বিপর্যস্ত আমাদের মানবিক স্বাধীনতা। আমাদের বিবেক আজ রুদ্ধ। তা না হলে তনু’র মতো একজন যুবতীকে হত্যার পর রাষ্ট্রপক্ষ আজ তার পরিবারকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করত না।
বাংলাদেশে আজ মৌলবাদী রাজনীতি বন্ধ করার প্রচেষ্টা চলছে। এর পাশাপাশি সামাজিক হায়েনাগুলোকে শায়েস্তা করার কি উদ্যোগ নিচ্ছি আমরা?
আমরা দেখছি, বাংলাদেশে একাত্তরের পরাজিত শক্তি নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। একাত্তরে গণহত্যাসহ সাত ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামাতে ইসলামীকে চিরতরে নিষিদ্ধ করার আবেদন চূড়ান্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদনে সে সময়ের জামায়াতের সহযোগী সংগঠনের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আবেদন জানানো হয়। পাশাপাশি জামাতের মুখপত্র ‘দৈনিক সংগ্রাম’কে অভিযুক্ত করে নিষিদ্ধের সুপারিশও করা হয়েছে। বলে রাখি, একটি দৈনিককে নিষিদ্ধের কথা ওঠার পর কেউ কেউ বলবে সংবাদ মাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরা হচ্ছে। অথচ এই দৈনিকটি একাত্তরে কী করেছিল—তা কি আমরা ভুলে যাচ্ছি?
বাংলাদেশ আরও একটি স্বাধীনতা দিবস পালন করছে। ৪৫ বছর একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতার জন্য কম সময় তা বলা যাবে না। বাংলাদেশ এই দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এসেছে। কিন্তু সময়টি কি খুব সুখকর ছিল জাতির জন্য? খুব অনুকূল ছিল রাষ্ট্র গঠনের জন্য? না ছিল না। কেন ছিল না—সে উত্তর খোঁজার প্রয়োজন মনে করি। ১৯৪৭ সালে যখন পাক-ভারত ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীন হয় তখন ধর্মীয় সম্বন্ধের দোহাই দিয়ে উর্দুভাষী পাকিস্তানিরা দল বাঁধতে আগ্রহী হয় বাঙালিদের সঙ্গে। এই ঐক্যের মূলমন্ত্র কী ছিল, তা পর্যালোচনা করার প্রয়োজন আজো আসছে।
উর্দুভাষীরা ‘বিগ ব্রাদার’ সেজেছিল
জাতিসত্তার পরিচয় নয় বরং ‘আমরা মুসলমান’—এই ডঙ্কা বাজিয়ে উর্দুভাষীরা ‘বিগ ব্রাদার’ সেজেছিল বাঙালিদের। কেন বাঙালিরা সেদিন এই নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন—সে প্রশ্ন আমি আজও করি নিজেকে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সমকক্ষ নেতা কি ছিলেন না সেদিন বাঙালিদের মাঝে? হ্যাঁ, ছিলেন। তারা কেন সেদিন বাঙালিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ডাক দেননি—তা এখনো আমার বোধে আসে না।
বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান— এই তিনটি রাষ্ট্র ১৯৪৭ সালেই জন্ম নিতে পারত। কিন্তু তা নেয়নি। পাকিস্তানি নেতারা সে সময়েই নিজেদের স্বার্থ চাপাতে ব্যস্ত ছিলেন বাঙালিদের ওপর। ভাষার দাসত্ব চাপিয়ে দেওয়ার কাজটি ছিল প্রথম প্রচেষ্টা। তাতে তারা সফল হননি। এরপর সামরিকতন্ত্র চাপিয়ে দিয়ে যে শেকল পরানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, তার প্রধান লক্ষ্য ছিল সেই বাঙালি জাতিই। পাকিস্তানিরা আসলেই গণতন্ত্রমনা ছিল না। তাদের গণতন্ত্রমনস্কতা যে এই ২০১৪ সালেও গড়ে ওঠেনি তার প্রমাণ আমরা পাচ্ছি। সেই পাকিস্তানিরা ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বাঙালিদের সঙ্গে যে আচরণ করেছিল, এখন তারা সে আচরণ করছে নিজ দেশের মানুষের সঙ্গেই। পাঞ্জাব, বেলুচ, সিন্ধিরা যে একে-অন্যকে বিশ্বাস করতে পারছে না—তা স্পষ্ট হচ্ছে ক্রমেই। আর অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে এগুচ্ছে পাকিস্তান। ঠিক একইভাবে পাকিস্তানিরা, বাঙালি জাতিকে অনিশ্চয়তায় ডুবিয়ে রেখে শোষণ করতে চেয়েছিল। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাঙালি জাতি। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে আদায় করে নিজেদের স্বাধীনতা।
কিন্তু স্বাধীনতা পাওয়াটাই কি শেষ কথা ছিল? না, ছিল না। সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রত্যাশা নিয়ে যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল এর জনসংখ্যা এখন দ্বিগুণের চেয়ে বেশি। বাড়েনি ভূমি। কিন্তু মানুষ ঠিকই বেড়েছে। যে ভূমি, শক্তি, সামর্থ্য নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, তা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে এই দেশটিও উন্নতির বরমাল্য পেতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যবিন্দুতে পৌঁছতে না পারার প্রথম কারণটি হচ্ছে রাজনৈতিক ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার বীজ কারা বুনেছিল এবং কিভাবে বুনেছিল তা সচেতন মানুষের অজানা নয়। ১৯৭২ থেকে পঁচাত্তরের আগস্ট, মাত্র সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে যতোই সমালোচনা করার চেষ্টা করা হোক না কেন—রাষ্ট্রগঠন এবং জাতির স্বপ্নপূরণে তার চেষ্টার কোনো ঘাটতি ছিল না। অথচ ঠিক সে সময়ে সেই শকুনেরা ছিল তৎপর। তারা সর্বহারা, সমাজবাদী, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বিপ্লবীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে তৎপর ছিল। জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার পর তারা নিজ চরিত্রে বেরিয়ে আসে প্রত্যক্ষরূপে। সেনা শাসকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা গোটা বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে ’৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তৎপর হয়।
সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে যারা তথাকথিত ‘দেশ গড়া’-র যে প্রত্যয় (?) ব্যক্ত করেছিল, তারা কি আসলেই জাতিসত্তার প্রতি অনুগত ছিল? না ছিল না। মুখে তারা ‘মিলেমিশে’ কাজ করার কথা বললেও মূলত ছিল সেই পাকিস্তানি পরাজিতদের প্রেতাত্মা। যারা বাংলাদেশের বিজয়কে মেনে নিতে পারেনি। আর পারেনি বলেই ছলে-বলে-কৌশলে তারা সেই পাক প্রভুদের স্বার্থরক্ষা করেছে। তাদের জয়গান গেয়েছে। ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকার খাম্বা হিসেবে তারা কাজে লেগেছে সামরিক শাসকদের। এর মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের সংগঠিত করেছেন নানাভাবে আবির্ভূত হয়েছে সস্তা বুলি আউড়িয়ে।
বাংলাদেশে এখনো দুটি পক্ষ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের জন্য এখনো প্রধান হুমকি হচ্ছে সেই মৌলবাদীরাই। যারা ধর্মীয় জোশ কাজে লাগিয়ে জনগণের চোখে ধুলা দিতে চায়। বাংলাদেশে গেল কয়েক বছরে নতুন নতুন ধর্মীয় জঙ্গিবাদী দলের অস্তিত্বের খবর পত্রপত্রিকায় বেরিয়েছে। তারা কারা? তারা কি নতুন? না তারা নতুন নয়। তারা বহু নামে আবির্ভূত হচ্ছে। বহু পরিচয়ে। একই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে। আর সেই তত্ত্বটি হচ্ছে ধর্মীয় উন্মাদনা ভরা মৌলবাদ। যা ক্রমশ পাকিস্তান-আফগানিস্তানকে গ্রাস করেছে। যে আল-কায়েদা তত্ত্ব হরণ করতে চাইছে গোটা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের পরিশুদ্ধ চেতনার উৎস।
বাংলাদেশে এখনো দুটি পক্ষ। একটি গণমানুষের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ী। আর অন্যটি ‘মিলেমিশে’ কাজ করার প্রত্যাশী। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় দেখা গেছে, এই ‘মিলেমিশে’ কাজ করার প্রবক্তারা ক্রমশ গ্রাস করেছে বিএনপির বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।
বর্তমান সরকার দেশে রাজাকারদের বিচার শুরু করেছে এবং তা চলছে। রায় কার্যকর হচ্ছে। এটা ভালো লক্ষণ। এই প্রক্রিয়া থামিয়ে দিতে চেষ্টা হচ্ছে প্রতিদিন। এ জন্য প্রজন্মকে সজাগ থাকতে হবে। বর্তমান সরকার দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার কাজটি করার মাধ্যমেই একটি ধাপ এগিয়ে যেতে পারে। যতই কঠিন হোক, কাজটি করতেই হবে বর্তমান সরকারকে। চলমান সরকারকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে নানাভাবে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ হচ্ছে, দলের ও সরকারের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা সুবিধাবাদী চক্র। এই চক্র অতীতেও অনেক সরকার ডুবিয়েছে। আগামীতেও ডোবাবে। যদি এদের শায়েস্তা করা না যায়।
আমি খুব দৃঢ়ভাবে এই প্রজন্মের শক্তিতে বিশ্বাস করি। এই প্রজন্মের চেতনায় স্বাধীনতার পরিশুদ্ধ বিবেক উজ্জ্বলভাবে জাগ্রত। এই শক্তিকে ধরে রাখতে হবে। কাজে লাগাতে হবে। যতোই বাধা আসুক, এই পতাকার প্রতি সম্মান জানাতেই হবে বুকে হাত দিয়ে। মনে রাখতে হবে, যারা লাখো শহীদের রক্তের ঋণ স্বীকার করে না তারা এ মাটির মিত্র নয়।