মুহূর্তের পদাবলি
মহল্লার দরজা খুলে দাড়িয়ে আছে নির্জন দুপুরের নৃত্য—
অপরাহ্নের শোকসভা—মাদুলি—
আমাকে উড়িয়ে নিচ্ছে শুকনো পাতা—সন্ধ্যার গলিমুখ
পেরিয়ে হাসনাহেনা ফোটাচ্ছে রাত্রির কলহ—যেন
কেউ গুটিয়ে নিচ্ছে স্মৃতির সারিন্দা—ফেলে আসা পদচিহ্ন—
যতই উড়িয়ে দেই ঘনঘোর দিনের শস্যদানা— ঘামফুল;
ঘুরে ঘুরে নিজের ছায়া একে যায় বিচূর্ণ মুহূর্তের পদাবলি
কতবার চলে গিয়ে এসেছি ফিরে, না ফেরার প্রলোভনে—
চুম্বনের ঘোর কেটে গেলে মানুষও মৃত্যুমুখর; বহুগামী—
তবু পার্কিং করে রাখি ধূলোপড়া দিনের পাতানো শরীর—
মৃত মানুষের শহরে পাখিরা খুলে রাখে তন্দ্রা ও অন্ধকার,
মুহূর্তেরা অবিরাম গেয়ে যায় বিস্মরণের গোপন এলিজি।
তৃষ্ণার ভেতর থেকে
তৃষ্ণার ভেতর থেকে নদী উঠে আসে
প্রতিটি ঝর্ণার শব্দকে
ভাঙতে ভাঙতে তুমি ডুবে যাও কথায়
অক্ষরের নাম ধরে ডাকো—প্রতিধ্বনি ফিরে আসে—
পিপাসা থেকে খসে পড়ে তেষ্টা—
জলের নামে;
তৃষ্ণার ভেতর থেকে পাখি উড়ে যায়
কয়েকটি চরণে মেখে
বৃষ্টির রেণু
কুয়াশায় ভিজে যাওয়া ভোরে একদিন
তৃষ্ণার ভেতরে খুঁজে নেবো
তোমার আদ্যাক্ষর।
রুপালি অক্ষরের নারী
সোনালি আলোর ভেতর থেকে মধ্যাহ্নের কররেখা বরাবর
ফুটে আছে অজস্র ছায়াপথ
মলাট পেরুলেই আমাদের গলি ঘুপচির জীবন—
স্নেহের আঁচল বিছিয়ে দাঁড়িয়ে এক নারী
তাকে আমি বৃক্ষ বলি—নক্ষত্রের রাতে
একা একা হেঁটে যেতে যেতে সে কথা বলে পাখির স্বরে
নদীর মতো গান গায় উড্ডীন পাখনায়
জীবনের নামে
কথারা ফুরিয়ে গেলে বেজে ওঠে হাওয়াদের মাউথ-অর্গান
এই বিরামচিহ্নের উপত্যকায়—
সময়ের স্রোতে বর্ণমালার খড়কুটো জ্বালিয়ে সে পোহাচ্ছে
অক্ষরের আগুন; ভাষা।
কথা
টুকরো টুকরো ইটের মতো ভেঙে যাচ্ছে কথা—
নৈঃশব্দের নিচে চাপা পড়ে গেছে
কথাদের মৃতদেহ
সব কথা ফুরিয়ে গেলে জিজ্ঞাসা চিহ্নের
পাশে দাঁড়িয়ে থাকে
দীর্ঘশ্বাস
কথা গিলে খেতে খেতে একদিন
নিজেকেই গিলে খায়
মানুষ।
ঘামের গ্রাফিতি
ভেতরে বৃষ্টি—বাইরে তুমুল স্রোত
হাওয়াদের অটোক্র্যাটিক পাখনা ভাঙছে বাতাসে—
মৃত্যুর ভেতরে গান! উপড়ানো আঙুলের পাখনায়
ফুটছে পাখিদের জন্মোৎসব
মানুষ জেগে গেলে হাওয়ারা খুলে রাখে পায়ের পাতা
রক্তের ভেতরে দৌড়ে আসে জিজ্ঞাসাচিহ্ন—
মুক্তির করতলে ঘামের গ্রাফিতি—
বুক চেতিয়ে দাড়িয়ে থাকা মুহূর্তেরা বারুদের ঘ্রাণে
একে যায় নতুন বাংলাদেশ।
দেশলাই পাখির গান
নিজের আগুনে পুড়ছে সূর্য—আলোর ভেতর হাতপাখা—
কাঠের নদীতে সাতরায় মানুষ, কালো পাথরের ভাতঘুম
ভেঙে নিদ্রারা খোঁজে অন্ধকার, ওটা নদী নয়—মৃতমানুষের
চোখ—ওখানে সমুদ্র ডুবে যায় মধ্যরাতে—স্বপ্নের ঘোরে—
সলতের মতো পুড়ে পুড়ে উবে গেছে পথ—ধুলো আর ছাই
ওড়াতে এসে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে হাওয়া—ভালোবাসা—নিমগ্ন
প্রজাপতি—ডানা মেলে পড়ে থাকা ঘামের ফাউন্টেন! খুঁজে
ফেরে যাবতীয় অভিধা—বাইফোকাল—নস্টালজিয়া—পেইন।
আলোর ভেতর দেশলাই পাখির গান—মানুষই মুলত গায়
রান্নাঘরের এলিজি—ধোঁয়ার খোসা উড়ে গেলে পাখিরা ফিরে
আসে মাটিতে—ফুল ফুটে আছে মধ্যবয়েসী নারীর শরীরে—
আগুনের লোভেও ছুটে আসে হঠাৎ নিহত পোকা ও পুরুষ!
শীতফুলের আয়ু
আসন্ন শীতকালের মতো ছোট হয়ে আসে আমাদের আয়ু—
কুয়াশারা লিখে রাখে সুইসাইড নোট
গোপন ব্যালটে
সময় একটা শামুকের খোল—
তার ভেতরে লুকিয়ে থাকে ধানপাতার দৌড়
পথের ধারে দুটো নিঃশ্বাস রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে ট্রাফিকরুম
ছোট হয়ে আসে অপেক্ষা—
প্রকান্ড বটগাছের ভেতর স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে মানুষ
জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে শুয়ে থাকা রাস্তায় ফুটে আছে বিয়োগচিহ্ন।
রাতের মলাট পেরুলেই পায়ের কাছে নেমে আসে শীতকাল।
নদী পেরুলেই সেতু
গাছগুলো উপুড় হয়ে হাওয়া খাচ্ছে বিছানায়
আমরা দৌড়াচ্ছি মৃত্যুর কাছাকাছি
নক্ষত্র তলিয়ে গেছে ঘুমে
জলগুলো একাকি
মানুষের মতো দাঁড়িয়ে
স্রোতের উপরে কতিপয় দৃশ্যের ছায়া
ভিজে গেছে রোদে
পাখির ঠোঁটে ধূলিফুল—বুকের ওপর
সেঁটে আছে তিনটি আঙুল
নদী পেরুলেই মানুষের সেতু—পারাপারহীন।
পতনের ভাষা
কিছু দৃশ্য থেকে এমনভাবে নামো
যেন সিড়ি ভেঙে নিচে নেমে যাচ্ছে জল
হাত থেকে খসে পড়ছে আঙুল
পাতারা কুড়িয়ে রাখে এইসব পতনকাল।
এই ভ্রমণ শেষ হলে দৃশ্যের পৃষ্ঠা
উল্টিয়ে চলে যাই
নামার শব্দেরা নিচু হয়ে বসে থাকে
তোমার পায়ের ছাপ
আমার কাছে হয়ে ওঠে প্যাচানো অক্ষর।
ফেরা
নিজের ফিরে আসার দিকে তাকিয়ে আছি
. একটা আকাশ
. একটা পথ
. আর একটা পা
পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে পড়ে আছে গুহায়
ধূলি ওড়া একটা মানুষ পাখি হয়ে উড়ে যাচ্ছে
গন্তব্য খেয়ে গেছে পথের দুই ধার
. একটা মানুষ
. একটা নক্ষত্র
. আর একজোড়া চটি
পায়ের তলায় লিখে যাচ্ছে না—ফেরার সংলাপ।
নিজের ফিরে আসার দিকেই তাকিয়ে আছি।