একটু একটু করে
একটু একটু করে মানুষ আমাকে মনে রাখুক।
খোলা মাঠে, আড্ডায়—তৃষ্ণার চেয়ে
চায়ের উষ্ণতা বেশি মগ্ন করে।
একটু একটু করে উষ্ণতা শেকড় মেলে।
একটু একটু করে মানুষ
আমাকে মনে রাখুক।
দুহাতে চেপে পেয়ালার
উষ্ণতায় ভরে তুলুক।
পুরনো স্মৃতিতে কিছু না কিছু
ফেলে আসি। ভাবি, এইসব স্মৃতিচিহ্নে
মানুষ আমাকে জানুক।
আমাকে মনে আছে
দ্বিধা আর দ্বন্দ্বে আমাকে রেখে
রাজহংসীর মতো নীলিমাকে পেছনে ফেলে
হেলে দুলে অদ্ভুত এক স্বপ্নসীমার
সন্ধানে; আর কখনোই ধরতে না পারা
দূরত্বে—ঠিক ঠিক শান্তির আবাসে দিয়েছ উড়াল।
নদী যেমন—জেগে থাকে, বয়ে চলে,
মাকড়শার জালের মতো অদ্ভুত রহস্যময়তায়
সাজায় সংসার। মায়া নেই, ভালোবাসা নেই,
পিছু টান নেই—যে যেখানে আছে, থাকুক,
মিলন আকাঙ্ক্ষায় ভেঙেচুরে ভীরু মানুষের
মন—খেয়ালি হাতের মুঠোয় চুরমার হয়ে যায়।
ভুলগ্রামে, জাদুকরী প্রভাবে যথারীতি
বয়ে যাচ্ছে রাত্রিদিন। এমন সঘন অন্তরঙ্গ
শ্রাবণে-আমাকে মনে পড়ে? মনে আছে?
প্রবাস
মুকুরে প্রতিফলিত মুখ কখনো সত্য বলে না
তবু সেই সত্যে আস্থা রাখি বারবার।
সীমান্তঘেঁষা শরণার্থী শিবিরের দূর ভূমি থেকে অস্পষ্ট
নিভু নিভু আলোররেখার দেখানো পথে
চৈত্রের হঠাৎ দমকা হাওয়ায়
গাছের পাতায় লিখে রাখা প্রিয় মুখ
ঝরে যায়, শিবিরে হুটোপুটি করা শিশুর সরল চোখে
দুপুরের আলস্য ভেঙে নামগুলো মাথা গাঁথে।
কোনো দুঃসংবাদ নয়, বরং প্রতিদিন ডানাগজানো ঘুড়ি ওড়ে
মুকুরে প্রতিফলিত মিথ্যে মুখের মতো, বদ্ধ কুঠুরিতে।
পুরীর সমুদ্র দেখিনি
পুরীর সমুদ্র দেখিনি, দেখেছো তুমি—
সে নাকি সুন্দর, পোষ মানা, তার খাঁপখোলা
রূপ, জীবনজোয়ার, প্রান্তর, বেলাভূমি, নুড়ি—
ক্রয়মতা থাকলে আর কাউকে দিতে না।
দিগন্তছায়া, পথের পাশের কচিপাতা, বারেবারে কার্পেটিং
হতে হতে লুপ্তপ্রায় আলপথ—সব নির্ভুলভাবে
বলে দিতে পারো। তাই যেকোনো সমুদ্রের কাছে
স্মৃতির ক্যানভাসে জড়িয়ে যায় পুরীর উপমা।
প্রত্নতাত্ত্বিক হারানো নগরের কাছে এলে
জীবনবদলানোর যে দমকা বেগুনী শিখা
বিচ্ছিন্ন করে রাখে মন
তাকে কোন পরিখায় আটকাবে?
বুকের মধ্যে বয়ে চলা যে সর্বশক্তিমান সমুদ্র
নির্ভুল গর্জনে, তপ্তবালুতে আছড়ে ফেলে ঢেউ
তাও ঠিক ঠিক গুনতে পারো অভিজ্ঞ আম্পায়ারের মতো।
আমি মুগ্ধ, দীর্ঘমায়ায় তোমার সমুদ্র মেলানো উপমায়।
স্থিরতা কি কারও ধাঁচে থাকে
দেখা হলে কি হতো, কি হতে পারতো
তা-কি কেউ বলতে পারে? দূর থেকে ভেসে আসা
মাতাল সঙ্গীতের মতো কল্পনার পাখা গতিপ্রগতিতে
বুঝি চিরকাল এমনিভাবে পূজারীর সম্মুখে
বারবার ভেঙে ভেঙে নিজেকে ঢেউয়ের মতো
দোলাতে দোলাতে মিলিয়ে দিতে চায়।
গোপন বাসনা কখনো প্রকাশ্য বেদনা হয়ে
উঠে আসে না, বরং জীবনের সীমা থেকে যে
রঙ কখনো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে না, তাকে
ক্রমে ক্রমে দখলের মন্ত্র শিখিয়ে তৃপ্তিবিহীন
এক তৃষ্ণার সাগরে ডুবিয়ে দিতে হয়।
যুগে যুগে এই অশ্লীল বিকারগ্রস্ত পালতোলা
নৌকা যার নাম কেউ ভোলে না কখনো, জীবনের
সমস্ত কল্লোল মিশিয়ে দিতে থাকে
মনেপ্রাণে, গাঢ় হয়ে আসা কল্পনার ডানায়।
তাকে আজ কি দিয়ে বাঁধি? কোন যতিচিহ্নে?
সেই দুরন্ত স্রোতে, বুকের ধুকধুকানি
বলো ভালোবাসি, বলো বউ, বলো নোনা স্বাদ
চিরকাল ঘুমহীন মুখের আঁশটে, অপাঠ্য ঘ্রাণ,
বলো মৃদু পায়ে উঠে আসা ভয়ের চাহনি মাখা
গোপন কাঁপন, বলো ঘামের স্পর্শমাখা কবিতা,
স্থিরতা কি কারও ধাঁচে থাকে? বলো?