সাক্ষাৎকার গ্রহণ: সালমান তারেক শাকিল
পর্ব: এক
ড. কামাল হোসেন—খ্যাতিমান এই আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ বাংলাদেশের রাজনীতিতেও রেখেছেন অমূল্য ভূমিকা। ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার নেতৃত্বে প্রণীত হয়ে হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান।নিজের প্রধান এই দুই কাজের বাইরে মানবাধিকার নিয়েও তিনি সোচ্চার।তাঁর সঙ্গে দুই দুই দফায় কথা হয়। বেইলি রোডে সবুজ আচ্ছাদিত তার নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা বাসভবনের নিচতলায় আর ব্যস্ততম এলাকা মতিঝিলে তাঁর চেম্বারে। দ্বিতীয় দফায় আমার সঙ্গে ছিলেন সাংবাদিক-লেখক ওমর শাহেদ। মূলত তার আগ্রহের কারণেই দ্বিতীয় দফায় ড. কামাল হোসেনের মুখোমুখি হই আমরা।এই আলাপে ওমর শাহেদ ছিলেন বেশি সক্রিয়।
ড. কামাল হোসেন এসব আলাপে তার নিজের নানা অজানা কথা বলেছেন। আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধুর কথা মনে করে। কথা বলেছেন জন্ম, বেড়ে ওঠা, আইন পেশা,বিদেশে আইনি লড়াই, পাকিস্তানের কারাগারের দিনগুলো,আফগানিস্তানে জাতিসংঘের হয়ে প্রতিনিধিত্বকালীন জটিল সময়গুলো। ১৯৬৭-৬৮ পর্যন্ত পার্ট টাইম শিক্ষকতাও করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর লন্ডনের অক্সফোর্ডের অলসোলস কলেজে দুই বছর এবং নাফিল কলেজে ২ বছর শিক্ষকতা করেছেন। ওই সময় থেকেই শিক্ষকতার পাশাপাশি পেশাজীবী হিসেবে উপদেশ দিতে ডাক আসা শুরু হয়। জীবনের নানা সময়ে বহুমাত্রিক পেশায় নিজের সম্পৃক্ততা তৈরি করলেও সব মনযোগ কেড়েছে আইন পেশা-ই।
উচ্ছ্বসিত হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ড. কামাল হোসেন বলেন, আমার প্রায় ৫৫ বছর কম্পলিট হয়ে ৫৬ বছর শুরু হলো প্র্যাকটিসের। দু চারজন যারা আছেন,আমাদের যাদের সৌভাগ্য হয়েছে ৫৫ বছর প্র্যাকটিস করার, আমি এটাই চিন্তা করেছি, যদি পুনঃজন্ম হতো, আমি আবার এই ল পেশাতেই আসতাম। ৭৯ বছরে এসেও সম্পূর্ণ সতেজ তাঁর স্মৃতি। অতীতের ঘটনা,নিজের অভিজ্ঞতা, প্রেম-পরিচয়, বিয়ে নিয়েও নিজের অবস্থান অকপটে জানিয়েছেন। আলাপে-আলাপে জানা গেল, ১৯৩৭ সালে কলকাতার চৌরঙ্গী রোডে জন্ম নেওয়া ড. কামাল হোসেনের বাবার নাম ডাক্তার আহমাদ হোসেন। ১২ বছর বয়সে ভারত-পাকিস্থান বিভক্তির পর ১৯৪৯ সালে সপরিবারে বাংলাদেশে চলে আসেন তাঁরা। আর ঠিক ১০ বছর পর ১৯৫৯ সালের ১৬ই জুন বাংলাদেশের হাইকোর্টে আইন পেশায় প্র্যাকটিস শুরু করেন। ড. কামাল বলেন, তখন তো এটা সম্ভব ছিল। এখন তো সবাইকে দুইবছর লোয়ার কোর্টে করতে হয়। আমি যখন ব্যারিস্টার হয়ে আসছি তখন সোজা হাইকোর্টে এনরোলমেন্ট করা যেত। নিজের প্রথম সম্মানী প্রসঙ্গে হেসে ওঠেন ড.কামাল হোসেন। বলেন, এখন তো শুনলে হাসাহাসি করবে মানুষ, তখনকার যে ফি ছিল,হাজার বারো শ পেলেই মনে করা হতো, তরুণ আইনজীবী হিসেবে অত্যন্ত সফল। তখন পার্টটাইম শিক্ষকতায় আড়াই শ টাকা পাওয়া যেত। ওই আড়াই শ টাকার সঙ্গে হাজার বারো শ টাকা পেয়ে গেলে মনে হতো খুব ভালো প্র্যাকটিসের ভেতরে আছি।
এখন আইনপেশাকে নিজের সবচেয়ে প্রিয় পেশা হিসেবে বিবেচনা করলেও এই পেশায় কিন্তু এসেছেন তাঁর বাবার কারণেই। এ প্রসঙ্গে বলেন, আমার ল পেশায় আসার পেছনের কারণ হলো, আমার আব্বা ডাক্তার ছিলেন।অনেক অনারেবল একটা জমিদার পরিবারে তাঁর জন্ম। জমিদার যারা ছিলেন তখনকার, তারা দেশে তো থাকতেন,আবার কলকাতা যখন ছিল তখনকার বড় শহর, সেখানেও থাকতেন।আমার আব্বা ছাত্রজীবন থেকে বলে এসেছেন যে, আমি লেখাপড়া করব। আমি ডাক্তার হব। আর প্রেসিডেন্সি কলেজে তখন খুব কঠিন ছিল ভর্তি হওয়া। তিনি সেটা টার্গেট সেট করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন। ১৯২০ বা ২১ সনের দিকে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র হলেন, ভালো পাস করলেন,মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হলেন।যেটা খুব কঠিন ছিল তখন। তিনি ডাক্তার হলেন, তারপর আমার দাদাকে মানে উনার আব্বাকে বললেন, দেখেন,আমি কিন্তু জমিদারির ওপরে নির্ভরশীল হব না,আমি কিন্তু একজন পেশাজীবী হব।এটা নিয়ে তিনি খুব গর্ব করতেন। আমাকে বলেছেন,দেখো স্বাধীন পেশার মতো কোনো কিছু থাকে না। চাকরিতে তুমি যাবে না। তখন তো সিএসপি হওয়ার আগ্রহ ছিল,ব্রিটিশ আমলে আইসিএস।বললেন দেখো তুমি চাকরিতে যাও, এটা আমি চাই না। তুমি লেখাপড়া করেছ, আমি চাই তুমি স্বাধীন পেশায় যাবে। আমার বাবা তাঁর বাবাকে বললেন, বড় ভাইকে সব জমি ছেড়ে দিলাম। আমি কেন বলছি, কারণ স্বাধীন পেশার যে মূল্য তা আমি হাড়ে হাড়ে অনুভব করছি। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে আমি বললাম যে, আমি দেশে ফিরব না। আমার ওখানেই থাকতে হবে। লন্ডনে বসে আমি ভাবছি, আমি এখন কী করব! পকেটে মাত্র চল্লিশ পাউন্ড নিয়ে, তখন যে কলেজে আমি ছিলাম, রিসার্চের জন্য গিয়েছিলাম,তখন ওরা খোঁজখবর করছিল হাই কমিশনারে যে উনি বেঁচে গেছেন। তখন বলল যে না, উনি শুধু বেঁচে যাননি,উনি লন্ডনে আসছেন। তখন ওরা ফোন করল। আমি বললাম যে, আমি আসছি। ওরা বলল, ঠিক আছে, তোমার ফেলোশিপ এটা, তুমি নিয়ে নাও। তখন আমি ওই মুহূর্তে বুঝে গেলাম, আব্বার কথাটা কত মূল্যবান ছিল। আমি তখন ৫ বছর থাকতে পেরেছি, ওখানে শিক্ষকতা করেছি, ওখানে পেশাজীবী হিসেবে থেকেছি।কোনোভাবেই আমাকে কারও ওপরে নির্ভরশীল হতে হয়নি।
বাবার কথা বলতে গিয়ে লম্বা সময় নিজের স্মৃতিতে ডুব দেন ড. কামাল হোসেন। মনে করিয়ে দিলাম তার মায়ের কথা।আপনার আম্মার কথা মনে পড়ে? ড. কামাল অনেকটাই অশ্রুসজল। বললেন, হ্যাঁ। উনি লেখাপড়ার ওপরে সবচাইতে বেশি গুরুত্ব দিতেন। তখন তো মেয়েদের পড়ালেখার অতটা সুযোগ ছিল না। তারপরেও তিনি লাইব্রেরি থেকে বই এনে এনে পড়তেন আর কি! আমার আব্বার ব্যাপারে যেটা বললাম, উনি লেখাপড়াকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতেন, আমার আম্মাও একইরকম। লেখাপড়ার মাধ্যমেই তুমি মানুষ হতে পারবে। সত্যি এটাই ঘটল। উনি যেটা বলতেন সেটা বিশ্বাস করতেন, আমি যখন আইএ তে ফার্স্ট আসলাম ইউনিভার্সিটিতে, তখনকার সেন্ট গ্রেগরি কলেজে, তারা বলল, আমরা একটা ফুল স্কলারশিপ দিচ্ছি, আমেরিকাতে যে ইউনিভার্সিটি আছে, নটরডেম ইউনিভার্সিটি, তোমাকে ওখানে অ্যাডমিশান করব, দুই বছরে তুমি ডিগ্রি করে নিতে পারবে। ১৯৫৩ সালে আমার বয়স হবে ১৪। ১৬ বছর বয়সে বলছে আমাকে ওখানে পাঠাবে, আমি ভাবলাম, আমাকে সম্মতি তো দেওয়া হবে না, এত অল্প বয়সে বিদেশে যাওয়া, তখন তো বিদেশে যাওয়াটা অনেক কঠিন ব্যাপার ছিল।
বাবা মায়ের সঙ্গে ড. কামাল স্মরণ করলেন জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে। নিভৃতচারী এই দার্শনিকও তাকে পিএইচডি করতে বিদেশি যেতে উৎসাহিত করেছেন। ড. কামাল বলেন, আরেকজন আমাকে খুব উৎসাহিত করেছিলেন, পরে যিনি ন্যাশনাল প্রফেসর হলেন, সেই প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক। আমাদের সবার স্মরণীয় স্যার। উনি বললেন, না, না, তুমি বাইরে পড়ছ ঠিক আছে, পিএইচডির সুযোগ কেন তুমি নেবে না? তুমি কাজ করছ,তোমার সুপারভাইজারও বলেছে, একটা সুযোগ তুমি নিতেই পারো। এভাবে কাজটা করা কঠিন কিন্তু অবশ্যই তোমাকে সুযোগ নিতে হবে।ওনার প্রেশার,আর সুপারভাইজারের কাছে আমার কমিটমেন্ট ছিল,যে আমার দিক থেকে আমি করে যাব। আমি ১৯৬৪ সালের মে তে গেলাম। তিন-চারমাসের মধ্যে কমপ্লিট করে সাবমিট করা দেখি!এনিওয়ে, গেছি, সাবমিট করেছি, সেপ্টেম্বরে আমার পরীক্ষা হলো, ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে।
জাতিসংঘের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করেছেন আফগানিস্তানেও। যুদ্ধবিধ্বস্ত ওই দেশে প্রতিবেশী পাকিস্তান তালেবানদের অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করত, বিষয়টি ড. কামাল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে তুলে নিয়ে আসেন নিজের রিপোর্টে। ৯৮ সালে স্পেশাল রেপোর্টিয়ার হিসেবে তিনি সেখানে ৫ বছর ছিলেন। ড. কামাল বলেন, আমি দেখছি যে তালেবানদের সাপোর্ট দিচ্ছে পাকিস্তান। তারা তো অস্বীকার করে না, তালেবানদের পক্ষে পাকিস্তান তো বক্তব্যও রাখে। ড. কামাল এ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের অনেক বেশি অবদান আছে এই সংকটকে খারাপ থেকে খারাপের দিকে নিয়ে যেতে। তালেবান তো তাদের গঠন। এটা নিয়ে তো কোনো বিতর্কের ব্যাপার নেই। তালেবান তাদের তৈরি করা। এই যে সাত্তার এহজাজী এখন ফরেন মিনিস্টার হয়েছেন, তা সঙ্গে আমার দেখা হতো আফগানিস্তান যাওয়ার আগে। তো আমি তাকে তখনো বলেছিলাম, দেখো তোমরা এটা বুঝতে পারছ না যে তালেবানদের তোমরা মনে করছ যে, কাবুলের ওপর একটা প্রভাব ফেলার জন্য, নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য তোমরা তালেবানদের উৎসাহিত করছ। দেখো এটার পরিণতি হবে যে, তারা তোমাদের দেশে এসে তোমাদের বিপদ সৃষ্টি করবে। ওর নোট টেকারকে একটু বাইরে পাঠাতে বলে ওকে বললাম যে, তোমার নোট টেকারকে একটু বাইরে পাঠাও আমি তোমাকে কিছু স্ট্রেট কথা বলতে চাই।তো আমার মনে হয় ওর সঙ্গে দেখা হলে বলব যে, ভাই কি বলেছিলাম তোমাকে কত বছর আগে। ও আমার সামনে স্বীকারও করল। বলল যে, আমি তোমাকে অ্যাগ্রি করি যে এই ব্যাপারটা করা উচিত না। আমি বললাম কেন হচ্ছে? তখন বলল যে, আমাদের আইএসআই এগুলো করাচ্ছে। ওইযে আইএসআইয়ের ভূমিকা, ওদের ইন্টেনিজেন্সের ভূমিকা ওরা স্বীকার করেছে। জানতে চাইলাম, আইএসআই কি সরকারের চেয়ে ক্ষমতাবান? ড. কামাল বললেন, অবশ্যই। ক্ষমতাবান মানে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান তারা।
নিজের রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশসময় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন ড. কামাল। এবার আয়েশ করে তার চেম্বারে লালচায়ের কাপে মৃদু চুমুক দিতে দিতে বলেন, রাজনীতিতে একদম প্ল্যান করে আসা হয়নি। আমার জীবনে ওইরকম প্ল্যান হয়নি আরকি। আমি বলি যে ভাগ্য বলেন আর আল্লাহর রহমত বলেন, আমি দুটোই বলি আরকি।পলিটিক্স করার চিন্তা মাথায় আসার কথাই না আরকি। ৬০-৬১ সালের দিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। উনার বেইল-এর জন্য সরোজি সাহেব গেছেন আমি পেছনে-পেছনে গিয়েছি। উনার সঙ্গে কথা বলার পর। বঙ্গবন্ধু তো উনি অনেক পরে হয়েছেন ৬৯-এ। আমি ৬৯-এর কথা বলছি না। মুজিব ভাই। তো মানিক মিয়া সাহেবের বাসায় উনার আইনজীবী থাকতেন, আমিও যেতাম। তো উনার সঙ্গেই কথা বলি যে মার্শাল ল কতদিন চলবে? তো উনি বললেন যে পাঁচ বছর, খুব বেশি হলে দশ বছর। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল। যখন ৬৯-এ আইয়ুব গেছেন, তখন আমি উনাকে বলেছি যে, আপনি কিভাবে অংক করলেন? ঠিক আপনার কথার প্রিসাইসলি আপনার কথা মতোই তো আইয়ুব খান বিদায় নিচ্ছে। তখন হাসলেন। তো এইসব ব্যাপারে উনার অসাধারণত্ব আমি খেয়াল করেছি।
আইনের পথ ধরে বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি আরও কয়েকজন দেশসেরা রাজনীতিকের কাছাকাছিও এসেছিলেন ড. কামাল হোসেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, উনার (সিরাজ শিকদার) সঙ্গে সঙ্গে একদম পরিচয় ছিল না। মনি সিংয়ের সঙ্গে ছিল। কেস নিয়ে না। আমরা সংবিধান করার সময় উনি এসেছেন। আমরা উনার মত চেয়েছি। উনি খুব বিস্তারিতভাবে খসড়া করতে মত দিয়েছেন। রাজনীতি তো এ ভাবেই।
গণফোরাম সভাপতি ড.কামাল হোসেনের কাছে এবার জানতে চাই বঙ্গবন্ধু সরকারের দুই দফা মন্ত্রী ছিলেন। আওয়ামী লীগ ছাড়লেন কেন? তিনি বলেন, অলমোস্ট সময় এসেছে, আমার যে চিঠিপত্র আছে, সেগুলো তোমাদের সামনে পাবলিকলি দিয়ে দেওয়া দরকার। আমি চাইনি যে, আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো বিভাজনের ঘটুক।আসলে কোনো সময়ই এমনটা চিন্তা করিনি। তো আমি চিঠি দিয়েছিলাম তখন। যে এই,এই করো। নাহলে আমরা ভুল পথে যাচ্ছি। পার্টির মধ্যে গণতন্ত্রকে স্টাবলিশ করো। তখন একজন দাঁড়িয়ে বলেছিল,একদম কোট অ্যান্ড কোট আমি উনার নাম বলব না, যে কামাল হোসেন তো লন্ডনে, বিলেতে অক্সফোর্ডে পড়ালেখা করেছে। উনিতো ওয়েস্ট মিনিস্টার ডেমোক্রেসি চিন্তা করেন। আমাদের দেশে একদেশ একনেত্রী এক দল। তো আমি বলেছিলাম যে, এটা ছিল নাৎসি পার্টির স্লোগান। নাৎসিজমের পরিণতি কী হয়েছিল? তাদের ভোট দিতে হয়েছিল। একতরফা একচেটিয়া ভোট দিয়ে তারা সব হয়েছিল।পুরা একটা দেশকে তারা ধ্বংস করেছিল। কতদিন ডিভাইডেড দেশ থাকল। ৫০ বছর পর দুটো দেশ আবার ইউনাইটেড হলো। তো এইগুলো থেকে আমাদের কী শিক্ষা?
এবার বলি, স্যার আপনি বারবার ঐক্যের কথা বলছেন। বিগত ৬ বছরের বেশি সময় ধরে একাধিকার রাজনীতিকদের হাত ধরে জাতীয় সনদ তৈরিরও তাগাদা দিচ্ছেন। কিন্তু কেউ তো শুনছেন না। হাসলেন ড. কামাল হোসেন। বলেন, না না। মজার ব্যাপার হলো, ২০০৮ ঘটলো। ২০০৮ তো খুব উল্লেখযোগ্য একটা বৎসর। ২৯শে ডিসেম্বর। এই তারিখটা মনে রাখতে হবে। আমি সেদিন আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে বলেছি ১৫ অগাস্ট যেটা আমরা হারিয়েছিলাম সেটা ২৯ শে ডিসেম্বর আমরা ফিরে পেয়েছি। ২৭০টা সিট পার্লামেন্টের আর ৩০টা বিএনপি জামায়াত। এটা অবজেক্টিভ ট্রুথ। মানে এটাতো আমি বাড়িয়ে বলছি না। যদি ২২ জানুয়ারি ২০০৭ এ নির্বাচন হতো তখন তিনশো সিট জামায়াত-বিএনপির। কারণ আমরা সব বর্জন করেছি। ওরা হলে কী হতো? তারেক রহমান প্রাইম মিনিস্টার। এটা কোনো বিতর্কের ব্যাপার না। তো এই যে ১/১১ বলা হয়, আমি ১/১১ ঘটাইছি এরকম বাজে কথা ওরা এখন বলেও না। কারণ সব রেকর্ড তো আছে। তো আমরা কী করেছিলাম? আমি মামলা করেছিলাম। করে ভোটার লিস্টকে বাতিল ঘোষণা করিয়েছিলাম। এই কারণে ইলেকশন কমিশন যে ব্যর্থ হয়েছিল সেটা কোর্ট বললেন। তারপরে আমরা মামলা করেছিলাম, রিট মামলা। যে ইয়াজউদ্দিন নিরপেক্ষ ব্যক্তি হতে পারেন না। উনি মন্ত্রী ছিলেন বিএনপির। আমরা প্রায় অর্ডার পেয়ে যাচ্ছি যখন এসে হিয়ারিং বন্ধ করে দিল। তখন একটা গণ্ডগোল সৃষ্টি হলো কোর্টে। আমি সেদিন রাতে চলে গিয়েছি আমেরিকায়। যে এই মামলাটা করতে গেলাম। ওয়াশিংটনে একটা আন্তর্জাতিক মামলার ডেট ফিক্সড ছিল, আমি সেই রাতেই চলে গেলাম।পরে শুনেছি যে বিএনপি সরকার দুঃখ করেছে যে,ও পালিয়ে গেল কী করে? ওখানে গিয়ে শুনতে পেয়েছি যে, আপনার নামেতো দেশদ্রোহিতার মামলা চালু হয়েছে। আমার, আমিরুল ইসলাম, শুব্রত চৌধুরী সবার নামে। তো তখন আমি বললাম যে, ঠিক আছে আমি এসে দেখব। আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল,চিফ জাস্টিসের অফিসে আমরা ফার্নিচার ভেঙেছি। পতাকা পুড়িয়েছি। আরও কী করেছি? শাহজাহান ওমর। তার গাড়ি পুড়িয়েছি সুপ্রিম কোর্টের অঙ্গনে। কে আগুন দিয়েছে এটা ওটা। আমার সঙ্গে থাকতো সিকিউরিটির লোক। তো ওকে আমি বললাম যে,ভাই আপনি তো ছিলেন। আপনিতো বলবেন যে এ সব আমি করেছি কিনা। আপনি বলে দিলে তো সরকারের কাজ হয়ে যাবে। তো তিনি হাসেন। তো এই কেসের ব্যাপারে আমি ফিরে এসেছি আমেরিকা থেকে। আমি হাইকোর্টে গেছি। কোর্ট বললেন, আপনি কেন এসেছেন? তো আমি বললাম, আপনার লিস্টে কেস আছে। রাষ্ট্র ভার্সেস কামাল হোসেন। কোর্ট জানতে চান, তো আপনার বক্তব্য কী? আমি বললাম,আমার কোনো বক্তব্য নাই।কোনো বক্তব্য নাই? আমি বললাম,না আমি আসাসি হিসেবে আছি।তখন কোর্ট বললেন, ঠিক আছে, বেল ক্ষমতা স্টে করে দিলাম। তারপরে আমি দ্বিতীয় দিনে খবরও নেইনি।সুব্রতরা কেস চালিয়ে চালিয়ে ক্লোস করেছে। তো এই হলো আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড।যে আমরা বিএনপি জামায়াতের ব্যাপারে সারাজীবন স্টেপ নিয়েছি, এখনো নিচ্ছি, ২০০৭ সালেও নিয়েছি। সে আমার বিরুদ্ধে বলা হয়, উনি ১/১১ ঘটিয়েছেন। ১/১১ আমি কেন ঘটাব? যখন এই জিনিসটা হলো যে,ইয়াজউদ্দিন পদত্যাগ করেছেন ইলেকশন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তারপর নতুন ইলেকশন কমিশন হলো, নতুন লিস্ট হলো। তো আমি বললাম এইগুলো, হ্যাঁ ফখরুদ্দীন এসে আমাকে ডাকলেন, বললেন, আমরা এখন এসেছি, আমরা কী করব? ইলেকশন কিভাবে হবে? আমি বললাম যে আপনি ইলেকশন করবেন। আর কী করবেন? যে ইলেকশন হবে একটা গ্রহণযোগ্য ইলেকশন আপনি করবেন। তো কী করা? বললাম,ভোটারলিস্ট বানাতে হবে। এই ভোটার লিস্টতো এক কোটি চৌষট্টি লাখ ভোটার। পরে প্রমাণিত হলো ভুয়া।এই ইলেকশন লিস্টতো আপনি ইউজ করতে পারেন না।তো কী করবো? ইলেকশন লিস্ট করবেন। জাতিসংঘ সাহায্য করবে। ছবি তুলে তুলে সবাই করল। ইলেকশন কমিটি নতুন করে গঠিত হলো।
ওই সময় কি আপনার ভূমিকা ছিল জাতিসংঘ যে সাহায্যটা করেছিল? এমন প্রশ্নে ড. কামাল বলেন, অবশ্যই। আমি সেটাই তো কতজনকে বললাম যে,ইলেকশন কমিশন যদি আপনারা নতুন করেন,ইলেকশন লিস্ট করেন। জাতিসংঘ সাপোর্ট করবে। অবশ্যই করবে। কেননা তাদের কর্তব্য এটা। কেননা দশটা রাষ্ট্রের মধ্যে আমরা নাইনথ না এইটথ লার্জেস্ট। তো এইখানে তো ইলেকশন লিস্টকে নষ্ট করা হয়েছে। তারা অবশ্যই সাহায্য করবে। করলোও। আর আমরা কী করলাম? আমি তখন ঐক্যের একটা প্রক্রিয়া চালাচ্ছি। ঐক্যের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু যে শিক্ষা দিয়েছিলেন, আমি ছাত্রলীগও করি নাই যুবলীগও করি নাই। কোনো পলিটিক্যাল সেরকম ব্যাকগ্রাউন্ডও নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যেগুলো শিখিয়েছে আমি মনে করি হান্ড্রেড পার্সেন্ট প্রযোজ্য আজকেও। আর কোনো নেতাও নাই। আর কোনো রাজনীতিও নাই। আমি তখনো বলেছি যে, ভাই এটা বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিকে জিইয়ে রাখা। নীতির দিক থেকে।
চলবে…