নিঃসঙ্গতা-২
(কবি প্রমোদ বসু- কবি কেন হবে মৃত্যুরও স্রষ্টা?)
জুঁইফুল ভোরে চোখ খুলতেই মনে হলো
আজ আমি অন্য কেউ হব।
বেদনা বালিশটি সরিয়ে রেখে
মশারির অ্যাকুরিয়াম থেকে বেরুলাম
উষা-কুরিয়ার আজ কোনো বেদনার খাম
আনবে না
দক্ষিণের বারান্দায় আজ না হয়
একটু গানই হবে
সমুদ্রের নুন ঠোটেঁ পাখিরাও আসুক উড়ে
ছায়ামেঘ-জলবৃন্ত উপুড় বিছিয়ে আর
জলের আড়ত ছেড়ে নদীরাও আসুক তবে
আজ আর আমি নই ‘মধুকূপী ঘাস’
যতটুকু সংগোপন ছিল
তারও বেশি স্বপ্ন বিলাস
আমিও বাসনা করি
বাসনা ইস্কুলে পড়ি-একবেলা দুই বেলা
দিনমান ধরি…
এতসব আয়োজন শেষে
সমস্ত তন্ত্রীতে কেন বেজে ওঠে
নিঃসঙ্গ মন্দিরা?
কে এমন বিপুল বিন্যাসে
ঢেকে দেয় শাদা সকাল?
কে এমন বাজায় পাখোয়াজ, বলে
সকলি শূন্য সখা,
বাতুল বাসনায় কাঁদো
একা একা
একা একা…
মৃত্যু যজ্ঞ
আমার মাথার খুলিটি রোদে পেতে
বসে আছি। উড়ে যাচ্ছে কুয়াশা-মুক্তির ফাঙ্গাস
বাদামের খোসার মতো ভেঙে
মেলে রেখেছি দেহ। মহা সৌরজাগতিক সভায়
উড়ে যাচ্ছে আমার আয়ুর কণা…
আর
যারা বিভঙ্গ মনের রেণু ছড়িয়ে
কেঁদে কেঁদে আকুল
তাদের বুকের পাশে চোখের জল ছুঁয়ে
আঁজলায় তুলে ধরি মুখ
বিষন্ন সূর্যের নিচে এরা জমে যাচ্ছে
সড়কগুলো কালো পিছিল সাপের মতো
আর গাছ গাছালির পাতা
তীব্র তরবারি চকচকে…
মহাকাশ জুড়ে ঝুলে থাকা দড়িতে
দন্ডিত ক’জন
শূন্যতা হে…
উবে যেতে যেতে দেহাতীত বোধের ভেতর
মনে হলো…
একদিন আমিও ছিলাম।
গুটিকয় আমির কথা
সারাদিন গড্ডল জীবন বয়ে যায়
রুটিনওয়ার্ক শেষে মৃত্যুর মতোন
শ্বাসরুদ্ধকর যে ঘুম
রুটিনওয়ার্ক করে হেঁটে আসে সে-ও।
টেবিল ও সেলফের বইগুলো ঘরময় হাঁটে
ত্যক্ততিক্ত ক্লেদে ভ্রূকুটি করি
বুকের ভেতর পোয়াতী স্তনের মতো শাদা ভাষা
মাঝে মাঝে ধুলো ঝাড়ি
একাকীত্ব তবু ঝরে না।
কথারা বারুদফুল
রক্ত ঝরে স্বস্বর কণ্ঠ চিরে।
তবুও ‘নমস্য’ মানি প্রতিদিন ঘুমফোটা
এই আমাকেই।
কী দারুণ বেঁচে আছি!
দিনান্তে নিকেশ করি
মুখোশগুলো খুলে রাখি সিথানে।
পেণ্ডুলাম
আজ সারাদিন রক্তের ক্রমবর্ধিষ্ণু চাপে
মৃত্যুময় উল্লম্ফনে -ঘুমবড়ির প্রলোভনে
ঘড়ির কাঁটার মতো নিঃসঙ্গ চলেছি ।
নিঃসঙ্গ বলি কেন
তুমি চললেই তো আমার গতি…
তবু একথাতো সত্যি যোজন যোজন ঘুরেও
আমরা একই ভূতলে দাঁড়াতে পারি না ।
বহুরৈখিক ভুতল থেকে বাড়িয়ে দেওয়া
তোমার করতলে
আমি এক মোহময় পাখি
পেণ্ডুলাম আমার নাম
আদিগন্ত ব্যাপে তোমাকেই কেন্দ্র করে
ডানে বাঁয়ে ডানে বাঁয়ে
অনিঃশেষ খেলার সরঞ্জাম…
ফসিলকাহিনি
আমাদের মৃত্যু অনেকদিন আগেই ঘটেছিল
এই যে ছবিগুলো-সফেদ ঢেউয়ের ভেতর
পানকৌড়ির মতো তাকিয়ে আছে-ওরা মৃত
বিগত। এমনকী স্মৃতি থেকেও কিছুটা দূরে ।
অতএব তোমার জন্য কোনও ঘড়ি গলে পড়ে না
এবং আমিও তোমার জন্যে শিয়রের পাশবালিশের
মতো ওম ছড়াই না ।কেবল কতিপয় দিন ও রাতের
‘তশ ‘ থেকে খোলস ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে –
এমন এক প্রান্তরে এসে দাঁড়াই যেখানে অন্যকে তো নয়ই
নিজেকেও চেনা যায় না । তবু কী করে যেন আমরা
আমাদের ফসিলগুলো পেয়ে যাই ।
মানুষ মৃত্যুর পরও খুব হাসতে পারে ।আমরাও হাসলাম
এভাবেই গতকাল আজ ও আগামি দিন…
আমাদের ফসিলগুলো খুব যত্ন করে ধুয়ে মুছে নিই আমরা
আমাদের কোনও আকাশ নেই, চাঁদ কিংবা সূর্য ।
কোনও দিগন্ত নেই, এমনকী আলো অন্ধকারও!
তবু হঠাৎই কোনো অনন্তের ভেতর থেকে
বেজে ওঠে আমাদের হারানো মন্দিরা!