অন্ধকার আর মাটির রঙ মিশে আরও ঘন হয়ে রয়েছে রাত। বজ্রের আলো হঠাৎ হঠাৎ এসে আর্দ্র কাদামাটির পথটাকে উজ্জ্বল করতে চাইছে। সাত-আট জোড়া পা কাদা ভেঙে ভেঙে অন্ধকারে হেঁটে চলেছে। একজনের হাতের টর্চ বিদ্যুতের আভায় চিকচিক করে উঠছে। সুইচে চাপ দিতে যাওয়ার মুহূর্তে পশলা পশলা আলো এসে দূর পর্যন্ত দেখিয়ে দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। ‘আইজ আর তোর এভারেডি লাইটের ব্যাটারি খরচ হবে না। আল্লাহর লায়িটিই চলবে।’ রসিকতা করল কেউ। বেশ কিছুক্ষণ অন্ধকার ছেয়ে রইল। নরম পথের বুকে থপথপ শব্দ। দৃষ্টির মনযোগ জড়ো করে পথ চলছে সবাই। হঠাৎ একজনের হাতে ধরা বছর পাঁচেকের ছেলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। ধপাস শব্দে সচকিত হলো লোকটা। আলোর রেখা পড়ল ছেলেটার গায়ে। দু’হাত দেবে আছে কাদায়। উঠতে পারছে না। লোকটার বাঁ কাঁধে বাজারের ব্যাগ। ঝুঁকে উঠাতে পারছে না। ব্যাগটা ঝুঁলে পড়ল। তাল সামলে সোজা হলো। পাশ থেকে আরেকজন দু’হাত বাড়িয়ে তুললো ছেলেটাকে। কাঁধে নিয়ে পা ফেলে ফেলে হাঁটতে লাগল। অন্য পদশব্দগুলো কিছুটা এগিয়ে। কাঁধের ছেলেটা শক্ত করে গলা চেপে আছে। স্বর বন্ধ হওয়ার জোগাড়।
‘আমার মাথা শক্ত কইরে ধরো খুকা। গলা ধরলি দোম বন্দ হইয়ে যাবে। তকন আমরা আর বাড়ি যাতি পাররো না। হাহাহ।’
ছেলেটা গলা থেকে হাত সরিয়ে মাথা আঁকড়ে ধরল। দশ আঙুল জোড়া দিয়ে চেটাল হাতুর তালুতে কপাল চেপে দু’কনুই একখানে করে শক্ত হয়ে বসে রইল। দুলদুলে ঘোড়ায় চড়ার মতো লাগছে। একহাত শিথিল করে লোকটার ঝাঁকড়া চুল মুঠি করে ধরে রইল লাগামের মতো। পথের দুপাশের ঘরবাড়িতে তখনও আলোর আভা। মিহি স্বরে কারও ডাকার শব্দ, ও খুকি, না খাইয়ে ঘুমোয় পড়িস নে। তোর আব্বা মাছ আইনেচে, পেটির মাছ দে ভাত খাইয়ে শো’। কিছুক্ষণ পরে মাঠের শুরু। পথটা একা হয়ে যায় এ-সময়। দুপাশের ক্ষেতখামার আর গাছপালা অন্ধকারে দূরের আকাশের দিকে আলো দেখতে চায়। আজ আকাশে শুধুই তারা। মেঘ যা ছিল নেমেছিল দুপুরে। তুলিভরা আলোয় আঁকা আকাশের অন্ধকার পটে পটে প্রিজমের ফুটকি। দেখতে দেখতে তারাগুলো বেশ নিচে নেমে এলো। হাত বাড়িয়ে ধরতে চাইল ছেলেটি। হঠাৎ দিগন্ত থেকে বর্ষার ফলার মতো একফালি আলো ছুটে নেমে এসে মিলিয়ে গেল। ভয় পেয়ে গলা আঁকড়ে ধরল আবার।
‘তুই ভয় পাইছির?’
‘হুম’।
‘ও কিছু না। ধুমকেতু।’
‘আমি ভাবলাম তারা খইসে পইড়েছে। গা’য় পড়বে একুনি।’
‘হাহাহা। নারে পাগল। গা’য় পড়বে না। উডা আল্লাহর শয়তান মারার কল।’
সামনে থেকে একজন গলা চড়াল, ‘তুরা এত কি গল্প করতিচিস? আমার খুকা তোরে জ্বালাতন করে না তো, করেশ?’
‘না না ভাই, মোটেই না। ছোট মানুষ, জানতি চাচ্ছে ইডা উডা। তুমি পা চালাও, আমরা আসতিচি।’
‘কাদা রাস্তায় তুমারে কষ্ট দিচ্ছি। খুকারে কলাম হাটে আসতি হবে না, তা মোটে শোনলেই না।’
‘তা বাইচ্চা মানুষ কি আর কাদা-বর্ষা বোঝে, হাটে আসলি একটু মিষ্টি-মিটাই খাতি পারে।’
পিচের পথটা অতি অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে এসে মুখভার করে দেখে নেয় বাজারটাকে। অথচ মণিরামপুর থেকে রাজগঞ্জ কোনো অংশে কম নয়। বাওয়ের বেড় থেকে নিয়ে তিনটে স্কুল, গুদাম ঘর, ছ’মিল, তেল-চাল ভাঙানোর মিল পর্যন্ত রয়েছে। কিন্তু দিনরাত গমগমে মানুষের পায়ের জন্যে পাকা পথের বন্দোবস্ত হয়নি। বাজারের প্রান্তে, গার্লস্ স্কুলের মোড় পেরিয়ে, রাস্তার ধারের বড় হরিতকি গাছটার পর থেকে চওড়া কাচা পথ চলে গিয়েছে দূরে। দশ বারো বাড়ি পরেই মাঠ। অল্প লোকালয় আর মাঠের বহু বিস্তৃতি পায়ে দলে হাটুরেরা আসা যাওয়া করে। মাইল দেড়েক দূরে মনোহরপুরে করেশদের বাড়ি। বাজারে আসবার জন্যে মাঝে মাঝে পাড়ার কোনও দলে ভিড়ে যায় ও। ফেরার সময় সবার হাতে থালি থাকলেও প্রায়ই ওর হাতের আঙুলের ফাঁকে এক ফুলকি আগুন আর লতানো ধোঁয়া ছাড়া আর কিছুই থাকে না। অন্ধকারে বিড়ির মুখ শুষে ধোঁয়া নিয়ে উড়িয়ে দেয়। ফুসলে ওঠা আগুনে ওর জ্বলন্ত চোখ জ্বলে ওঠে। আজ কিছুটা বাজারও করেছে। মা’র শরীর ভালো নেই। জ্যান্ত মাছের ঝোল খেতে চেয়েছিল। অন্তত কিছু কই মাছ পাওয়া গেছে। বাড়ির কাছাকাছি এলে, ছেলেটির বাবা বলল, ওরে নামায়ে দ্যাও করেশ, এইটুসকানি পথ হাইটে যাবেনে।’ হাঁটা না থামিয়ে করেশ বলল, না না ভাই, কী যে কন! এই ছোট্ট মানুষটারে এইরাম কাদায় নামায়ে দিয়া যায়? চলো তুমাগের বাড়ি পইর্যন্ত দিয়ে আসি’।
বারান্দায় একটা ছায়া বসে আছে। পায়ের শব্দ শুনে নড়ল ছায়াটা। হালকা কেশে উঠল। ছোট্ট রান্নাঘরের খোলা দোরে ম্লান হলদেটে আলো। জানালার পাল্লাটা হঠাৎ হঠাৎ আলোকিত হয়ে উঠছে। একটি হাত চুলোর মুখের পাটখড়িগুলো নেড়েচেড়ে দিয়ে থেমে যাচ্ছে। পাতিলের তলা ছুঁয়ে চেটাল অগ্নিশিখায় ঘোমটা ভেসে উঠছে। একটু থির হয়ে চোখের সামনে থেকে কাপড় সরিয়ে বাইরে তাকাল।
‘তুই বাড়ি আইচিস খুকা? এত রাইত কল্লি ক্যান্?’
‘রাইত আর কনে মা। কাদাপানির দিন, রাস্তায় কি চলার মতন আচে? ন্যাও তাড়াতাড়ি এই মাছ গুলোন ঝোল করো দিনি, কাচামরিচ আর আলু দিয়ে। দুটো ভাত খাইয়ে শুইয়ে পড়ি।’
‘এত রাত্তির আবার মাছ কোটপো?’ বেগুন রানদিচি, আর উচ্চে ভাজা। তাই খা আইজ রাত্তিরি। কাইল খাইস মাছঝোল।’
‘ঠিক আচে মা’।
ঘরের কোণায় রাখা মাটির কলসের পানিতে পা ধুয়ে বারান্দায় বসল করেশ। পাশে নির্বিকার বাবার মুখ থেকে গুচ্ছ গুচ্ছ ধোঁয়া খড়ের চাল পেরিয়ে উড়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। কুড়–ক কুড়–ক শব্দে একরকমের ঘুমের ঘোর আসছে। প্রতিটি শব্দের পরে কলকের আলোর বৃত্ত উত্তাপহীন আভায় ঝিমুনি থেকে জাগিয়ে তুলছে চাইছে।
‘কাজকাম কিছু করবি, না খালি ঘুর ঘুর কইরে বেড়াবি?’ শব্দগুলো দুচোয়ালের ভেতর ফুলে উঠে ধোঁয়ার সাথে মিলিয়ে গেল দূরে। কিছুক্ষণের নীরবতায় আধবোঁজা চোখের পাতা পুরোটা বিছিয়ে যেতে চাইছিল চোখের ওপরে। নিমপাতার বৃষ্টিবিন্দুগুলো ঝুমঝুমি বাজালো যেই ছোট্ট উঠোনে, বাবার দিকে তাকাল করেশ।
‘এইবার আর গিরামেই থাকপো না বাপ। কাজ জোগাড় করিচি।’
‘কাজ কইরে খা। শান্তি আচে তাতে। উল্টোপাল্টা কিছু করিসনে। মনে রাকিস, গরিবির ভুল সবসুমায় বড়।’
দুই
ভোরের আলো না ফুটতেই ঘুম ভেঙে গেল করেশের। আর ক’দিন পরেই গ্রাম ছেড়ে যেতে হবে। কালরাতে বাবা প্রথম জানলেন। আর কাউকে বলা হয় নি। কে-ই বা আছে। পড়ো পড়ো মাটির দেয়ালের ওপরে খড়ের চালের খুপড়ি ঘরের ছেলে ও। রাস্তা দিয়ে হাঁটলে নিজে থেকে মানুষের কাছে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে। কিছুপথ যাওয়ার পরে নানারকম বাক্য ভেসে আছে। পুরোপুরি মানে না বুঝতে পারলেও, সুখকর যে নয় তা নিশ্চিত। মাঝে মাঝে কেউ বলেই বসে, ‘কী করেশ, বিলাকের মালটাল আর আনো না?’ বর্ডার এখান থেকে বেশ দূরে হলেও একসময় যাতায়াত ছিল। সারারাত মাল কাঁধে হেঁটে এসে লাইনম্যানের বাড়িতে ঘুমানো। মাঝে মাঝে দূর সম্পর্কের কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে অতিথি হওয়া সেই দিনগুলো মনে পড়ে। একদিন দুপুরে পাড়ার এক বোনের বাড়ির বারান্দার খাটে বসে রেডিও শুনছে। আবদুল আলীমের গান শুরু হলে ভল্যুম বাড়াল। পাড়া থেকে ছেলেমেয়েরা দূর থেকে ভীত চোখে দেখে দেয়ালে আড়ালে দাঁড়ানো। উঁকি দিচ্ছে একটু পর পর। কোটর ঠিকরে বের হয়ে আসা আসা ডাগর চোখে দুপুরের রোদের ঝলকানি। গানের তালে তালে কালো কুকড়ানো বাবরী চুলের দুলুনি। কেউ একজন আরেকটু এগিয়ে এসে দেখতে চাইল। পেছন থেকে কেউ জামা টেনে ধরে বলল, ‘সামনে যাইস নে, ও বোলো বিরাট বিলাক মার্কেট। ধইরে ভারতে বেইচে দেবে।’ বড়রা এসে গল্প করে কখনও। শুকনো মুখে হেসে হেসে কথা বলে। চোখমুখ দেখে বুঝবার চেষ্টা করে লোকটাকে। সবাই চলে গেলে গৃহিনী এগিয়ে আসে।
‘কিছু বলবা বু?’
‘না সিরাম কিছু না।’
‘তুমার জন্যি এই খ্যাপে এটটা ডাবুর আনিচি বু। খাটের নিচে রাকিলাম রাত্তিরি। এই দেকো।’
‘না, আমার ডাবুর লাগবে না, করেশ। তুই ফেরত নিয়ে যা।’ জ্বলজ্বলে পিতলের কলসের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অন্যদিকে চোখ ফেরাল গৃহিনী।
‘কেন নিবা না বু? তাগায় দেখো, ডাবুরডা কত সুন্দুর। চকচইকে।’
‘দেকিচি। আর, তুই আমাগের রেডিও যোনো নিয়ে যাইসনে কলাম।’
‘ধুর বু। কী যে কও! তুমার জিনিস আমি নিতি পারি? তুমার বাড়ির নুন খাইচি না? নুন খাইয়ে নুন-হারামি কত্তি নেই।’
‘আরাট্টা কতা করেশ।’
‘কও বু।’
‘কচ্চি কি, তুই তো আমার গিরামের ভাই। তোর দুলাভাই কচ্চিলো, কডা দিন আসা বন্দ দে। লোকে আমাগের পরে চাপ দেচ্চে। কচ্চে, তুমরা দুষি লোকের খাতির যত্ন করো, তুমাগের নিচ্চই স্বার্থ আচে।’
‘বুজদি পারিচি বু।’
‘তুই কি মন খারাপ করলি?’
‘না না, তা না। আমার জন্যি তুমাগের বদনাম হোক তা চাই নে। দ্যাও গরম ভাত যকন রানদেই ফেলিচো, খাইয়েই যাই, হাহাহা।’
তারপরে আর কোনওদিন মাল পারাপারে যাওয়া হয় নি। সেই বাড়িতে তো নয়-ই। এই সকালের রোদে চেনাপথে হাঁটা কতনা সহজ। কত না শান্তির। খেটে খাওয়া কাজে বন্ধন যত থাকুক না কেন, লোকে চোখ করে দেখুক না কেন, তা-ই ভাল। ভাবনাটা থমকে গেল করেশের। কচার বেড়া থেকে একটি ডাল ঝুঁকে ছিল রাস্তার কিনারে। কচাপাতার গুচ্ছ মুদৃ ঝাপটা খেলো কপালে। সরিয়ে সামনে তাকিয়ে একটু দাঁড়াল। সকাল সকাল যে যার কাজে চলে যায় সবাই। কেউ মাঠে কেউ গঞ্জে। গাঁয়ের পথে পথে ধুলো উড়িয়ে নানারঙের জামাকাপড় পরে স্কুলে যায় ছেলেমেয়েরা। খুনসুটিতে ধুলিমলিন হয়ে ওঠে তাদের পা। ঘর গৃহস্থালির কাজে মন দেয় গৃহবধূরা। পায়ে পায়ে এগিয়ে মজা পুকুর পাড়ের ডুমুর গাছটার নিচে দাঁড়াল করেশ। উঠোনে নতুন দুটো চুলা উঠেছে। বড় বড় মুখ। খেজুরের রস জ্বালানোর চারকোণা কড়াই চড়বে এর ওপর। এখনও গাছকাটা শীতের বেশ দেরি। তবে তবিবর সরদার আগে থেকে গাছ তুলে রাখে। বাড়িতেও সেই প্রস্তুতির তোড়জোড় জারি হয়েছে বোধ হয়। সানকিতে মাটি গুলে তেনা দিয়ে লেপে লেপে দিচ্ছে দুটি অঞ্চল হাত। চুলার ঝিকার ওপরে তেনাটা নিয়ে স্থির হয়ে রইল কিছুক্ষণ। আবার একটানে লেপে দিলো চারপাশ। পেছন ফিরে তাকাল কি ভেবে। ডুমুর তলায় চোখ আঁটকাল। জ্বলজ্বলে একজোড়া চোখ, কাঁধ-অবধি ঢেউদোলা চুল, দুসারি মুক্তোর ঝিলিক নিয়ে কে যেন দাঁড়ানো। বারান্দার দিকে দেখে শাকিলা চঞ্চলা পায়ে এগোল।
‘তুমি আবার আইছো?’
‘আমি তো যাই নে কখনও। আসার কি হইলো?’
‘ঠাট্টা করবা না, কী জন্যি আইছো কও। মা বাড়ি আচে, বেশি দাঁড়াইনে যাবে না।’
‘আমি কাজ নিচি। গিরামে না। মণিরামপুর বাজারে। বেতন-কড়ি পাকা হইয়ে গেলি তুমারে নিয়ে যাবো। ঘর বাঁনবো।’
‘আমি কি তুমার বউ, যে নিয়ে যাবা ! হুম, খায়েশ কত?’
‘আইজ না হোক, কাল বউ হবা।’
‘বুজিচি বুজিচি, তা কাজ কি তাই কও।’
‘সাইকেল ম্যাকানিক্ । অয়েলিং-ও শিকোয় দেবে, তখন বেতন হবে বেশি। আপাতক দুকানের পিছনের খালি জায়গায় শুতি দেবে। মালিকির বাসায় যাইয়ে খাইয়ে আসতি হবে।’ কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে তাকাল শাকিলার দিকে। মুখ নিচু করে আছে দেখে তালু মেলে থুতনি ছুঁয়ে বলল, আমার কাজ তুমার পছন্দ হই নি না? তাই কথা কচ্চাও না।’
‘উহুম, না না, কাজ তো কাজই। পছন্দ হবে না ক্যান্ ? চুরি তো আর না। গতর আর বুদ্দি খাঁটাইয়েই তো পয়সা কামায় করবা। ’
‘ঠিক কতা কইছাও’।
‘তা অয়েলিং মানেডা কও দিনি।’
‘অয়েলিং মানে হইলো, সাইকেলের সব নাটবল্টু খুইলে তেল মাখাইয়ে আবার জুড়া দিয়া।’
‘ওরে বাবা। তুমার মাথায় এত বুদ্ধি ধরবে? তার আর কি কি জোড়া দিতি পারবা তাই কও।’
‘সুমায় হলি জানতি পারবা। হাহাহ।’
‘তা তো হইলো। একটা কথা তুমার দিতি হবে।’
‘কি?’
‘জীবনেও আর মালপারাপার করতি পারবা না। পরের জিনিসি হাত দিবা না। তা-লি আমারে পাবা না কইয়ে দিলাম।’
‘যদি পরের জিনিস, নিজির জিনিস বানাইয়ে নিয়ে হাত দিই, তখন কি অসুবিদে হবে?’
‘যাও… ! তুমি বদই থাইকে যাবা। ভাল হবা না।’ করেশকে দু’হাত দিয়ে ধাক্কা দিলো শাকিলা। পানিতে প্রায় পড়ে যাবে, তখনই জামা টেনে ধরল। এক পা তবু কাদায় দেবে কাত হয়ে রইল করেশ। হাত বাড়াল শাকিলা। হাঁপাতে হাঁপাতে টেনে তুলল ডাঙায়।
তিন.
দিনে কুয়াশা ছিল। রোদের তেজ ফিরে ফিরে গিয়েছে জলকণায় লেগে। শীতের বাতাস জুবুথুবু হয়ে বয়ে যায়। সন্ধ্যা থেকে হিম আর হাওয়া জেকে বসবার পায়তারা করে। চাদর জড়িয়ে মা’র কাছে গিয়ে বসে করেশ। কৈ মাছগুলো কুটে আলু আর কাঁচামরিচের সাথে মশলা মিশিয়ে চুলোয় চড়িয়েছেন মা। খোলা পাতিলের ওপরে মাছঝোলের সুবাসিত বাষ্প। নাক টেনে ঘ্রাণ নিলো করেশ।
‘তুমি রানতি থাকো, আমি একটু ওই পাড়াত্তে আসি।’
‘না না, একন কুতাও যাইস নে। রানদা হইয়ে গেছে গরম গরম খাইয়ে শুইয়ে পড়। কাইল তো চলেই যাচ্চিস।’
‘এই যাবো আর আসপো মা।’
‘কচ্চি যাতি হবে না। যাবার আগে মা’র কতাডা শোন।’
‘তুমি কলি, না শুইনে কি পারি? কিন্তুক, শাকিলার সাতে এটটু কতা আচে। কইয়ে আসি। যাবো আর আসপো।’ উঠতে উদ্যত হলে মা হাত ধরে বসিয়ে দিলেন। পাশ থেকে বাটি টেনে চামচে করে ক’টুকরো মাছ আর আলু উঠালেন।
‘দাঁড়া দাঁড়া, এটটুখানি মুখি দিয়ে যা। বুজি তো, ওর কতা মনে পড়লি তোরে থামানো যাবে না। হিহিহি।’
মুখ লাল করে বাটির কিনার ধরে উঠাল করেশ। চামচ দিয়ে খুঁচিয়ে মাছের টুকরো খসিয়ে মুখে দিলো। জিহ্বা পুড়ে যাবে যাবে। হা করে গরম হাওয়া বের করে দ্রুত চিবিয়ে গিলে ফেলল। পানি এগিয়ে দিলেন মা।
ভর সন্ধেবেলায় দুপুররাত ঘনিয়েছে বাগের আমতলায়। আকাশে তবু তারার আলো আছে, এইখানে দুনিয়ার অন্ধকার। আম বাগান থেকে বৃত্তের মতো ঘুরে পথটা ছুটে বেরিয়েছে শাকিলাদের বাড়ির দিকে। মাঝবৃত্তপথে গায়ের চাদরটা ঠিকমতো জড়িয়ে নিলো করেশ। বাদিকে ঘন আকাশসমান গাছগুলোর দিকে তাকাল। দিনের বেলা ভেতর দিয়ে হাঁটতে ভাল লাগে। ঘন ঘাসের ওপরে বিরল পায়ের ছাপে পথ পথ হয়ে থাকে। পাদুটো ঘাসপথে দেবে দেবে যায়। আরাম বোধহয় হাঁটার সময়। এখন নিজের হাত পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ঝুঁকে কোনওরকমে মাটির প্রলম্ব দাগের ওপরে পা ফেলে অতি ধীরে হাঁটছে। খসখস শব্দে গা কাঁটা দিয়ে উঠল। বুকে ফুঁ দিয়ে আবার পা ফেলতে যাবে, এমন সময় কে একজন সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর আরও কয়েকজন। ঘিরে ধরল। কিছু বুজে ওঠার আগে শুনতে পেলো, তো চাদরের তলে কি? কার ঘরে চুরি করিচিস? দেখা কি আছে?’
‘আমি কিছু চুরি করি নি। তুমরা কারা ভাই। আমি তো ওসব ছাইড়ে দিছি ভাই। আমারে যাতি দ্যাও।’
প্রচণ্ড ব্যথায় কঁকিয়ে মাটিতে পড়ে গেল করেশ। হাতের জিনিসটাকে তবু আঁকড়ে ধরে রইল। পাশ থেকে একজন ছিনিয়ে নিলো। মাথা তখনও ঘুরছে। ঝাড়া দিয়ে উঠতে যাবে, আরেকটি ঘুষি এসে পড়ল অন্য চোয়ালে। এবার উঠবার শক্তি রইল না। টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল।
কবজি আর কোমরে ব্যথা নিয়ে চোখ মেলল। সামনে নিবু আলোর হারিকেন। পিছমোড়া পেছনটা বাঁধা খুঁটির সঙ্গে। এদিক ওদিক তাকিয়ে জায়গা বুঝবার চেষ্টা করছে। কয়েকজোড়া পা’র উপরে লুঙি দুলছে। একজনের পরণে প্যাণ্ট। বুটজুতো পায়ে। এগিয়ে আসছে জুতোদুটো। একটির তলা উঠে কপালে খটাশ করে লাগলো। সাথে গালি।
‘হারামির জাত আবার চুরি কইরেচে। এই দ্যাখো চুরির মাল। নতুন কাপড়। তিনডে। বাজারের কারও দুকানতে নেছে। এরে আর রাখা যাবে না। গিরামের মান সম্মান থাকপে না।’
‘ভাই আমি চুরি করি নি,ভাই। এডা আমার নিজির টাকায় কিনা। আমি কাজ কইরে খাবো ভাই। আমারে মাইরে না।’
‘তালি ক’ রাত্তির বেলা এইগুলো নিয়ে কনে যাচ্চিলি। বেচতি?’
‘না রে ভাই না, এমনি একজনরে দিতি যাচ্চিলাম।’
‘আবার মিথ্যে কথা। তোরে আইজ শেষই কইরে ফেলবো।’
চারদিক থেকে কিল ঘুষি লাঠির আঘাতে আঘাতে নিস্তেজ হয়ে কাঁত হয়ে রইল করেশ। বাড়ির ভেতর থেকে বয়স্ক কেউ সবাইকে ভর্ৎসনা করে বাঁধন খুলে দিলেন। ভ্যান ডেকে বললেন, ‘হাসপাতাালে নিয়ে একুনি। তুরা কি মানুষ? ছ্যামড়াডারে এইরাম কইরে মারতিচিস? মইরে গেলি বুঝবিনি, পুলিশির গুঁতো কারে কয়!’
সরকারী হাসপাতালের সামনে ভ্যান থামলো। তখনও গভীর রাত। বাতাসে হিম। দিনের কুয়াশা নেই। তারাগুলো নতুন আলোয় জ্বলছে। দেরি করে আসা পিয়নের মতো জড়োসড়ো চাঁদ টুকরো মেঘের ছায়ায় আশ্রয় নিতে চাইছে। ছোট্ট দোতলা বিল্ডিংয়ের বারান্দায় কেউ ঘুমিয়ে আছে। ভ্যান থেকে নেমে একজন সেদিকে গেল। ডেকে ডেকে জাগাতে চাইল।
‘এই যে ভাই, দারোয়ান ভাই, ওটেন। রুগি আচে।’
‘আরে মিয়া, এত রাত্তিরি ঘুমডা ভাঙালেন ক্যান্?’
‘ভাই খুব সিরিয়াস, ডাক্তার সায়েপের ডাকেন। রুগির একনও জ্ঞান ফিরি নি।’
‘আরে ভাই, জ্ঞান তো তুমারও নেই। রাইতদুপুরে কোনও ডাক্তার পাওয়া যায় ? ডাক্তারগের ঘুমটুম লাগে না নাকি। যান, রুগি থাক। সাহেব সকালে নিচে নামবে।’
দোতলার বারান্দার দিকে তাকাল ভ্যানওয়ালা। ঘুমচোখে সিঁড়িতে বসে পড়ল। সাথের লোকটাও বসল পাশে। চারজোড়া চোখে সকালের আলো। হেঁচকির মতো শব্দ আসছে ভ্যানের ওপর থেকে। লেপ জড়ানো করেশের গায়ে। কালশিটে মুখে শুধু হা করছে। শুকনো ঠোঁটদুটো জিহ্বা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভেজাতে চাইছে। লেপের স্তুপ ঝপ্ করে নিচে পড়ল। বিরল ঘাসের দিকে ঘেঁষটে যাচ্ছে স্তুপটা। একটু থামল। ছোট্ট মাঠের ওপরে সর্ষে দানার মতো শিশির। পাষানের মতো গা চলতে চাইছে না। চোখে রাজ্যের ভার। অতি কষ্টে দুপাতা মেললো। মুহুর্মুহু সূর্যছটায় ঝলসে উঠছে চোখ। অনেক রোদের ঝালর বিছানো মাটিতে। রোদবিন্দুগুলো গলে গলে রূপোয় বাঁধানো আয়না হয়ে উঠছে। ঘাসের ওপরে জিহ্বা মেলে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আয়নার ভেতর মায়ের মুখটা সরে সরে যায়। নতুন শাড়িতে শাকিলা হেসে সামনে এসে দাঁড়ায়। থির চোখে দেখতে দেখতে করেশ হেলে পড়ে মাটিতে।