কবিতা নিয়ে নিরীক্ষা কবিদের জাতধর্ম। যারা নিরীক্ষণ করছেন তাদের লক্ষ্য যে কবিতার বিবর্তন এবং উত্তরণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উত্তরাধুনিক কবিতা আন্দোলন কতটুকু সফল হচ্ছে সে বিচারের দায়িত্ব বিবেকবান পাঠক সমাজের। তবে উত্তরাধুনিক কবিতা নির্মাণকারীরা যে সাহিত্যের একটি মূলধারার সন্ধানে সর্বদা নিমগ্ন তা স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে। একঝাঁক তরুণ কবিতাকর্মী এখন কাজ করছেন কবিতার মাঠে। শুদ্ধাচারী এসব মাঠকর্মীরা কি ফসল ঘরে তুলবেন বা তুলতে পারবেন তা পরখ করে বলার দায়িত্ব নিয়ে এ নিবন্ধের অবতারণা হয়নি। কবিতার বিশাল সমুদ্রে ভাসমান নাবিকদের কিছু কিছু বিচূর্ণ উচ্চারণের সাথে বাংলা লোকসাহিত্যের কিছু মৌলিক ধ্বনির সঙ্গতি এবং প্রভাব খুঁজে দেখার লক্ষ্যেই এই প্রচেষ্টা।
কালের বর্ণনায় একটি বিষয় আজ অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, একজন লোকজ কবি যেমন সহজ সরল ভাষায় তার আকুতি জানাতে পারছেন কিংবা পেরেছেন একজন শহুরে অথচ আধুনিকতার দাবিদার কবি তা পারেননি বা পারছেন না। আর সেজন্যেই ময়মনসিংহ গীতিকা, বৈষ্ণব পদাবলির মতো লোকসাহিত্যের আবেগ সাধারণ পাঠক-পাঠিকার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে অমর ভালবাসার মর্মর গাঁথা হিসেবে।
ঐতিহাসিক উপলব্ধি এবং স্বগত সত্ত্বার বয়ানের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, প্রথমটি পুঁথিপাঠের বিস্মৃত চারণ আর দ্বিতীয়টি অমর আত্মার একান্ত আবদার। সাহিত্যের লোকজ নিসর্গ সেজন্যেই বোধহয় যুগে যুগে নবরূপে বার বার প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে। মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রাবতী, কাজলরেখা, রূপবান কিংবা সোনাভানের পালাগানও যে তৃপ্ত আনন্দ দিতে সক্ষম, অনেক আধুনিকতার জটিলতা যে তার কিঞ্চিৎও পূরণ করতে সক্ষম নয় তা এ সময়ের সাহিত্যসেবীরা ক্রমশই বুঝতে পারছেন।
লোকসাহিত্য ভাণ্ডারের কাছে আধুনিক কবিরা যে কত ঋণী তা তাদের শিল্পকর্মের পঠন-পাঠন থেকে পাঠোদ্ধার সহজেই সম্ভব। আপন দর্পনে আত্মদর্শন একটি কবিমনের অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন। ‘জীবাত্মা’র সাথে ‘পরমাত্মা’র যোগমিলন ঘটাবার বাসনা একজন বাউল কবির গানে যেমন ভাস্বর হয়ে ওঠে একজন আধুনিক কবি ও তার কবিতায় যোগ করেন ভিন্ন মাত্রার অনুষঙ্গ। লালন শাহর প্রাপ্তির উন্মাদনা যেমন প্রবল হয়ে ওঠে- ‘বাড়ির পাশে আরশি নগর সেথা এক পড়শী বসত করে/ আমি একদিনও না দেখিলাম তারে’ ঠিক তেমনি আজকের বাংলাসাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান লেখেন তাঁর আত্মবিশ্লেষণ:
বাইরে আমি ছড়িয়ে পড়ি মাঝে মাঝে কিসের টানে?
আবার আমার ভেতর যাই অনেকদূরে গহনপুরে।
ধ্যানের ছোঁয়ায় একতারাটা হাতে নিয়ে নিজের ভেতর
ঘুরে বেড়াই, গেয়ে বেড়াই ধু ধু মাঠে, নদীর ঘাটে
(স্বপ্ন পুরাণ: শামসুর রাহমান)
রাধা-কৃষ্ণের প্রেম উপাখ্যান আজো সমৃদ্ধ করছে বাঙলা কবিতার কাব্য ভাণ্ডারকে। কালজয়ী এসব কথকতা নতুন বলয় নির্মাণ করে। বিকশিত হয় নির্ঝর ঝরনার মতো।
কেন বা ঢেউয়ের মধ্যে ছল-ছল করে শ্যামনাম,
কলস বুড়াতে গিয়ে চোখ ভরে পানি নিয়ে এসে
উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখি ঘরে ঘরে পড়ে গেছে খিল।
তবে কি অকূলে যাবো? সর্বনাশী যমুনারই কাছে-
খালি ঠিলা দেখে যেথা কৃষ্ণ কৃষ্ণ জপে ওঠে জল?
(কৃষ্ণকীর্তন: আল মাহমুদ)
কবিতার প্রতিপক্ষ কবিতা নিজেই। যুথবদ্ধ বাণীগুলো যা একসময় ‘প্রেমের কবিতা’ নামে হাটবাজারে পয়ার ছন্দে ফেরিঅলার মুখে মুখে গীত হতো, তারই গ্রহণযোগ্যরূপের সংষ্করণ হচ্ছে অনেকগুলো উত্তরাধুনিক কবিতা। আর আশার কথা হচ্ছে এর নান্দনিক সৌন্দর্য পাঠককে নিয়ে যাচ্ছে আবারো স্বরূপ সন্ধানে। মরমী বাউল কবিরা তাদের লেখা কবিতা, গানের প্রথমে বা শেষে ভনিতা দিতেন। সেই প্রবণতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে আজকের উত্তরাধুনিক কবিতায়।
স্বঘোষিত জ্ঞানী থাকে জ্ঞানের প্রবাসে।
জ্ঞানী-বিজ্ঞানীর দম্ভে রহমান হাসে।।
বর্ণনা তামাম, বলি, ভেদকথা খাঁটি।
জগতে ভেদার্থ জানে চল্লিশ প্রজাতি।
(ভেদকথা/ পর্ব: উষ্টুম গান- রহমান হেনরী)
জারি, সারি, মারফতি, মুর্শিদি প্রভৃতি গান লোকসাহিত্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এসব গানের রচয়িতা কবিরা ‘মরমী কবি’ নামে পরিচিত হলেও তারা যে কত জীবন ঘনিষ্ট রচনার স্রষ্টা, তা অন্তত তাদের মৃত্যুর পরও স্বীকার করা হচ্ছে। এসব কবিদের নাম নেই, যশ নেই, খ্যাতি নেই। তা তারা চানও না। তারা চান একান্ত পরমের সান্নিধ্য যা যুগ যুগ ধরে তাদের কাছে আরাধ্য বিষয়। রবীন্দ্রনাথ, ইয়েটস্, শেলী, দান্তে, এলিয়টের মতো অমরতা চাননি তারা। তারা অমরতা খুঁজেছেন চৈতন্যের নিমগ্ন প্রভায়। যে চৈতন্যের দেশে আজ ফিরে যেতে চাইছেন একজন আধুনিক কবি। পর্যবেক্ষণে-প্রকরণে যে রূপান্তরের বুৎপত্তি আজ রচিত হচ্ছে, এর আদিমন্ত্র কিন্তু সেই মৌলিক লোক সাহিত্যেই নিহিত।
আজ এই বিশ্রামের অবকাশে এক ফসল থেকে
আরেক ফসলের দূরত্ব কাটাতে, এসো
আমরা কিছু সহজ আনন্দের গান গেয়ে নিই।
ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাউল, মুর্শিদি নাকি
মাথুর কীর্তন শোনাবে তুমি?
গাজীর গীত? হ্যাঁ তাও গাইতো পারো।
(আমার কলম- নির্মলেন্দু গুণ)
পাশ্চাত্যের আধুনিক কবিরাও কিন্তু বর্তমান সময়ে তাদের হারিয়ে যাওয়া ফোক সঙ্গীতগুলোকে আধুনিক কবিতায় ব্যবহার করতে ব্যস্ত। বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত নিউইয়র্ক শহরের ‘গ্রীনিচ ভিলেজ’ কিংবা ‘সহো’ এলাকায় যে সব তরুণ কবিগোষ্ঠী সাহিত্যচর্চা করছেন তাদের অনেকের মাঝেই সেই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অতীত মূর্ছনাগুলোকে যেন তারা চিত্রায়ণ করতে চান আগামী শতাব্দীর চকচকে আয়নায়।
গান হতে বলি আজ দীর্ঘশ্বাসগুলিকে আমার
সম্পূর্ণ লোকজগীতি, ভাওয়াইয়া কিংবা ভাটিয়ালি
দেশজ, ঐতিহ্যময়, লোকায়ত গীতিকার মতো।
(গান হ’তে বলি- রফিক আজাদ)
বাংলা লোকসাহিত্যের একটি বলিষ্ঠ অংশ জুড়ে আছে আধ্যাত্মিকতাবাদ। পরকাল, মৃত্যুচিন্তা, প্রভৃতি বিষয় অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে প্রভাব ফেলেছে মানবজীবনে। একজন গ্রামীণ লোককবি হাসন রাজা যেমন বলেন, ‘নিদানকালে কি হইবো আমার গো মাবুদ আল্লা, পরকালে কি হইবো আমার’। তেমনি একজন আধুনিক কবিও মৃত্যুচিন্তায় কাতর হয়ে যান। কারণ মৃত্যুই তো মানুষের পরিণত পরিণাম।
যখন তুমি অন্ধকারে হারিয়ে যাবে রাতে-
কেউ কি তখন যাবে তোমার সাথে?
পুত্র-পৌত্র সবাই ভুলবে তোমার কথা
যখন তুমি মাটির নিচে বনানীতে
(যখন তুমি অন্ধকারে- ইকবাল আজিজ)
অভিজ্ঞতার আঙ্গিকে কবিতাকে বিচার করা যায়। অনুভব শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এ বিচার করতে গেলে দেখা যাবে বাংলা কবিতার সিংহভাগ জুড়ে আছে বিরহের আকাশ, বিচ্ছেদের অনল। এই অনলে পুড়ে, এই আকাশে উড়ে অনেকেই পেয়েছেন আত্মার আসল ঠিকানা। আর তা হতে পারে একজন মানুষের শ্রেষ্ঠ অর্জন। কাদামাটির গন্ধ গায়ে মেখে যারা এ বাঁশি বাজিয়েছেন, যারা শ্যামনাম ধরে করেছেন কীর্তন, ভজন-উত্তরসূরীরা আজো অনুসরণ করছেন তাদের পদাংক। আর এ যেন শিল্পের চলমান উত্তরাধিকার। বাঁশি উপাখ্যান প্রখ্যাত মরমী কবি সৈয়দ শাহনূর চিত্রায়ণ করেছেন এভাবে, ‘বাঁশিটি বাজাইয়া কানু থৈল কদম ডালে/ লিলুয়া বাতাসে বাঁশি রাধা রাধা বলে/ তন রাধা, মন কানু শাহনূরে বলে/ রাধা কানুর মিলন হৈব আড়াই হাতের তলে।’
কবিতায় লোকজ ঐতিহ্যের ব্যবহারকে অনেকেই সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না। তারা বলছেন, এতে লোকঐতিহ্য বিনির্মাণের চেয়ে অনুকরণ সদৃশতাই অধিক দৃষ্ট হচ্ছে। এর সহজ উত্তরে বলা যায় আপাতঃদৃষ্টিতে পুরনো উপাখ্যানগুলোকে নবরূপে শুনে এমনটি ধারণা করা হলেও মূলত লোকসাহিত্যের উৎপ্রেক্ষা, অনুপ্রাণই হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের প্রকৃত রসদ। পরমাণু বিজ্ঞানের এই যুগে, একবিংশ শতাব্দীর দোরগোঁড়ায় দাঁড়িয়ে মৌলিক অনুসন্ধিৎসু কবিতাকর্মীরা যে নিশান উড়িয়েছেন তা কিন্তু ক্রমশই আলোকিত হচ্ছে। দেহতত্ত্বের বিশ্লেষণ এখন আর বয়াতির গানেই সীমাবদ্ধ নেই।
‘জীনপুর’ যাবো গুরু পথ বলে দাও
দেহবৃক্ষের পাঁচডালে ঢুকে গ্যাছে কাল
শেকড়ে ক্ষুধার্ত কালো মুষিকের ঠোঁট
আটটি কুঠুরী গুরু ভিজে গ্যালো খোলা অন্ধকারে
দশম দরোজা থেকে এ্যমোনিয়ার গন্ধ ভেসে আসে।
(শুন্যগর্ভ মানুষ- টি.এম. আহমেদ কায়সার)
লক্ষ্যণীয়- আট কুঠুরী, নয় দরোজা, ষড়রিপু, পঞ্চস্তম্ভ প্রভৃতি বাউল ধারায় বর্ণিত দেহরাজ্যের সোপান। যে সত্যকে বিশ্বাস করে ‘আনাল হক্ব’ প্রবক্তা মনসুর হেল্লাজ বজ্রকণ্ঠে বলতে সক্ষম হয়েছিলেন, আমিই প্রধান সত্য। সে সত্যের মঙ্গলপ্রদীপ হাতে আগুয়ান কবিকুল আধুনিকতা পেরিয়ে প্রবেশ করতে চাইছেন উত্তরাধুনিকতার বাসর ঘরে। যদিও কেউ কেউ বলছেন, আমরা এখনো আধুনিকতাই অতিক্রম করছি। সেই বিতর্কে না যাওয়াটাই ভালো। কারণ সৃজনশীলতার স্বপক্ষে মানুষের পর্যবেক্ষণ এবং আবিষ্কার অব্যাহত আছে থাকবে।
আমিই জোশন্ত রুশ্নি অশেষ যৌবন
মড়ার মাথাকে করি পানপাত্র খোল
আরশের ছায়া ধরে লক্ষ্য ভেদে ছুটি
শূণ্যে পূর্ণ এক জীবন নির্ভুল।
(রুশ্নি- কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার)
আধুনিক কবিতায় আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার গণমানুষের সাথে কবিতার দূরত্ব কমিয়ে আনতে যথেষ্ট করেছে। সহজ ভাষায় মানবিক সত্ত্বাকে জাগ্রত করতে, আর্থ সামাজিক দুরাবস্থা, রাজনৈতিক লাম্পট্য প্রভৃতির বিরুদ্ধে গণজাগরণ সৃষ্টি করতে আঞ্চলিক ভাষায় লেখা কবিতা আরো বলিষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে বলে মন্তব্য করছেন কাব্য বিশ্লেষক সমালোচকরা।
আর কোনো ধন চাই না গো মুর্শিদ
মইলে আমায় সঙ্গে নিয়ো
আমার যখন মরণ হবেরে-
গোরের বাঁশ না দিয়োগো
আমার মুর্শিদ চান্দের হাতের লাঠি
আমারও না সঙ্গে দিয়ো
(মুর্শিদা গান- মোহাম্মদ সাদিক)
ইসলাম ধর্মের সুফিবাদ, হিন্দু ধর্মের বৈরাগ্য বরণ দুয়ের মাঝেই যে গভীর যোগসূত্র রয়েছে, তা হচ্ছে ত্যাগের দীক্ষা। ত্যাগেই পরম শান্তি, কথাটি মনে প্রাণে স্বীকার এবং ব্যক্তিগত জীবনে কাজে লাগিয়ে যে মানুষ সৃষ্টিতে নিমগ্ন হয়েছে তার কাছ থেকে মানবের কল্যাণ আশা করা যেতেই পারে। তিরিশ দশকের কবিরা যে আধুনিকতার চিত্রায়ণ শুরু করেছিলেন, পঞ্চাশের দশকে এসে তা পূর্ণতা পেতে থাকে। হিংসাত্মক মনোভাব পরিহার করে হৃদয়ের বিশালতা দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে, জীবদ্দশায় যে জীবনানন্দ দাশ অত্যন্ত নিগৃহীত ছিলেন আজ তার মৃত্যুর দীর্ঘদিন পর তাকে নিয়ে ব্যাপক মাতামাতি হচ্ছে, গবেষণা হচ্ছে তার লেখা নিয়ে।
লোকসাহিত্যের পরিশীলিত উপাদানকে কাজে লাগিয়ে যে কাব্যচর্চা চলছে একে আরো গতিশীল করা যেতে পারে। এজন্য আরো উদ্যম প্রয়োজন। উর্বর মাটি যেমন দিতে পারে উন্নত ফসল, বাংলা লোকসাহিত্য তেমনি শৈল্পিক আলো দিতে সক্ষম তা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। বাঙালি জাতিসত্ত্বার গহীন গহনে যে কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বহমান, এর মৌলাধুনিক সাহিত্য আন্দোলন থেকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। বৈয়াকরণের ছক ডিঙিয়ে যে মানবিক, বৈষয়িক, জাগতিক, শৈল্পিক উচ্চারণ তাই তো এক একটি কবিতার পূর্ণাঙ্গ স্তবক। কারণ চলিষ্ণু জীবনের নিয়ামক শক্তি হিসেবে কবিতার বিকল্প কিছু নেই।