জাতীয় দৈনিকের সাময়িকীগুলো সাহিত্য বিকাশে ভূমিকা রাখছে। বলা যায়, সাহিত্য চর্চাকে অনেক ক্ষেত্রে তরান্বিত করছে। অনেক নবীন লেখক সাহিত্য সাময়িকীগুলোকে লেখার প্লাটফর্ম হিসেবে পাচ্ছেন। এর ফলে তারা নিজেদের সহজেই পাঠকদের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে পারছেন। আর সাময়িকীগুলোকে পাঠকমহলও গুরুত্বসহকারে নিচ্ছে। ফেসবুকে বা সামাজিক মাধ্যমে যেমন ইচ্ছে করলেই একটা লেখা প্রকাশ করা যায়, শেয়ার করা যায়, তা যত ভালো অথবা বাজে লেখাই হোক না, তেমনি ইচ্ছে করলেই সাহিত্য সাময়িকীতে একটি লেখা প্রকাশ করা যায় না। ফলে সাময়িকীগুলো লেখা প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে পাঠকদের উপকার সাধন করে আসছে। সব ইতিবাচক ও সুন্দর দিকেরও অনেক নেতিবাচকতা আছে। আছে অসুন্দর দিকও। দৈনিকের সাহিত্যপাতা নিয়ে আলোচনা করার উদ্দেশ্য ভালো লেখাগুলোর প্রশংসা করা এবং অপেক্ষাকৃত কম ভালো লেখাগুলো নিয়ে মন্তব্য করা। আমরা বিশ্বাস করি, ভালো লেখার জন্যে প্রশংসা প্রয়োজন, কেননা এই প্রশংসাই যেকোনো কাজের উৎসাহ হিসেবে কাজ করে থাকে। প্রশংসা লেখককে আরও ভালো লেখার জন্যে উৎসাহিত করতে পারে। আর সাহিত্যে ভালোটাকে যেমন ভালো বলা সমালোচকের ধর্ম, তেমনি মন্দটাকে মন্দ বলাও হচ্ছে সমালোচকের ধর্ম। সমালোচক ভালো মন্দ মিলিয়েই আলোচনা করে থাকেন। কোনো লেখার দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করলে সে লেখকের জন্যেও এ আলোচন ইতিবাচক বার্তা বহন করে। কেননা, সংশোধনের সুযোগ তার আছে। পরবর্তী লেখাগুলো তিনি ভেবে-চিন্তে লিখতে পারেন। কাউকে ছোট করতে কিংবা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কারও নিন্দা করতে এই আলোচনা নয়। সাহিত্যের প্রয়োজনেই আলোচনা।
এপ্রিলের সাহিত্য সাময়িকীরগুলোর আলোচনা করতে গিয়ে আমরা প্রথমেই প্রথম আলোর কাছে আসতে পারি। বিশেষত, প্রথম আলোর ১ এপ্রিলের ‘শিল্প-সাহিত্য’ সাময়িকীতে প্রকাশিত মঈনুস সুলতানের গল্প ‘আতই চোরার আতন্তর’ গল্পের কথা বলতে হয়। গল্পটি বেশ সুখপাঠ্য। যেমন বর্ণনা, শব্দের ব্যবহার, তেমন ঘটনাচক্র। এটি হচ্ছে এমন গল্প, যে গল্প প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠক এ নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলতে পারেন। গল্পটি শুরু হয়েছে এভাবে— ‘আসমানে আজ চান-তারা তেমন কিছু নেই। তবে কী কারণে জানি আলো আছে একটু। তাতে বেসামাল মেঘ খেলছে দেখে আতই চোরা বড় খাজুল হয়। সে নাসির বিড়িতে দম দিয়ে কেবল একটি তারার হাছুমিছু আলোর নিশানার দিকে মিড়মিড়িয়ে তাকায়। আতই তার সাকরেদ বশারত মটিয়া ও নাবালক শুকুর আলীকে নিয়ে মাঝরাতে বসে আছে ঝুপড়ি ছাতিমগাছের তলায়। গাছটি খুঁতি। তার দু-কল্লি ডালায় বাস করে বুড়া থুত্থুড়া এক প্রেতাত্মা গাঁও-গেরামে ‘ছাততি পেরোত’ বলে পরিচিত। সে কাউকে তেমন একটা জ্বালায় না, তার বয়স হয়েছে বেহদ, তাই কোনো ধরনের ফেতনা-ফ্যাসাদ বা খবিসিতে তার মন নেই।’ এটুকু পড়েই পাঠকের উপলব্ধিতে আসবে যে, গল্পটি বর্ণনার ঢংয়ে, উপস্থাপনের জোরে কতটা শক্তপোক্ত হয়েছে। গল্পের শেষ হয় এভাবে: ‘মেয়ে সামিনার কথা আবার মনে পড়ে আতইয়ের। জেলা সদরে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে শুনে সে তার বাবাকে একটি নীল চোখের পুতুল কিনে দিতে আবদার করেছে। পুতুলের দামই-বা কত? বড় জোর সত্তর-আশি টাকা। বালিশের তলায় খুঁতির তালাশ না পেলেও বউটির তুলতুলে ভালুকটি সরানো কঠিন কিছু হবে না। আর বশারত মটিয়া নিঃশব্দে আলমারির তালা খুলে তুলে নিতে পারবে সোনার জেওর কখানা। তারপর শুধু পুতুল কেন, সামিনা চাইলে আরও বিশ-পঞ্চাশ টাকা খরচ করে অন্য কোনো খেলনাও সে কিনে দিতে পারবে। আতই সিঁদের গাতায় কলাগাছের পোঁটলাটি ঢোকাতে যায়। আসমান থেকে হুক-তারা যেন আলোর ইশারায় তাকে সাবধান করে দেয়। আতই আজ বড় আতান্তরে পড়ে—তবে কী কাম বাতিল করে খালি হাতে আজান পড়ার আগে আগে ফিরে যাবে বাড়িতে?’ অর্থাৎ পাঠককে এক অদ্ভুত দ্বিধার মধ্যে ফেলে গল্পকার বিদায় নেন। পাঠক ঘুরেফিরে ভাবেন, কী করবে আতই চোরা? এই ভাবনাটুকুর মধ্যেই গল্পকারের সফলতা নিহিত। এর বাইরে অন্যান্য গল্পের কথা বলতে গেলে সাময়িকীগুলোর বৈশাখী সংখ্যার গল্পগুলোর কথা বলতে হয়। সাময়িকীতে যেহেতু বিশেষ লেখকদের লেখা থাকে, তাই এ গল্পগুলো ভালো হওয়াটাই স্বাভাবিক। ২২ এপ্রিলের জনকণ্ঠ সাময়িকীতে প্রকাশিত মার্ক টোয়েনের ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি’ গল্পটি অনুবাদ করেছেন কাজী আখতারুদ্দিন। এ গল্পের অনুবাদও ঝরঝরে হয়েছে। অনুবাদ গল্প এমন ঝরঝরে হলে পাঠকরা প্রকৃতপক্ষেই উপকৃত হবেন।
শুধু রাজনীতি নয়, সবকিছুর ওপরই সাহিত্যের প্রভাব রয়েছে
এবার প্রবন্ধের কথায় আসা যাক। কালের কণ্ঠের সাময়িকীতে ২৯ এপ্রিল প্রকাশ করেছে ব্যতিক্রমধমী একটি প্রবন্ধ। ‘নৃত্যে লুকিয়ে আছে শক্তি ও সৌন্দর্য’—লিখেছেন শেখ মেহেদী হাসান। পাঠকদের জন্যে এ প্রবন্ধটি বিশেষ কিছু হবে বলেই মনে হয়। এটিকে ঠিক গতানুগতিক ধারার প্রবন্ধ বলা যাবে না। প্রবন্ধের একস্থানে প্রাবন্ধিক লিখেছেন, ‘বারো মাসে তেরো পার্বণের এই দেশে প্রতিটি উৎসব ও মানুষের জীবনাচারের সঙ্গে নৃত্য মিশে আছে। নৃত্য ছাড়া বাঙালির কোনো উৎসব পূর্ণতা পায় না। দেশের শিল্প-সংস্কৃতির উন্নয়নে যতখানি রাজধানী ও নগরের প্রাধান্য, ঠিক ততখানি উপেক্ষিত আঞ্চলিক সংস্কৃতি। এর প্রচার-প্রসারে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ সীমিত। অথচ আমাদের লোকসংগীত, নাটক ও নৃত্য অযুত বছরব্যাপী মানুষের হৃদয় জয় করে আসছে; এতে মানুষের অংশগ্রহণও বেশি। বিশ্বব্যাপী নৃত্যশিল্প জনজাতির শিল্পরুচির প্রধান বাহক হিসেবে কাজ করছে। এ জন্য নৃত্যের শক্তি ও সৌন্দর্য মানুষের কাছে প্রচার ও চর্চার দাবি রাখে।’ সবার জন্যেই এ প্রবন্ধটি অবশ্য পাঠ্য বলেই মনে করি। এ সংখ্যায় ‘নগ্নপদ ইলিয়াড’ শিরোনামে প্রবন্ধ লিখেছেন রাজু আলাউদ্দিন, কবিতা লিখেছেন শিবলী মোকতাদির, হাইকুগুচ্ছ লিখেছেন শেখ আতাউর রহমান। ‘রূপান্তর’ শিরোনামে বড়গল্প লিখেছেন রুবাইয়া মঞ্জুর। ইমতিয়ার শামীমের ‘সাদা আগুনের চিতা’ বই নিয়ে আলোচনা লিখেছেন এমরান কবির। ৮ মে’র যুগান্তর সাময়িকীতে লিখেছেন রফি হক। কবিতা লিখেছেন সানাউল হক খান, মিজানুর রহমান বেলাল, জিনাত রশীদ। বিশ্বসাহিত্য নিয়ে লিখেছেন মেজবাহ উদ্দিন। আল মাহমুদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সৈয়দ সাইফুল ইসলাম। আল মাহমুদ যেহেতু শেষ বয়সে পৌঁছে গেছেন, অভিজ্ঞতায় পুষ্ট তিনি, তাই তার কথাগুলো গুরুত্বপূর্ণ। স্বল্প পরিসরে হলেও এ সাক্ষাৎকারে আল মাহমুদ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘সাহিত্য রাজনৈতিক হাতিয়ার নয়। সাহিত্য সমাজের অসঙ্গতিগুলো দূর করতে এগিয়ে আসে। শুধু রাজনীতি নয়, সবকিছুর ওপরই সাহিত্যের প্রভাব রয়েছে। তবে সে (সাহিত্য) ইচ্ছা করলেই সমাজের সবকিছুর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। আমার মনে হয় যে, এখনো সাহিত্য সমাজের সবকিছুর ওপর প্রভাব বিস্তার করেই আছে। তবে সাহিত্য সামাজিক নানা সংঘর্ষ এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে। বিরোধ থেকে নিজেকে দূরে রাখে। সমাজ ও জনসাধারণের মধ্যে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করে। সাহিত্য সমাজ বিনির্মাণে কাজ করে। আগের চেয়ে এ কাজ কম করলেও একেবারে ছেড়ে দেয়নি।’ তবে সাক্ষাৎকারটি আরও বড় হলেও হতে পারত। তাহলে পাঠক আরও অনেক কিছু জানতে পারত। গল্প লিখেছেন স্বপনা রেজা ‘জলে ভেজা পদ্ম’ শিরোনামে। লিখেছেন আবুল মকসুদও। ছোটকাগজ ‘বাঁক’ নিয়ে আলোচনা করেছেন সরদার মাহফুজ।
এখানেও গল্প উপেক্ষিত হয়ে আছে
ভোরের কাগজের কবিতা নিয়ে আমরা ইতোপূর্বেও মন্তব্য করেছি। ভোরের কাগজের গল্প ও প্রবন্ধের চেয়ে কবিতাগুলো অনেক দুর্বল হয়। তবে এ মাসে আমাদের নতুন কিছু করে দেখাতে সক্ষম হয়েছে ভোরের কাগজ সাহিত্য সাময়িকী। ১ এপ্রিল প্রকাশিত হয়েছে জিনাত জাহান খানের তিনটি কবিতা। ২২ এপ্রিল প্রকাশিত হয়েছে মুহাম্মদ আমানুল্লাহর তিনটি কবিতা। ২৯ এপ্রিল প্রকাশিত হয়েছে ১৬ তরুণের কবিতা। এ মাসে ভোরের কাগজে প্রকাশিত প্রায় প্রতিটি কবিতাই সুখপাঠ্য হয়েছে। এ জন্য সাহিত্য সম্পাদককে আমরা ধন্যবাদ জানাই। এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তীর ‘হার’ কবিতাটির পাঠ নেওয়া যাক :
যা কিছু বিষাক্ত ও নিভৃতের
যে তোমার পা চেটে
অন্যকে বোঝাল তুমিই শ্বাপদ!
বিভাজ্য হওয়া অবধি
বিশ্বাস করো তাকে—
বাকিটা প্রহেলিকায় বন্ধক রেখো
৮ এপ্রিল সমকালের কালের খেয়া প্রকাশ করেছে ‘চৈত্রে রচিত পদ্য’ শিরোনামের বেশ কটি কবিতা। লিখেছেন আল মাহমুদ, আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, আলফ্রেড খোকন, তুষার দাশ, শোয়াইব জিবরান, মুজিব ইরম, মাহবুব আজীজ, ওবায়েদ আকাশ, আহমেদ স্বপন মাহমুদ, দ্রাবিড় সৈকত, অনন্ত সুজন, ফেরদৌস মাহমুদ, আফরোজা সোমা, অতনু তিয়াস, সারাজাত সৌম, শেলী নাজ ও তানিম কবির, সুদীপ্ত সাঈদ। সেলিনা হোসেনকে নিয়ে লিখেছেন আশিক মুস্তাফা। গল্প রিখেছেন রেজাউর রহমান। কালের খেয়া তার বিষয় ভিত্তিক স্মৃতিকথার পর্বটি ধরে রেখেছে। তবে কালের খেয়া তরুণদের বেশি প্রাধান্য দেবে বলে আমরা মনে করি।
ইত্তেফাক, সংবাদ, যায়যায়দিন, বাংলাদেশ প্রতিদিনও যথারীতি সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করেছে। ইত্তেফাক তার অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। সংবাদ ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা। তবে সংবাদে দুটি ধারাবাহিক লেখা প্রকাশিত হয় প্রতিটি সংখ্যাই। দুটি ধারাবাহিক না করে বরং একটি করলে ভালো হয়।
এ সবের বাইরে চট্টগ্রামের পূর্বকোণ, পূর্বদেশ ও সুপ্রভাত বাংলাদেশের শিল্প সাহিত্য পাতা সম্পর্কে দুটো কথা বলতে চাই। সুপ্রভাত বাংলাদেশের ২৯ এপ্রিলের সাময়িকীতে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখি যে, অধিকাংশ লেখকই আমাদের পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত। মনে রাখতে হবে যে, এ পত্রিকাগুলো একটি বিভাগকে ধারণ করে। এ জন্যে এ পত্রিকাগুলো নবীনদেরই বেশি স্থান দেবে। এটাই হওয়াই উচিত। যারা ইতোমধ্যে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত, তাদের লেখা যে একেবারে দেওয়া উচিত নয়, তা বলছি না। প্রতিষ্ঠিতরাও লিখবেন, তবে সেটা কম। তাদের লেখা অন্যদের উৎসাহ দেবে। আলোচ্য সংখ্যায় কোনো গল্পক স্থান দেওয়া হয়নি। সাহিত্য সাময়িকীগুলোর পূর্ণতা দিতে গল্প আবশ্যক বলেই আমরা মনে করি। দৈনিক পূর্বকোণের ১ এপ্রিল সংখ্যায় আমরা তিনটি প্রবন্ধ ও ১টি ফিচারের দেখা পাই। আছে কবিতাও । কিন্তু গল্প নেই। এখানেও গল্প উপেক্ষিত হয়ে আছে।
সাহিত্য সময়কে জয় করে এগিয়ে চলে। ধারণও করে সময়কে। বাংলাদেশের সাহিত্য সাময়িকীগুলো আরও সমৃদ্ধ হবে, সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে এগিয়ে যাবে—আমরা এমনটিই প্রত্যাশা করি।