‘আলোর আঘ্রাণ’ কবিতাগ্রন্থটি এহসান হায়দার-এর প্রথম একক প্রকাশনা। প্রায় একই সময়ে তাকে ছোটদের পত্রিকা ‘রূপকথা’-র সম্পাদক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করতে দেখছি। এহসান-এর কবিতার মধ্যে এক ঝলকেই চোখে পড়বে ভাষা ও ভাবের ঝকঝকে আপাত বোধগম্য বিষয় এবং কবিজনোচিত উদার আস্তিক্য। সবচে’ বড় কথা, কেবল স্থাপন নয়, শব্দের বুননও করেছেন তিনি। ক্রমাগত পুড়তে থাকা এই পৃথিবীর প্রতিপক্ষে অত্যন্ত সঙ্গতভাবে ও স্পর্ধার সঙ্গে তিনি যা দাঁড় করাতে চেয়েছেন, তা প্রেম। যেন কলমের তৃণদাঁড়ে একটানে তুলে নেবেন রক্তপাতহীন দিন। তাই কোনো কোনো বিকেলে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে দেখেন, সাহসী কথারা পথ অতিক্রম করে চলে যায়। বলেন—‘তুমি’
বরফ ও পাখির ডানা আবৃত এক অচেনা/ বন দিয়ে ওড়ো। আমি পাহাড়ে উঠি/ ততোটাই সহজ ও চিত্রল—তোমার অনড় চিন্তারা আচ্ছন্ন করে/ সহজাত মন। কাচের গ্রীবার দিকে তাকাই— দেখি একটা আলোর কণা/ দু-টুকরো হয়ে ছুটছে/ তোমার সাম্রাজ্য চারদিক ছড়ানো— রেখা, রং, সূর্যমুখী ও বিহঙ্গ— আর/ দেখো বাড়ী ফেরার আগে নিচু হয়ে পান করছ সময়— যেখানে/ এইমাত্র ফুটেছে একটি চুম্বন ফুল’। ( ‘চুম্বনফুল’ ) এই ফুলেই সাজি ভরে শেষমেশ জেতা বাজি হারার কথা ভাববেন। কেননা, যুদ্ধদীর্ণ সময় ও মার্কিনপ্যাকেটে মোড়া সভ্যতার মেরুবাসী বিভ্রান্ত নাগরিক তিনি, তার দিন যাবে স্মৃতিসমুদ্র হাতড়ে, ধুলো আর মরচেপড়া দিনরাতের তল্লাশ নিতে-নিতে। কিন্তু সে কিছুতেই আর ফেরা যায় না। ফড়িংয়ের অবিশ্বাসী ডানায় তখনই তো মন-খারাপের রঙ লাগে। কারও নীরবতা-পাথর তার ব্যথাবিহঙ্গ হয়ে এলে তিনি দীর্ঘ অভিমানশীত শেষ হওয়ার প্রতীক্ষা করতে থাকেন। তার চোখের নিবিড়ে একে-একে মা, বাবা, পরি-পরিমিত পারিবারিকতা, আবার বুড়ো বট, বালুইয়ের ডানা, কানি বক, বেনাফুল, নলখাগড়া, ঘুঘুর বিষণ্ণ ডাক, ময়না, পাকা ধানের চিড়ের গন্ধ, প্রিয় নদীজল, মাঝিলোক, বাঁশের বেড়ার সবুজ খেত, হেলেঞ্চা, পুঁই পাতা, লাউডগায় লটকে থাকা ঝিঁ ঝিঁ, কুমড়ো, মহুয়া, মৌরি ফুল, ডুমুর ফুল, ভাঁট ফুল, জোনাকির হিরে, আমের মুকুল, কৃষ্ণচূড়া, গোলাপ, চাঁদ, জ্যোৎস্না, গির্জা, কৃষ্ণকীর্তন, শামুক, পায়রা, মাছরাঙা, হরকোচ ধানের ফালি, ঝরনা প্রভৃতি সমন্বিত আভুবন ভুবনময়তা ভেসে উঠতে থাকে।
রূপকথা-রাজ্যের অপ্রতিম চাবির জিম্মাদারিই তাকে আজকেদিনের মনুষ্যধর্ম হিংসে, সন্দেহ, ধর্ষণ ও খুনের উলটো পিঠটায় বাঁচিয়ে রাখে। ‘এই সুনির্মিত বৃক্ষ-অরণ্যে/ মা’র বুকে আমার ঘ্রাণ/ বাবা একটা বটপাতা/ এইরকম দৃশ্যের মধ্যে বেঁচে থাকতে আমার ভালোলাগে।’ ( একাকি প্রবাহ ) বা, ‘সত্যি যদি বাবার চোখে একটা চশমা থাকত/ বাবাকে বলতে হতো না— সবুজ রং কী/ আর মাকেও বলতে পারতাম কীভাবে চমকায়/ বিদীর্ণ আলো;’ ( বাবার চশমা বিষয়ে ) বা, ‘এইরকম ভোরে মা একদিন শিবসার জলে/ নাকের নথ ধুয়েছিলো— যা কেওড়ার ফুল হয়ে/ শহরে শহরে এখন মধু রূপে কিনছে সকলে/ অথচ সবুজ বনে ঘুঘুর ডাক সকলেই শোনে/ কেবল চেনে না ময়না কিংবা পরির মুখ’ (রোদের ভোরে পাকা ধানের গন্ধ ওড়ে ) এমন পঙ্ক্তিতে রয়ে গেছে সেই সনাতন, অবিচ্ছিন্ন প্রাকৃত, গ্রামীণ তন্ত্রীগঠনের ইতিহাস আভাসটি।
জন্মে ইস্তক বহু রূপ-অরূপের খেলা খেলে তাঁর একদিন মনে হয়— ‘তুমি অরূপের ভেতরে কেবলই এক রূপ/ কোনো ভিন্নতা নেই/ সুরে ঝরে পড়ে আকাঙ্ক্ষা—/ যেন হাওয়া আর একটা বেতফল ছুটে আসে/ বহমান নদী।’ (আলোসন্দেহ দিন) ‘বেতফল’ শব্দটি নিঃসন্দেহে জীবনানন্দীয়। তাঁর ‘তুমি’ পরি: বিদায় পরিচিতা, ডানা ছিঁড়ে এখন মানুষ। দিগন্তে এই সংবাদ পৌঁছলে একা রাতে কবি জোনাক জ্বালেন আর ‘তারারা নেমে আসে উঠোনে/ বলে যায় পরি হারাবার দিন…’ (পরিবিষয়ী ) কখনও ‘নগর শুচিসিদ্ধ আর আনুমানিক হারে ছড়ি ঘোরানোর ভঙ্গিতে নেমে/ আসে একটা পরি-পরিডানা শান্ত সবুজ বৃক্ষ। নগরে এখন সন্ধ্যা; নামবে/ রাধার ঢল— আর পরি যাবে মথুরা নগরে।’ (এখন ) বা, ‘চোখ ঠিকরে বের হচ্ছে সবুজ ঘাস/ শরীর জড়িয়ে গেছে পরিভালোবাসা’ ( হাওয়াবাঁশি এবং অন্যান্য ) বা, ‘প্রতিটি প্রহর শেষে গান শোনো,/ দায় নাও প্রহর কাটার/ আর মহুয়া সুরে পরিবিষয়ী/ রং সব লেগে যায় আমার শিরায় শিরায়’ (পরিবিষয়ী/ চার ) বা, ‘পরির পেপুল রঙের চোখ আর বরষা দেখা যাবে’ (পরিবিষয়ী/ পাঁচ ) বা, ‘মা নেই পরির ভুবনে কেবল একরাতের কাঁপন’ ( বালকের সুরে ভাসে মাটির নুন ) উচ্চারণে আদতেই আমাদের জাল ও জঞ্জাল পরিকীর্ণ নগরীর কুকুরে দাঁতের পাল্লা অতিরেক সংযুক্তি আছে।
দিকশূন্য অন্ধকারমদে প্রীত মূল আকণ্ঠ ডুবলে কবির নিঃসহায়তা কোনো বোধিকল্প আলোয়-আলোয় খোঁজে মুক্তির খোঁজ। মায়ের নুনমাখা হাতে কবির ছোটবেলা রোদ মাখে, ভোরের আলোয় গায়ে কাঁটা দেয় বাতাসিয়া লুপ। সদ্য মা’র বিয়োগচৌহদ্দি সামলে ওঠা কবি এহসান-এর ক্ষেত্রে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে নয়, মায়ের পরিবর্তে এসেছে যে পরি, সে মুহূর্ত-সম্বল। দু’-দু’টো ভিন্ন মেয়েলি ঘ্রাণ মিশতে দেখবার সৌভাগ্য তার হয়নি। আগুন জ্বালাতে ও আগুনের মতো জ্বলতে শিখেছেন। কষ্টের জানালা খুলে তারাদের দেশে যেতে কেন যেন তার ইচ্ছে হয় না। তার মনোকন্যাকে ছুঁয়ে অনন্তগ্রাম থেকে বসন্ত আলোর আঘ্রাণ আসছে দেখতে পান, বুভুক্ষু-তৃষ্ণার্তের মতো তিনি আলো খান, পান করেন।
এই বসন্ত অবধারিতই মন-ফোটার বসন্ত, আলোটিও। দুর্লভ সহিষ্ণুতা তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য এবং এই নিরিখে তাঁকে লালন-নজরুলপন্থী বলে মনে হতেই পারে। রাধা, মথুরা, গির্জা, ক্রুশবিদ্ধ যিশু, উলুধ্বনি, শ্মশান, মায়ের নাকের নথ (নোলক) ইত্যাদি ধর্মানুষঙ্গ অনায়াসেই একত্রবদ্ধ হয়ে অলৌকিক নিশানদিহির চেহারা নেয়।
আলোর আঘ্রাণ
এহসান হায়দার
প্রকাশক: প্লাটফর্ম
মূল্য ১২০ টাকা।