ঘরের ভেতর কালো কিন্তু ঝলমলে রেশমের মতো মোলায়েম অন্ধকার। অন্ধকারে সুনমের হাসি দেখা যায় না, শব্দ শোনা যায়।
মায়ার একবার পাহাড়ে পথ হারিয়ে দূর থেকে ঝরনার কলধ্বনি শুনেছিল। তার চারদিকে ছিল তখন বিপুল বৃক্ষরাজি আর বুনো লতাপাতার ঘন সন্নিবেশ। সেখানে সূর্যালোক ছিল না; আরণ্য অন্ধকারে নিমজ্জিত প্রকৃতির সুবিশাল মৌনতায় অদৃশ্য ঝিঁঝিদের সন্তর্পণ শব্দময়তা আর অরণ্য শরীরের গভীরতায় মিশে থাকা বাতাসের হঠাৎ কম্পনে সৃষ্ট আলো-ছায়ার আলোড়ন ছিল শুধু। সে আলো-ছায়ায় ডুবতে ডুবতে আর ভাসতে ভাসতে সে পথ খুঁজছিল বিহ্বলের মতো। নীরবতার অন্তর্ভেদী ঝিঁঝিতানের মতো তার ভেতরেও ছিল পথ খুঁজে পাওয়ার আকুতি; অবশেষে হতাশায় আচ্ছন্ন হতে হতে সে যখন হেঁটে যাচ্ছিল যে-কোনো একদিকে, হঠাৎ তার অবসন্ন শ্রবনেন্দ্রিয়কে সচকিত করে দিয়ে কোথাও একটা হরিণ ডেকে উঠলো। তার সঙ্গে ভেসে এলো ঝরনার কলধ্বনি।
মায়ার ঝরনার তীর থেকেই অরণ্যে প্রবেশ করেছিল, তাই ঝরনার শব্দে তার আচ্ছন্নতা কেটে গেল পথ খুঁজে পাওয়ার আনন্দে। তারপর সে দু’হাতে বুনো লতাপাতা সরাতে সরাতে ঝরনার শব্দ শুনে শুনে এগিয়ে চললো। এক সময় ঝরনার পানিতে নেমে দু’হাত আঁজলা বানিয়ে পানি খেলো ইচ্ছেমতো। তখন নিশ্চিন্ততায় তার মন ভরে গেছে এবং শরীরের অবসাদ কেটে গিয়ে পাখির পালকের মতো হালকা হয়ে গেছে সে।
অন্ধকারে সুনমের হাসির শব্দ মায়ারকে সে পাহাড়ে পথ হারিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শোনা ঝরনার কলধ্বনির কথা মনে করিয়ে দেয়। চকিত আবেগে গলে যেতে যেতে সে বুনো লতাপাতা সরানোর মতো করে সুনমের চুলের অরণ্যে হাত চালায়। তার হাত ক্রমে ক্রমে সুনমের কপাল গাল এবং গাল থেকে ঠোঁটের মাঝখানে এসে স্থির হয়। সুনমের ঠোঁট এখন সংবদ্ধ। সংবদ্ধ ঠোঁটের ওপর আঙুল বোবুলাতে বোলাতে সে ঝরনার কথা ভাবে। সুনমের ঠোঁটের পাপড়ি দুটো ঝরনার দু’পাড়ের মতো উঁচু আর সজীব। আর মাঝখানের নিচু অংশ যেন ঝরনার বুক। মায়ার মুখ নিচু করে। দু’হাতে আঁজলা বানিয়ে পানি খাওয়ার মতো করে সে সুনমের মুখ তুলে ধরে ওপরের দিকে। তারপর আস্তে আস্তে নিজের দু’ঠোঁট ডোবায় তার ঠোঁটের ঝরনায়। সুনম শুয়ে আছে স্থির আর শান্ত ভঙ্গিতে; শুধু তার হৃদয়ের প্রবলোচ্ছ্বাস থেকে থেকে কেঁপে ওঠে মায়ারকে আলোড়িত করছে, উন্মথিত করছে।
মায়ার মুখ উঁচু করে কম্পিত স্বরে ডাকে, সু…
সুনম নিবিড় পাহাড়ের অন্তরে লুকানো ঝরনার মতো বেজে ওঠে, উঁ!
…তারপর তারা ঘুমিয়ে পড়ে প্রবল ঝড়ে বিধ্বস্ত বৃক্ষের মতো। তাদের নিঃশ্বাসের সঙ্গে নিঃশ্বাস আর প্রশ্বাসের সঙ্গে প্রশ্বাস মিশতে থাকে সারারাত ধরে অন্ধকারে।
দুই.
আবার কখনো চাঁদের আলোয় অন্ধকার উবে যায়। অজস্র তারা ফুটে থাকে আকশ-আঙিনায় ভালোবাসার ফুলের মতো। কোটি বছর বয়সী সেসব ফুলের অননভূত সৌরভ আলোকাবেশে উন্মথিত করে চেতনার লোকালোক। কোথাও রাতজাগা পাখি ডাকে, সামান্য বাতাস দোলা দেয় জানালার পাশে দণ্ডায়মান নারকেল পাতার আত্মমগ্ন স্থিরতায়। তখন একটি প্রিয় গান বাজতে থাকে ঘরের ভেতর। প্রিয় গান মনকে মথিত করে, বুকের গভীরে এক সমুদ্র তরঙ্গ জাগায়; প্রিয় গান বৃষ্টির মতো অবিচ্ছিন্ন সুরময়তায় ঝরতে থাকে চেতনার অরব প্রান্তরে আর সেই প্রান্তরস্থিত মৃত্তিকার প্রতি বিন্দু সুরের বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে একদম গলে যায়, কাদা হয়ে যায়। মায়ার তখন চন্দ্রালোকিত সে প্রান্তরে বসে সুরের বৃষ্টিতে ভেজা কাদামাটির ডেলা নিয়ে খেলা করে।
আপন মনে খেলতে খেলতে সে অজস্র মূর্তি বানায়। সে সব মূর্তির নাক, চোখ আর ঠোঁটের গড়নের সঙ্গে সুনমের নাক, চোখ আর ঠোঁটের অবিকল মিল। আসলে সে একটিমাত্র মূর্তিই গড়তে পারে শুধু। তবে সে মূর্তির ভঙ্গিমায় অজস্র কারুকাজ। কিন্তু কারুকাজের এরকম অজস্রতায়ও তার অভীষ্ট সৃজনী কর্মের নিবৃত্তি ঘটে না। এক তীক্ষ্মমুখ সূচসদৃশ অতৃপ্তির অসহ্য খোঁচায় সে শুধু রক্তাক্তই হতে থাকে অবিরাম। এবং এরকম অতৃপ্তির খোঁচায় রক্তাক্ত হতে হতে তার আবার অন্ধকার চাই। আসলে অন্ধকারই ভালো। অন্ধকারই মানুষকে তার প্রকৃষ্ট পরিচয়ে প্রদীপ্ত করতে পারে। অন্ধকারে আলোর কৃত্রিমতা থাকে না এবং আলোকেই মানুষ জটিল আর দুর্বোধ্য হয়ে যায়। আলোক মানুষের মুখকে দৃশ্যমান আর মনকে আড়াল করে দেয়। আর অন্ধকারেই স্বপ্ন তার নানা রঙে দীপ্যমান হয়। মায়ার তাই সুনমকে সঙ্গে নিয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে জানালার পাশে প্রাকৃতিক আলো-আঁধারির মধ্যে গিয়ে বসে।
তখন সুনম তার সামনে রক্ত-মাংসের শরীর নিয়েই বসে থাকে এবং সুনমের কণ্ঠস্বর প্রিয় গানের সুরকে ছাপিয়ে ওঠে প্রিয়তর ব্যঞ্জনায়। তখন সুনম কথা বলে, আর মায়ার তার কথার প্রতিটি শব্দকে অমূল্য রত্নদানার মতো বুকের গভীরে ভরে রাখে। ক্রমে রাত বাড়তে থাকে, সপ্তর্ষিমণ্ডল হেলে পড়ে পশ্চিম দিকে, রাতজাগা পাখির কণ্ঠ ক্লান্তিতে অস্পষ্ট হয়ে আসে, তবু সুনমের কথা ফুরায় না। সুনম জীবনের কথা বলে, স্বপ্ন আর ভালোবাসার কথা বলে, ফুল আর পাখিদের আনন্দ নিয়ে আলাপ করে। মায়ার শুধু শোনে, তার সামনে বসা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম নারীর মুখের দিকে তাকিয়ে তার কথা শোনে শুধু।
শুনতে শুনতে সে এক সময় সুনমের কোলের ওপর মাথা নিচু করে। অপূর্ব এক সমর্পণের আনন্দে তার কোলে মুখ ঘষতে থাকে। সুনম তার মাথায় হাত বুলায়। তার আঙুলের ডগা চুইয়ে মমতা ঝরে মায়ারের মস্তিষ্কের কোষে কোষে, সমস্ত হৃদয় জুড়ে। মায়ার মুখ ঘষতে থাকে পাগলের মত। সুনমের হাঁটু, উরু, আর তলপেটের উষ্ণতা থেকে র্নির্ভরতার আস্বাদ গ্রহণ করতে থাকে বুভুক্ষুর মত। সুনম হেসে ওঠে। দু’হাতে মায়ারের মাথা জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নেয়। তারপর কপালে টুক করে চুমু খেয়ে বলে, ‘এত অবুঝ কেন তুমি, বলো তো?’
মায়ার তার বুকের উপত্যকায় মুখ লুকিয়ে শিশুর মতো সরল অভিমানে জবাব দেয়, ‘আমি কী করবো, সু?’
আসলেই মায়ার বুঝতে পারে না সে কী করবে? এটা তার জন্যে এক মর্মান্তিক জিজ্ঞাসা। আর এ জিজ্ঞাসার জবাবও এক ভয়াবহ অন্ধকারে নিমজ্জিত। সে অন্ধকারের কাছে সে আজন্ম নতজানু। তার এক প্রবল বিক্ষেপে আলোড়িত শৈশবস্মৃতি আছে। এই প্রজ্জ্বলন্ত ত্রিশে দাঁড়িয়ে এখনো সে জমে যায় শৈশবের তীব্র শীতলতায়। আর তার আজন্ম অন্ধকার এখনো রয়ে গেছে তার বিধ্বস্ত চৈতন্যের নির্জন উপত্যকায় বহুমাত্রিক বর্ধমানতায়। মায়ার জানে না সত্যিই সে কী করবে।
আসলে আমরা কেউই বুঝতে পারি না কী করবো। আমাদের বোঝার পৃথিবীটা এত ছোট যে, সেখানে পাঁচটি মহাসমুদ্রকে একত্রে ধারণ করার মত পরিসর নেই, সেখানে অগণিত মানুষকে বিচরণ করতে দেয়ার মত মহাদেশ নেই। আর সে বোঝার জগতে দাঁড়িয়ে ঊর্ধ্বমুখে তাকানোর অনন্ত আকাশ কিংবা আকাশ জুড়ে প্রবল সূর্য অথবা অসংখ্য নক্ষত্র পাই না।
আমাদের সে বোঝার জগতে নিঝুম অরণ্য নেই, আদিগন্ত প্রান্তর নেই। কিছু পরিকল্পিত পথ ধরে আমাদের বোঝার জগতে আমাদের নিত্য পর্যটন, আমরা সে পরিকল্পিত পথ ধরে আমাদের যার যার গন্তব্যে পৌঁছাতে চাই। কিন্তু আমাদের পরিকল্পিত পথকে আচ্ছন্ন করে আছে অসংখ্য আঁকাবাঁকা সূক্ষ্ম, সূক্ষ্মতম চোরাপথ এবং তা আমাদের চোখে অদৃশ্য। আর আমরা নিজেদের অজান্তে পরিকল্পিত পথ ছেড়ে সে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অচেনা পথ বেয়ে না-বোঝার জগতে চলে যাই।
মায়ারের মনে হয়, সুনম বুঝি তেমনি এক না-বোঝার জগৎ। সুনম তার কাছে এক অন্ধকার রাত, নিঝুম অরণ্য; সে এক অনন্ত নীলাকাশ, দুর্জ্ঞেয় মহাসমুদ্র। সে জানে না সুনম কী।
প্রবল বিক্ষেপে আলোড়িত শৈশব তাকে আজো তাড়িয়ে ফেরে। সে শৈশবের বারান্দায় তার মায়ের চুলের গন্ধ নেই। তার আনমনা কৈশোরের আঙিনায় মায়ের পদধ্বনি নেই। আর তার শৈশবের কোনো সন্ধের আকাশে তার মায়ের হাতের ইশারায় দেখানো কোনো পূর্ণিমার চাঁদ কিংবা অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র নেই। সে অন্ধকার আর অবিরাম শূন্যতায় আচ্ছন্ন তার শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত বিস্তৃত পথ-প্রান্তর।
মায়ার সে শূন্যতাচ্ছাদিত পথের বাঁকে বাঁকে একাকী হাঁটে। সে অন্ধকারাচ্ছাদিত শূন্য প্রান্তরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অবোধ শিশুর মত ছুটোছুটি করে। তারপর অপরিসীম ক্লান্তিতে নতজানু হয় সে অন্ধকারের কাছেই। অন্ধকারের বুকেই চেতনাবিলুপ্তি ঘটে তার।
তারপর সে অনন্ত অন্ধকারের কোথাও ধীরে ধীরে এক আলোড়ন জাগে। সে অনন্ত অন্ধকারের আলোড়িত অন্তঃস্থল থেকে আরেক অন্ধকার মূর্ত হয়ে ওঠে। সে এক অপরূপ অন্ধকার। চেতনার বিমূর্ত নয়ন থেকে ক্ষরিত অশ্রুর মত উষ্ণ আর কল্পনার অসীম আকাশের মত নীল সে অন্ধকার। সে অন্ধকারের প্রতিটি অনুভূত বিন্দু জ্বলে ওঠে উজ্জ্বল নক্ষত্রালোকে। মায়ার সে অনন্ত নক্ষত্রবীথিতে হাত বাড়ায় তার বিলুপ্ত চেতনার গহীনতম প্রদেশ থেকে জেগে উঠতে উঠতে। কিন্তু তার বাড়ানো হাতের নাগালের বাইরে থেকে সে নক্ষত্রবীথি শুধু হাসে।
অন্ধকারে সুনমের হাসি দেখা যায় না, শব্দ শোনা যায়। তার হাসির শব্দ মায়ারকে কোনো এক পাহাড়ে পথ হারিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শোনা ঝরনার কলধ্বনির কথা মনে করিয়ে দেয়। চকিত আবেগে গলে যেতে যেতে সে বুনো লতাপাতা সরানোর মত করে সুনমের চুলের অরণ্যে হাত চালায়। কিন্তু সে অরণ্য পেরিয়ে তার হাত সুনমের হাসিকে ছুঁতে পারে না। তার হাসি শুধু বাজতে থাকে মায়ারের চেতনার প্রতিটি রন্ধ্রে তার শৈশবের মায়ের চুলের গন্ধ পাওয়া আর পায়ের শব্দ শোনার আকাঙ্ক্ষার মত।
আলোড়িত শৈশবের কোনো এক অন্ধকার রাত্রির গভীর নিস্তব্ধতায় মায়ের বুকের উষ্ণতাহীন শয্যায় হঠাৎ ঘুমভাঙা কান্নার মত শূন্যতার স্বপ্নোৎসবে মায়ারের কণ্ঠ বেজে ওঠে, ‘সু…সু…’
এবং সে একই শূন্যতায় সুনমের কণ্ঠও তার রেশ ধরে ধ্বনি তোলে, ‘উঁ..উঁ..উঁ…’