মলয় রায়চৌধুরী সারা জীবন সাহিত্যজগতে মূলধারার উজান স্রোতে সাঁতার কেটেছেন, যা প্রতিষ্ঠানবিরোধী ধারা হিসাবে পরিচিত। সাহিত্য ও সৃষ্টিশীলতাকে সব রকমের ক্ষমতাকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত ও স্বাধীন রাখার প্রত্যয় থেকে তাঁর এই আদর্শিক অবস্থান, যা ভারতের বাংলাভাষী বিভিন্ন অঞ্চলের কবি, সাহিত্যিকদের মধ্যে চর্চিত একটি বিকল্প ধারা। এর ক্ষীণ প্রভাব বাংলাদেশেও লক্ষণীয়। ক্ষমতাধর ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা প্রত্যাখ্যান করে চিন্তা ও তৎপরতার পাটাতন হিসেবে লিটল ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করে এই ধারার সাহিত্য গড়ে উঠেছে, যার অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব মলয় রায়চৌধুরী। এই ধারা থেকে তিনি দুটি সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছিলেন। এর একটি হচ্ছে ষাটের দশকের হাংরি আন্দোলন, অন্যটি নব্বইয়ের দশকে পোস্টমডার্ন বা অধুনান্তিক চিন্তা-দর্শন।
দ্বিতীয়টিকে অবশ্য আন্দোলন হিসেবে না দেখে চিন্তা-দর্শনের তৎপরতা হিসেবে দেখা হয়। সাহিত্যে বিশুদ্ধ চিন্তা, ভাষিক শুদ্ধতা ও উচ্চ আদর্শের যে-আভিজাত্যময় পরিমণ্ডল রয়েছে, তার স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে হাংরি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, যা সার্থকতা খুঁজেছিল নিম্নবর্গের ভাষা, অচ্ছুৎ-অশ্লীল শব্দ, অপরিমার্জিত আবেগ ও চিন্তার নৈরাজ্যকে স্থান করে দেওয়ার মাধ্যমে ক্ষমতাকেন্দ্রকে আঘাত করার স্বপ্ন ও স্পর্ধায়। হাংরি আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় কবি মলয় রায়ের কোমরে দড়ি বেঁধে, হাতকড়া পরিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ও কোর্টে তোলা হয়েছিল। সেই হাংরি আন্দোলন বেশি দিন স্থায়ী হয়নি, কিন্তু তার একটা প্রভাব বাংলা কবিতায় কারও কারও লেখায় দেখতে পাওয়া যায়। তিনি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস, ‘ছোটলোকের ছোটবেলা’তে বিহারের অনভিজাত পল্লিতে বেড়ে ওঠা বালক নিজের বেড়ে ওঠার সময় ও পরিপার্শ্বকে বর্ণনা করেছেন। যেখানে কুয়োতলায় জল নিতে আসা কলহরত নারীদের কণ্ঠস্থ অমার্জিত শব্দাবলী, স্ল্যাঙ ও খিস্তি-খেউড়ের মধ্যে জীবনের যে-উত্তাপ দেখেছেন, তার কোনো সাক্ষ্য প্রমিত ভাষার সাহিত্য ও বাগভঙ্গির মধ্যে পাননি। হাংরি আন্দোলন তাঁকে সেই স্পেস নির্মাণ করার প্রণোদনা জুগিয়েছে। এর সার্থকতা সম্পর্কে আমি নিঃসন্দিহান নই, তবে মূলধারার বাইরে স্পর্শকাতর প্রয়াস হিসেবে এর একটা মূল্য নিশ্চয়ই আছে। তবে তিনি যে তাঁর শুধু ‘ছোটলোক’ পরিচয়েই সন্তষ্ট ছিলেন, এমনটা মনে হয়নি। তাঁর বিভিন্ন লেখায় পূর্বপুরুষ সাবর্ণ জমিদার বংশের স্মৃতিচারণা উঠে এসেছে আত্মপরিচয়ের স্মারক হিসেবে, পেশাগত জীবনে চাকরিও করেছেন কর্পোরেট কোম্পানির উঁচু পদে।
হাই-মডার্নিস্ট বা অবক্ষয়ী আধুনিকতাকে নাকচ করে গত শতাব্দীর মধ্য আশি ও নব্বইয়ের দশকে চিন্তা-দর্শনের যে-নতুন ধারার সূত্রপাত হয় বিভিন্ন নামকরণে, উত্তর আধুনিক, আধুনিকোত্তর, অধুনান্তিক, পোস্টমডার্ন, সেখানেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক হিসেবে উপস্থিত হন। এই নতুন চিন্তা-দর্শনের দুটি ধারা : একটি হচ্ছে আধুনিকতাবাদী জীবনব্যবস্থায় মানুষের ওপর মানুষের সব রকমের কর্তৃত্ব নিরসনের উপায় হিসেবে নৈরাজ্যবাদে আত্মসমৰ্পণ; অন্যটি হচ্ছে আধুনিকতার অবক্ষয়ী ও খণ্ডত্ববাদী জীবনদর্শনের বিপরীতে অখণ্ডবাদী জীবনবোধের চর্চা; যা উত্তর-ঔপনিবেশিক চেতনার অন্বেষণে স্বদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মাটিঘনিষ্টতায় মুখর।
শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রে, প্রথমোক্ত ধারা প্রধানত ভাষা ও আঙ্গিকবাদী যেখানে মানুষের উপস্থিতি গৌণ; দ্বিতীয় ধারায় মানুষের উপস্থিতিকে মুখ্য জ্ঞান করে ভাষা ও আঙ্গিককে মুক্ত করার প্রেরণায় সৃষ্টিশীলসত্তা উন্মুখ ও ক্রম প্রকাশমান। মলয় রায়চৌধুরী প্রথমোক্ত ধারার প্রবক্তা এবং সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার চর্চায় এই ধারার অনেক অনুসারী আছে। এর সমস্যা আমি যেখানে দেখি তা হলো, কবিতাকে অর্থকেন্দ্রিকতা থেকে মুক্ত করতে গিয়ে অর্থাৎ ক্ষমতা কাঠামোর দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে গিয়ে একপ্রকার নৈরাজ্যময় শব্দক্রীড়ার জন্ম হচ্ছে যার পায়ের নিচে মাটি নেই। এ নিয়ে আমি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছি এবং ‘বাংলা কবিতা: অধুনান্তিকতার অভেদ সন্ধান’ নামে আমার বই প্রকাশিত হয়েছে, তাই এ প্রসঙ্গে আলোচনা দীর্ঘ করবো না। [১] এই যে দুটি আন্দোলনের (হাংরি ও পোস্টমডার্ন) সঙ্গে তিনি সক্রিয় তাত্ত্বিক হিসেবে যুক্ত ছিলেন তার ভেতর একটা মিল আছে। সেটা হচ্ছে প্রচণ্ড উন্মাদনা থেকে স্থিরাবস্থাকে আঘাত করে তছনছ করে দেওয়ার চেষ্টা, কিন্তু এর ফলে নতুন কী দাঁড়াবে, সেটা সম্পর্কে কোনো স্বচ্ছ ধারণা না থাকা বা প্রজ্ঞায় পৌঁছাতে না পারা।
মলয় রায়চৌধুরী তাঁর ‘হাংরি জেনারেশন সাহিত্য আন্দোলন’ প্রবন্ধে অনেক খুঁটিনাটিসহ জানিয়েছেন কোন পরিপ্রেক্ষিতে এই আন্দোলনের আইডিয়া তাঁর মাথায় আসে, কিসের ভিত্তিতে এর তাত্ত্বিক বুনিয়াদ তিনি গড়ে তোলেন, সতীর্থ হিসেবে তিনি কাদের সম্পৃক্ত করেছিলেন এবং সাহিত্যিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগতে এর তাৎক্ষণিক ও দূরপ্রসারী প্রভাব কেমন হয়েছিল। ১৯৫৯-৬০ সালে ইতিহাসের দর্শন ও মার্কসবাদের উত্তরাধিকার বিষয়ে দুটো লেখা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তাঁর উপলব্ধি হয় যে ‘স্বদেশী আন্দোলন’-এর সময়ে জাতীয়তাবাদী নেতারা যে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা উত্তর ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে এসে নষ্ট হয়ে গেছে এবং দেশভাগোত্তর পশ্চিমবঙ্গ যে-ভয়ঙ্কর অবসানের মুখে পড়েছে সেখান থেকে উনিশ শতকের মনীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয়। এই অবসান-অবক্ষয়কে তিনি একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিতে চেয়েছিলেন সাহিত্য আন্দোলনের মাধ্যমে, যার নাম দেন ‘হাংরি’ এবং শব্দটি তিনি পেয়েছিলেন ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসারের ‘ইন দ্য সাওয়ার হাংরি টাইম’ বাক্যটি থেকে। তিনি আন্দোলনের দার্শনিক পরিপ্রেক্ষিত গড়ে তোলেন ওসওয়াল্ড স্পেংলারের লেখা ‘দ্য ডিক্লাইন অব দ্য ওয়েস্ট’ বই থেকে। যেখানে স্পেংলার এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, একটি সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটি সরলরেখা বরাবর অগ্রসর হয় না, তা জৈবপ্রক্রিয়ার মতো একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়। এ কারণে সমাজটির নানা অংশের বাঁকবদল, কার কোন দিকে ঘটবে, তা আগাম বলা যায় না। যখন সমাজ নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, তখন তার সংস্কৃতি বিকশিত ও সমৃদ্ধ হতে থাকে নিত্য নব বৈচিত্র্যে, কিন্তু সেই সংস্কৃতির অবসান হয় যখন তার নিজস্ব সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে যায় এবং বাইরে থেকে যা পায় তাই নির্বিবাদে আত্মসাৎ করতে থাকে।
এর প্রেরণা এসেছিল বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কালখণ্ডে, বাঙালি জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠা ও স্বাধিকার অর্জনের উত্তাপ থেকে। আল মাহমুদের ‘সোনালী কাবিন’, আবুজাফর ওবায়দুল্লাহর ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ ও ‘বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা’, মোহাম্মদ রফিকের ‘কীর্তিনাশা’ ও ‘কপিলা’, মুহম্মদ নুরুল হুদার ‘আমরা তামাটে জাতি’, রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত সৈয়দ শামসুল হকের ‘পরাণের গহীন ভিতর’ এরকম কিছু উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত।
এ পর্যায়ে তিনি উপলব্ধি করেন যে “ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল একরৈখিক ইতিহাসের বনেদের ওপর অর্থাৎ আন্দোলনগুলো ছিল টাইম-স্পেসিফিক বা সময় কেন্দ্রিক। কল্লোল গোষ্ঠী এবং কৃত্তিবাস গোষ্ঠী তাঁদের ডিসকোর্সে যে নবায়ন এনেছিলেন সে কাজগুলোও ছিল কলোনিয়াল ইসথেটিক রিয়্যালিটি বা ঔপনিবেশিক নন্দন-বাস্তবতার চৌহদ্দির মধ্যে, কেননা সেগুলো ছিল যুক্তিগ্রন্থনা নির্ভর এবং তাদের মনোবীজে অনুমিত ছিল যে ব্যক্তিপ্রতিস্বের চেতনা ব্যাপারটি একক, নিটোল ও সমন্বিত।” এখান থেকে তিনি ফিরে তাকান প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলার কৌম-লালিত উদার সাহিত্য পরিসরের দিকে যেখানে পদাবলী সাহিত্য নামক স্পেস বা পরিসরে সংকুলান ঘটেছে বৈষ্ণব ও শাক্ত কাব্য; মঙ্গলকাব্য নামক ম্যাক্রো-পরিসরে মনসা বা চন্ডী বা শিব বা কালিকা বা শীতলা বা ধর্মঠাকুরের মাইক্রো-পরিসর। এখানে রচয়িতা নন, বরং মাইক্রো-পরিসরগুলো ছিল গুরুত্বপূর্ণ যেখানে বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা, উচ্চারণ ও বাকশৈলী ভাষিক বহুত্ববাদের স্মারক, কারণ ভাষা তৈরীর ব্যাপারে মানুষ জৈবিকভাবে প্রোগ্রামড। লর্ড কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং মেকলে সাহেবের শিক্ষাব্যবস্থার কারণে, ধনসম্পদ ও ভাবসম্পদে গড়ে ওঠা নতুন উচ্চ বর্গের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় বাঙালির ডিসকোর্স এবং নিম্নবর্গের প্রাক ঔপনিবেশিক ডিসকোর্সটি হারিয়ে যায়। মলয় রায়চৌধুরী দাবি করেন যে ১৯৬১ সালের প্রথম বুলেটিন থেকে হাংরি আন্দোলন চেষ্টা করে সময়কেন্দ্রিক চিন্তাতন্ত্র থেকে স্বতন্ত্র পরিসরলব্ধ চিন্তাতন্ত্র গড়ে তুলতে। এই হচ্ছে হাংরি আন্দোলনের মূল দার্শনিক ভিত্তি যার প্রাসঙ্গিকতা ও আবেদন অনুপেক্ষনীয়, কিন্তু এই দার্শনিকতার প্রয়োগ যে-ভাষাশৈলী, সাহিত্য প্রকরণ ও তৎপরতার মাধ্যমে হাংরিয়ালিস্টদের রচনাকর্মে ও সামাজিক পরিসরে মূর্ত হলো, তা নিয়ে বিতর্ক সে সময়ে যেমন ছিল, আজও আছে। আমি এর দূরবর্তী একজন পাঠক মাত্র এবং আমার পাঠকৃতিতে এই আন্দোলন-জাত রচনাকর্ম কোন রূপে ও অনুভবে ধরা দেয়, আমি শুধু সেটাই বলার চেষ্টা করব।
এই আন্দোলনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা যার অর্থ সরকার বিরোধিতা নয়, সংবাদপত্র বিরোধিতা নয়; হাংরি জেনারেশনের বিরোধ প্রচলিত সাহিত্যের ‘মৌরসি পাট্টা’কে উৎখাত করে নবতম মূল্যবোধ সঞ্চারিত করা। প্রচলিত সাহিত্যের ভাষিক শুদ্ধতা ও স্থিতাবস্থাকে তাঁরা আক্রমণ করলেন অপরিশুদ্ধ ভাষা, অপরিমার্জিত আবেগ, খিস্তি-খেউড়-স্ল্যাং ও রগরগে যৌনগন্ধী শব্দবন্ধে। যে কবিতার জন্য মলয় রায়চৌধুরী অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত এবং নিম্ন আদালতে দণ্ডিত হয়েছিলেন, ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’, ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হাংরি বুলেটিন, তার থেকে কিছু অংশ পাঠ করা যাক :
ওঃ মরে যাব মরে যাব মরে যাব
আমার চামড়ার লহমা জ্বলে যাচ্ছে অকাট্য তুরুপে
আমি কী কোর্বো কোথায় যাব ওঃ কিছুই ভাল্লাগছে না
সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাব শুভা
শুভা আমাকে তোমার তর্মুজ-আঙরাখার ভেতরে চলে যেতে দাও
[…]
আমি জানি শুভা, যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও
প্রতিটি শিরা অশ্রুস্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে হৃদয়াভিগর্ভে
শাশ্বত অসুস্থতায় পচে যাচ্ছে মগজের সংক্রামক স্ফুলিঙ্গ
মা, তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন?
[…]
ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতদিন
কবিতার আদিত্যবর্ণা মূত্রাশয়ে
এসব কী হচ্ছে জানি না তবু বুকের মধ্যে ঘটে যাচ্ছে অহরহ
সব ভেঙে চুরমার করে দেব শালা
ছিন্নভিন্ন করে দেব তোমাদের পাঁজরাবদ্ধ উৎসব
শুভাকে হিঁচড়ে উঠিয়ে নিয়ে যাব আমার ক্ষুধায়
[…]
আমাকে মৃত্যুর দিকে যেতে দাও একা
আমাকে ধর্ষণ ও মরে যাওয়া শিখে নিতে হয়নি
প্রস্রাবের পর শেষ ফোঁটা ঝাড়ার দায়িত্ব আমায় শিখতে হয়নি
অন্ধকারে শুভার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়া শিখতে হয়নি
শিখতে হয়নি নন্দিতার বুকের ওপর শুয়ে ফরাসি চামড়ার ব্যবহার
অথচ আমি চেয়েছিলুম আলেয়ার নতুন জবার মতো যোনির সুস্থতা
যোনিকেশরে কাঁচের টুকরোর মতন ঘামের সুস্থতা
[…]
তোমার তীব্র রূপালি য়ুটেরাসে ঘুমোতে দাও কিছুকাল শুভা
শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও
তোমার ঋতুস্রাবে ধুয়ে যেতে দাও আমার পাততাড়িত কঙ্কাল
আমাকে তোমার গর্ভে আমারি শুক্র থেকে জন্ম নিতে দাও
আমার বাবা-মা অন্য হলেও কি আমি এরকম হতুম?
সম্পূর্ণ ভিন্ন এক শুক্র থেকে মলয় ওর্ফে আমি হতে পার্তুম?
আমার বাবার অন্য নারীর গর্ভে ঢুকেও কি মলয় হতুম?
শুভা না থাকলে আমিও কি পেশাদার ভদ্রলোক হতুম মৃত ভায়ের মতন?
ওঃ বলুক কেউ এসবের জবাবদিহি করুক
শুভা, ওঃ শুভা
তোমার সেলোফেন সতিচ্ছদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে দাও আমায়
[…]
১৯৫৬ সালের সেই হেস্তনেস্তকারী চিঠি মনে পড়ছে
তখন ভাল্লুকের ছাল দিয়ে সাজানো হচ্ছিল তোমার ক্লিটোরিসের আশপাশ
পাঁজর নিকুচি-করা ঝুরি তখন তোমার স্তনে নামছে
হুঁশাহুঁশহীন গাফিলতির বর্ত্মে স্ফীত হয়ে উঠছে নির্বোধ আত্মীয়তা
আ আ আ আ আ আ আ আ আ আঃ
মরে যাব কিনা বুঝতে পার্ছি না
[…]
শুভা
আমাকে তোমরা ল্যাবিয়া ম্যাজোরার স্মরণাতীত অসংযমে প্রবেশ কোর্তে দাও
দুঃখহীন আয়াসের অসম্ভাব্যতায় যেতে দাও
বেসামাল হৃদয়বত্তার স্বর্ণসবুজে
কেন আমি হারিয়ে যাইনি আমার মায়ের যোনিবর্ত্মে?
কেন আমি পিতার আত্মমৈথুনের পর তাঁর পেচ্ছাপে বয়ে যাইনি?
কেন আমি রজোস্রাবে মিশে যাইনি শ্লেষ্মায়?
[…]
ওঃ এ সমস্ত কী ঘটছে আমার মধ্যে
আমি আমার হাত হাতের চেটো খুঁজে পাচ্ছি না
পায়জামার শুকিয়ে যাওয়া বীর্য থেকে ডানা মেলছে
৩০০০০০ শিশু উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমণ্ডলীর দিকে
ঝাঁকে ঝাঁকে ছুঁচ ছুটে যাচ্ছে রক্ত থেকে কবিতায়
এখন আমার জেদি ঠ্যাঙের চোরাচালান সেঁদোতে চাইছে
হিপ্নোটিক শব্দরাজ্য থেকে ফাঁসানো মৃত্যুভেদী যৌনপর্চুলায়
ঘরের প্রত্যেকটা দেয়ালে মার্মুখী আয়না লাগিয়ে আমি দেখছি
কয়েকটা ন্যাংটো মলয়কে ছেড়ে দিয়ে তার অপ্রতিষ্ঠিত খেয়োখেয়ি
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা কাব্য এবং সংস্কৃত কাব্য-সাহিত্যে, শৃঙ্গার রসের সুপ্রচুর নান্দনিক ব্যবহার আমরা দেখেছি। চর্যাপদের বৌদ্ধতান্ত্রিক পদকর্তা গুণ্ডরী পা যখন লেখেন, ‘তিঅড়া চাপী জোইনি দে অংকমালী।/ কমল কুলিশা ঘাণ্টে করহু বিআলী।। (বাংলা রূপান্তর : জঘন চেপে যোগিনী দে আলিঙ্গন।/ পদ্মবজ্র ঘেঁটে করি বৈকালিক রমণ।।), অথবা বৈষ্ণব পদাবলীর কবি জ্ঞানদাস রচিত ‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।/ প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর।।‘ এই পঙক্তিগুলোতে দেহসংরাগের ভাষা তীব্র তীর্যক ও আব্রুহীন, কিন্তু সেটা রতিলিপ্সার বৃশ্চিকজ্বালায় নিঃশেষিত নয়, অন্তরে যে-আনন্দ ও ভাবরসের ঢেউ তোলে, তার তুলনীয় কোনো অনুভব ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ পড়ে পাই না। এতে মেলে যৌনবিকারগ্রস্ত, ধর্ষকামী, পর্ণোগ্রাফিক বর্ণচ্ছটা যা স্নায়ু বিপর্যয়কারী। এই কবিতার জন্য মলয় রায়চৌধুরীকে কোমরে দড়ি বেঁধে গ্রেফতার করা এবং নিম্ন আদালতে দণ্ডিত করা হয়তো বাড়াবাড়ি, কিন্তু এর দ্বারা প্রচলিত সাহিত্যের নান্দনিক সৌকর্যের বিরুদ্ধে কীভাবে দাঁড়ানো যেতে পারে বা এর জন্য বিশেষ মূল্য দাবি করা যায়, আমি অন্তত বুঝি না। এই কবিতায় মলয় রায়চৌধুরী কথিত প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলার ডিসকোর্স, পদাবলী বা মঙ্গলকাব্যের কোনো মায়াবী পরিসর দেখি না ; বরং দেখি বটতলা সাহিত্যের রগরগে যৌনগন্ধীপথে হারিয়ে যাওয়া বিকারগ্রস্থ ব্যক্তিপ্ৰতিস্বের আর্তনাদ ! তাঁরই সতীর্থ, তীব্র তাপিত ফাল্গুনী রায়ের কবিতার শিরোনাম ‘অনডো-কোষ-এ ঝলোমলো দিন’ যে-কাম সঙ্কেত দেয়, তা উপভোগের জন্য বিশেষ রুচির দরকার হয় বৈকি !
ইউরোপীয় মননগত ব্যক্তিপ্ৰতিস্ব নির্মাণের বিপরীতে মলয় রায়চৌধুরী বাংলার পরিসরলব্ধ নিজস্ব ডিসকোর্স নির্মাণের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেছেন যে প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলার নিজস্ব স্পেসে রচয়িতা নন, পাঠবস্তই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমার বিবেচনায় এর একটা সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, বহুকাল ধরে পাঠবস্তু সেখানে স্থির ও পুনরাবৃত্তিমূলক। একজন মাইকেল মধুসূদন দত্তের আবির্ভাব না হলে ‘রামায়ন’-এর যে ভিন্নতর পাঠ সম্ভব এবং সেখান থেকে নতুন বোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ‘মেঘনাদবধ’-এর মতো কাব্য রচিত হতে পারে, তা প্রচলিত ধর্মভক্ত পাঠকদের পক্ষে অনুমান করাও অসম্ভব। মহাভারতের ঋষ্যশৃঙ্গ ও তরঙ্গিণী চরিত্রদ্বয়কে উপজীব্য করে বুদ্ধদেব বসুর অমর সৃষ্টি ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ এই ধারার আরেকটি উদাহরণ। ব্যক্তিপ্ৰতিস্বের সাথে ঐতিহ্যের সার্থক সংযোগে, তিরিশের হাই-মডার্নিস্ট কবিদের প্রধান জীবনানন্দ দাশ বাংলার নিজস্ব স্পেসকে তার নিসর্গ, ঐতিহ্য, ইতিহাস ও আর্কিটাইপ সহ নতুন মাত্রা ও অনুভবে উন্নীত করেছিলেন। ষাটের দশকে এসে মলয় রায়চৌধুরী বাংলার সেই স্পেস নতুনভাবে নির্মাণের কথা বললেও, তাঁর এবং অনুসারীদের রচনায় এমন কোনো সৃষ্টিকর্ম আমার চোখে পড়ে না যা তাঁদের অন্তর-তাগিদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেদিক থেকে বরং পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব বাংলার (আজকের বাংলাদেশ) কবিদের একাংশ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য দেখিয়েছেন। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে বাংলাদেশের আধুনিক কবিতায় দুটো ধারা শুরু থেকেই স্পষ্ট ছিল : একটি হচ্ছে তিরিশের আধুনিকতা প্রভাবিত নগরাশ্রয়ী কাব্যধারা এবং অপরটি গ্রামীণ জীবন ও ঐতিহ্যলগ্ন ধারা যা মলয় রায়চৌধুরী কথিত প্রাক ঔপনিবেশিক বাংলার নিজস্ব পরিসরের অন্তর্গত। এর প্রেরণা এসেছিল বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কালখণ্ডে, বাঙালি জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠা ও স্বাধিকার অর্জনের উত্তাপ থেকে। আল মাহমুদের ‘সোনালী কাবিন’, আবুজাফর ওবায়দুল্লাহর ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ ও ‘বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা’, মোহাম্মদ রফিকের ‘কীর্তিনাশা’ ও ‘কপিলা’, মুহম্মদ নুরুল হুদার ‘আমরা তামাটে জাতি’, রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত সৈয়দ শামসুল হকের ‘পরাণের গহীন ভিতর’ এরকম কিছু উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত।
বাঙালির নিজস্ব সাহিত্য স্পেস সৃষ্টির তাগিদ আশি ও নব্বইয়ের দশকে আরো জোরালো ও সংগঠিতভাবে উচ্চারিত হলো পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, ভারতের বিভিন্ন বাংলাভাষী অঞ্চল এবং বহির্বঙ্গে। বিবিধ অভিধায় চিহ্নিত হলেও (উত্তর আধুনিক, আধুনিকোত্তর, অধুনান্তিক, পোস্টমডার্ন) দুটো প্রধান ধারায় এর লক্ষণগুলো ফুটে উঠতে দেখা গেল যা নিয়ে শুরুতে কিছুটা আভাস দিয়েছি। পশ্চিমবঙ্গে ‘হাওয়া ৪৯’ নামক লিটল ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করে সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, রুদ্র কিংশুক এবং প্রভাত চৌধুরী যে পোস্টমডার্ন/ অধুনান্তিক চিন্তাধারা প্রকাশ করেন তার সার সংকলন পাওয়া যায় ‘পোস্টমডার্ন বাংলা কবিতা’র ভূমিকায়। [২] এর সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের চিন্তাধারার বেশ কিছু বিষয়ে সাদৃশ্য রয়েছে : কবিতায় বিষয়কেন্দ্রিকতার অভাব, যুক্তি কাঠামোর অনুক্রমের অনুপস্থিতি/ ক্রমান্বয়হীনতা, যুক্তিবিপন্নতা/ যুক্তিফাটল বা লজিক্যাল ক্র্যাক, যুক্তির দ্বৈরাজ্য, বহুরৈখিকতা, গ্র্যাণ্ড ন্যারেটিভের বিলোপ ও মাইক্রো ন্যারেটিভের জয়গান ইত্যাদি। তাদের বক্তব্য হলো নিটোল কবিতা, স্বয়ংসম্পূর্ণ এলিটিস্ট কবিতা, গুরুগম্ভীর কবিতা যেমন সনেট, ওড, ব্যালাড ইত্যাদি যা কিছু ঔপনিবেশিক মডেলের দান, তার পরিবর্তে তারা আগ্রহী হলেন এলো-মেলো, বহুরঙা, বহুস্বর, অপরিমেয় নাগালের বাইরের কবিতা রচনায়। যার যেমন ইচ্ছা তেমন লেখা ও বেপরোয়া হওয়াই যদি মোক্ষ হয় এবং কবিতার মান সংক্রান্ত বিবেচনা যদি সম্পূর্ণ লোপাট করা হয়, তাহলে যে-কেউ যা কিছু লিখে তাকেই কবিতা দাবি করতে পারে। তাই এ সময়ের অনেকের কবিতা পড়ে মনে হয়, বোধহীন নৈরাজ্যময় শব্দক্রীড়া। [৩] অথচ কাব্যরচনার জন্য কাব্যপ্রতিভা অনস্বীকার্য এবং কবিতার প্রক্রিয়াটিই এমন যে তা প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস ইত্যাদির যুক্তিকাঠামো অনুসরণ করে এগোয় না বটে, কিন্তু তারও থাকে আলো-ছায়াময়, আবেগ ও যুক্তির এক অন্তর্লীন পরম্পরা। স্মর্তব্য যে প্রাচীন ভারতীয় কাব্যসাহিত্য, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে এক সর্বব্যাপ্ত নান্দনিক শৃঙ্খলা দৃশ্যমান। যুক্তি-বিপন্নতা/ লজিক্যাল ক্র্যাক সম্বলিত একটি কবিতার উদাহরণ :
তাহলে দুর্গাপুর থেকে আজই ফিরলেন আর ওই রজতশুভ্র
আমি তো মিনিং ব্যাপারটার একেবারে দোরগোড়ায় পোঁছে গেছি
একটা বিশ্বব্যাকরণের যোগান অর্থবোধকতা খুঁজছে বানান
দুর্গাপুরে কি পাত্রী দেখলেন নাকি কবিদের সঙ্গে
রথীনের বোউ বেশ ছোটো সাইজের ভূত আর চোরের ভয়
যেভাবে চিনির শিশি খুঁজে বের করে একরতি পিঁপড়ে
বুঝে ফেলাকে যে-জন্য বলা হয়েছিল অবগতি
এবার প্লেটোর গুহায় বিপরীতে দিকে
ওই রসুলপুর সেই ব্রাশ ফেলে যাওয়ার স্মৃতি মেলডি
ঘটনা স্থির দর্শক গতিময় ঘটনা দর্শক খুঁজছে
[একটি বহুরৈখিক টেক্সট, সমীর রায়চৌধুরী]
কবিতায় লজিক্যাল ক্র্যাক যদি সৃজনপ্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে এবং তাতে সৃষ্টির নতুন আস্বাদ মেলে — ভালো; অন্যথায় এই তত্ত্ব অনুসরণ করে কবিতা রচনায় দুর্ভোগ মিলবে সন্দেহ নাই। এ যেন পয়সা দিয়ে ছেঁড়া জিন্স প্যান্ট কিনে ফ্যাশন করার বিলাসিতা !
মলয় রায়চৌধুরীর পরিসরলব্ধ চিন্তাতন্ত্রের স্বপ্ন মহৎ ও বৈপ্লবিক, কিন্তু এর পথ ও পদ্ধতি ভঙ্গুর এবং অপরিণামদর্শী। তিনি সৎ, সাহসী, নির্লোভ এবং তাঁর মধ্যে দ্বিচারিতা দুর্লক্ষ্য। মনের দিক থেকে, নতুন চিন্তা-দর্শনের সন্ধান ও গ্রহণে তিনি ছিলেন চিরযুবা—যা বিশ্বাস করেছেন তা আন্তরিকভাবে করার চেষ্টা করেছেন। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কথা বলে আরো অনেকের মতো সুযোগ বা পুরস্কারের লোভে আদর্শ বিচ্যুত হননি। তাঁর সাহিত্যকর্ম ও শিল্প-সাহিত্যের বিপুল পাঠ, তত্ত্ব নির্মাণের মনীষা ও জেদ তাঁকে বহু তরুণের আইডল হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে ; তিনি হয়ে উঠেছেন বিকল্প প্রতিষ্ঠান। তিনি তাঁর এই অবস্থান থেকে গুরুবাদী হয়ে ওঠেননি, বরং অহংহীনভাবে তরুণদের কাতারে নিজেকে নামিয়ে এনেছেন, তরুণদের সৃষ্টিশীলতাকে সম্মান করেছেন ও পাঠকসমক্ষে তাদের লেখা গুরুত্ব সহকারে প্রচার করেছেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে অন্য যে-ধারাটির উল্লেখ করেছি আগে, উত্তর আধুনিক/ আধুনিকোত্তর, তার তাত্ত্বিক অমিতাভ গুপ্ত, অঞ্জন সেন, প্রবাল দাশগুপ্ত, তপোধীর ভট্টাচার্য প্রমুখ। বাংলার নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, মাটিঘনিষ্ঠ সমবায়ী পাঠকৃতির অন্বেষণ ও অর্জন এই ধারার কবিদের হাতে বেশি ফলপ্রসূ হয়েছে বলে আমার পর্যবেক্ষণ। [৪] অঞ্জন সেন ‘উত্তর আধুনিক’ অভিধাটির ব্যাখ্যা করেন এভাবে : ‘উত্তর’ শব্দটি অনেকান্ত অর্থবাচক, পরবর্তী একটি অর্থ, প্রচলিত অর্থ। কিন্তু কোনো শব্দের অর্থই অনড় অচল নয়। শব্দের অর্থও পরিবর্তিত হয়। ‘উত্তর’ শব্দটি ভারতীয় দর্শন থেকে নেয়া, সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমরা এই শব্দের ব্যবহার করেছি ‘উত্তরণ ঊর্ধ্বে’ অর্থে। অর্থাৎ আধুনিকতা থেকে উত্তরণ (ইউরোকেন্দ্রিক-ঔপনিবেশিক আধুনিক) — আধুনিকতার ঊর্ধ্বে। […] উত্তর আধুনিকতার সাথে আধুনিকতার একটা সম্পর্ক থাকতেই পারে, উপরন্ত আধুনিকতার কয়েকটি গুণ উত্তর আধুনিকতার সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে।” [৫] এরপর যে কথাটি তিনি বলেন, খুব গুরুত্বপূর্ণ, “আধুনিকতা যেখানে সীমাবদ্ধ এবং জানে না কীভাবে তার থেকে উত্তরণ পাওয়া যাবে; উত্তর আধুনিকতা সেই সমাধান সম্পর্কে জ্ঞাত আর তাই আধুনিকতার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে যেতে জানে।” এখানেই অঞ্জন সেন গ্ৰুপের সাথে মলয় রায়চৌধুরী গ্ৰুপের চিন্তাদর্শনের পার্থক্য। কারণ তাঁরা বলছেন, “অধুনান্তিক কবিতা কোনো আদর্শ খাড়া করতে চায় না। সে কোনো যাত্রার সঙ্কেত দেয়। অধুনান্তিকতা কোনো পূর্ব নির্ধারিত তত্ত্ব নয়। কবির রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে কবিতাকে যুক্ত করা সম্ভব নয়।” [ভূমিকা : ‘পোস্টমডার্ন বাংলা কবিতা’]
এই তুলনামূলক আলোচনা করার অর্থ, হাংরিয়ালিস্ট-পোস্টমডার্নিস্ট মলয় রায়চৌধুরীর জীবন ও সাহিত্য দর্শনকে বোঝা এবং তা হলো, তিনি ক্ষমতাকেন্দ্রকে আঘাত করে তার স্থিতাবস্থাকে ভাঙতে চান, কিন্তু কী গড়বেন সে বিষয়ে অজ্ঞাত ও উদাসীন। একসময় তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহিত্য পরিমণ্ডলের কিছু বন্ধুদের সাথে মেলামেশা করার সূত্রে আমি শুনেছি তিনি বলতেন, ” আমি আমার নিজের পতাকাও বহন করি না।” এটা তো নৈরাজ্যবাদিতারই লক্ষণ, কিন্তু এই নৈরাজ্যবাদ কি অরাজনৈতিক?
ফিরে দেখা যাক, মলয় রায়চৌধুরীর ভাষ্য অনুযায়ী, হাংরি আন্দোলনের স্বভাব কীভাবে রাজনৈতিক চেহারায় আবির্ভূত হয়েছিল, “হাংরি আন্দোলনকারীরা সাহিত্যজগতের মূল্যবোধ-মালিক ও প্রকাশক-বাজারের জোতদারদের উৎখাত করতে চেয়েছিল, জন্তুজানোয়ারের মুখোশ পাঠিয়ে বিদ্যায়তনিক জোতদারদের টপলেস অর্থাৎ গলা কেটে ফেলতে চেয়েছিল, সাহিত্যিক ক্ষমতাকে দখল করে বিলিয়ে দিতে চেয়েছিল লিটল ম্যাগাজিনের মাঝে, জুতোর বাক্স রিভিউ করতে দিয়ে এবং শাদা ফুলস্কেপ কাগজকে ছোটোগল্প নামে বাজারি কাগজে জমা দিয়ে সাহিত্যিক জোতদারদের দলিদস্তাবেজ বেদখল করতে চেয়েছিল। […] তার কয়েক বছর পরেই নকশাল তরুণরা শিক্ষকদের গলা কাটা আরম্ভ করলেন, জোতদারদের বাড়ি লুঠ করে দলিল-দস্তাবেজ পুড়িয়ে দিলেন, জমি দখল করে বিলিয়ে দিলেন ভাগচাষিদের। […] নকশাল তরুণরা এসে দেখিয়ে দিল যে হাংরি আন্দোলনকারীদের এই কাজগুলো ঠাট্টা-ইয়ার্কি করার ব্যাপার ছিল না, তা ছিল চোখে আঙুল ঢুকিয়ে বাস্তবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার প্রক্রিয়া।” [প্রবন্ধ : ‘হাংরি জেনারেশন সাহিত্য আন্দোলন’]
ষাট ও সত্তরের দশক তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের স্বর্ণযুগ, তখন আন্দোলনের পন্থা নিয়ে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের মধ্যে মতভেদ ছিল যে বিপ্লবীরা কি পার্টির প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মেহনতি জনগণকে সংঘটিত করে শ্রেণীবিপ্লব সংঘটিত করবেন নাকি আন্ডারগ্রাউণ্ডে থেকে টার্গেট করে শ্রেণীশত্রুদের গলা কেটে তা সম্পন্ন হবে? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, লক্ষ্য অর্জনে দ্বিতীয় পন্থার গ্রহণযোগ্যতা এবং দূরদর্শিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। অনেক মেধাবী ও সাহসী তরুণদের আত্নত্যাগ সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে নক্সালপন্থীরা কেন ব্যর্থ হয়েছিলেন, তার উত্তর প্রশ্নের মধ্যেই নিহিত। প্রচলিত সাহিত্যের ‘মৌরসি পাট্টা’-কে উৎখাত করে লিটল ম্যাগাজিনের মধ্যে ক্ষমতা বন্টন করার হাংরি আন্দোলনের যে-বিপ্লবী মনস্তত্ব, তার সুফল হলো বহুস্বর ও বহু কবি, লেখকের আত্মপ্রকাশ ; এর কুফল হলো ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে একজন কবি বা লেখকের বৃহৎ পাঠকের কাছে পৌঁছানোর প্রতিবন্ধকতা। সেইসাথে রয়েছে ব্যক্তি অহংজনিত গোষ্ঠীর আভ্যন্তরীণ কলহ, বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যকার একে অপরের সাথে বিবাদ ও কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার জন্য লিটল ম্যাগাজিনের অপমৃত্যু ইত্যাদি সম্ভাবনাময় কবি, লেখকের বিকাশের পথে অন্তরায়। লিটল ম্যাগাজিনের সাথে যুক্ত কবি, লেখক মাত্রেরই রয়েছে এ অভিজ্ঞতা।
মলয় রায়চৌধুরীর পরিসরলব্ধ চিন্তাতন্ত্রের স্বপ্ন মহৎ ও বৈপ্লবিক, কিন্তু এর পথ ও পদ্ধতি ভঙ্গুর এবং অপরিণামদর্শী। তিনি সৎ, সাহসী, নির্লোভ এবং তাঁর মধ্যে দ্বিচারিতা দুর্লক্ষ্য। মনের দিক থেকে, নতুন চিন্তা-দর্শনের সন্ধান ও গ্রহণে তিনি ছিলেন চিরযুবা—যা বিশ্বাস করেছেন তা আন্তরিকভাবে করার চেষ্টা করেছেন। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কথা বলে আরো অনেকের মতো সুযোগ বা পুরস্কারের লোভে আদর্শ বিচ্যুত হননি। তাঁর সাহিত্যকর্ম ও শিল্প-সাহিত্যের বিপুল পাঠ, তত্ত্ব নির্মাণের মনীষা ও জেদ তাঁকে বহু তরুণের আইডল হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে ; তিনি হয়ে উঠেছেন বিকল্প প্রতিষ্ঠান। তিনি তাঁর এই অবস্থান থেকে গুরুবাদী হয়ে ওঠেননি, বরং অহংহীনভাবে তরুণদের কাতারে নিজেকে নামিয়ে এনেছেন, তরুণদের সৃষ্টিশীলতাকে সম্মান করেছেন ও পাঠকসমক্ষে তাদের লেখা গুরুত্ব সহকারে প্রচার করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে তাঁর ঘোষিত অবস্থান তিনি নিজের জীবনে নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন। প্রসঙ্গত বলতে হয়, ২০০৩ সালে ‘হাওয়া-৪৯’, কলকাতা থেকে ‘পোস্টমডার্ন বাংলা পোয়েট্রি ২০০৩’ নামে অধুনান্তিক বাংলা কবিতার একটি ইংরেজি অনুবাদ সংকলন প্রকাশিত হয় যার সম্পাদকত্রয়ী যথাক্রমে কবি সমীর রায়চৌধুরী, আমি এবং কবি কামরুল হাসান। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের বিভিন্ন শহর এবং বহির্বঙ্গে (পৃথিবীর অন্যান্য দেশে) বসবাসরত মোট ১০০ জন বাঙালি কবির প্রত্যেকের সর্বোচ্চ তিনটি করে কবিতার অনুবাদ ও বিষয় সম্পর্কিত দীর্ঘ প্রবন্ধ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়। মলয় রায়চৌধুরী পুরো সংকলনটির ওভারভিউ করেছিলেন। এই সংকলনের কাজে আমি কলকাতা গিয়েছিলাম ২০০২ সালে, তখন মলয়দার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয় তাঁর বাড়িতে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাঁর দাদা, ‘হাওয়া-৪৯’ পত্রিকার সম্পাদক সমীর রায়চৌধুরী এবং ঐ পত্রিকার কার্যনির্বাহী, গল্পকার মুর্শিদ এম এ। ২০০৫ সালে আমি কানাডায় অভিবাসী হয়ে চলে আসি এবং ২০০৯ সালে ফেসবুকের মাধ্যমে মলয়দার সাথে যোগাযোগ স্থাপিত হয়, ফেসবুক ও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত আমাদের লেখা নিয়ে পারস্পরিক মন্তব্যের আদান-প্রদান তাঁর মৃত্যুর (অক্টোবর ২০২৩) আগ পর্যন্ত কম-বেশি বহাল ছিল। এটা তাঁকে ব্যক্তি ও সাহিত্যিক হিসেবে বুঝতে আমার সুবিধা হয়েছে।
মলয় রায়চৌধুরীর চিন্তা-দর্শন নবায়ন করে সাহিত্য ও সামাজিক পরিসরে নতুনভাবে প্রয়োগের সুযোগ আছে বলে আমার বিশ্বাস।
তথ্যসূত্র
১. তুষার গায়েন, বাংলা কবিতা : অধুনান্তিকতার অভেদ সন্ধান, বেহুলা বাংলা প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ঢাকা
২. প্রভাত চৌধুরী, পোস্টমডার্ন বাংলা কবিতা, সম্পাদনা কবিতা পাক্ষিক, কলকাতা ২০০২
৩-৪. তুষার গায়েন, বাংলা কবিতা : অধুনান্তিকতার অভেদ সন্ধান, বেহুলা বাংলা প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ঢাকা
৫. অঞ্জন সেন, উত্তর আধুনিকতা প্রসঙ্গ, লিরিক, সংখ্যা-৯, চট্টগ্রাম, পহেলা বৈশাখ, ১৪০০ বঙ্গাব্দ
বি. দ্র. প্রথম প্রকাশ: অর্কিড, পঞ্চম বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা, খড়্গপুর, পশ্চিমবঙ্গ, জানুয়ারি ২০২৫