তুমি বলেছিলে, ‘তোমার ধনসম্পদ বাড়ি গাড়ি আমি কিছুই চাই না। তোমাকে পেলেই আমার সব পাওয়া হয়ে যাবে।’
যখন তুমি কথাটা বলেছিলে,তুমি ছিলে কিশোরী। আমি তখন তারুণ্য ছাড়িয়ে যুবক হয়ে উঠছি। আমি জানি, তোমার বলার মধ্যে কোনো শঠতা ছিল না, কৌশল ছিল না, মিথ্যা তো নয়ই। একটি মনের আকাঙ্ক্ষা ছিল সেটা, আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আকুলতা। তোমার মনের নির্দোষ ইচ্ছাকে তুমি এত সহজ ভাষায় বলেছিলে যে, এটা বুঝতে অনেক পড়াশোনার দরকার হয় না। আর তুমি যখন কথাটা বলেছিলে, তখন বাস্তবে ধনসম্পদ, টাকাপয়সা বা বাড়িগাড়ি বলতে যা বুঝায় তা তুমি বুঝতে না। কারণ একজন বৈষয়িক মানুষ হবার বয়স তখন তোমার হয়নি। আর যে-সময়ে একটা টিন ছাপড়ার নিম্নমধ্যবিত্ত-মধ্যবিত্ত শিল্প-মফস্বল শহরে বসে তুমি কথাটা বলেছিলে সে-সময়ে খোদ রাজধানীতেই হাতেগোনা কয়েকজন ধনী লোকের কাছে ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল।
টিনছাপড়ার ছোটো শহরের কিশোরী মেয়েটি যখন ধনসম্পদ-বাড়িগাড়ির কথা বলে তখন সে নিশ্চয়ই কোনো উপন্যাসে পড়া ভাষা ব্যবহার করেছে। হয়তো তোমাকে কথাটি বলতেই হতো না। তখন আমি জেলাশহরের কলেজে পড়াশোনা করি। সেখানে মাঝেমধ্যে আমার কলেজের ধনী বন্ধুদের বাড়ি যাওয়া-টাওয়া হয়। তাদের দালানবাড়ি, ব্যক্তিগত গাড়ি আমার অবচেতনে স্বপ্ন হয়ে জমে থাকে। তোমার সঙ্গে আমার যখন দেখা হয়, আমিও আবেগের আতিশয্যে তোমাকে বলে ফেলেছি, ‘একদিন আমারও ধনসম্পদ হবে, গাড়িবাড়ি হবে। আমাকে তুমি একটু সময় দাও,আমার পড়াশোনাটা শেষ করতে দাও।’ আমার কথার জবাবেই তুমি ওভাবে কথাটা বলেছিলে।
আমি চিঠির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের সুন্দর সুন্দর প্রেমের গান আর কবিতার পঙক্তিমালা লিখতাম। সেসব তুমি অনায়াসেই মুখস্থ করতে। আসলে তখন তোমার হৃদয় ছিল ভালোবাসায় পূর্ণ এক আশ্চর্য সুন্দর স্বর্ণখনি। একদিন চিঠিতে লিখলাম ওমর খৈয়ামের কবিতা, ‘এই জীবনের আঁধার পথে পাও যদি কেউ এমন প্রাণ / যে তোমাকে ভালোবেসে আপন হৃদয় করবে দান / প্রাণ খুলে তায় ভালোবাস জড়িয়ে ধরো বক্ষে তাকে / ত্যাগ করো সব তার খাতিরে তুচ্ছ করো জগৎটাকে।’
তুমি ফিরতি চিঠিতে লিখলে , তুমি এত সুন্দর কবিতা লিখতে পারো?
আমি তোমার ভুল ভাঙাতে লিখতাম, না না, এটা আমার লেখা নয়। এটা পারস্যের কবি ওমর খৈয়ামের কবিতার অনুবাদ। পৃথিবীর সব প্রেমিক হৃদয়ের জন্য তিনি এরকম অনেক কবিতা লিখে গেছেন।
তখন জেলা শহর থেকে মফস্বলে এলে আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ হতো। তোমাদের বাসার রক্তজবার গাছগুলোর আড়ালে আমাদের দেখা হতো। আমরা একজন আরেকজনের ঠোঁটে ঠোঁট রাখতাম। আমাদের মনে হতো পৃথিবীতে এর চেয়ে শুদ্ধস্বাদ আর কোনো কিছুতেই নেই। আমরা এতে কোনো দোষ খুঁজে পেতাম না। আমরা বিশ্বাস করতাম, আমরা দুজন দুজনার। আমরা কখনো আলাদা হবো না। আমরা কী-সব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলতাম।
তুমি বলতে, ‘আমি গুনেগুনে পাঁচটা ছেলেমেয়ের মা হবো।’
আমি বলতাম,‘আমি চাই, আমাদের সবগুলো মেয়ে হবে।’
তুমি বলতে, ‘এ কী আজব খেয়াল গো তোমার?’
আমি বলতাম, ‘আমাদের মেয়েগুলো সব তোমার মতো সুন্দর হবে, তাই।’
একদিন কেউ একজন রক্তজবার আড়ালে আমাদের লক্ষ করলো। আমাদের সম্পর্কের কথা সে তোমার মামাকে জানিয়ে দিলো। পরে জানলাম, সে তোমার দূরসম্পর্কের চাচা হয়। তোমার প্রতি তারও দুর্বলতা ছিল। তুমি এখানে তোমার মামার বাসায় থেকে পড়তে। তোমার সেই চাচা আমার সম্পর্কে অনেক আজেবাজে কথা বলেছে তোমার মামাকে। বলেছে,আমি নাকি একজন মাস্তান ও স্থুল চরিত্রের মানুষ। মামা ভাবলেন,আমি বুঝি তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবো। কিন্তু আমাদের মনে তো এমন ইচ্ছে ছিল না।
আমাদের মধ্যে কথা হয়েছিল, আমার পড়াশোনা শেষ হলে তোমার পরিবারের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাবো আমি। কিন্তু তার আগেই মামা তোমাকে নিয়ে গেলেন তোমার বাবার কাছে। তিনি দূরবর্তী এক শহরে খুব দায়িত্বপূর্ণ একটা সরকারি চাকরি করতেন।
সবকিছু শোনার পর তিনি প্রচণ্ড রাগ করলেন। কিছুতেই মেয়ের এই অধঃপতনকে ক্ষমা করলেন না। তুমি একদিন কথায় কথায় বলেছিলে তোমার বাবা একজন কড়া মেজাজের মানুষ। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, তিনি যখন তোমার দিকে অসন্তোষ নিয়ে তাকান, তখন তুমি বাবার সামনে লজ্জায় মিইয়ে যেতে। কিন্তু তিনি বা তোমার মা বিষয়টি নিয়ে উচ্চবাচ্য করলেন না। কারণ তুমি পরিবারের বড় মেয়ে। তোমার পিঠেপিঠি আরও দুটো বোন আছে, ছোট দুটো ভাই আছে। বিষয়টা বুঝতে পেরে তুমি চুপচাপ হয়ে যাওয়ার ভান করলে। তখন আমার সঙ্গেও চলছে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা। বিচ্ছিন্নতা মানে বিরহ। এ বিরহ কত দীর্ঘ হবে জানি না। আমার হৃদয় ফেটে যায়। আমার পড়াশোনায় মন বসে না। আমার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়। একদিন যে-তুমি একজন মেধাবী ছাত্র বলে প্রথম আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলে, সেই আমি পরীক্ষার ফলে আশানুরূপ সাফল্য লাভ করতে পারলাম না। তুমি কিন্তু চুপ করে বসে রইলে না। ছোট বোন আর ছোট ভাইকে ম্যানেজ করে চিঠি পাঠালে। আমাকে অভয় দিলে।
তার সৌভাগ্য হলো না সানাইয়ের সুরতরঙ্গ আর আলোকমালায় সজ্জিত হয়ে একটা বড়ো উৎসব আয়োজনের ভেতর দিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবে। বরং জামাই শ্বশুর বাড়ির গলগ্রহ হয়ে থেকে গেলো।
তোমার চুপচাপ নীরবতা দেখে তোমার বাবা ভাবলেন, মেয়ে তার অতীতের কথা ভুলে গেছে। তোমাকে তিনি কলেজে ভর্তি করালেন। আমাদের পত্র যোগাযোগ চলমান থাকে। আমরা আবার আশায় বুক বাঁধি। ততদিনে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে থার্ড ইয়ারে পড়ছি। তোমার এদিক-ওদিক থেকে বিবাহের প্রস্তাব আসছিল তখন। সুন্দর মেয়ে তুমি, তোমাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তো থাকবেই লোকের। তোমারও মনে হলো বিপদ বাড়ছে। একদিন সাহস করে আমার কথাটা তুমি তোমার মা-কে বললে। তাঁরা তোমার কথাটা এককথায় নাকচ করে দিলেন না। তবে একটা শর্ত দিলেন। তারা পির সাহেবকে দিয়ে ইস্তেখারা করাবেন। এই পির সাহেবের সঙ্গে তোমাদের পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। আমি ঠিক জানি না সেটা কতটা পারিবারিক। তারা ইস্তেখারার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
ইস্তেখারা হলো গভীর নিশিথে আল্লাহর কাছ থেকে কোনো একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে ‘হাঁ-না’ মতামতের নির্দেশনা পাওয়ার জন্য দুই রাকাত সালাত। সালাত শেষে বিশেষ প্রার্থনার দোয়া আছে। দোয়ার শেষে প্রার্থনাকারী তার ইচ্ছাটা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন। ঘুমের মধ্যে তিনি স্বপ্ন দেখবেন আর স্বপ্ন না দেখলে ঘুম ভাঙার পর তাঁর অনুভবে আসা মতটাই ইস্তেখারার মত।
ইস্তেখারার জবাব পাওয়া গেলো, ‘না’। তোমার হৃদয়-বিদারক কান্নার ভেতর তোমাকে সান্ত্বনা দিতে এলেন তোমার নিকট স্বজনেরা, তোমার খালারা-ফুপুরা। এটাকে ঠিক সান্ত্বনা বলা যাবে না, তারা সবাই মিলে তাদের নিজেদের প্রজ্ঞামতো তোমাকে বোঝালেন, আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে গেলে সেটা কখনো ভালো হতে পারে না। এই ছেলে তোকে তার রূপের জাদুতে ফেলেছে, বেশি সুন্দর ছেলেদের নানারকম সমস্যা থাকে।
নানারকম সমস্যা যে কী, সেটা তারা তোমাকে বলেন না। তবে তোমার মগজ ধোলাই করার জন্য যে-যার মতো করে যুক্তি উপস্থাপন করতে থাকেন। এই ছেলে ভিন্ন জেলার,ভিন্ন পরিবেশ থেকে আসা, তার সঙ্গে আমাদের যায় না, যেতে পারে না।
কিন্তু তোমার চোখের পানি শুকোয় না। একদিকে চলছে তোমার মগজ ধোলাই, আরেকদিকে চলছে পাত্র বাছাইয়ের কাজ। একজন পাত্রকে তোমার স্বজনদের মনোপূত হলো। তিনি উচ্চ বংশীয়। পারিবারিক ব্যবসা বাণিজ্য আছে শহরে, শহরে বাড়ি আছে। অনেক বছর থেকেই তিনি নিজের এলাকার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। পাত্রের বাড়িঘর, জমিজমা, ধনসম্পদ বিপুল। একটা গাড়ি ব্যবহার করাও কোনো ব্যাপার নয়, বিয়ের পর কন্যার আগ্রহে একটা গাড়িও কেনা হতে পারে। তোমার বাবাকে তুমি যতই কঠোর বলো না কেন,তাঁর মনটা কিন্তু তোমার জন্য ছিল খুব সংবেদনশীল। তুমি তার প্রথম সন্তান এবং মেয়ে। তোমার জন্য তাঁর টানই ছিল আলাদা। সেজন্যই তার এত সতর্কতা। তিনি তোমাকে একান্তে ডেকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে কান্নাপ্লুত কণ্ঠে বললেন, ‘মা রে, যা কিছু করেছি সব তোর ভালোর জন্য করেছি। মনে রাখবি, সন্তানের জন্য বাপ-মার চেয়ে বড় আপনজন আর কেউ নেই। পির সাহেবের কথার অবাধ্য হওয়ার সুযোগ আমার নেই।’
খুব সাদামাটা কথা,বাবার হৃদয়ের দুঃখ ও আবেগ একসঙ্গে ঝরে পড়ে। একজন কিশোরী তুমি, তোমার বালিকাকাল সবে শেষ হয়েছে, কতটুকুই বা তোমার প্রতিরোধের ক্ষমতা অথবা নিজের দাবি প্রতিষ্ঠা করার সাহস! তোমার কান্নাই তোমার সঙ্গী হয়ে থাকে।
তোমার শুভ বিবাহের সংবাদ আমি পাই তোমার প্রতিবেশী ছেলে কাজলের কাছ থেকে। তোমার ছোট ভাই টুটুলের কাছ থেকে সে সব শুনেছে। আমি বুঝতে পারি,তুমিই তাকে বলার জন্য পাঠিয়েছিলে। কাজলের সহযোগিতায় তোমার-আমার দেখা হতো তাদের বাসায়। সে যখন আমার ইউনিভার্সিটির হলে আসে আমি তাকে দেখে তো অবাক। সামনে আমার পরীক্ষা, আমি পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত। কাজল তখন আমাকে জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর কথাটি শোনালো। বললো, তুমি সারাক্ষণ সবার নজরদারিতে আছ, তাই চিঠি লেখা সম্ভব হয়নি। বললো, ‘বিবাহের দিনতারিখ ঠিক হয়ে গেছে, সব প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়ে গেছে।’
বললাম, ‘সামনে আমার পরীক্ষা। এ-অবস্থায় আমি কী করতে পারি?’
কাজল বললো, ‘আপনি ওকে নিয়ে পালিয়ে যান।’
বললাম, ‘সেটা করা কী ঠিক হবে? প্রথমত,এর জন্য একটা মানসিক প্রস্তুতি লাগে। এই মুহূর্তে আমার কাছে তেমন অর্থবিত্ত নেই, তাকে লুকিয়ে রাখার মতো ঘরবাড়ি নেই। আমার এরকম অবস্থায় তাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার অর্থ হলো,তাকে একটা কষ্টের মধ্যে ফেলে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, তুমি বললে সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। এরকম অবস্থায় তার বাবার সামাজিক মর্যাদা বা তার পরিবারের সম্মান নষ্ট করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।’
কাজল চলে গেলো বটে, তার চোখে জল ছিল সমুদ্রের মতো। তোমার সঙ্গে আমার বিচ্ছেদের সে-ই শুরু। আমার এখন অনেক অর্থবিত্ত, বাড়ি-গাড়ি সবই আছে। সমাজে আমার নিজের একটা পরিচিতি দাঁড়িয়েছে, দেশের বহুমানুষ আমাকে একনামে চিনে। আমার এখন সব আছে, শুধু তুমি নেই। তারপরও কোনোদিন আমি উপযাচক হয়ে তোমার কোনো খবর নিতে চেষ্টা করিনি। খবর নিতে গেলে যদি কিছু জানাজানি হয়ে যায়, তাতে যদি তোমার সংসারে কোনো অশান্তি হয়। জানতে চাইনি, তোমার স্বামীর কাছে তুমি কেমন আছ, উনি কি তোমাকে ভালোবাসেন? তোমার ক’জন ছেলেমেয়ে হয়েছে? ওরা কত বড় হয়েছে, কে কী করে? ইচ্ছে করেই তোমার খবর নেইনি। তাতে যদি তোমার বর তোমাকে কটু কথা বলেন অথবা তোমার সন্তানরা তোমাকে ভুল বোঝে! আমি চাইনি এতটুকু মালিন্য যেন তোমাকে স্পর্শ করে! মাঝেমধ্যে খুব জেদ চাপে। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি, এমন অন্ধত্বে পূর্ণ আমাদের সমাজ! স্রষ্টার উপরও মেলা অভিমান আমার। কী ক্ষতি হয়ে যেত তাঁর, যদি তিনি তোমাকে-আমাকে মিলিয়ে দিতেন? আমরা নিশ্চয়ই কখনো একজন আরেকজনের সঙ্গে ঝগড়া করতাম না, কখনোই না। ঝগড়াই যদি করবো, তাহলে ভালোবাসলাম কেন! এক ‘ইস্তেখারা’ অথবা একজন পিরের কথা আমাদের জীবনটাকে চিরকালের জন্য আলাদা করে দিল! আরেকজন পিরের কথা তোমাকে বলি। মনে আছে, তোমাকে একবার আমার এক ব্যারিস্টার মামার কথা বলেছিলাম যিনি লন্ডনেে থাকতেন। তাঁর পরিবার ও সন্তানরা এদেশে থাকতো। সেবার তাদের নিয়ে যাবার জন্য তিনি দেশে এসেছিলেন। তাদের যাবার প্রস্তুতি চলছিল। ঠিক তখনই একদিন হঠাৎ তাঁর হার্ট অ্যাটাক হলো এবং তিনি মারা গেলেন। আমার মামী ও মামাতো ভাই-বোনদের তখন আর লন্ডন যাওয়া হলো না। মামা এদেশের একজন বিখ্যাত পিরের মুরীদ ছিলেন। তিনি তাঁকে বাবা ডাকতেন। তোমার বিয়ে হয়ে যাবার পরের ঘটনা। মামীর একজন ভাইয়ের ছেলে তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এসেছে। সে সবে স্কুল-ফাইনাল দেওয়া আমার মামাতবোনকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিল। মামি রাজি হলেন না, কারণ তার মেয়ের বয়স কম।
কিন্তু বুদ্ধিমান ইঞ্জিনিয়ার চলে গেলো পির সাহেবের কাছে। পির বললেন, ‘আমি নিজে এসে এই শাদির আকদ পড়াব।’
একদিন দুপুরে হঠাৎ করে কয়েকজন মুরিদসহ এলেন তিনি। তাঁর আগমনে সারা বাড়ি এমনকি মহল্লায় একরকম সাড়া পড়ে গেলো। তিনি মামিকে বললেন, ‘নাতনিকে সাজিয়ে দে মা। আমি আকদ পড়াবো।’
তাঁর আদেশ অলঙ্ঘনীয়। মামির কী সাধ্য সেখানে বাধ সাধেন! মামা তো বোনের আকদ হয়ে গেলো অনানুষ্ঠানিকভাবে। তার সৌভাগ্য হলো না সানাইয়ের সুরতরঙ্গ আর আলোকমালায় সজ্জিত হয়ে একটা বড়ো উৎসব আয়োজনের ভেতর দিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবে। বরং জামাই শ্বশুর বাড়ির গলগ্রহ হয়ে থেকে গেলো।
আমি কী দেবতা হওয়ার জন্যই বলেছিলাম, তোমার বাবার মর্যাদা বা পরিবারের সম্মান নষ্ট করার ইচ্ছে আমার নেই। কী জানি, সবকিছুই এখন অর্থহীন মনে হচ্ছে। আর যা সত্য তা হলো, তোমার জন্য আমি সারাজীবন কেঁদে চলেছি, একা। তুমিও কি কখনো কোনো গভীর নিশীথে কাঁদো?
বিরোধটা বোধহয় সেখানেই শুরু হলো। তাদের বয়সের ব্যবধানও ছিল বেশ, তারা একজন আরেকজনকে ভালোবাসতে পারলো না। এবং একদিন তারা দুজন দুদিকে ছিটকে পড়লো। প্রশ্ন হলো এই পির সাহেব কি ‘ইস্তেখারা’ করেননি? নাকি তার সেটা করার প্রয়োজন নেই? তার পড়ানো আকদের আয়াত কেন তাদের সুরক্ষা করতে পারলো না? তাহলে কি বলতে পারি তিনি দূরদর্শী ছিলেন না, ওই আকদের আয়াতের রজ্জু কি এতই ঠুনকো ছিল যে একটু টানেই ছিঁড়ে গেলো? আমি জানি না, কেমন জীবন তুমি তোমার বরের সঙ্গে যাপন করেছ? অনেকগুলো তো বছর মাঝখানে পার হয়ে গেছে। এখন খুব জানতে ইচ্ছে করে, তুমি সুখী ছিলে তো! বিশ্বাস করো, এই জানতে চাওয়ার মধ্যে কোনো রাগ বা অভিমান নেই, বরং যদি এমনটাই শুনতে পাই, তুমি সুখী ছিলে এবং অনেকগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে তোমার সুখের সংসার, তাহলে আমার ভালোবাসার কসম আমার চেয়ে আর বেশি কেউ খুশি হবে না।
একবার কী হলো জানো, তোমাকে হারিয়ে ফেলার কয়েক বছর পর কাজলের সঙ্গে আমার দেখা হলো। তুমি কেমন আছ,সেকথা সে বলতে পারলো না। খুব আগ্রহও দেখালো না। কিন্তু একটা ভয়াবহ দুঃখের সংবাদ সে দিলো, টুটুল পিস্তল ঠেকিয়ে নিজের মাথায় গুলি করেছে। তাতে তার মৃত্যু হয়েছে। আমার হঠাৎ বোবা বিষণ্ন হয়ে যাওয়া নিথর মুখের দিকে তাকিয়ে সে আমাকে ঘটনাটি বলেছিল। কী কারণে যেন বাবার সঙ্গে অভিমান করে টেবিলের ড্রয়ারে রাখা পিস্তলটা নিয়ে সে ঘটনাটি ঘটিয়েছিল। টুটুল আমাকে ভাইয়া বলে ডাকতো। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, সারাক্ষণ সে আমার কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতো, আমার হাতটা জড়িয়ে ধরে রাখতো পরম নির্ভরতায়। তখন ওকে আমার নিজের সন্তানের মতো মনে হতো! তোমার মনে আছে, একদিন আমরা একটা স্টুডিওতে গিয়ে অনেকগুলো ছবি তুলেছিলাম। টুটুলের সঙ্গেও আমার কয়েকটা ছবি আছে। ওর কথা আমার খুব মনে পড়ে। তখন সেই ছবিগুলো আমি দেখি, ওর নিষ্পাপ মুখটায় হাত বুলিয়ে আদর করি। এত অভিমান কেন ছিল ওর? আমি জানি ওকে হারানোর বেদনা তোমাকে কিভাবে ব্যাকুল করেছে! হয়তো এই জীবনে কখনো তাকে হারানোর ব্যথা তোমরা ভুলতে পারবে না। তোমার বাবা, সেই কঠোর মানুষটা হয়তো চিরকাল এই কষ্টের পাহাড়টা একাই বয়ে চলেছেন।
আজকাল মাঝেমধ্যে আমার কী মনে হয় জানো, তোমার সঙ্গে আমার হয়তো কোথাও দেখা হয়ে গেছে, কোনো রেলস্টেশনে অথবা কোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে, তুমি যাচ্ছ দূরে কোথাও, ছেলের কাছে অথবা মেয়ের কাছে। তুমি সেই আগের মতোই সুন্দর আছ। তোমার প্রশান্ত চোখগুলো আগের মতোই আমার চোখের তারায় স্থির করে রেখেছ। কিন্তু হাত বাড়িয়ে আমার মুখটাকে ছুঁয়ে দেখলে না। আমিও না। জানতে চাইলাম, ‘তোমার বর কোথায়?’
ম্লান হাসলে তুমি। বললে, ‘আছে। আমি যা বোঝার বুঝে নিলাম।’
দুষ্টুমি করে বললাম, ‘তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে?’
তুমি বললে, ‘পালাতে বলছো?’
বললাম, ‘হাঁ।’
তুমি বললে, ‘সেদিন কেন এলে না? তোমাকে তো খবর পাঠিয়েছিলাম। আমি তো তোমার অপেক্ষায় ছিলাম।’
তোমার চোখ জলের সরোবর হয়। সরোবরে আমার বিষণ্ণ মুখ দেখি। ভাবি, কী হয়েছিল সেদিন? আমি কী ভয় পেয়েছিলাম? ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়? ওদের পাঠানো পুলিশ অথবা গুণ্ডা আমার কাছ থেকে তোমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভয়? আর পিটিয়ে আমার হাত-পা ভেঙে দেবে, সে ভয়? আমার আসন্ন পরীক্ষার সময় জেলখানা অথবা মাস্তানদের চার দেওয়ালের ভেতর আমাকে বন্দি করে রাখবে, সে ভয়? এখন কথাগুলো এভাবে ভাবছি কেন, আমার মনে কি সত্যি এমন ভাবনা এসেছিল? আমি কী দেবতা হওয়ার জন্যই বলেছিলাম, তোমার বাবার মর্যাদা বা পরিবারের সম্মান নষ্ট করার ইচ্ছে আমার নেই। কী জানি, সবকিছুই এখন অর্থহীন মনে হচ্ছে। আর যা সত্য তা হলো, তোমার জন্য আমি সারাজীবন কেঁদে চলেছি, একা। তুমিও কি কখনো কোনো গভীর নিশীথে কাঁদো?