নদী বলে একে চেনা যায় না। বনের কিনারে যেখানে গাছপালা আর লতাগুল্ম জড়িয়ে আছে একে অন্যকে, তাদের ছায়ায় এই নদীর নিভৃতি। শান্ত জলের ওপর পড়িমরি করে যেসব ডালপালা ঝুঁকে মুখ দেখার চেষ্টা করছে, তার ওপর কোনো পাখিও বসে থাকতে দেখেনি কেউ। মাঝে মাঝে এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ছোট্ট ব্রিজের পাশে বেশ পুরনো নেম-প্লেট, ‘ব্লাক ব্রুক’ ছাপিয়ে জল দেখার চেষ্টা করেছে মিনু। পারেনি। প্রতিবার মনে হয় ঘুমিয়েছে নদীটা। ঘুমন্ত নদী দেখেনি কোনোদিন। আছে বলেও জানা নেই। ভরা বর্ষার দিনে একবার ওইখানে, গাড়ির গতি কমিয়ে প্রায় থেমে দেখে, গাছগুলো কী আনন্দে জল ছিটোচ্ছে শীর্ণ নদীটার গায়ে। এত খুনসুটিতেও একটুও হাসি নেই ওর মুখে। একটি ছোট নালাও বয়ে যায়, গান গায় মিহি সুরে। এই নদীটার যে কী হলো! স্থবিরতায় মুখ কালো করে থাকে।
এই জলধারা থেকে মিনুদের বাসা অল্প দূরে। দুই মিনিটের ড্রাইভ। কতবার ভেবেছে কোনো অবসরে বিকেলে কিংবা সকালে পায়ে হেঁটে আসবে। কিন্তু অন্ধকার আসার পর একে আলাদা করে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাছাড়া ছোটবেলার সেই ভয় ধরানো পথটাই যেন পথ আগলে ধরে। আনুকে বলতে চেয়েছে, ‘চলোনা, সক্কাল বেলা একটু হেঁটে আসি।’ কিন্তু ভোরের ঘুম আর ওম ছেড়ে হাওয়া খেতে বের হওয়ার মানুষ ও নয়। আর এই শীতের সময়ে তা তো একেবারেই অসম্ভব।
নভেম্বর প্রায় শেষ। নিউ ইংল্যান্ডে এখনো তুষার নামেনি। কোনো কোনো দিন শীত জমাট হয়ে এলেও মাঝে মাঝে কড়া রোদ আর সামান্য উষ্ণতার ছোঁয়া রেখে যায়। আজ আবহাওয়াটা তেমন। ঘুম থেকে উঠে জানালার পর্দা একটু সরিয়ে বাইরে দেখল মিনু। অন্ধকার নেই। চারপাশ ফর্সাও হয়নি। ওদের বাসার পেছনে ছোট্ট একটা বন। পাইন, বার্চ আর সেডার বৃক্ষরা মিলেমিশে দাঁড়ানো আকাশের দিকে মাথা তুলে। সকাল হলেও বনের লতায়, পাতায় ছোপ ছোপ আঁধার জড়ানো থাকে। রোদ আসা অবধি ওরা বসে থাকে বনে। পাখিদের গান শোনে। আলো দেখে পাখিরা চুপ হয়ে আসে। এখনো নিশ্চুপ সব। মিনু ভাবল। বেশ ভোর ভোর আছে। এখন গেলে মন্দ হয় না।
সিটি থেকে দূরে এই উপশহর অঞ্চল। ঘন কালো পিচের পথ চলে গিয়েছে বন চিরে। মনে হয় এমন নিঝুমপুরে পথও বুঝি পথ হারায়। বাঁক এলে গাড়ির গতি খুব ধীর করে রাখে মিনু। এখন হেঁটে যাওয়ার সময় তেমন করে ব্রেকে আঁটকে আঁটকে আসছে পায়ে। বিরল বাড়িঘরগুলোয় অথৈ ঘুম। এমন নিঝুম পৃথিবী বহুদিন দেখেনি। পর্দার ফাঁক গলিয়ে আলো এসে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। আড়মোড়া ভেঙে ভেঙে উঠে বসে বিছানায়। চোখে এখনো মধুর মতো ঘুম জড়ানো। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। হিমেল হাওয়া নিলো চোখভরে। আহ, কি মধুর বহতা হিম! ঘুম উড়ে গেল মুহূর্তে। এখন এইচোখে শুধুই নীল আকাশ। আর দুচারটে ভোরের তারা। তন্ময়তায় প্রায় অর্ধেক পথ এসেছে। মোড়টা ওই ঝোঁপগুলোর পরেই। তারপর কালো নদীর বাঁক। এই সকালে কেন যাচ্ছে ওখানে বুঝতে পারে না। দিনের বেলায় তো দেখেছে জায়গাটা। আবার এমন অসময়ে যাওয়া কেন। অবাক লাগে। নিজের মনে মিহিশব্দে হেসে ফেলে। এমন সময় শোঁ করে একটি কার যায়। কিছুটা ভয়ার্ত হয়ে কয়েক পা পিছিয়ে আসে। বিপরীত বাতাসে চুল ওড়ে। অর্ধেক স্কার্ফের ভার বাধ মানে না ঢেউতোলা চুল। একসময় নদীর নেমপ্লেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। পাড়ে যাওয়ার পথ খোঁজে। কারও পায়ের স্পর্শ পাওয়ার অভ্যাস তো নেই তৃণগুল্ম-ছাওয়া প্রলম্ব পাড়টার।
দীর্ঘ চওড়া ফিতের মতো নদীটা শুয়ে। দুপাড়ে, একটু পর পর বিদ্যূতের পিলার। ছোট্ট মেয়ের মাথার দুধারের বিনুনির মতো বিদ্যুতের পেঁচানো তার পিলারগুলোর শীর্ষে। একটা ফাঁকামতো ঘাসেভরা জায়গায় দাঁড়ালো মিনু। বেশ বড় ঘাসগুলো। দেশের দুর্বা’র মতো নয়। কিন্তু খুঁটিগুলো দেখলে দেশের কারেন্টের খুঁটির কথা মনে হয়। দূরে গিয়ে ওদের আকৃতি ছোট হয়েছে। বাঁক নিয়ে নদীর সঙ্ড়ে চলে গিয়েছে হয়ত কোনো অজানা লোকালয়ে। একটা নৌকো হলে ভাল হতো। স্রোত নেই তাই কি। বৈঠায় বহমানতা আনা যেত। একটি শুকনো পাতা তুলে জলে ছুঁড়ে দিলো। পাতাটা অনেক অনিচ্ছায় কোনোমতো নড়েচড়ে স্থির হয়ে রইল। বর্ষার দিনে কাগজের নৌকোর কথা মনে এলো। ছাদের ওপরে জল জমতো পুরু। আনন্দে ভেসে যেত নৌকো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চারপাশে তাকালো। ফিনফিনে কুয়াশার ভেতর আলো ফুটছে। পাইন পাতার আড়ালে সুগোল ধোঁয়াশা সূর্য। সরে গিয়ে সূর্য দেখতে চাইলো। কোনো পাখির গান তো ভেসে এলো না। হঠাৎ হঠাৎ গাছের ভেতর দিয়ে পত্ পত্ করে উড়ে যাওয়ার শব্দ শুনেছে। এক নতুনতর ভোর যেন এ। অভিনব সকাল। অচেনা লাগছে নিজেকে নিজের কাছে।
আনু উঠেছে কিনা ভাবতে ভাবতে দরোজা খুলল মিনু। একটুখানি হাওয়া ও আলো ঢুকল পায়ে পায়ে। দরোজা বন্ধ করতেই ভারী পর্দার ভেতর অন্ধকারের ঘূর্ণন। আলো জ্বালাতে ইচ্ছে হলো না। সোফার এককোণে, শালটা টেনে পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে রইল। বাইরের আভা ভেতরে আসবার জন্যে জানালার পর্দায় পর্দায় কাঁচের কোণে কোণে ভিড়ে আছে। ঘরের ওমভরা অন্ধকারের তখনও সাড়া নেই। মিনুর একটুখানি ঝিমুনি এলো। সোফার হাতের ওপর ধীরে মাথাটা বিছিয়ে গেল। কপালে উষ্ণ জ্বলজ্বলে হাতের স্পর্শ টের পেল। অতি উজ্জ্বল আলোকরশ্মি আনোয়ারের হাতের ওপরে জ্বলছে। আলোর প্রলেপ মিনুর কপালে বুলিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছে। চোখ খুলে হাসল মিনু। আনোয়ার আবার মুগ্ধতায় স্ত্রীর ঘুম ঘুম হাসি দেখে হারাল নিজেকে।
কখন এখানে এলে টের পাই নি তো? আনোয়ার জানতে চায়।
শুধু এখানে নয় মাই ডিয়ার আনু জানু, সকাল-হন্টন থেকে ফিরে গা এলিয়েছিলাম, তন্দ্রা এসে ঘিরে যে নিলো কখন?
কাছ থেকেই তো হেঁটে এলে, দূরে কোথাও কি যাবে?
চলো।
আজ শনিবার। দুজনেরই ছুটি। সপ্তাহে দুটো দিন—শনি, রবি ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ায় ওরা। কখনো পরিকল্পিত, কখনো এলোমেলো। আনুর ব্যাংকে চাকুরি। টেলার। কাউন্টারে বসে টাকা গুণে নেওয়া বা দেওয়া। সপ্তাহে ৫ দিন ৪০ ঘণ্টা। বাকি সময় শুধুই নিজের জন্যে। মিনু এলিমেন্টারি স্কুলে সাবস্টিটিউট টিচার। স্কুল শেষ হলেও বাসায় এসে মাঝে মাঝে খাতা-বই নিয়ে বসে। বাচ্চাদের মাঝে থেকে নিজের ঘরে ছোট-ছোট পায়ের শব্দ শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। আনুকে কতবার বলেছে। আরও কিছুকাল যাবার কথা বলে চুপ হয়ে গিয়েছে আনু। লং ড্রাইভে গেলে মা হওয়ার বিষয়টা তেমন আর মনে আসে না। আড়চোখে আনুর দিকে তাকায়। নতুন পরিচয় আর বিয়ের শুরুর দিকের দিনগুলোর ছবি থাকে চোখে।
আজ ওয়েদার বেশ ওয়ারম্ । কেইপ কডে চলো।
এই শীতের সময়ে সমুদ্রে? মিনু অবাক হয়ে হেসে চেয়ে রইল।
গ্রীষ্মের সৈকত আর ঊর্মিমালা দেখবার জন্যে সবাই আসে, আমরা না হয় শীতেও সমুদ্রের একটুখানি সঙ্গ দিলাম।
তা, মন্দ বলোনি।
ব্যর্ন ব্রিজের ওপরে উঠে গাড়ির গতি কমালো আনু। খুব সতর্ক দৃষ্টিতে দুপাশের সরু লেক দেখল। অনেক নিচের এই জলরেখা দেখলে মন উদাস হয়। মনে হয়, মন নিয়ে একমনে এই জলস্রোতে ছুটে চলেছে অজানায়। ডানে বাঁয়ে দেখবার সময় তার নেই। ব্রীজটার অর্ধবৃত্তাকার মাঝের দিকে এলে গাড়ি শূন্যে উড়ছে বলে ভুল হয়। তারপরেই চোখে আসে ঘাসের ওপরে খোদাই করা, ঈধঢ়ব ঈড়ফ । চত্বর ঘুরে আরও মিনিট কুড়ি ড্রাইভে ফ্যালমাউথ শহর। পাশেই সমুদ্র সৈকত। ওপারে গ্রীষ্ম অবকাশের বিখ্যাত দ্বীপ মার্থাস ভাইনইয়ার্ড। এখানকার অধিবাসী ছাড়া আর কেউ নেই এখন। গ্রীষ্মের প্রায় সব ভ্রমণপিপাসুরা পাড়ি দিয়েছে আপন আলয়ে। সৈকত এই শীতের বিকেলে একাকী গায়ে রোদ মেখে শুয়ে আছে। ওপারে ঝক্ ঝক্ করছে ভাইনইয়ার্ড। ঢেউগুলোরও তেমন তাড়া নেই। অতি ধীরে, তীরে এসে নিজেদেরকে মিলিয়ে দিচ্ছে বালুর ভেতরে। মিহি বাতাসে মিনুর চুল উড়ছে। মৃদু পায়ে হাঁটছে একা। আনু গাড়ি পার্ক করে আসছে। মিল রোড আর শৌর রোডের মাঝখানের এই বেলাভূমিতে ওরা দুজন ছাড়া কেউ নেই। আনু পায়ে পায়ে মিনুর প্রায় পাশে চলে এসেছে। চিবুক আর ওড়াচুল দেখছে। তরল সোনার প্রলেপ ওর চিবুকে। শ্যামল কোমল মুখশ্রীতে ঠোঁটদুটো নিখূঁত করে সাজানো। ওকে যখন প্রথম দেখেছিল, সেইদিন শুধুই ঠোঁটযুগলের ছবি অন্তরে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল। বড় বোন বলেছিল, কিরে, ‘আনু মিয়া, মেয়ে দেখে পাথর হয়ে গেলি। কালো মেয়ে দেখে চোখে অন্ধকার দেখছিস? তবে যাই বলিস, মেয়ের চোখদুটো কিন্তু আলাদা করে বানিয়ে বসিয়ে দেয়া ঠিক ভুরুর নিচে, নিখূঁত করে। আর কিছু না হোক, চোখদুটো দেখে ‘হ্যাঁ’ করে দিতে পারিস।
আনু হেসে বলেছিল, আর ঠোঁটদুটো দেখলে না বড়পা?
ওরে, বোবা ছেলে, এত করে কখন দেখলি। যাক, ঘরে তবে ডায়মন্ড আসছে, ব্লাক ডাইমন্ড।
ওকে কিন্তু শ্যামলা বলা যায় আপু। কালো থেকে একধাপ এগিয়ে, হেহে।
আচ্ছা, তুই যা বলিস, তাই। বিয়ের পরে কিন্তু রং খোলে আরও। তোর মন ভরানো এক খাঁটি খবর দিয়ে রাখলাম।
আপুর কথা ঠিকই। বিয়ের পরে মিনু যেন পরী হয়ে উঠতে লাগল। সকাল থেকে বিকেলে, বিকেল থেকে সকালে ওর সৌন্দর্য নানা রকমে দেখা দিত। সেই ভাললাগাটা এখনও আচ্ছন্ন হয়ে আছে। পাঁচ বছর পার হলেও মনে হয় পাঁচ দিনও হয়নি। মাঝে মাঝে বাচ্চা নেবার কথা বলে, কিন্তু আরও কিছুটা কাল গেলে না হয় ওসব হবে। বছর তিনেক হলো আমেরিকায় আসা। আরেকটু গুছিয়ে নেয়া যাক।
দুই
দুদিন ছুটির পর অফিসে এসে অবসাদ লাগে আনুর। যাওয়ার পথে ডানকিন ডোনাটস্ থেকে কফি নিয়ে নেয়। কফির চুমুকে চুমুকে ঘুম পালানোর কথা। কিন্তু তার উল্টোটা হয়। ঘুম, চাদরের মতো বিছিয়ে যায় শরীরে। দশটা পর্যন্ত তেমন কেউ আসে না। লো ভল্যুমে রেডিওতে গান বাজে। বসার জায়গাতে নীরব চলচ্চিত্রের মতো টিভির পর্দা পরিবর্তন হয়ে চলে। কাস্টমার ডলার জমা দিতে এলে মানি-কাউন্টিং মেশিনের ফড় ফড় আওয়াজ মৌমাছির গুঞ্জনের মতো লাগে। অন্যান্য টেলারের মধ্যে আনু আর মেরিলিন এসেছে শুধু। আরও দুজনের দেরি হচ্ছে আসতে। ম্যানেজার আর একাউন্টটেন্টরা যে যার স্বচ্ছ কাচের ভেতরের চেম্বারে বসেছে। ব্রকটনের এই শাখাটি নতুন বানানো। সিটির একপাশে অনেকখানি জায়গার ওপরে ব্যাংকের নিজের জমিতে বিল্ডিংটা। জানালার ওপাশে সারি সারি দোকানের প্লাজা। পার্কিং লট। তিন লেনের ড্রাইভ থ্রু ও এটিএম বুথের পথ। ভেতরে বাইরে অতি যত্নে গড়া সবকিছু। যন্ত্রের স্বল্প হুশ হুশ শব্দ ছাড়া ভেতরটা খুব নীরব। পাশের মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। কাস্টমার চলে গেলে আনুর দিকে তাকালো মেরিলিন।
খ্যামন আচো, অ্যানু?
ভা…লো আছি । তুমি কেমন? হেসে উত্তর দিলো। মেরিলিনকে কিছু কিছু বাংলা শিখিয়েছে। মেয়েটা সময় পেলেই সেটার চর্চা বজায় রাখতে চায়। ভালো লাগে ওর মুখে বাংলা শুনতে।
হেই অ্যানু, ইজ এলিস অফ টুডে?
নো আইডিয়া মিস মেরিলিন মনরো।
ও… সো সুইট অব ইউ। বাট আই অ্যাম নট দ্যাট বিউটিফুল।
হু ছেইড দ্যাট? ইউ আর মোর বিউটিফুল দ্যান মিস মনরো।
দ্যাটস্ এনাফ প্রেইজ ফর মি টুডে। হিহি। ইউ আর ইন এ ভেরি গুড মুড। নট স্লিপি এনি মোর ।
মেরিলিনের কথার উত্তর দিতে যাবে, এমন সময় কাউন্টারের দরোজায় কারও প্রবেশের হাওয়া ও ঘ্রাণে ফিরে তাকাল আনু। এলিস এলো। দ্রুত পায়ে হাঁটে মেয়েটা। কাজেও খুব চটপটে। মাঝে মাঝে শান্ত হাতে কাজ করে যায়। তখন আশপাশে কেউ আছে, খেয়ালও হয় না। কোণার মানি-কাউন্টিং মেশিনে নাইট-টাইম ড্রপিং ব্যাগ এনে ডলার গুনছে এলিস। উজ্জ্বল প্রলম্ব সোনালি চুল নির্ভুল বিছিয়ে আছে পিঠে। প্রায় কোমর ছুঁয়েছে। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের ওপর প্রথম সকালের সূর্য শুয়ে আছে যেন। ঢেউ ভেঙে ভেঙে জল নামছে অথৈ জলে। আর তার পরতে পরতে ভেসে যাচ্ছে রঙের আলপনা।
হাতের ডলারগুলোকে মানি-ব্যাগে ভরতে ভরতে তাকালো এলিস। চোখে চোখ পড়ল আনুর। আনু চোখ ফিরিয়ে নিতে নিতে বুঝল এলিস তখনো তাকিয়ে আছে। মৃদু হাসছে। ভরাট লম্বাটে মুখশ্রীতে হাসির সুরভী। হাসিও ঘ্রাণময় হয়!
ডু ইউ হ্যাভ এনিথিং টু ডু আফটার ফোর টুডে? কয়েনরুমে কাস্টমারের জন্য ভাংতি পয়সার রোল্ আনতে গেলে একফাঁকে এলিস এসে চাপা গলায় জানতে চাইল।
নো। ঠোঁট টিপে ক্ষণিক অবাক চোখে তাকিয়ে উত্তর দিলো।
ওয়েট ফর মি, দেন। ইন দ্য পার্কিং লট।
ওকে।
পার্কিং লটের পাশ ঘিরে সারি সারি মেপল গাছ। পাতাহীন এখন। তবু ন্যাড়া ডালেরা প্রায়-সন্ধ্যার আলো নিচ্ছে। চারটের পরপরই সূর্য ডোবে আজকাল। এত ছোট দিন! আগে আগে রাত আসে, যায় দেরিতে। এলিস একটি গাছের গায়ে হালকা হেলানে দাঁড়ানো। আনু ভারি পায়ে ধীরে হেঁটে আসছে। হাসতে চেষ্টা করলো। শুকনো ঠোঁট মুছলো জিহবা দিয়ে।
হাউ ই ডুয়িন, আনু?
ফাইন, থ্যাংক য়্যু।
ইউ সিম ভেরি নার্ভাস, হোয়াই ইজ দ্যাট?
নো, নো। আই অ্যাম ওকে।
ইউ নো, দ্যাটস্ দ্য প্রবলেম উইথ ম্যান। ক্যান-নট ছে দেয়ার ছে, প্রপারলি।
আই ডিডিন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড, হোয়াট ডু ইউ মিন?
মেরিলিন আর ব্যাংক ম্যানেজার পামেলা দুজনের দিকে ‘হাই’ বলে নিজেদের কারের দিকে গেলো। আনু আর এলিস একটু সরে গিয়ে পাশের ঘাসের ওপর দাঁড়ালো। সারাদিন হাঁটাহাঁটির পর ঘাসের নরমে পা ডুবিয়ে দাঁড়াতে ভালো লাগছে দুজনের। এলিসের হঠাৎ এমন কথার বাণে অস্থির লাগছে আনুর। এক বছর হয়েছে কাজ করছে সিটিজেন ব্যাংকে। আনুর জয়েনের পরপরই ও এসেছিল। ভাল কলিগ হিসেবে জানে এলিসকে।
অ্যানু?
ইয়া।
ডু ইউ লাভ মি?
আনুর চোখ ঝোড়ো বাতাসে ঘোমটার মতো খুলে গেল। পলকহীন তাকিয়ে রইল এলিসের দিকে। কোনোরকমে বলল, হোয়াট আর ইউ টকিং এবাউট?
ইউ নো ভেরি ওয়েল, হোয়াট অ্যাম আই টকিং এবাউট?
নো, নো। ইউ নো আই হ্যাভ এ ভেরি নাইস এ-বিউটিফুল ওয়াইফ।
ইউ মাইট হাভ। বাট ইয়োর আইজ ডোন্ট রিমেমবার দ্যাট, হোয়েন ইউ লুক অ্যাট মি। আই রিয়েলাইজ দেয়ার অ্যাপিল। ইয়েস, অ্যাপিল। ইন দ্য ইনারমোস্ট কর্নার অব ইয়োর হার্ট, ইউ সি ইয়োর ওয়াইফ ওয়াচিং ইউ। বাট আপ হিয়ার, ইন ইয়োর আইজ অনলি ক্যান সি মি। ইউ নো, লাভ ইজ এ বেগার, এ শেইমলেস সান অব এ গান্ । ইউ ক্যাননট ইগনোর ইট, নো ম্যাটার হাউ মাচ ইউ ট্রাই। ইউ মাস্ট লিসেন টু ইট, অ্যাট সাম পয়েন্ট। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু ডিসাপপয়েন্ট ইউ। আই ওয়ান্ট টু সি ইউ হ্যাপি।… টক্ টুই উই লেইটার, ডিয়ার। বাই।
আনু থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এলিস পেছনে না তাকিয়ে ওর কার স্টার্ট দিলো। মুহূর্তে বেলমন্ট স্ট্রিটের দিকে ছুটে চলল।
পরের দিন অফিস শেষে এলিস একরকম হাত ধরেই প্যানেরা ব্রেড-এ নিয়ে এলো আনুকে। নানারকম পাউরুটির প্রাধান্য এই রেস্টুরেন্টটিতে। ওভেন থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসা ধোঁয়া-ওড়া ঘ্রাণভরপুর ব্রেডে আধাপেট ভোজন হয়ে যায়।
আই লাইক দিস রেস্টুরেন্ট, অ্যানু। উইথ দ্য ফ্রেশ স্মেইল অব ব্রেড ইউ উড নট ইভেন স্লিপ টুনাইট। হিহি। ও , বাই দ্য ওয়ে, কুড ইউ স্লিপ লাস্ট নাইট?’
শুকনো হেসে জানালা দিয়ে পাশের ছোট্ট বনটার দিকে তাকালো আনু। বাসার পাশের বনের মতোই দেখতে। মনে পড়লো, কাল রাতের ঘুমন্ত মিনুকে। আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল ও। বহুক্ষণ জেগেও, টিভি দেখেও, বই পড়েও ঘুম আনতে পারেনি। শিয়রের টেবিল ল্যাম্পের আলোয় দেখছিল মিনুকে। সেই মুখ, একটি মুহূর্তের জন্যও যা পুরনো হয়নি। সেই ঠোঁট, কপাল, চিবুক, ঢেউদোলা কালো চুল। ওহ, নিজেকে বরফ-জলে ডুবিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়েছিল। ভেবেছিল, খুব ঠাণ্ডা একটা শাওয়ার নেয়। কিন্তু শীতের রাতে, অকারণে স্নান করা কেমন হবে! ভাবতে ভাবতে মিনুর পাশে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
ইউ নো, অ্যানু। ইয়োর লাভ ফর মি ইজ ভেরি ডিপ। দ্যাটস্ হোয়াই ইউ ক্যাননট ছে এনিতিং। ’
আনু অবাক বালকের মতো দেখছে এলিসকে। এতদিনের একসঙ্গে কাজ করা স্বল্পবাক এই কি সেই মেয়ে। মানুষও জীবন্ত-ঘুমন্ত অগ্নিগিরি হয়!
ইউ ছেইড, ইয়োর ওয়াইফ ইজ ভেরি বিউটিফুল। আই এগ্রি, শি ইজ। বাট, ইউ নো হোয়াট? ছাম গার্লস ডোন্ট নো, হাউ টু মেইক লাভ। দে মাইট লাভ দেয়ার হাজবেন্ডস, দে ক্যান মেইক দ্য বেড বিউটিফুল, বাট দে ডোন্ট নো হোয়াট টু ডু টু দেম ইন বেডস্, একসেপ্ট লায়িং ডাউন প্যাসিভ্লি।
বিছানায় ভালোবাসা কত রকম হয়, এলিস তা বুঝিয়েছে। গত তিন বছরের মুহূর্তগুলো তিন সপ্তাহ বলে মনে হয়। এক অনিবার্য বন্যায় ভেসে আছে আনু। সেদিন এলিস বলে গিয়েছিল অনর্গল। ওর কথার বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করবার ক্ষমতা ছিল না। নিঃশব্দে পিছু নিয়েছিল। সেই কথাটা গভীর ঘুমের ঘোরেও কানে বাজে। আমি তোমাকে তিন বছরের জন্য ভালোবাসব, অ্যানু। এই সময়ের জন্য আমি একমাত্র তোমার। তুমি যেমন করে যখন চাও পাবে আমাকে। এলিসের এক বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টে যখন গিয়েছে, মনে হয়েছে এ এক অন্য জগত। গল্পে গল্পে বলেছে, ও অরেগন অঙ্গরাজ্য থেকে এসেছে। ছবির মতো দেখতে অরেগনের পাহাড়ে তুষার জমে থাকে। আকাশে মেঘেরা বেশিক্ষণ সাঁতরাতে পারে না। একটু পর পর রোদের ভেতরও বৃষ্টি হয়ে নামে। বোস্টন থেকে বহুদূর হলেও আবহাওয়ায় বেশ মিল আছে। মা মারা যাবার পর পুরনো ওই বাড়িটাতে আর মন টিকলো না ওর। চলে এলো এক দূর সম্পর্কের আন্টের প্রতিবেশি হয়ে।
এদেশে, বাড়ির দরোজা বন্ধ করলে অন্দরে নিজস্ব পৃথিবী। সবাই যে যার মতো। অফিসের পরে কিংবা কোনো ছলে উইকএন্ডে এলিসের সঙ্গ নিয়েছে আনু। শরীর শুধু নয়, সব রকম মায়ায় ভরিয়ে দিয়েছে এই মেয়ে। মুখভরে আগুনরঙের ঠোঁট নিয়ে মনে হয়েছে, কমলার রস কখনও তো শেষ হয়, এই অধরের নয়। মনে মনে মিনুর অধর এলিসের মুখে বসিয়ে নিতো। এলিসের মোমের শরীরে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েও, সাম্পানের মতো দুলে দুলেও মনে হতো এ যেন, ইস্ট রিভার নয়, এ আমাদের মধুমতী। একদিন অনেক ভালোবাসা শেষে ক্লান্ত আনু ঘুমিয়ে পড়েছিল। স্বপ্নে দেখল দুটো নদী, পাশাপাশি। একটির জল দুধসাদা। প্রশান্ত, স্নিগ্ধ। অপরটির জল অত্যন্ত অন্ধকার। খুব উচ্ছ্বল। কিন্তু এই কালো নদীটার দুই তীরে দুটো সাদা আলোর রেখা। সেই আলোয় পাশাপাশি শুয়ে আছে দু্টো নগ্ন নারী। এলিস ও মিনু। নদীর দিকে হেঁটে যেতে যেতে এলিসের ডাকে ঘুম ভাঙল।
ইউ রিমেমবার, দিস নভেম্বর, আওয়ার লাভ ইজ গোয়িং টু বি এনডেড। ফ্রম নেক্সট মানথ্, উই আর নট স্লিপিং উয়িদ ইচ আদার এনিমোর।
আনুর মাথায় কিছুই ঢুকছে না। প্রথমে মনে করেছিল, এলিস মজা করছে। এখন ওর কথা শুনে মনে হচ্ছে ও মোটেই মজা করে বলছে না। জীবনভরের ভালোবাসার মূল্য ওর কাছে নেই। নানাভাবে ব্যথিত মুখে ক্ষণিক ভালোবাসার কথা বলেছে। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো গল্প আছে যা ও বলেনি, আর আনুও জানতে চায়নি।
এবছর ডিসেম্বরের শুরুতেই প্রথম বরফ পড়ল আজ। ইঞ্চি চারেক। আনু বাসায় আসার আগেই শাবল দিয়ে তুষার পরিষ্কার করে রক-সল্ট ছিটিয়ে রেখেছে মিনু। বেডরুমের আলো নিভিয়ে লিভিংরুমে বসে গায়ে চাদর জড়িয়ে টিভি দেখছে। চ্যানেল পরিবর্তন করছে দ্রুত। নিউজ চ্যানেল থেকে মুভি, মুভি থেকে হিস্টরি, হিস্টরি থেকে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে এসে চোখ থামল। কেনিয়ার প্রকৃতি দেখাচ্ছে। দুর্গম বনভূমি, বিস্তৃত পশুচারণ ক্ষেত্র। দিগন্তের প্রান্ত পর্যন্ত আলোরেখায় চরে বেড়ানো পশুর পাল। বেশ সাউন্ড দিয়ে দেখছে। কয়েকটি মহিষ-শিশু পিছে পড়ে গিয়েছিল, হঠাৎ খেয়াল হওয়ায় মায়ের দিকে দলবেঁধে পড়িমরি করে ছুটে চলেছে। ওদের পড়ে আবার তখনই উঠে দৌঁড় দেবার ভঙ্গিতে হাসল মিনু। আনু দরোজা খুলে ভেতরে ঢুকল।
বাহ বেশ খুশি যে এখন? কি, কোনো মজার দৃশ্য?
হ্যাঁ, খুবই মজার। আরও মজার খবর আছে।
তাই? শিগগিরই বলো। তুষারমাখা জুতো দরোজার বাইরে ঝাড়তে ঝাড়তে বলল আনু।
আগে বিশ্রাম নাও, খাওয়া দাওয়া করো। আয়েস করে বলি। ডাইনিং টেবিলে খাবার রেডি আছে।
তুমিও এসো।
না, আমি আজ আগেই খেয়ে নিয়েছি। ক্ষিদে পেয়েছিল খুব।
বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আনু বলল, ও।
মিনুর ভেতর কোনো ভাবান্তর নেই। একমনে টিভি দেখছে। আনু পাশে এসে বসলে ফিরে তাকালো।
আনু।
হু।
‘কেমন আছ তুমি?
কেমন আছি মানে? ভালো আছি।
আমিও চাই তুমি ভালো থাকো।
গত কয়েক বছর ধরে তুমি শত চেষ্টা করেও আগের মতো ভালো থাকতে পারোনি। তোমার চোখে মুখে শরীরে অন্য জগতের ভাষা লেখা থাকতো। যে ভাষাটা তোমারও অজানা ছিল। তাই ভাবতে, অন্য কেউ, বিশেষ করে আমিও পড়তে পারবো না তা। তবু তোমার শরীরে মিশেছি। তোমার আনমনা মিলনে আমি মা হতে চলেছি। মাস কয়েক হলো।
আনু খুব খুশি হওযার ভঙ্গি করে বলল, তাই নাকি, আমাদের বাবু তাহলে আসছে শেষমেষ। ও থ্যাংক য়্যু, থ্যাংক য়্যু মাই লাভ, মাদার অব মাই চাইল্ড।
তোমার এত উদ্বেলিত হওযার প্রয়োজন নেই। আর তোমার লাভ কে, তা তুমিই ভালো জানো।
মানে? আনুর চোখ বিস্ফারিত।
মেয়েদের সিক্সথ সেনস্ নয়, ছয় হাজার সেনস্ আছে, তা জানো?
তোমার প্রথম দিককার ব্যাপার আমি ইগনোর করবার চেষ্টা করেছিলাম, ভেবেছিলাম, ও কিছু নয়। মন তো সব সময় একরকম থাকে না। হয়ত অন্য কোনো চিন্তায় তোমার এই অন্যমনস্কতা। কিন্তু না। বুঝেও অপেক্ষায় থেকেছি তোমার ফেরার।
আমি ফিরে এসেছি মিনু। তুমি ছাড়া এখন আর আমার ভেতর কেউই নেই। আর বাবুর দিকে তাকিয়ে আমাকে ক্ষমা করে দাও।
ক্ষমা? ক্ষমা সবখানে হয় না। শেষবারের মতো আমি শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম। একদিন মিলনের সময় তোমার গলার কাছ থেকে একটি সোনালি চুল আমার মুখে এসে পড়ল। তোমার শরীরে ছিল অন্য নারীর ঘ্রাণ। সেই গন্ধ পিষে মিশিয়ে দিচ্ছিলে আমার ভেতর। ঘৃণায় তোমার ওই মুখে থুথু দিয়ে ইচ্ছে হয়েছিল তখনই। মনে হয়েছিল আমি তলিয়ে যাচ্ছি। তলিয়ে যাচ্ছি আলকাতরার তলে। আর কখনো ভেসে উঠব না। তবে কি জানো, আমার জন্য বাড়ির কাছে ওই স্নিগ্ধ কালো নদীটাই ভালো। ওর নির্জনতা আর সজীবতা আমার আর আমার বাবুর জন্যে যথেষ্ট। কাল থেকে তোমার আর আমার পথ ভিন্ন ।