কবিতা—সে আদতে অনেক রকম অনুভবের ছন্দিত প্রকাশ বলেই ধারণা। কবিতা সময়েরও উচ্চারণ। ব্যক্তিক বিষয় হতে গভীর প্রেম এবং রাজনীতি অবধি কবিতার বিষয়বস্তু হতেই পারে। কারও কবিতা যখন দেশ-কাল-প্রেমবোধে জারিত হয়ে অনেক পাঠকের হৃদয়ছোঁয়া হয়, তখন সেই কবিতা কালোত্তীর্ণ বলাই যায়। কালিদাসের কাল হতে কবিগুরু, নজরুল, সুকান্ত এবং আজকের নবিস কবিদের হাতেও এভাবেই কবিতা হৃদয়জয়ী হওয়ার ধারাটি ধরে রেখেছে। প্রচুর অকবিতাও রয়েছে বৈকি। কবিতার বই প্রকাশ যত বেশি, তার ভেতর যোগ্য কবিতা তত হাতেগোনা। কবিতা হয়তো সবার না বলেই অসাধারণ অনুভবের পঙ্ক্তিমালা। কবিতাকে এমন ভেবেই আমার যত কবিতা নামের অধরা বিষয়কে লেখার প্রয়াস স্কুলবেলা থেকেই। আজ এখানে তারই নমুনা হিসেবে নিজের কয়েকটি কবিতা তুলে ধরছি আমার ‘জীবনপুঁথি’ কাব্য থেকে।
এক.
তবু যে কি হয় দেশে?
ঘরপোড়া মানুষের বিলাপ বাতাসে।
সিঁথির সিঁদুর লেপ্টে লাল ধকধকে ভাসে
মানুষ নামের পশু দলের উল্লাস কেন দেশে?
তখন কি কবিতারও মাথাখারাপ?
তখন কি কবিতারও মনখারাপ?
তাই বাতাসের খামে পাঠাইয়াছে বিলাপ!
তাই সুশীলগণের দিকভ্রান্ত সংলাপ!
শুনে কবিও রশিরে ভাবে সাপ!
তাই জানালায় হরিষে বিষাদ।
তাই জানালায় হরিষে বিষাদ।
দুই.
তবু মনেমনে চিঠি লিখি—
প্রিয় নদীদের কাছে পাঠাই না, তবু লিখি
প্রিয় ধর্মসাগর, কেমন আছো?
বহুকাল দেখা হয়না তুমি কি সুখে আছো?
না কি তোমারও দশা গোমতির মতো দুখী? বহুকাল দেখিনাতো জানি না কেমন নদী দু’টি?
শুনেছি বিকেল হতে উপচানো ভিড়ে পড়ে তোমার দু’ধার ভাসে… তরুণীরা খুব ওড়ে।
শুনেই আমার স্মৃতিমালা বড়ো মনে পড়ে।
তখন আমার তোমারই জন্য হৃদয় কেমন করে।
জানি, কত নতুন তরুণী আসে …
হেসেহেসে বসে পাশে … তাই মনে নেই পুরনো তরুণীদের?
তাই মনে নেই পুরাতন খুশীদের?
প্রিয় ধর্মসাগর, তবুও তুমি ও গোমতি সুখে থাকো।
প্রিয় ধর্মসাগর, তবুও তুমি ও গোমতি সুখে থাকো।
তিন.
মনে আছে? শহরে সেদিন মেলা?
মনোহরপুরের দোকানে লাল-নীল মরিচবাতির খেলা?
আমরা রিক্সায় তিন সইয়ের হাসাহাসিগুলি শুনে রিক্সাঅলা সেও টিংটিংটিং বাজিয়ে ঘণ্টিগুলো প্রায় উড়িয়েই নেয়!
অবশেষে আমাদের মেলায় নামিয়ে দেয়।
ভাড়ার পয়সা নিতে যেন সিনেমার
সেই সে মাঝি সে …
‘তোমার কাছে পয়সা নিবো না’ এমন সে!
শহর ছেড়েছি কবে …
ঊনচল্লিশ বছর হবে …
মনোহরপুর কি আগের মতো আছে?
অই রিক্সাঅলা সে কি বেঁচে আছে?
রূপকথা সিনেমা হলে কি ম্যাটিনি শো চলে?
রূপসীরা সেজেগুজে দলবেঁধে যায়? ঢলেঢলে কথা বলে?
চার.
আদতে তেমন কিছুই লাগে না ভাই—
মাতপিতৃস্নেহচ্ছায়াময় ছাতটুকু লাগে ভাই।
দুই পায়ের তলার মাটি—
অই ভিত্তিমূল হতে হয় খাঁটি।
তাই গীতিকার তাই শিল্পী গায়—
‘ও ভাই খাঁটি সোনার চে’ খাঁটি’ হৃদি ভেসে যায়।
অশ্রুতকাব্য আমার খুঁজেখুঁজে বেলা বয়ে যায় …
অশ্রুতকাব্যে আমার দিবসরজনী ধায়।
সাধনে ভজনে তত ছিল না তো মনোযোগ—
জীবনে ভাবিনি তত ভিটেমাটিহীন সংযোগ।
অল্পেই আমার চলে।
অল্পেই আমার চলে।
কেবল কি দোষে আসে মহা রোগশোক …
কেবল ভাগ্যের জোরে শুশ্রূষার মহাযোগ।
তাই জীবনভাই আজও আছি …
তাই জীবনভাই কৃতজ্ঞচিত্ত বেঁচে আছি।
হ্যাঁ, আমাদের এই বেঁচে থাকার জন্যই জগতে এতটা আয়োজন এতটা শিল্পকলা, কবিতা, গল্প, চিত্রকলা ও সংসারযজ্ঞ সামলানো। তার ওপর এক একটি দেশ, রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদরা। এরপর হাজার রকম জনসাধারণ। এরপর হাজার রকম জীবনযাপন। যা যায়, তা আর আসে না ফিরে জীবনে। কেবল কালের খাতায় স্মৃতিলিপি, কোনও-কোনও দেশজ ইতিহাসলিপি লিখিত থাকে।