দীলতাজ রহমান কবিতার পাশাপশি গল্পও লেখেন, তবে তাঁর কবিতার সঙ্গে আমি যত পরিচিত গল্পের সঙ্গে অত নই। তিনি অবশ্য তাঁর একটি গল্পগ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন আমাকে ও আমার স্ত্রীকে। তারপরও, স্বীকার করে নেওয়া ভালো, তাঁর গল্পের সঙ্গে তেমন মনোযোগী পরিচয় হয়নি আমার। এর কারণ অন্য কিছু নয়, আমারই ফুরসতহীন, চাপাক্রান্ত ঊর্ধ্বশ্বাস জীবন। তবে দীলতাজ তাঁর গল্পের আন্তরপ্রেরণা করে রেখেছেন কবিতাকে। তাই প্রতিটি গল্পের শীর্ষে স্থান দিয়েছেন কবিতা বা কবিতাংশকে। যেমন, ‘স্বার্থপর’ গল্পটির শীর্ষে রয়েছে এই কবিতাংশ—
ঈশ্বরের বন্দনা করলে
ঈশ্বর নেমে আসতো
হয়তো আমার প্রার্থনা
তোমার চেয়ে দীর্ঘ হয়ে গেছে…
এ গল্পটি এ রকম—বড় ভাইয়ের মৃত্যু হলে তার অসহায় হয়েপড়া স্ত্রীকে বিয়ে করে ছোটভাই। উদ্দেশ্য, তাকে দিয়ে গ্রামের জমিজমা সম্পদ আগলে রাখা, যেন নিজের শহুরে আমলা জীবনে কোনও ছিটেফোঁটা না লাগে ঝামেলার। শুধু তা-ই নয়, তার সন্তানটিকেও আত্মস্থ করাও তার আরেক মতলব। তবে ওই সন্তান, গল্পের কথক, ‘চাচীআম্মা’র মৃত্যুর পর জানতে পারে, তিনিই ছিলেন তার জন্মদাত্রী মা।
এখন ওই কবিতাংশের সঙ্গে গল্পের সূত্র-সম্পর্ক কী? হয়তো গভীরতর কিছু, ভেবে দেখতে পারেন পাঠক। দীলতাজের ব্যাখ্যা এ রকম— ‘প্রতিটি গল্পের ওপরে যে অণু কবিতাগুলো স্থাপিত, এক গল্প থেকে আরেক গল্পে ঢুকতে তা পাঠকের দৃষ্টিকে একটু অন্যদিকে ঘুরিয়ে ভারহীন করে আনাই এর লক্ষ্য। যেন ঘর থেকে আঙিনায় এক মুহূর্ত চোখ বুলিয়ে ফেরা। কিন্তু গল্পের সঙ্গে কবিতাগুলোর ভাবের মিল নেই কোনওই।…’ আসলে জগৎ ও জীবনে সবারই সব কাজের পক্ষে যুক্তি আছে, অপ্রাসঙ্গিকতারও। তবে আমার মনোযোগ গেছে মূলত দু’টি দিকে, দীলতাজ রহমান কী লিখেছেন আর কিভাবে লিখেছেন। লক্ষ করি, তাঁর গল্প লেখার ধরনটা তাঁর গল্প বলার ধরনের মতোই। যেমন, ‘স্বার্থপর’ গল্পের শুরু—’আমি আমার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। আমার বাবা সরকারের একজন ডাকসাইটে আমলা। অর্থবিত্ত, ব্যক্তিস্বাধীনতার কোনও অভাব ছিল না আমার জীবনে। আমার বাবার একটিমাত্র ভাই ছিলেন। তিনি বহু বছর আগে মারা গেছেন নিঃসন্তান অবস্থায়। সেই সূত্রে আমার বাবা তার পৈতৃক সম্পত্তিরও একচ্ছত্র অধিপতি।…’
সেখানকার কথা-কাহিনি দুঃখ-সুখ ভালোবাসার জীবনছবি
দীলতাজ রহমান গল্প লিখেছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক। ২০০১-০৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সাতটি গল্পগ্রন্থ- ‘বহুকৌণিক আলোর সংঘাতে’, ‘ধূসর আঁচলে চাবি’, ‘বৃত্তভাঙার আয়তন’, ‘মেঘের মেয়েরা’, ‘ফেরার ঘর নেই’, ‘গহিন দূরত্ব’, ‘নীলকণ্ঠ নাগ’। এতে গল্পসংখ্যা ৬১। ‘গল্পসমগ্র ১’ নামে একটি খণ্ডে তিনি গ্রথিত করেছেন ওই সাত গল্পগ্রন্থ। মোট ৬৪০ পৃষ্ঠার এই বৃহদায়তন বইটি প্রকাশ করেছে উৎস প্রকাশন, শাহবাগ, ঢাকা। ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার করকমলে’ উৎসর্গীকৃত এ বইয়ের মূল্য ১০০০ টাকা। বলাবাহুল্য এত বৃহৎ একটি বই একনাগাড়ে পড়ে যাওয়ার ধৈর্য ও সময় কোনোটাই আমার নেই, কিন্তু দীলতাজ এমন একজন মানুষ যে তাঁকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় অন্তত আমার জানা নেই। এ অবস্থায় অর্পিত দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করা সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। ইতস্তত বেছে নেওয়া কয়েকটি গল্প পড়ে, সেগুলোরই আলোকে, এখানে দু’-চার কথা বলতে হচ্ছে তাই। প্রথমত আমার মনে হয়েছে, দীলতাজ তাঁর গল্পের উৎস হিসেবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খুঁজে নিয়েছেন নিজের চেনা-জানা চৌহদ্দি, নিত্যদিনের ঘর-সংসার-পরিবার। সেখানকার কথা-কাহিনি দুঃখ-সুখ ভালোবাসার জীবনছবি ফুটিয়ে তুলেছেন সহজ বাস্তবতায়। তবে এই প্রকৃত প্রকৃতির মধ্যে থাকে কোনো গূঢ় রহস্য, কোনো জটিল গভীরতা। এজন্যই ‘স্বার্থপর’ গল্পে আপন মা যেমন আড়াল হয়ে থাকেন এক দুঃখী ‘চাচীআম্মা’ হয়ে তেমনই ‘প্রতিশোধ’ গল্পে ভাইয়ের আগ্রাসী কামনায় বিব্রত এক বোন শেষ পর্যন্ত জানতে পারে যে, ওই ভাই আগেই জানতো যে, সে তার ভাই নয়। এ গল্পের শীর্ষে স্থাপিত কবিতাংশ এ রকম:
জানি আমার কষ্টে তুমি সুখ পাও না
এ ভাবে ভাগাভাগি হয় কষ্ট, হয় সুখ
শুধু দেখা হয় না হৃদয় খুলে চোখের মতো।
ওগুলান খাইতে গেলে কান্দন আসে
তবে সবসময় রহস্যগূঢ়তা নয়, মানবিক পরিস্থিতিও করুণঘন করে তুলেছে কোনো-কোনো গল্পকে। ‘পিঁপড়েরা আসছে ধেয়ে’ গল্পে পানিতে ডুবিয়ে রাখা নারকেলে ছোট-ছোট দাঁতের কামড় দেখে গৃহকর্ত্রী রোকেয়া বেগম সন্দেহ করেন কাজটি বছর সাতেকের কাজের মেয়েটির। প্রথমে তার দু’গালে ঠাস-ঠাস করে কয়েকটি থাপ্পড়, পরে কয়েক ঘা বসান তিনি। মেয়েটি জানায়, কাজটি তার নয়। তার কথা যে সত্য, তা প্রমাণের পর কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়েন রোকেয়া বেগম। তার হাতে একটু কোরানো নারকেল আর দু’টো জামরুল গুঁজে দিয়ে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। পরে জানা যায়, ওগুলো মুখে তোলেনি মেয়েটি। কারণ ‘ওগুলান খাইতে গেলে কান্দন আসে’ তার।
এ গল্পের শীর্ষে স্থাপিত কবিতাংশ
ঠোঁটের কাছে ঠোঁটটি এলে
বুকের কাছে মুখ,
দীর্ঘ কেন করো বিরহ
এতেই যদি সুখ!
আগেই বলেছি দীলতাজ গল্প লেখেন বলার ধরনে। তবে মাঝেমধ্যে সে বলার মধ্যে হোঁচট খেয়ে ঢুকে পড়ে উটকো শব্দ- ‘আবার তিনি ধপাস্ করে অবদমিত হয়ে গেলেন’। উটকো কথাও চলে আসে কখনো- ‘তারপর যুবতী কাজের মেয়ে জরিনার দিকে মুখ ফিরিয়ে…’। গল্পের শুরুতে যাকে উল্লেখ করেছেন ‘কাজের বড় মেয়ে জরিনা’ হিসেবে, তাকে পূর্বাপর কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই বিশেষভাবে ‘যুবতী’ উল্লেখের কোনো হেতু খুঁজে পাওয়া যায় না।