‘অনুরণন’ সাহিত্যের কাগজ। এটি ৪র্থ সংখ্যা। প্রকাশকাল ২০১৬। এই সংখ্যাটি সাক্ষাৎকার সমৃদ্ধ। কলকাতা প্রতিনিধি স্বপ্নগুহ ঠাকুরতা সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি সুফিয়া কামালের। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ১৯৯৪ সালে। শিরোনাম ‘বেণী বিন্যাসের সময় ছিল না কবি সুফিয়া কামালের’। এটি ঘরোয়া সাক্ষাৎকার হলেও উঠে এসেছে নানা অজানা কথা। এই সাক্ষাৎকারে রয়েছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কথা, বেগম রোকেয়ার স্মৃতি। কবির মাকে বেগম রোকেয়া ‘কুকু’ বলে ডাকতেন। উঠে এসেছে সুফিয়া কামালকে নিয়ে লেখা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিঠির কয়েকটা উদ্ধৃতিও। উঠে এসেছে বিখ্যাত নেত্রী লীলা রায়ের কথা।
কবি ইকবাল হাসান লিখেছেন ‘প্রকৃতি ও মানুষের কবি হাসান আজিজুল হক’। হাসান আজিজুল হক কবিতার ঘোরলাগা শব্দে গল্পে লেখেন। তাঁর একটি বাক্য মনে পড়ে–‘বাতাসে কলা গাছে পাতা একবার বুক দেখায়, একবার পিঠ দেখায়।’ কি অসাধারণ অনুভূতি! ইকবাল হাসান যথার্থই বলেছেন ‘কবি’। এই সাক্ষাৎকারটি তথ্যনির্ভর। এতে উঠে এসেছে দেশভাগ, দাঙা এবং হাসান আজিজুল হকের লেখা। তিনি একটি প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘সবচেয়ে কঠিন এবং সবচেয়ে পশ্চাদমুখী গোঁড়ামী হচ্ছে ধর্মীয় গোঁড়ামী। এরা মানুষের বৃদ্ধিও বন্ধ করে দেয়। সমাজ সভ্যতার গতিকে স্থবির করে দেয়।আর যদি তা রাজনীতিকে আক্রমণ করে তাহলে সেই রাষ্ট্র অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’ সমরেশ মজুমদার সাহিত্য জগতের এক অনিবার্য নাম। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্বপ্নাগুহ ঠাকুরতা। তিনি বলেছেন,‘চেষ্টা করে মানুষ সাইকেল চালাতে পারে, সাঁতার শিখতে পারে লেখক হতে পারে না। লেখক মানুষের ভেতর থেকে হয়ে যায়’। ঠিকই বলেছেন। লেখক হওয়া কঠিন ব্যাপার। একজন মানুষকে শ্রমে ঘামে লেখক হতে হয়। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বুদ্ধিজীবী। দেশি-বিদেশি সমকালীন সাহিত্য ও শিল্পকলায় রয়েছে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জব্বার আল নাইম। তিনি বলেছেন, ‘বিশ্বসাহিত্যকে চ্যালঞ্জ করার মতো সাহিত্যকর্ম আমাদের আছে’ এছাড়া তাঁর সাক্ষাৎকারে আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতা বিষয়টির বিষদ ব্যাখ্যা উঠে এসেছে, যা পাঠকের কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠবে।
আবুল বাশার অনন্য গদ্যকার। যার গদ্যের বিষয়বস্তু বৈচিত্র্যময়। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্বপ্নাগুহ ঠাকুরতা। তিনি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ভালো গদ্য বা উপন্যাস লিখতে হলে একটা কবিত্ব শক্তির দরকার।’ সত্যিই গদ্যকে কবিতার মতো করে লিখেছেন জীবনানন্দ, সুনীল, শক্তি।
অনুরণন এই সংখ্যাটিতে ব্যতিক্রম একটি সাক্ষাৎকার উঠে এসেছে। খ্যাতিমান শিল্পী হৈমন্তীর শুক্লার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্বপ্নগুহ ঠাকুরতা। তিনি তার গানের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে বলেছেন, গানগুলো তো আসলে কথাপ্রধান, মানুষ সুরের দিকে অত ধ্যানও দেয় না। উদ্বৃত্তি দেওয়া যায়; আমার বলার কিছু ছিল না, না গো, চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে…।
গুচ্ছ কবিতা লিখেছেন, ইকবাল হাসান, আশরাফ শিশির। ‘একদা চৈত্রের রাতে’-ইকবাল হাসান লিখেছেন, ‘অজানা পথের খোঁজে তবু আমি অপেক্ষায় আছি/জানি তুমি অতিদুরে অচেনা তারার কাছাকাছি।’
আশরাফ শিশির “পাসপোর্ট” কবিতায় লিখেছেন, ‘মেয়াদোত্তীর্ণ পাসপোটের মত তোমার সীমানায় আমার যেকোন চলাচল প্রতিরুদ্ধ থাকে’
একক কবিতা লিখেছেন, সৈয়দ সারোয়ার, পার্থপ্রতিম ভট্টাচার্য, মোহাম্মদ নূরুল হক, বীরেন মুখার্জী, ফরিদুল আলম সুমন, অলক বিশ্বাস, দীনা আফরোজ, ছায়েদা আলী, সুমন আহমেদ, সোনালি বেগম, দিশা চট্টোপাধ্যায়, সুবীর সরকার, রোশনি ইসলাম, রিমান চৌধুরী,
গল্প লিখেছেন, নাসরীন মুস্তাফা। গল্পের নাম দন্তস্য প দন্তন্য। গল্পটি ডায়লগ ভিত্তিক।
বিশেষ রচনা লিখেছেন, ঔপনাসিক সমরেশ মজুমদার । লেখাটিতে দেশভাগ আর শিকড়ের টান ধরা পড়ে। ভ্রমণ কাহিনি লিখেছেন, ফজিলাতুন নেছা শাপলা। ‘সেই গল্পটা এখনও শেষ হয়নি’ লেখাটিতে জাপানের বিখ্যাত স্থানগুলোর বর্ণনা উঠে এসেছে।স্বপ্নাগুহ ঠাকুরতা লিখেছেন ,‘স্বপ্নের শহর সিংগাপুর’। লেখার পরতে পরতে ছড়ানো দেশপ্রেম, নস্টালজিয়া।
সাক্ষাৎকার-২ বিভাগে কবি আসাদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, কবি রনজু রাইম। আসাদ চৌধুরী বলেছেন, ‘কবিতার লেখার জন্য ছন্দ জানতেই হবে। কিন্তু কবিতায় সবসময় ছন্দ থাকতে এমন কোনো কথা নেই। ’ ঠিকই বলেছেন, ছন্দ সঠিক জায়গায় প্রয়োগ করাই গুরত্বপূর্ণ। সদ্যপ্রয়াত কবি রফিক আজাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, রনজু রাইম। রফিক আজাদ বলেছেন, ‘ধর্মের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি বলেই ফররুখ আহমদ অনেক শক্তিমান কবি হয়েও বিস্তৃতি ঘটাতে পারেননি।যথার্থই বলেছেন। কবি লেখক বুদ্ধিজীবীদের মৌলবাদের ঊর্ধ্বে থাকতে হয়।
কবি অসীম সাহার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রনজু রাইম। কবি বলেছেন,‘জীবন নিয়েই শিল্পের অধিষ্ঠান।’
শিল্পে সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকতেই হয়। অদ্ভুত-উদ্ভট শিল্প কখনো কালজয়ী হয় না। কবি রনজু রাইম ব্যতিক্রম একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রচ্ছদ শিল্পী, ছড়াকার, কথা সাহিত্যক ধ্রবএষ-এর। তিনি বলেছেন, ‘প্রচ্ছদকে পরজীবী ছাড়া আর কিছু বলতে আমি রাজি নই’। এই সাক্ষাৎকারে প্রচ্ছদ শিল্প নিয়ে নানান কথা উঠে এসেছে।
প্রবন্ধ লিখেছেন আইভি চট্টপাধ্যায়। ‘আ মরি বাংলা ভাষা: বাংলা সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি’। লেখাটিতে বাংলা সাহিত্যের মনীষীদের অবদানের কথা উঠে এসেছে। যাতে ধরা পড়েছে চর্যাপদ থেকে সম-সাময়িক সাহিত্য চর্চা।
ড. মুহাম্মদ আবুল কাসেম লিখেছেন, ‘মীর মশাররফ হোসেন: নাটক ও সমাজ বাস্তবতা। লেখাটিতে মীর মশাররফ হোসেনের বসন্তকুমারী, জমিদার দপর্ণ, বেহুলা গীতাভিনয়, টালা অভিনয় নাটক গুলোর কথা উঠে এসেছে।
পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখেছেন জান্নাতুল নাহার। তাঁর আলোচিত গল্পটির নাম ‘মার্কেজ অ্যান্ড মানিপ্লান্ট’-এতে মার্কেজের গল্পটি নিয়ে ভালো লাগারই কথা প্রকাশ পেয়েছে। ইউজেন জেবেলিনু’র কবিতা অনুবাদ করেছেন রেজা নুর। তাঁর অনুবাদ আক্ষরিক এবং নান্দনিক। ‘বিবর্ণ আজ রাতের চাঁদ/ধোঁয়াশা দাড়ির মতো মেঘ করেছে আড়াল।’
‘অনুরণন’-এই সংখ্যাটি প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করেছেন আশরাফ শিশির। সাহিত্যের আকালে এ রকম একটি লিটলম্যাগ উপহার দেওয়ার জন্য রেজা নুরকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়।এর প্রকাশ অব্যাহত থাকুক।