কিছু কিছু সিনেমা দেখলে হয়তো দর্শকেরা নিজেরাই অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যান । বাহ্যিক জীবনচারণের ঊর্ধ্বে উঠে যখন মানুষ তাড়িত হয় ইন্দ্রিয় অনুভূতির দ্বারা, তখন হয়তো বস্তুগত জীবন থেকে মনস্তাত্বিক বিষয়টি হয়ে ওঠে তার প্রাত্যহিক জীবনের প্রধান অবলম্বন। যাকে ছুঁতে পারে না আশপাশের দৃশ্যমান বিষয়গুলো।
‘পারফিউম: দ্য স্টোরি অব অ্যা মার্ডারার’ একটি প্রখর ইন্দ্রিয় অনুভূতির গল্প। জার্মান লেখক প্যাট্রিক সাসকাইন্ডের বিখ্যাত উপন্যাস ‘পারফিউম’, অবলম্বনে মুভিটি নির্মাণ করেছেন পরিচালক টম টাইকার। এ গল্প জ্য ব্যাপ্টিস্ট গ্রানুইলিরকে ঘিরে। যাকে একদিকে যেমন বলা যায় প্রকৃতির বরপুত্র, আবার একজন ভাগ্যাহত মানুষও বলা যায়।আর সিনেমার দৃশ্যপটে একজন সিরিয়ার কিলার। প্যারিসের এক মাছ বাজারে জন্ম নেওয়া গ্রানুইলিকে তার মা ফেলে রেখে যান তার আগের সন্তানদের মতো। ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে যান। মৃত প্রায় যে শিশুটি প্রথম নিশ্বাস নিয়েছিল আশপাশের আঁশটে ঘ্রাণ নিয়ে, তাকে তো প্রকৃতি এত সহজে তুলে নিয়ে যেতে পারে না।
একবার ভাবুন তো পথ দিয়ে চলার সময় কাছে–দূরের প্রতিটি বস্তুর ঘ্রাণ আলাদাভাবে অনুভব করছেন কি না আপনি। বিষয়টি ভাবতে নিজের কাছেই অস্বস্তি লাগতে পারে। আর এমনই এক বিরল বৈশিষ্ট্য নিয়ে গ্রানুইলির জন্ম।
সুগন্ধীর রাজধানী ফ্রান্সের আঠারো শতকের এক ভিন্নধর্মী চিত্র তুলে ধরা হয়েছে সিনেমাটিতে। সুগন্ধীর জন্য প্যারিস বিখ্যাত আদি কাল থেকে। যেখানে প্রতিনিয়ত হাজারো রসায়নের সমীকরণে তৈরি হচ্ছে বিচিত্র সুগন্ধী। বস্তুত এ জীবনে প্রতিটি জিনিসের যে আলাদা অস্তিত্ব আছে, তা অনেক সময়ই নির্ণয় হয় ঘ্রাণশক্তির গুণেই। তবে তা বোঝার মতো তীক্ষ্ম এবং অসামান্য দক্ষতা ক জনেরই বা আছে। আর সিনেমাটির প্রধান চরিত্র গ্রানুইলিই সে ব্যক্তি, যে ভূমিষ্ঠ হয়েছে সে বিশেষ দক্ষতা নিয়ে।
আশ্রমে বড় হওয়া গ্রানুইলিকে বিক্রি করে দেওয়া হয় একজন চামড়া ব্যবসায়ীর কাছে। চামড়ার কাচা গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে যখন তার প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত, তখন দূরের প্যারিসের হাতছানি আর ভেসে আসা গন্ধই গ্রানাইলের বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে ওঠে। মালিকের হাত ধরে একদিন মূল শহরে পা রেখে গ্রানুইল হারিয়ে যায় হাজার প্রাণের ভিড়ে। আর আবিষ্কার করে নিজের এ গুণটির। তার মূল আকর্ষণ নারী দেহের ঘ্রাণ। আর সে অনুভূতিকে অবলম্বন করে খুঁজতে শুরু করে জীবনের লক্ষ্য।
সে সূত্রে ইতালি থেকে আসা গন্ধবণিক গুসেপ্পি বালদিনির কাছে দিক্ষা নেওয়া শুরু করেন গ্রানুইলি। তবে বলে রাখা ভালো গ্রাণুইল জন্মসূত্রে কিছুটা অশুভ চরিত্রের অধিকারী। আর তা না হলে জন ব্যাপ্টিস্ট রেনোয়া (মুভির ব্যাকগ্রাউন্ডের ভাষায়, হি ও’জ নো-বডি।) তাকে জন্ম দিয়ে ফেলে যাওয়ার অপরাধে তার মা’কে কেন ঝুলতে হয় ফাঁসিকাষ্ঠে। এতিমখানায় সে যার হাত ধরে বড় হয়েছিল, সেই নারীও খুন হন ছিনতাইকারীদের হাতে। যে কারখানায় সে প্রথম জীবনে কাজ করতো, কারখানা মালিক তাকে বিক্রি করে দেওয়ার পরপরই গাড়ির ধাক্কায় পানিতে ডুবে মারা পড়েন কেন তিনি। আর পারফিউম প্রস্তুতকারক গুসেপ্পি বালদিনির কে ছেড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সেই লোকের বাড়িই ধ্বসে পড়ে কেন সিন নদীর ওপর।
ফিরে আসি রেনোয়ার গল্পে। প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানের ঘ্রাণ শুঁকতে পারা রেনোর ছিল না নিজের কোনো ঘ্রাণ। আর এ ঘ্রাণ না থাকার অনুভূতি তাকে আরো হিংস্র করে তোলে নিজের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির লক্ষ্যে পৌঁছতে। তার লক্ষ্য একটাই । সে এমন একটি সুগন্ধী তৈরি করবে, যা হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পারফিউম। সেটা সে নিজের গায়ে মাখবে, সেটা হবে তার নিজের গন্ধ। তার শরীরেরও ঘ্রাণ আছে, এটাই সে দেখাতে চেয়েছিল পৃথিবীকে।
গুসেপ্পির কাছ থেকে রেনোয়া শিখেছিল কিভাবে উপাদান থেকে ঘ্রাণ সংগ্রহ করতে হয়। শর্তসাপেক্ষে জানিয়ে দেয় কিভাবে তেরো ধরনের গন্ধ সংরক্ষণ করতে হয়। আর তা থেকে কিভাবে সম্ভব আসল সুগন্ধী তৈরি।
জরাজীর্ণ আর দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের কাছে দাঁড়িয়ে পুরো বোতল ঢেলে দেয় নিজের শরীরে। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও, সে ঘ্রাণে দারিদ্র্যে ওষ্ঠাগত প্রাণ নিয়ে প্যারিসবাসী খুঁজে পায় এক ভিন্ন অনুভূতি। আর সেই সময় সব নারী-পুরুষ আর সেই সুগন্ধীর মধ্যেই মিশে যায় গ্রানুইলি, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুগন্ধী প্রস্তুতকারক।
কিন্তু্ আগেই বলেছি রেনোয়ার সুগন্ধী তৈরির উপাদান হিসেবে বেছে নিয়েছিল নারী দেহের অজানা এক রহস্য ঘেরা ঘ্রাণ। কিন্তু, তা সংরক্ষণের উপায় কী? গুসেপ্পি বালদিনির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেনোয়া যাত্রা শুরু করে গ্রাসের পথে। যেখানে তৈরি হয় পৃথিবীর বিখ্যাত সব সুগন্ধী। আর বিশাল ফুলের বাগানগুলোও সেখানে।
সেখানে সে একটি সুগন্ধী তৈরির খামারে শুরু করে কাজ। আর ঘুরে ফিরে খুঁজতে থাকে তার পছন্দের ঘ্রাণ। যেটি সে সংগ্রহ করবে তার নিজস্ব সুগন্ধী সৃষ্টির জন্য। এভাবে নারীদের ঘ্রাণের মাদকতা নিয়ে একে একে নীরবে তাদের হত্যা করে। তাদের শরীর থেকে বিশেষভাবে গলিত মোম দিয়ে ঘ্রাণ সংগ্রহ করে তা ভরতে থাকে তার ১৩টি সুগন্ধি সংগ্রহের ছোট বোতলে। ওদিকে শহরময় পড়ে যায় ভয়ঙ্কর এই খুনির তল্লাশি।
তবে যাদের সুগন্ধীর ওপর বিশেষভাবে আকর্ষণ আছে, তারা জানতে পারবেন সুগন্ধি তৈরির মাধ্যম সম্পর্কে। সিনেমার শেষ অংশে দেখা যায়, ধারাবাহিক হত্যার শেষ পর্যায়ে প্রয়োজন মাত্র আর একটি হত্যা। তাহলেই সে জোগাড় করে ফেলতে পারবে, তার সেই পারফিউম তৈরির সকল উপকরণ।এ সময় সে বেছে নেয় ধনাঢ্য বাবা অ্যান্টোনিও রিচির একটু বেশি আদরের মেয়ে লরাকে। লরার শরীর থেকে সংগ্রহ করা উপাদান দিয়ে সম্পন্ন করা হয় মিশন। কিন্তু, সম্পন্নের পরপরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে রেনোয়ার। কিন্তু এরই মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে সেই মোহনীয় শ্রেষ্ঠ সুগন্ধী।
এদিকে, ধরা পড়ে যাওয়া গ্রানুইলিকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। সারা শহর থেকে নারী-পুরুষ জমায়েত হয় তাকে হত্যার মঞ্চের কাছাকাছি। আর বীরের বেশে মঞ্চে নিজের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি নিয়ে উপস্থিত হয় গ্রানুইলি। মুহূর্তেই মাতিয়ে দেয় সবাইকে। সবাইকে ক্ষণিকের জন্য মোহময় করে পালিয়ে যায় গ্রানুইল। ফিরে আসে জন্মস্থানে। জরাজীর্ণ আর দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের কাছে দাঁড়িয়ে পুরো বোতল ঢেলে দেয় নিজের শরীরে। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও, সে ঘ্রাণে দারিদ্র্যে ওষ্ঠাগত প্রাণ নিয়ে প্যারিসবাসী খুঁজে পায় এক ভিন্ন অনুভূতি। আর সেই সময় সব নারী-পুরুষ আর সেই সুগন্ধীর মধ্যেই মিশে যায় গ্রানুইলি, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুগন্ধী প্রস্তুতকারক।
পরিচালক টম টাইকার এর আগে একবার বিশ্বকে জানান দিয়েছিলেন তার ‘রান লোলা রান’ মুভির মাধ্যমে। আর পারফিউম মুভির মাধ্যমে যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন সময় এবং স্থানের বাস্তবসম্মত উপস্থাপনে। ২০০৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ মুভিটি তৎকালীন ব্যয়বহুল জার্মান সিনেমাগুলোর একটি। অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ৫২০০ জন এক্সট্রা, ১০২টি বিশাল সেট, আর ৫২০ জন টেকনিশিয়ান কাজ করেছে মুভিটির নির্মাণে। আর লোকেশন নির্বাচনে ইউরোপের আটটি দেশ ঘুরেছেন নির্মাতা। সে কারণেই হয়তো ১৪৭ মিনিটের এই মুভিটি ১২টি পুরস্কার জিতে নিয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে!