বলতে চাও না, আবার তাদের এটা ভাবার সুযোগ দিচ্ছ না, তারা যেন বুঝতে পারে তুমি বেশি কিছু জানো। আবার অন্য দিকে তোমাকে কিছু না কিছু বলা দরকার করে হলেও যেন তারা ঘুরে ফিরে তোমাকে একই প্রশ্ন করে। প্রতিটি পক্ষই অপেক্ষা করে অন্য পক্ষ কী বলতে চায় এবং ধরতে চায় এমন কী লুকাচ্ছে।
ফিলিপ: ‘দ্য অ্যাপোয়েন্টমেন্ট’ বইটির মূল চরিত্রের অভিজ্ঞতায় যা দেখতে পেয়েছি। কিন্তু যারা জিজ্ঞাসাবাদ করেন তারা কি তাদের ভুক্তভোগীদের পর্যবেক্ষণ করে কিছু আঁচ করতে পারেন?
মুলার: আমি জানি না আপনি এরকম কাউকে দেখেছেন কি না। আপনি হয়ত ভাবতে পারেন কিংবা নাও ভাবতে পারেন। কিন্তু সেই লোকগুলো কিন্তু পেশাজীবী। তারা মনস্তত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেছে। আমার একজন বন্ধু আছে যাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল এবং প্রতিক্ষেত্রেই নতুনভাবে। প্রতিটি ব্যক্তিই তাকে নানাভাবে নির্যাতন করেছে। তারা ভালো করেই জানে একজন মানুষকে কিভাবে হতাশ-ভীত করে তোলা যায়। আমি সরাসরি যদিও তাদের কোনো পদ্ধতি দেখিনি। প্রতিবার তারা অতর্কিতভাবে বাড়িতে চলে আসত কোনো পূর্বাভাস পর্যন্ত পাওয়া যেত না। আমার সমস্ত ঘর নজরদারি করে রাখা হতো। গোপনে মাইক্রোফোন লাগিয়ে আমার কথাবার্তা পর্যবেক্ষণ করা হতো। আমি জানতেও পারিনি। পরে জানতে পারলাম তারা আমার ব্যক্তিগত জীবনের সবকিছুই নজরদারিতে রেখেছে। তারা আমাকে নিয়ে ভীষণ আগ্রহী ছিল। আমি ভাবতেও পারিনি কেনই বা তারা আমাকে এতটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবছে। পাশাপাশি এটাও ভেবেছিলাম যে, রোমানিয়ানরা এতটাই গরিব যে নজরদারি করার মতো যন্ত্রপাতি তারা ক্রয় করতে পারবে না। মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খাবারের জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি কিন্তু মাইক্রোফোন কিনতে কাউকে দেখিনি।
ফিলিপ: আপনার কিছু চরিত্রের মধ্যে অন্যরকম নীরবতা প্রকাশ পেয়েছে। যেমন ‘দ্য হাঙ্গার এনজেল’-এ কাটি সেন্ট্রি’র একধরনের মানসিক অক্ষমতা ছিল এবং খুব কম কথা বলতে পারতো।
মুলার: কিন্তু সে অন্যদের চেয়ে গভীর কিছু বলত। আমি সবসময়ই ক্ষুদে সংলাপ পছন্দ করি। এবং ব্যাকরণের সংহত ব্যবহার অপছন্দ করি। জার্মান ভাষায় ব্যাকরণের গঠনরীতি অনেকটা জটিল। এগুলো অনেকটা ভাষার প্রকাশভঙ্গিতে বাধা সৃষ্টি করে। এগুলো গ্রাম্য ভাষারই একটা বর্ধিত গঠন।
ফিলিপ: ল্যাকোনিক?
মুলার: সবসময় মূল কথাটা প্রকাশ করা। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কিছু না বলা। এটা অবশ্য আমার পারিবারিক আবহ থেকেই তৈরি হয়েছে। মানুষ কোন কথা না বলে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয় অবশেষে যখন কিছু বলার প্রয়োজন হত জরুরি সেইটুকুই প্রকাশ করতো। বাস্তবিকভাবেই তাই প্রয়োজন ছিল। সেখানে কথা বাড়িয়ে সময় অপচয় করার সময় ছিল না। কখনো কখনো দেরি হয়ে যেত, তখন কিছু বলার প্রয়োজন হতো না। কেননা যা বলার দরকার ছিলো তা বহু আগেই বলা হয়েছিল।
ফিলিপ: এবং এখনো যদি খুব দেরি হয়ে যায়-
মুলার: তাহলে প্রয়োজনের গুরুত্বটাই বেশি প্রাধান্য পাবে।
ফিলিপ: আপনি খুব কম যতিচিহ্ন ব্যাবহার করেন। যেমন প্রশ্নবোধক চিহ্ন খুব কম দেখা যায়।
মুলার: যেখানে প্রশ্ন বোধক চিহ্নের প্রয়োজন নেই সেখানে করিনি।
ফিলিপ: কখনো কখনো এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, আমরা নিজেরাও নিশ্চিত হতে পারি না যা বলতে চাইছি, তা জোড় দিয়ে উচ্চারণ করব না কি স্বাভাবিকভাবেই বলব। এটা কি দুশ্চিন্তা তৈর করে না?
মুলার: পারিবারিক আবহ থেকেই বলা যায়, ভাষা প্রকাশের বিষয়টি পেয়ছি। আমরা সবাই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতাম। পরবর্তী সময়ে যখন শহরে গিয়ে স্কুলে ভর্তি হই, তখন বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা স্কুল বন্ধুদের কাছ থেকে বিভিন্ন রকম আঞ্চলিক ভাষা শেখার সুযোগ হয়েছে। তবে এটা ঠিক আমাদের লিখিত জার্মান ভাষা শিখার একটা আগ্রহ ছিল। সেখানে অনেক লেখক ছিলেন। আবার রোমানিয়াতে জার্মান ছিল একপ্রকার নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ভাষা। আর একারনেই সঠিকভাবে শেখার আগ্রহ ছিল প্রবল। আমাদের ভেতর একটি দল তৈরি হয়েছে ধীরে ধীরে। আমরা সবাই তখন লিখিত জার্মান ভাষা কথা বলতাম। আমাদের আঞ্চলিক সাহিত্যগুলো ছিল আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত এবং অনেক প্রতিক্রিয়াশীল। অস্ট্রিয়াতে কিছু কিছু লেখক সমসাময়িক ধারণা নিয়ে নতুনভাবে আঞ্চলিক ভাষার মাধ্যমে সাহিত্য রচনা করার চেষ্টা করেছেন। আমার কাছে বিষয়টি তেমন ভাল লাগেনি। ‘নাদিরস’-এ আমি এ বিষয়ে লিখেছি। স্বদেশপ্রেমের সঙ্গে একটা জাতিগত মনোভব তাদের মধ্যে লালিত হয়। আমাদের বন্ধু চক্রের কেউ এরকম মনোভব প্রকাশ করুক আমি সেটা চাইনি। জাতিগত মনোভব সবসময়ই একটা রক্ষণশীল বোঝা বইতে সহযোগিতা করে। কিন্তু আমাদের দলের সদস্যরা নানারকম বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিল। কেননা আমরা অনেকেই তখন কিছু জানতাম না। পরবর্তী সময়ে আমরা লিখেছি আমরা কী করতে পারি। এটা অন্যদের সহযোগিতা করেছে। আমরা এগুলো নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবিনি। আর এ কারণেই আমি মনে করি বৃহৎ ঐতিহ্য থেকে আসলেই মানুষ স্বাধীনচেতা হতে পারে না। আমাদের অনেকের অনেক কিছু থাকে আমরা ছুড়ে ফেলে দেই নতুন কিছুর জন্য। অথচ আমার শুরু করার মতোই কিছু ছিল না আর ছুড়ে ফেলবই বা কী।
জানতাম না সাহিত্য আসলে কী
ফিলিপ: আপনার বাড়িতে বই ছিল?
মুলার: একটা রূপকথার গল্পের বইও ছিল না। যা আজকাল যে কারও বাড়িতে থাকা স্বাভাবিক ছিল। স্কুল থেকে পুরস্কার হিসেবে সর্বপ্রথম বই পেয়েছিলাম। তখন সমাজতান্ত্রিক সমাজ ছিল। ফলে পড়ে খুব একটা আনন্দ পাইনি। তবে এটা ভালোই হয়েছে আমি মনে করি। লোকজন জিজ্ঞেস করে আমার বাড়িতে কী কী বই ছিল, আমার কাছে প্রশ্নটি অদ্ভুত লাগে। মানে ব্যাপারটা এরকম হয়ে দাঁড়ালো যে, লাইব্রেরিতে না গেলে কিংবা তোমার পরিবারের কেউ উচ্চ শিক্ষিত না হলে তুমি লেখক হতে পারবে না। সত্যি কথা বলতে কি একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর থেকে আমরা নিজেরাই নিজেদের লালন পালন করেছি। এটা মনে করার কিছু নেই যে বাবা-মা একটি চমৎকার সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে দিলেই সন্তানরা এর সুবিধে নিতে পারবে। কখনো কখনো এর বিপরীত হয়। আমি অনেক উচ্চ শিক্ষিত পরিবারের সন্তানদের দেখেছি তারা কোনো রকম বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনচর্চা করতে পারেনি। কোনো কোনো বাবা-মা সন্তানদের এতটাই সাহিত্য পাঠ করানোর চেষ্টা করেছেন যে, সন্তানদের বইয়ের প্রতি আগ্রহ নষ্ট হয়ে গেছে। আমি এরকম কোনো পরিবেশ পাইনি কিন্তু জানার জন্য তৃষ্ণার্ত ছিলাম। একভাবে আমি এটা উপলব্ধি করতে পেরেছি যে সাহিত্য হলো আমার শিশুকালের সেই জগত যেটা দিয়ে আমি যেকোনো কিছুর সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করতে পারতাম। আমি তখন সেটা হয়ত বুঝতে পারতাম না। এটাও জানতাম না যে সাহিত্য আসলে কী। অথচ আমার সমস্ত সত্তাই সেখানে নিবিষ্ট হয়েছিলো।
ফিলিপ: কেননা আপনার অন্য কিছু ছিল না।
মুলার: আমার একপ্রকার অভ্যন্তরীণ তৃষ্ণা ছিল। আর সে কারণেই একটা নিরাপত্তার চেতনা আমাকে সেদিকে ধাবিত করেছে যেন পৃথিবীর মাঝে আমি আমার নিজেকে খুঁজে পেতে পারি। আমার সাহিত্যের ভেতর দিয়ে আমি শুধু আমাকে জানি, আমাকে চিনি, আমাকে বুঝতে পারি। যদি আর কেউ আমাকে জানতে পারত তাহলে নিঃসন্দেহে পাগল বলতো। এটা আমার এক প্রকার রহস্য। এ ব্যপারে আমি কাউকে কিছু বলতে চাই না। আমি সবকিছু আমার মতো করে ভাবি, সেগুলো কাগজে ছাপা হয় আর সেটাই সাহিত্যে রূপ লাভ করে। কিন্তু এ সবকিছু আমি আমার নিজের জন্য তৈরি করেছিলাম।
ফিলিপ: আপনাদের জার্মানভাষী লেখক দলের সবাই কি এরকম?
মুলার: তারা সবাই কৃষক পরিবারের সন্তান ছিল। আমরা সবসময়ই আমাদের শুরুটা নিয়ে আলোচনা করতাম। আমার ধারণা আমরা রীতিবিরুদ্ধ এবং আধুনিক সাহিত্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। পরে যখন অনেকটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল আমি উপলব্ধি করেছি আঞ্চলিক ভাষারও একটা ভাল দিক আছে। আমি এ নিয়ে কাজ করেছি। বিশেষ করে বিভিন্ন শব্দ নিয়ে যেগুলো উচ্চারণে অদ্ভূত শোনাতো। যেমন ‘গাধা’ যেটা বললে কাউকে অপমান করা হতো কিন্তু তার ভেতর একটা স্নেহ ছিল।
ফিলিপ: আপনি কি এখনো আঞ্চলিক ভাষায় কারও সঙ্গে কথা বলেন?
মুলার: মা’র সঙ্গে বলি। কখনো কখনো গ্রামের মানুষদের সঙ্গে। আমি আসলে গ্রামের মানুষের কাছে অতটা জনপ্রিয় না। বিশেষ করে নাদির’স লেখার ফলে তারা কেউ আমাকে পছন্দ করে না, এমনকি গ্রামেও যেতে দেয় না। আমার মা এবং দাদাকে নানাভাবে অপমান করেছে। আমাকে আমার নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত করেছে। তাদের দৃষ্টিতে আমি হচ্ছি শয়তান। রোমানিয়া এবং জার্মানেদের প্রতিক্রিয়া থেকে যেটা বোঝা যায় সেটা হলো আমি তাদের কেউ না। আমি হলাম একটি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী। সংখ্যালঘুরাও আমাকে শাসায়, সরকারও আমাকে শাসায়। তাহলে আমি কোথায় যাব? আমার বড়জোর ছয় সাতজন পরিচিত লোকের একটা যোগাযোগ আছে। মানুষ যখন নিজ পরিচয় নিয়ে কথা বলে, আমি বুঝতে পারি না এই ‘পরিচয়’ শব্দটা আসলে কী গুরুত্ব রাখে। আমি জানতাম না আমি কে কিংবা কিভাবে আমি পৃথিবীতে বাঁচতে চেয়েছিলাম। আমি শুধু এইটুকু জানি আমি কী চাইনি। আমি কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল কিংবা সংখ্যালঘুদের একজন হতে চাইনি। আমি যা হতে চাইনি আমার অস্তিত্বের ক্ষত জুড়ে শুধু তাই জড়িয়ে আছে।
ফিলিপ: এখনো?
মুলার: লোকজন ভাবে তোমার জানা উচিত ‘তুমি আসলে কী অথবা কী চাও’। আমার কাছে এটাকে অদ্ভুত লাগে। যেন বাইরে থেকে নানা ভাবনা জুড়ে দিয়ে তোমাকে প্রকাশ করা হয়েছে। আর আমাকে সেরকমই হতে হবে। কিন্তু আমার পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। কেননা এটা করার জন্য তোমাকে সে বিষয়গুলোর ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে, তারা যেগুলোকে বিশ্বাস করে। আমি এরকম কথাবার্তাও আর শুনতে আগ্রহ বোধ করছি না।
ফিলিপ: আপনি শহরে চলে এসেছেন। নিজের একটি ভাষা, সংস্কৃতি, জনগোষ্ঠী ছেড়ে নানা ভাষার মাঝে শহরে চলে আসা এটা কী কারণে? এবং ভাষা কিংবা সংস্কৃতি পার্থক্য থাকলেও সবকিছু কিন্তু রোমানিয়ান ছিল?
মুলার: আমরা স্কুলে কিছুটা রোমানিয়া শিখেছি। কেননা এটা রাষ্ট্রীয় ভাষা। তবে আমরা প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিন ঘন্টার বেশি সময় পেতাম না। সব শিক্ষকরা জার্মান ছিলেন তারাও বেশি ভালো রোমানিয়া বলতে পারতেন না। যখনি আমি শহরে চলে আসি তখন রোমানিয়া ভাষা শিখার জন্য খুব চেষ্টা করেছি। কেননা এটা আমার নিরাপত্তার বিষয়। সারা বছর ধরে আমি রোমানিয়া শুনতাম। রোমানিয়া ভাষার উচ্চারণগুলো আমার ভালো লাগত। বিশেষ করে রোমানিয়ান ভাষার প্রবাদ বাক্যগুলো আমার খুব ভালো লাগতো। তবে রোমানিয়া ভাষার একটা মজার দিক হলো অমার্জিত না হয়েও গ্রাম্যতা ইঙ্গিত করতে সক্ষম হতো। যেটা জার্মান ভাষায় দেখা যায় না। যেখানে ভাষাকে খুব নোংরাভাবে প্রকাশ করা যায়। কিন্তু রোমানিয়া ভাষায় এটা অনেকটা ভিন্ন। অভিশাপও যেন একটি জাদু। আমি যদিও অতটা শৃংখলভাবে রোমানিয়া শিখতে পারিনি। প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় কাজের মধ্য দিয়ে শিখেছি। তারপর আমি এই দুটো ভাষার পার্থক্য বুঝার চেষ্টা করেছি। যেমন আমরা বলি ‘মাইগলোকচিন’ কিন্তু রোমানিয়া ভাষায় বলে ‘মিছিলাকরিমি’। এবং প্রতিটি বিশেষ্যর একটি আলাদা লিঙ্গ থাকে। জার্মান ভাষায় সূর্য হচ্ছে স্ত্রী লিঙ্গের প্রতীক আর চন্দ্র হচ্ছে পুংলিঙ্গের প্রতীক। কিন্তু রোমানিয়ায় আবার সেটা অন্যরকম। আর এটাই সবকিছু পরিবর্তন করে দেয়। কুসংস্কারগুলোও আলাদা। রূপকথার গল্পগুলোও আলাদা। আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করি, কিভাবে প্রতিটি ভাষার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। এবং এটা আমাকে অনেক মুগ্ধ করে। আমি যতই এই বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করি ততই রোমানিয়া শিখতে আগ্রহী হই।
ফিলিপ: তাহলে কি এটা বলা যায় রোমানিয়ান দৃষ্টি ভঙ্গিটিকেই আপনি জার্মান ভাষায় প্রকাশ করেন?
মুলার: সবসময়ই। কেননা আমি তো বেড়েই উঠেছি রোমানিয়ায়। যখন আমি লিখি তখন লেখার দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা চিত্রকল্প কিভাবে তৈরি হয়, এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেই না বা খেয়াল করি না বলা যায়। কখনো রোমানিয়ান হতে পারে কখনো জার্মানও হতে পারে। কিংবা দুটোর সমন্বয়ও হতে পারে। আমি রোমানিয়া ভাষায় লিখতে চাই না কেননা আমি খুব বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি।
ফিলিপ: সব চিন্তাকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না এবং সেটা সম্ভবও না- আপনি লিখেছিলেন।
মুলার: এমন হাজারো চিন্তা আছে শব্দবিহীন। ভাষা আমাদের সত্ত্বার খুব গভীরে পৌঁছাতে সক্ষম নয়। তবে এটাও ঠিক রোমানিয়া ছাড়া অন্য কোথাও যদি চৌত্রিশ বছর কাটাতাম হয়ত সবকিছু এরকম নাও হতে পারত। কত শত সংস্কৃতি এবং সবগুলোই ভিন্ন ভিন্ন। আর ভাষাও একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতির প্রতিফলনকে প্রকাশ করে।
রোমানিয়ানরা খুব দ্রুতই অভিনয় করতে পারে
ফিলিপ: ভালো এবং মন্দ দুভাবেই প্রকাশ করে।
মুলার: একদিকে রোমানিয়ানদের একটা অন্যরকম প্রকাশভঙ্গি আছে আর এগুলোই একনায়কতন্ত্রকে আরো ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। কেননা তাদের আগে থেকেই এরকম একটি পরিস্থিতি তৈরি করার পূর্বাভাস ছিল। রোমানিয়ানদের একটি প্রবাদ আছে ‘চুপচাপ থাক’। রোমানিয়ানরা এই কথাটা বলে থাকে এই কারণে তারা নিজেদের সে রকমই মনে করে- খুব ধৈর্য্যশীল, সহজে দুর্নীতিগ্রস্ত। পশ্চিমা ইউরোপীয় দেশগুলো আবার একটু আলাদা। যুগোস্লাভিয়া, পোল্যান্ড এবং রাশিয়া। ইউরোপীয় এই দেশগুলো আবার ভিন্ন মতাবলম্বী। সেখানকার প্রতিবাদ গুলো অনেক সংহত এবং অনেক প্রকাশনী রয়েছে যারা প্রতিবাদী লেখাগুলো প্রকাশ করে থাকে। রোমানায়ীরা হয়ত বলবে তারা এগুলো করতে পারে না। তাদের দেশ ছোট খুব সহজে ভালো করে পর্যবেক্ষন করা হয়। আমি বিস্মিত হই যে, রোমানিয়ানদের একটি চমৎকার ভাষা ছিল বটে কিন্তু সেই সঙ্গে চরম সমন্বয়হীনতা যেটাকে তাদের সচেতন প্রবণতা এবং স্বতঃপ্রণোদিত ঢংও বলা যেতে পারে, অবশ্যই পাশবিকতাও। তবে আমি এটাকে চরম সমন্বয়হীনতাই বলব। আর এই সমন্বয়হীনতা তাদের রাজনীতিবিমুখ করেছে যেটা একটা বড় সমস্যা। কেননা মানুষজন কোনো বিষয় নিয়ে আগ্রহী না হলে সেই বিষয়কে গুরুত্ব দেয় না। রোমানিয়ানরা খুব দ্রুতই অভিনয় করতে পারে, খুব কম সিদ্ধান্ত নিয়ে যেকোনো কিছু করতে পারে এবং অন্যের প্রতি কখনো এতটাই পাশবিক হয়ে উঠে যেন নিজেকে বিপদে পড়তে না হয়।
ফিলিপ: ক্ষমতার পরিবর্তনের ফলে যুদ্ধ-পরবর্তী রোমানীয় ইতিহাসে এ বিষয়টি দেখা গিয়েছে।
মুলার: এ রকম একটা বিপর্যস্ত সময় অতিবাহিত করার পরও তুমি দেখবে না কোনো রোমানীয় সেটাকে বিপর্যয় বলে স্বীকার করে নিয়েছে। তারা বলবে তারা একটি সময়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং কিছু দায়িত্বপালন করেছে। তারা ফ্যাসিবাদকে সমর্থন দিয়ে হিটলারের সঙ্গে মিলে যুদ্ধ করেছে। তৎকালীন রোমানিয়ার প্রধানমন্ত্রী আয়ন ভিক্টর এন্টনস্কিউ নাৎসিদের মতো শাসন করেছিলেন। রোমানীয় কর্মী এবং প্রশাসনের অধীন ইহুদিদের বন্দিশিবিরে আটকে রেখেছিলেন এবং হত্যা করেছেন। তারপর শুরু হলো সমাজতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র। কেউই কোনো দায়ভার স্বীকার করে নিলেন না। এখন পর্যন্ত কোনো পুনর্মূল্যায়ন হয়নি। আমরা এখনো জানি না ১৯৮৯ সালে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করার জন্য কে দায়ী ছিল। বন্দিশিবিরে কতজন মানুষ ছিল তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
ফিলিপ: এবং সাহিত্যে?
মুলার: কিছু কাজ হয়েছে; তবে বিস্তৃতভাবে সেই ইতিহাস নিয়ে কাজ হয়নি। এ জন্য নানারকম অনুসন্ধানের প্রয়োজন। তুমি তথ্য সংগ্রহের জন্য যেখানেই যাবে না কেন সেই সময়কার কিছু লোক তোমাকে তা ঠিক মত করতে দেবে না। তাদের সংখ্যাটাও কিন্তু কম নয়। তারা অভ্যন্তরে নিজেদের ভালো করে চিনে-জানে। একজন আরেকজনকে রক্ষা করবে। এবং আরেকবার লোকজন হাস্যকরভাবে মাথা নাড়িয়ে প্রশ্ন করবে, এরকম কিছু কি সত্যি ঘটেছিল?’ কেউ একনায়কতন্ত্র নিয়ে মুখ খুলতে চায় না। পূর্বে হয়ত এটা সম্ভব ছিল না, ফ্যাসিবাদের পর পর স্ট্যালিন ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু এখন তো চাইলে লোকজন এসব নিয়ে পর্যালোচনা অন্তত করতে পারে। কিন্তু কারও তেমন কোনো আগ্রহ নেই।
ফিলিপ: কেউই ইতিহাসের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে চায়নি।
মুলার: আর এ কারণেই এগুলো ঘুরপাক খেয়েছে তাদের মধ্যে। উদারণ স্বরূপ বর্তমান রোমানিয়াতে ইহুদি-বিদ্বেষ মতবাদ অনেক শক্তিশালী। অবিশ্বাস্যভাবে তাদের জাতীয়তাবাদ অনেক বেশি উগ্র। কেননা কেউই এ বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলতে আগ্রহী নয়। রোমানিয়ার ভয়ঙ্কর এই জাতীয়তাবাদের রূপ হলো তাদের ধর্মীয় পোশাকধারী অন্ধ স্বদেশপ্রেম। এন্টনস্কিউ’র সময়ে তৎকালীন গির্জা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, আজও ঠিক সেটিই হচ্ছে।
ফিলিপ: কয়েকবছর আগে একটি সন্মেলনে আপনি বলেছিলেন, ‘সাহিত্য কি সত্যি সত্যি সময়ের সাক্ষ্য দেয়? আপনি আরও বলেছিলেন আপনার বইগুলো এক প্রকার সময়কে সাক্ষ্য দেয়। আপনি কি মনে করেন না আপনি নিজে সাক্ষী হিসেবে সেই বইগুলো লিখছেন?’
মুলার: আমি কর্মজীবনে প্রবেশ করেছি। সাহিত্য দিয়ে কিছু করব এ রকম ঘোষণা কখনো দেইনি।
ফিলিপ: যখন আপনি কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের জ্বালাতনের স্বীকার হয়েছিলেন-
মুলার: কর্মক্ষেত্রে এসেই আমি লেখালেখি শুরু করি। বলা যায় নিজের আত্মবিশ্বাসের একটি পথ হিসেবেই লিখতে শুরু করেছি। বাবা মারা গিয়েছিল। আমি জানি না কখন কী করব, সামনের দিনগুলো কেমন যাবে। গ্রামেও ফিরে যেতে চাইনি; কেননা সেখানে ফিরে যাওয়ার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। সেখানে সরকারি গুপ্তচর আমাকে প্রতিনিয়ত নির্যাতন চালাতো। এটা একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি ছিল। তারা আমাকে অফিস থেকে বের করে দিয়েছিল, আমি তখনো কাজ করছিলাম। কেননা তারা যেন আমাকে বরখাস্ত করার কোনো সুযোগ না পায়। তখনই লেখালেখি শুরু করেছি। আর হঠাৎ করেই আমার গ্রাম্য জীবনের ঘটনাগুলো প্রতিফলিত হতে থাকলো। আমি সাহিত্য রচনা করার কোনো চেষ্টাই করিনি। বরং জীবনকে আঁকড়ে ধরে থাকতে এবং পায়ের নিচে একটি আশ্রয় খুঁজে পাওয়ার জন্যই লেখালেখিতে হাত দিয়েছিলাম।