আমরা আমাদের অনুভূতিকে প্রকাশ করি—যত রকম পারি, জটিল-কুটিল করে। প্রকাশের জটিলতাই আধুনিক সভ্যকারদের ভঙ্গি। পল্লীকবিদের প্রকাশভঙ্গি পল্লীবাসিনীর মতোই সহজ-সরল; কোথাও হয়তো অর্ধনগ্নতা। কিন্তু সে নগ্নতায় বাসনার আমন্ত্রণ নেই। আছে আত্মভোলা মগ্ন মনের মাধুরী। সে মাধুরীর শ্রীতাকে দেখতে হলে আমাদের পড়তে হয় নিরক্ষর পল্লীকবিদের গান ও কবিতা। এ উক্তিটি করেছেন আমাদের জাতীয়, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি জানতেন একটা ইতিহাস, সভ্যতার সৃষ্টি করে ওই গ্রাম্য নিরক্ষর লোক কবি। যে মানুষেরা বাস করে, কাদা, মাটি, পানি আর প্রভৃতির নিটোল সান্নিধ্যে বা একান্ত কাছাকাছি। পল্লীর এসব কবি তাদের পারিপার্শ্বিক উপকরণ থেকে উপাদান সংগ্রহ করেই তো সৃষ্টি করল ময়মনসিংহ গীতিকা। যার উপজীব্য বিষয় পল্লী মানসের প্রেম, বিরহের উপাখ্যান। এ গীতিকাগুলোয় সমাজের প্রতিফলিত কালের পরিচয় ও সামাজিক পরিবেশের পরিচয় পাওয়া যায়। পল্লীকবিদের সহজ, সরল কথকতার মধ্য দিয়ে নারীর শাশ্বত জীবনের অকৃত্রিম রূপের বর্ণনা কবি সর্বজনীন করে ফুটিয়ে তুলেছেন।
এমন করেই এসব পল্লীকবিরা সৃষ্টি করেছে কতই না লোকসংগীত, লোকগীতি, লোককাব্য যা আমাদের এখন অমূল্য সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। লোক কবিদের যাপিতজীবন বোধের জায়গা আর ঘাত-প্রতিঘাতের জায়গা থেকেই তারা সৃষ্টি করেছে অজস্র তত্ত্বীয় সংগীত। এমনই একজন গ্রাম্য লোক কবি শ্রীকান্ত ক্ষ্যাপা (১৮৮২-১৯৭২)। তিনি জীবদ্দশায় অজস্র গান রচনা করে ছিলেন যা লোক সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। আমরা জানি লোক সংগীতের ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে ঝিনাইদহ জেলা সারাদেশেই সুপরিচিত। যেখানে জন্ম নিয়েছে লালন, পাঞ্জু, পাগলা কানাইয়ের মত দেশ জোড়া খ্যাতিমান লোকগানের দিকপালেরা। যাদের জন্মের মধ্য দিয়েই পরিবর্তিত হয়েছে ঝিনাইদহ মানুষের লোকসংস্কৃতির পরিবেশ। এ জেলায় জন্ম নিয়েছে বাউল, গীতিকার, মরমী সাধক, কবিয়াল, ভাবগান গায়ক, জারি, ধূয়ার রচয়িতা, কাব্য পুঁথির স্রষ্টারা। যাদের আগমনের ফলে এ জেলার লোকসংগীত তৎকালীন সময়ে সারা দেশের সেরা সংগীত হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। এখানে যে বাউল ধারা সৃষ্টি হয়েছে তার হাত ধরেই পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন জায়গা বিভিন্ন লোককবি বাউল গানের রচনা করেছেন। শ্রীকান্ত ক্ষ্যাপা ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা উপজেলায় ত্রিবেণী ইউনিয়নের অন্তর্গত জয়ন্তী নগর গ্রামে বাংলা ১২৮৯ সালের ৫ কার্তিক, ইংরেজি ১৮৮২ সালের ২০ অক্টোবর জন্ম গ্রহণ করেন। এটি একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। এ গ্রামে জন্ম হলেও কিন্তু ত্রিবেণীতে শ্রীকান্ত ক্ষ্যাপার আখড়াবাড়ি অবস্থিত। এ আখড়াটি নিরিবিরি, সুশান্ত একটা পরিবেশকে আশ্রয় করে গড়ে তোলা হয়েছে। যেখানে ক্ষ্যাপার শিষ্য ভক্ত বিভিন্ন সময় ভিড় জমিয়েছে এবং গান বাজনা করেছে। শ্রীকান্তের পিতা যজ্ঞেশ্বর অধিকারী এবং মাতা রজনী বৈষ্ণব। পিতা পরম বৈষ্ণব এবং মা বৈষ্ণব মতাদর্শ সাধিকা। রজনী বৈষ্ণবীর আবার অন্য নাম ছিল শ্রী চম্পক লতা দেবী। এ দুই বৈষ্ণব মিলে জয়ন্ত নগর একটি আশ্রম গড়ে তোলেন যেখানে কীর্তন ও ভাবসংগীততে সর্বদা এ আশ্রম মুখর থাকতো। কেননা আমরা জানি ঝিনাইদহ (বৃহত্তম যশোর), কুষ্টিয়া অঞ্চলে সে সময় সাধক বাউল, লোককবি, বাউলপন্থী, বৈষ্ণব কবির রমরমা অবস্থার কথা। আরও বলা যায় যে, সে সময়কালে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, যশোর, ফরিদপুর এসব অঞ্চল মুসলমান ফকির, বাউলপন্থী হিন্দু বৈষ্ণব প্রভৃতি সাধক সম্প্রদায়ের সাধনক্ষেত্র হিসেবে সুপরিচিত ছিল।
‘প্রেম-প্রেম বলে কত জনা ঘুরে বেড়ায় যতাতথা’
যজ্ঞেশ্বর অধিকারীর দুই পুত্র। জ্যেষ্ঠ মনিকান্ত আর কনিষ্ঠ শ্রীকান্ত। মনিকান্তের অকাল মৃত্যু হয়। পরবর্তী সময়ে আবির্ভাব হয় শ্রীকান্তের এসময় ঘটা করে পিতামহ গোপাল অধিকারী তার নাম রাখলো শ্রীকান্ত। শ্রীকান্ত ক্ষ্যাপা ছোট বেলায় কিছু দিন গ্রামের পাঠশালায় গেলেও পরবর্তী সময়ে তা আর চালিয়ে যেতে পারেননি। কে না উপভোগ করতে চাই পৃথিবীর সমস্ত প্রকৃতি, মানুষের শিক্ষা, যা তাকে প্রকৃত একজন আলেক সাইয়ের সন্ধান দিয়ে সঠিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। কিশোর বয়সের দূরন্ত কিশোর বালকের দিন দিন আগ্রহ বাড়ে প্রকৃতির একজন আপন বাউল সেজে উদাস মনে জয়ন্তী নগরের কালী নদীর পাড়ে গিয়ে প্রকৃতির দোল খাওয়া এবং রাখাল বালকদের সঙ্গে সঙ্গ দেওয়া যা তাকে পরবর্তী সময়ে জীবনসাধু হতে সাহায্য করেছে। শ্রীকান্ত ক্ষ্যাপার গ্রাম্য লোক কথনে জানা যায় তিনি নদী তীরবর্তী স্থানে মানে মাঝে যোগাসনেও বসতেন। পুত্রের এ অবস্থা দেখে পিতা যজ্ঞেশ্বর তাকে রাধা ক্ষ্যাপা মোহন্তের আশ্রমে পাঠান, এ সম্পর্কে দিলীপ বোসের সম্পাদিত ‘শ্রীকান্ত ক্ষ্যাপাও তাঁর গান’ পুস্তিকা থেকে জানা যায়—একদিন কিশোর শ্রীকান্তকে পিতা দেখলেন নদী তীরবর্তী বনে যোগাসনে বসে থাকতে। পুত্রের এবংবিধ আচরণে পিতা সন্তুষ্ট হলেন এবং পুত্রকে দীক্ষার জন্য পাঠালেন রাধা ক্ষ্যাপা মোহনের আশ্রমে। শ্রীকান্ত খ্যাপা এখানেই প্রথম দীক্ষা নেন। পিতা-মাতা যখন মারা যায় তখন তিনি খুব ভেঙ্গে পড়েন এবং কিছুদিনের মধ্যেই উদাস মনে কিশোর শ্রীকান্ত বের হয়ে পড়েন অজানা, অচেনা পৃথিবীর উদ্দেশে। গয়া, কাশি, বৃন্দাবন, প্রয়াগ, মথুরা, কামরূপ, কামাক্ষা ইত্যাদি তীর্থক্ষেত্র পর্যটন করে ফিরে আসেন আপন দেশে। কিন্তু এত কিছুর পরেও তিনি তার মনকে শান্ত¡না দিয়ে স্থির করতে পারছেন না। ঘুরে ফিরছেন এ শ্মশান থেকে অন্য শ্মশান। এ সময় তাঁর মনের অস্থিরতায় তাকে দিন দিন আরো ঘর, সংসার সম্পর্কে উদাসীন করে তুলছে। অনেক শ্মশান বাসের পর তিনি ফিরে আসেন যশোরের হরিণাকুন্ডু থানার ভায়না গ্রামের পূর্ব দিয়ে প্রবাহিত কুমার নদের পশ্চিম তীরের শ্মশান ঘাটে এসে শ্রীকান্ত গভীর ধ্যানে মগ্ন হন। এ শ্মশানে ধ্যান করার পর তিনি পাশেই নদীচরে একটি আশ্রম নির্মাণ করে বাস করতে থাকেন। এ সময় জয়ন্তীনগর ও তার পার্শ্ববর্তী গ্রামের কিছু ভাববাদী লোক এ আশ্রমে এসে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন।
আধ্যাত্ম সাধন পথের নির্দেশ লাভের আশায় ওই সব লোক শ্রীকান্ত খ্যাপার কাছে দীক্ষা গ্রহণের অভিলাষ জ্ঞাপন করেন। তিনি তাদের আশা পূর্ণ করেন। নবদীক্ষিত শিষ্যগণ ক্ষ্যাপাকে তাঁর পৈতৃক জন্ম ভিটেই আশ্রয় তৈরি করে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু সাধক শ্রীকান্ত শিষ্যদের এ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে রাতের আঁধারে, ভায়নার শ্মশান ছেড়ে চলে যান অন্য কোনোখানে। অতঃপর ঝিনাইদহ শহরের দক্ষিণে বিষয়খালী বাজারের পশ্চিমে মহারাজপুর গ্রামের উত্তর সীমানায় অবস্থিত যশাইখালী শ্মশানে গিয়ে আবার ধ্যানস্থ হন। এখানেও বেশ কিছুদিন থাকেন। পরে শিষ্যরা তাঁর খোঁজে আবার বের হয় এবং গুরুর কাছে গিয়ে তাঁর সাথে কথা বলেন। এবারও তারা জয়ন্তী নগর আশ্রম তৈরির আবেদন জানান, এবার খ্যাপা অনুমোদন দেন আশ্রম তৈরির কিন্তু জয়ন্তী নগর নয়- মূল ত্রিবেণী গ্রামে।১ ত্রিবেণী গ্রামে তখন নিত্য গোঁসাই এর আশ্রম নামে একটি আশ্রম ছিল। নিত্যগোঁসাই এখানে জীবন কাটিয়েছেন এবং এখানেই দেহ রাখেন। তাঁর সমাধিত এখনও এ আশ্রমে বিদ্যমান। শ্রীকান্ত এখানেই আশ্রয় নিলেন এবং আসন পেতে বসলেন। এখানে দিনকে দিন তাঁর শিষ্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েই যাচ্ছে। ‘শশীভূষণ পাগল’ নামে একজন সহজিয়া বৈষ্ণব কুষ্টিয়া সদর উপজেলাধীন কমলাপুর গ্রামে বাস করতেন। শ্রীকান্ত তার নিকট থেকে দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং সন্ন্যাস জীবন ত্যাগ করে সাধনতত্ত্বের দিকে মনোনিবেশ করেন। গুরুর আদেশেই পরবর্তী সময়ে কুষ্টিয়া শহরের নিকটবর্তী ‘কয়া’ গ্রামের এক বৈষ্ণব কন্যা, নাম শ্রী শৈলবালা অধিকারী তাকে তিনি বিয়ে করেন। এ সময় শ্রীকান্তের বয়স ৫৮ বছর। শৈলবালা দেবী স্বামীর সঙ্গে সঙ্গে বেড়াতেন। তিনি ছিলেন আমৃত্যু শ্রীকান্তের সাধনসঙ্গী। শ্রীকান্তের একটি গানে পাই-
প্রেম করা কি মুখের কথা
সে প্রেম রসিকের অন্তর গাঁথা।
প্রেমের লাগি শংকর যোগী
হয়ে আছে জ্যান্ত মরা।
ওসে শ্মশান মশানে ফেরে
পেলেনা তার বিন্দু কোথা
প্রেম-প্রেম বলে কত জনা
ঘুরে বেড়ায় যতাতথা
না জানি আপ্ত তত্ত্ব
পেলো না সে প্রেমের লতা।
যে প্রেমেতে গৌর হরি-
রাধা প্রেমে হয়ে মাতা।
খেপা কান্ত বলে ভাবের মানুষ
গলে দিয়ে চিন্তা খাতা।
স্ত্রী শৈলবালা অধিকারী শ্রীকান্তের সঙ্গে বেড়ানোর কারণে আশ্রমে লোকজনের খেদমত করার অসুবিধা হয়। যার কারণে মাতৃ আদেশে খ্যাপা দ্বিতীয় দায় গ্রহণ করেন। শ্রীকান্তের ২য় স্ত্রীর নাম যুগোল কিশোরী দেবী। শ্রীকান্তের মৃত্যুর পর এ স্ত্রী অনেক দিন জীবিত ছিলেন এবং শিষ্য, ভক্তদের অনেক খেদমত করতেন যা শিষ্যদের মুখে মুখে তার প্রশংসাসূচক কথা শোনা যেত শ্রীকান্ত খ্যাপার মধ্যে কবি প্রতিভার উন্মেষ ঘটলে তিনি মুখে মুখে রচনা করে যান অজস্র গান। যা লোক মুখে প্রচারিত হতো। এ গানের জন্যই তিনি অতি সহজেই সবার নিকট পরিচিত হয়ে ওঠেন। এ সংগীতের মধ্যে তাঁর চিন্তাজগতের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ভাববাদী একজন লোককবি। তাঁর একটি গানে লক্ষ্য করা যায়,
কুলবতী হয়ে সখী যেজন প্রেম করে
তুষের অনল হয়ে জ্বলে সদাই পুড়ে মরে রে।
গৃহ কাজে সদাই থাকি, হৃদয় মাঝে ঐরূপ দেখি গো
আমার মন গুমরে বসে থাকি কইলে কথা স্মরণে।
দাবানলে বন পোড়ে, জল দিলে নিভে আগুন গো।
মনের আগুন দ্বিগুণ জ্বলে জল দিলে নিভে নারে।
থাকি রন্ধন গৃহে বসে ধূয়ার ছলা রে করে কান্দি গো
হা গোবিন্দ বলতে নারি কুটিলার ভয় করে।
খেপাকান্ত বলে কৃষ্ণ প্রেম যতনে রেখো সংগোপনে গো
কইতে হলে বিন্দু না রয় কলঙ্কেতে দেশ ভরে ।
খ্যাপা একজন আধ্যাত্ম সাধন পুরুষ। যার কাছে গেলে মনের আঁধার ঘুছে যায়। সন্ধান পাওয়া যায় শুদ্ধ মনের, সাধন মানুষের যার মধ্য দিয়ে বিশুদ্ধ মানুষ হওয়া যায়। শুদ্ধ হওয়া যায় আত্মাকে জাগানোয় মধ্য দিয়ে যা আমাদের সঠিক পথ দেখিয়ে দেয়। পরিচয় করিয়ে দেয় সরল, সহজ মানুষদের সাথে। যারা জ্যাতা মরা।
ওগো মুর্শিদ তোমার লীলা বুঝা হলো দায়
শরিয়ত, হকিকত, তরিকত, মারফত
কোন তরিকে গেলে দয়াল তোমার পাওয়া যায়
জন্মবধি ঘুরে বেড়াই কোন তরিকে লব ঠাঁই
তাই বলো আমায়।
তুমি বলো বলো ওগো মুর্শিদ, কোন তরিকে হবো পার ।
চার তরিকে হয় মুক্তির পথ
কোনটা রেখে কোনটায় যাই, বলো মুর্শিদ ভাই।
(এখন) চৌমুহনায় পড়ে, কান্ত ভেড়োর জীবন যায়।
এই লোক কবি একজন অসম্প্রদায়িক। ধর্ম বৈষম্য তার কাছে নাই। তাঁর বড় ধর্ম মানব ধর্ম। এ ধর্ম ব্যতিত তিনি অন্য কোনো ধর্মকে প্রাধান্য দেননি। এ ধর্মই মানবমুক্তির ধর্ম। সমস্ত লোককবিই এ ধর্মনামের ঘোরকে এড়িয়ে চলেছেন। সবাইকে আনতে চেয়েছেন নিজস্ব এক বলয়ের মধ্যে। যেখানে এসে সবাই একসাথে থাকবে সেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না। শ্রীকান্তের পূর্বসূরি লালন যেমন বললেন-
অনন্তরূপ সৃষ্টি করলে সাঁই
শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই
দেব-দেবতাগণ করে আরাধন
জনন নিতে মানবে ।
তাদের সাধনাতে দেব-দেবী মূল্যহীন, সেখানে জয় হয়েছে মানবধর্মের। বর্ণভেদ আর মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে তাদের ধিক্কারময় সংগীত। মানবমুখী আর মানবতার জয় জয়কার তাদের গানে। এগানেই তারা সৃষ্টি করতে চাই ভেদহীন উন্নত সমাজ। তাইতো শ্রীকান্ত গলাই সাধলেন বিদ্রোহের সুর—
আমি জন্মাবধি দেখি কেবল জাতে বিচার
ও তুই জাত কুলমান না ছাড়িলে কেমনে হবে ভব পার।
বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান
এক নিখিলেই জন্ম দেখি ভিন্ন ভেদ নাই।
ও তুই যখন যাবি ভব পারে
এক নৌকাতে হবি পার।
শ্রীকান্ত খ্যাপার গানে উঠে এসেছে সামাজিক নানা অসঙ্গতি আর সংঘাতের কথা কারণ একজন লোককবি বা একজন বাউল তত্ত্বাকার হিসেবেও এগুলো এড়িয়ে চলার কোনো কারণ নেই। তিনি পাকিস্তান আমলে জিকে প্রকল্প ক্যানেল কাটা বিষয়েও গান করেছেন। এছাড়াও কুষ্টিয়ার বিখ্যাত মোহিনী মিল সম্পর্কেও রচনা করেছেন তাঁর গান। এ গানে তিনি কলকারখানার সাথে দেহের তুলনা করেছেন।
বাংলার শোভা মোহিনী মিল দেখতে কি বাহার
চৌষট্টী ভাবেতে কর্ম হচ্ছে এক ইঞ্জিনের পয়।।
কী দিব তাহার তুলনা এদেশে মেলে না আর
আপ্ত-তত্ত্ব না জানিলে বুঝে ওঠা ভার।
তিনি এ গানগুলোর মধ্য দিয়েই খ্যাতির শিখরে পৌঁছে গিয়েছেন। বাংলাদেশের ছাড়াও মথুরা ও ভারতের মধ্যে তাঁর আশ্রম রয়েছে। এ সম্পর্কে দিলীপ বোসের বর্ণনা প্রণিধানযোগ্য-সাধক শ্রীকান্ত প্রতিষ্ঠিত আশ্রমগুলো হলো মথুরাপুর, ভারতের মধ্যে অবস্থিত নবদ্বীপের সন্নিকটস্থ শম্ভুনগর গ্রাম। আশ্রমগুলোর মধ্যে ত্রিবেণীর আশ্রমই অপেক্ষাকৃত বৃহৎ। ত্রিবেণী ভক্ত সম্মিলনি আশ্রম। শ্রীকান্তের কবি প্রতিভা অসাধারণ। বাউলেরা যেমন আলেক সাঁই, আরশি নগর, বিশুদ্ধ মানুষের সন্ধান করে সেই রূপ শ্রীকান্তও সন্ধান করেছেন এ সাইকে। তাঁর কৃপাগুণেই তিনি পাড়িদেবেন ভবনদী, অন্যথায় নয়। তাঁর গানের বাণীতে সঞ্চালিত হয়েছে চেতনা, সামাজিক বাস্তবতা যা বাউল সাধনার পথই বাতলে দেয়। এ আধ্যাত্ম চেতনালোকই তাকে পৌঁছে দিয়েছে অধর মানুষ রূপে। তাইতো তাঁর গানে মুর্শিদ, ঈশ্বর, জীবে দয়া, পরার্থতার পরিচয় পাওয়া যায় যা তাকে অমায়িক গুণের শিক্ষা দেয়। জাতের ভেদাভেদ তাকে কলঙ্কিত করতে পারেনি এবং শুদ্ধ মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিয়েছে যা তাকে সকল শ্রেণীর মানুষ হয়ে ওঠার পথ বাতলে দিয়েছে।
‘কঠোর দেহে প্রেম হলো না, আমি ভেবে ভেবে হইলাম সারা’
গ্রামগঞ্জের শিষ্যদের মুখে এ সাধক কবির অসংখ্য গান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যা সংগ্রহ করা হলে বাংলা লোকসাহিত্যের বিশাল এক সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হবে। তবে অনুমান করা হয় তিনি ১০ হাজারের বেশি গান রচনা করেছেন। তবে বর্তমান ৬০২৫ টি গানের পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া গেছে। এগানগুলোয় তিনি সমকালীন সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানবপ্রেম ও আধ্যাত্মিকতাবে প্রাধান্য দিয়ে গেছেন। এমনকি তিনি গোড়ামি আর ভণ্ডামির মুখোশ উন্মোচন করেছেন তার গানের মাধ্যমে যা সমাজ জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। এ মহান ঋব্ধ পুরুষের জীবন অবসান ঘটে ১৯৭২ সালে (১৩৭৯ বঙ্গাব্দে আষাঢ়)। তাঁর মৃত্যুর পর পোষ্য কন্যা অলকাবালা অধিকারী এবং অলকাবালার স্বামী শ্রী নারায়ণ চন্দ্র অধিকারী আশ্রম তত্ত্বাবধান করতেন। বহুদিন থাকার পর তারা ভারতে চলে যান। এভাবে কিছুদিন আশ্রমটি পড়েছিল অযত্ন আর অবহেলায়। স্বাধীনতার পর কুমারখালীর কানু অধিকারী ও তার স্ত্রী এর তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত হন। তাদের পর বর্তমানে অনাদী কুমার চক্রবর্তী নামে একজন স্কুল শিক্ষক এখানকার দায়িত্বরত আছেন। শ্রীকান্ত খ্যাপার গানগুলো লোকায়ত বাউল গান। যার মধ্যে আরোপিত হয়েছে বাউলিয়ানা সুর। তাঁর শিষ্যরা একতারা, বায়া, খোল, করতাল, খমক, প্রেমজুড়ির সমন্বয়ে এগানগুলো পরিবেশন করে থাকেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো শ্রীকান্ত খ্যাপা কখনও গানের কোন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হননি। তিনি শাস্ত্রীয় ভাবগান শুনতে এবং রচনা করতেন। যা আজ আমাদের অমূল্য সম্পদ। এ গানগুলোর মাধ্যমে আমরা তাঁর কবি মানসের পরিচয় পাই এবং বুঝতে পারি তিনি কত উচ্চমার্গের তত্ত্বীয় সংগীত রচয়িতা ছিলেন। তার একটি গান এখানে যোগ করা হলো—
গুরুর প্রেমে নয়ন দিয়েছে যারা
এদেশে নাই তারা,
অপার নদী পাড়ি দিয়ে হয়ে গেছে স্বভাব ছাড়া
এদেশে নেই তারা।
কোটি জনম সাধন করে
এই মানব কুলে জনম
মনের স্বাদ মিটাইছে তারা
গুরু বলতে আত্মহারা নয়নে বয় অশ্রুধারা।
তারা ঝাঁপ দিয়েছে প্রেম সাগরে
খায় নাই ধরে-
মরণের ভয় করে নাই তারা।
(আ) যার হয়েছে গাঢ় ভক্তি
হৃদয়ে জ্বেলেছে জ্ঞানের বাতি
রূপ নিহারে দেয় পাহারা
বাতি কুবাতাসে নেভে নারে
ঐ দেখ অনুরাগের কাছে ঘেলা।
শ্রীকান্ত কয় হায় কি হলো
আমার কুসঙ্গে মন মজে রইল
আমায় কঠোর দেহে প্রেম হলো না
আমি ভেবে ভেবে হইলাম সারা।