স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা কবিতার ইতিহাসে সম্পূর্ণ নতুন এক বাঁকের নাম কবি আবু হাসান শাহরিয়ার। যিনি ঐতিহ্যকে আশ্রয় করে কবিতাকে মেহেদিপাতার মতো কোমল ও নান্দনিক করে তোলেন। ‘কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয়’ তাঁর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। ইতঃপূর্বে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের পর কেটে গেছে তাঁর দীর্ঘ আট বছর। এরপরই এবার প্রকাশিত হলো এই কবিতার বই। বাংলার কবিতা জগতে এটি একটি নতুন সংযোজন।
কবির কাজ কী? তিনি ঠিকই জানেন। ‘শব্দ’ কবিতায় কবি শব্দের মহাত্ম্য তুলে ধরেছেন। শব্দের নতুন ব্যঞ্জনা এনে চেনা-জানা ভূগোলে তিনি কবিতাকে দিয়েছেন জয়ী হওয়ার শক্তি। অমিল পঙ্ক্তিতে চলতে চলতে শেষ দুটি লাইনে অন্ত্যমিল তাঁরই আবিষ্কার। বাংলা কবিতায় নতুন সংযোজন। একইসঙ্গে পাঠক প্রিয় কৌশলও। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক—
‘এক পলকের বেশি দেখাই হলো না পৃথিবীকে। উঠান ছাড়িয়ে আজও প্রান্তরের ডাকে সাড়া দেওয়াই হলো না। মহাজীবনের পাঠে প্রথম পৃষ্ঠায় পড়ে আছি। কীটের খোলস ছেড়ে কবে আর প্রজাপতি হব? অপূর্ণই থেকে গেল ডানা-ডানা পাখির উড়াল। অপচয় ক্ষয়ে গেল বারো আনা পুঁজি। বাকি চার আনায় কেন নদীটিকে নর্দমায় খুঁজি?’
(জীবনদূষণ)
পুরো কবিতায় কোনো অন্ত্যমিল নেই। কিন্তু শেষ দুই পঙ্ক্তিতে হঠাৎই অন্ত্যমিল। এটি পুরো কবিতাটি পাঠের একঘেয়েমি দূর করে, নতুন রস সৃষ্টি করে। এতে পাঠক প্রথমে চমকে ওঠেন, শেষে কবিতাটি দ্বিতীয়বার পাঠের আগ্রহ অনুভব করেন। আর বিষয় হিসেবে কবির পাঠক মাত্রই জানেন, তিনি অধিবিদ্যার কবি তার ভাঁড়ারে অবিদ্যা নেই। কি স্বচ্ছ সাবলীল ভাষায় তিনি লিখলেন- ‘এক পলকের বেশি দেখা হলো না পৃথিবীকে’। ‘জীবন দূষণ’ কবিতায় তার বিনয়ী জিজ্ঞাসাই তাঁকে মহৎ কবিদের কাতারে দাঁড় করিয়ে দেয়। তিনি যেভাবে প্রকৃতি ও অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে কবিতায় দর্শন তুলে ধরেন, অভানীয়; অভূতপূর্ব।
বলেছিলাম কবির কাজ কী? কবির কাজ হলো শব্দকে নিজের মর্জিমাফিক বাজিয়ে দেখা। কবির কাছে এই শব্দ বেহালার মতোই। তা-ই তিনি বাজিয়ে দেখান, তাতেই তিনি সুর তোলেন। ‘শব্দ’ কবিতায় এ বিষয়টি পুরোপুরি বর্ণনা করেছেন কবি। বলেছেন-
কবির বেহালা শব্দ, শব্দই কবির বেহালা
ঢেউ-ঢেউ নদী তার ধ্বনি
শব্দকে বাজবে নদী কথা বলে; রূপসী রাত্রিরা খোলে মুখ
শব্দকে কাঁদালে কাদে ডাকাতিয়া বিলের ডাহুকশব্দই কবির প্রেম সে ঢোকে নিঃশব্দ পায়ে মনে
শব্দের ডুবুরি কবি; শব্দে বাঁচে ডুব-সন্তরণে
(শব্দ)
এ কবি চিন্তা ও কল্পনায় উত্তরাধুনিক। তিনি কাবিতায় তুলে ধরেন প্রান্তিক জনপদের সুখ-দুঃখের জীবনধারা। তার কবিতার বিষয় বিচিত্র। বিচিত্র তাঁর অভিজ্ঞতা। উল্লিখিত কবিতায় চিত্রকল্পের ভেতর দিয়ে তিনি নদীতীরবর্তী জনপদের হাহাকার তুলে ধরেছেন। তিনি শুধু কারণ শনাক্ত করেননি, কারণসৃষ্ট ক্ষতিটাও তুলে ধরেছেন। যেভাবে মানুষের হাতে মাঠ-বন উজাড় হচ্ছে, সেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে তক্ষক শুশুক শেয়াল। কবি প্রকৃতিপ্রেমিক। গাছ-নদী-মানুষ সবই তাঁর বিষয়। ফলে কোনো অনিয়ম-অন্যায় তাঁর চোখ এডিয়ে যায় না। তিনি তা তুলে ধরেন। বলেন-
ঘাস নেই কাঁদে: মাঠ
ঢেউ নেই মজে: নদী
গাছ নেই খাঁ খাঁ: বনমাঠ-নদী -বন কেউ নেই যথারীতি
তক্ষক করুণ স্বরে ডাকে
শুশুক করুণ স্বরে ডাকে
শেয়াল করুণ স্বরে ডাকে
(বিনাশ)
মানুষ সামাজিক জীব। কবিও এর ব্যতিক্রম নন। মানুষের কোল ঘেঁষে কবির বেড়ে ওঠা। মানুষই কবির কবিতার প্রধান বিষয়। কবি এখানে নানা বিষয়ের আশ্রয়ে সত্যকে তুলে ধরেছেন। কবির তৃতীয় চোখ বা উপলব্ধির ছোখ খুব প্রখর। ফলে মানুষের বেঈমানি তার চোখ এড়িয়ে যায় না। একথা অনেকেই জানেন, মানুষ বিশ্বাসঘাতক, কবি লিখেছেন আশ্বাসঘাতক। তাঁর মতে,
আবারও আসবে বলে সূর্যের রোজই অস্ত যাওয়া। সূর্য কথা রাখে। ঢেউ-
ঢেউ নদী কথা রাখে । ‘ফের দেখা হবে’ বলে কোকিলও ফিরে
আসে। একবার চলে গেলে মানূষ ফেরে না। কথা দিয়ে কথা সে রাখে
না। মানুষের ডাকনাম- আশ্বাসঘাতক।
(আশ্বাসঘাতক)
এই যে বিশ্বাসঘাতক রূপান্তরিত হলে আশ্বাসঘাতকে পরিণত হলো, এটিই শব্দের নতুনত্ব, নতুন ব্যঞ্জনা। এ বৈশিষ্ট্যই কবিকে পাঠকপ্রিয় করে তোলে।
আবু হাসান শাহরিয়ার লিখেছেন, ‘মানূষ ছাড়াও এই পৃথিবীতে কত কি সুন্দর জেগে আছে, কত কি বিস্ময় জেগে আছে’। কবি খুবই আশাহত মানুষের হিংসা-ক্রোধ-হানাহানি-বিদ্বেষ দেখে। ফলে কবি মানুষ থেকে অন্যদিকে, সুন্দরের মুখ ফেরান। তিনি অনেক ম্যাজিক লাইনের জনক। যা তার অগণিত পাঠকের মুখে মুখে ফেরে। ‘কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয়’ও তার ব্যতিক্রম নয়। এ কাব্যেও রয়েছে এমন সব ম্যাজিকপঙ্ক্তি, যা থেকে তৈরি হতে পারে বোধের এক শক্তিশালী জগত।
১. সমুদ্র অনেক বড়; এ জীবন একবিন্দু জল
২. মশালে জীবন জ্বালো, হায়েনা নেমেছে জনপদে
৩. সব বাদ অস্ত গেলে তাকে মৃত্যুবাদ
৪. ছত্রধর বিপদ সংকুল
৫. যে বাজে না, হাতুড়ির ঘায়েও বাজে না
৬. জীবন একটাই আর পৃথিবীতে দৃশ্য অগণন
৭. নিজেতো দেখি স্বপ্ন অন্যকেও দেখাই
পুঁজিবাদ মৃতুবাদ, দর্শন, টিকে থাকার লড়াই; কিছুই তাঁর দৃষ্টি এড়ায় না। তাঁর কবিতা সবসময় মানুষের পক্ষে, জীবনের জয়গান গায়। উল্লিখিত পঙ্ক্তিগুলো তারই প্রমাণ বহন করে। কবিতার সাধকের পক্ষেই এসব পঙক্তি লেখা সম্ভব।
সিংহাসচ্যুতির ভয়ে পলিপেমাসের মতো একচক্ষু দানবটি কাঁপছিলো থরথর
কত না ব্যঞ্জনা ছিল তোমার শব্দের ঝংকারে
(আশরাফ ফায়াদের জন্য ঢেউলিপি)একদা বীরগাঁথা রচনা করলেও এখনো আমরা নিতান্তই দুগ্ধপোষ্য একজাতি
(ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ: ২০১৬)
‘কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয়’ কাব্যগ্রন্থে এ দুটি কবিতা অন্যরকম। কবি সমাজ সচেতন, দেশপ্রেমিক। আকালের কামড় তার মগজে হল্লা করে। ফলে তিনি কবিতায় তুলে ধরেন সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ধর্মীয় উম্মাদনার কুটিল রূপ। কবিতা দুটি একধরনের প্রতিবাদও। আশরাফ ফায়াদ সৌদি নাগরিক। চিত্রকর । ছবি আঁকার অপরাধে সৌদিসরকার তাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ জারি করে। পরে বিশ্ববাসীর প্রতিবাদের মুখে ওই সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যায়। বিষয়টি আবু হাসান শাহরিয়ার চিত্রকল্প-পুরাণ-উপমার আশ্রয়ে উপস্থাপন করেছেন। দ্বিতীয় কবিতাটি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে নিয়ে। যেখানে আমরা হায়েনার তাণ্ডবের টের পাই, যাদের দেওয়া আগুনে পুড়ে গিয়েছিল ওস্তাদের জায়নামাজ, চিঠিপত্র। কবি আশাহত হয়ে বলেছেন, আমরা নিতান্তই দুগ্ধপোষ্য একজাতি।
এ কাব্যগ্রন্থে এটি টানাগদ্যে লেখা দীর্ঘকবিতা ‘আত্মপ্রতিকৃতি’। একবিতায় তিনি বলেছেন,
নিরন্তর পথ হাঁটা ছাড়া আমার অন্য কোনো পুঁজি নেই। আমি জানি কেউ নই, কিছু নই আমি: এ জীবন মুছে যেতে আশা: এ জীবন ভেসে যেতে আসা। থেমে যেতে যেতে চোখে চোখে গুঁজে দিতে আসা।
(আত্মপ্রতিকৃতি)
কবি এখানে অতীত-বর্তমানকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। যেখানে নদীতীরবর্তী জনপদের এক প্রাজ্ঞ কবির বেড়ে ওঠা, শৈশব, কৈশোর, তার প্রিয়জন, যুদ্ধ, জাতির জনককে কাছ থেকে দেখা; সবই উঠে এসেছে।
বইটি কি ছন্দে, কি ছন্দহীনতায়; উভয় ক্ষেত্রেই সাবলীল, প্রাঞ্জল। বইটি পড়তে পড়তে মনে হবে, আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতা এক বহুরৈখিক জনপদ, হাজার অতীতকে সঙ্গে নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হওয়া এক জ্যোতির্ময়ী দৃশ্য।
- কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয়: আবু হাসান শাহরিয়ার, প্রকাশক: প্লাটফর্ম, প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর, মূল্য: ১৩৫ টাকা।