কবি আকতার হোসাইন আমার কিছুটা পরে কাব্য করতে আসেন। আমার মতো তিনিও জন্মগতভাবে স্বতঃস্ফূর্ত কাব্যসুরভি নিয়ে জন্মেছেন। তবে আমার আর তার কবিতার বিষয়-আশয়ে বিস্তর ফারাক আছে। মূলত তাকে আমি প্রেমের কবিতা রচনায় বেশি সফল বলে মনে করি।
কবিতার ভেতরে যে অধরা সুর, সুরভি আর বিহ্ববলতা থাকে, আজকালকার অনেক কবির কবিতায় সেটি প্রায়শ অনুপস্থিত। কিন্তু আকতারের কবিতা তেমন নয়। বলা বাহুল্য, কবি আকতার হোসাইনের প্রায় সব কবিতাই আমার পঠিত এবং ইতোপূর্বে তার কাব্য বিষয়ে আমি লিখেছিও। সম্প্রতি কেনা আকতারের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ‘এখনও যুবক আছি’ কবিতাটিতে এসে আমার চোখ আটকে যায়! ‘হাড়ের হরিণী’ কাব্যগ্রন্থে আগেও এই কবিতা পাঠ করেছি। এবারকার পাঠ ভিন্নমাত্রার।
২০১৯ এর শেষে লেখা আমার ‘রজঃস্বলা থেমে গেছে’ কবিতাটি আর ‘এখনও যুবক আছি’র উপস্থাপন, বয়ান অনুভূতি ভিন্নমাত্রিক হলেও তাদের একটি বিশেষ মিল রয়েছে।আর সেটি নিয়েই আজকের এই লেখা।
কবিকে শেষ পর্যন্ত কবিই হতে হয়, কবিতাকে কবিতা; এই পুরোনো কথা নতুন করে মাথায় রেখে বারবার আমরা ‘নারী কবি’, ‘পুরুষ কবি’র তকমা থেকে নিজেকে বের করে আনি। লিখতে লিখতে একটা সময়ে প্রকৃত কবির আর কোনো লিঙ্গভেদ থাকে না। তিনি তখন কবিই হয়ে ওঠেন পাঠকের কাছে। তবু কখনো কখনো বিশেষ কোনো কোনো কবিতায় কবি নিজের নারীত্ব বা পৌরুষ অস্বীকার করতে পারেন না। শরীরকে কী করে অস্বীকার করবেন তিনি! তবে, কবি যেহেতু কেবল নিজের কথা বলেন না, সবার কথাই বয়ান করেন, তাই সেই পঙ্ক্তিগুচ্ছও আর কবির নিজস্ব থাকে না।
কবিতার ভাষায়-ভাবে এক আশ্চর্য যৌবন থাকতে হয়; যা অত্যাবশ্যকীয়ভাবে পাঠক সংক্রাম ঘটাবে। কবিতার সেই সংক্রাম- ক্রিয়া পাঠকের মধ্যে অতি অনায়াস বিস্তারিত না হলে কবির সব লেখা বা চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে ওঠে! কবিতা, তার পাঠককে শেষ শব্দে পৌঁছোনো পর্যন্ত স্বস্তি দেবে না। কেননা কবি তার শব্দ সমবায়ে, দৃশ্যকল্পের মধ্য দিয়ে এক পাঠসংক্রমণ ব্যাধি ছড়িয়ে দেন; যা তার পাঠকে তরান্বিত করে।
তার আগে আসুন বৈপরীত্য ও সমত্বে কবিতা দুটো পাঠ করি:
এখনো যুবক আছি ॥ আকতার হোসাইন
এখনো যুবক আছি
কবরের কাছাকাছি
পা রেখে, পেছনে তাকাতে ভয়, পাছে
কেউ নেয় টেনেহিঁচড়ে নিষ্ঠুর আয়নার কাছে।
সেখানে আমার মতো অবিকল, কদাকার হাসে
একজন, ঝুলন্ত চামড়া তার সত্যের অপ্রিয় আভাসে
কেঁপে ওঠে, পেছনে দাঁড়িয়ে তুমি অভয়-চিরুণি হাতে
সিঁথি কাটো রঙ করা চুলে, ক্ষয়ের প্রপাতে
মৃত কোষের সাথে ভেসে আসে হতবাক চুল
আপাতশান্ত মুখে পড়ন্ত ছায়া, ভয়াকুল।
তবু, কোথাও দুরন্ত মেঘ, নীল জল, ঝিরি ঝরনা দেখে
উল্টো ঘুরতে চায় জীবনের ঘড়ি, শুকনো পাতাকে ঢেকে
সজীব মাটির বুকে পুঁতে দিয়ে জীবনের বীজ
জলের ফোয়ারা হাতে তুমি ব্যস্ত অঙ্কুরোদগমে
যেন এ তোমার তপস্যা-সিরিজ
মৃত লখিন্দরে এনে দেবে প্রাণের স্পন্দন
স্রোতস্বিনী বুকে নেয় বেহুলার গোপন ক্রন্দন।
এখনো যুবক আছি, তুমি চির অমল যুবতী
বিপ্রতীপে সাঁতরালে জনতার কী অমন ক্ষতি
আমাদের পরাজয়ে হাসে যদি দাঁতাল শ্মশান
পাতকী হতেও রাজি, থাক ওরা মহাপুণ্যবান।
রজঃস্বলা থেমে গেছে ॥ সেলিনা শেলী
গভীর মোহনিদ্রা ঘোরে,নিদাঘ দুপুরে
বালিকা উত্তীর্ণকালে
শরীরে ফুটেছিল রক্তিমবিভা!
কুমারীকুসুম কালে, নিজেকে অস্পষ্ট মানি,
জানি, এই শরীরের কতটুকু জানি—
কী জানি কী জানি!
শরীরের রন্ধ্র বেয়ে
রজঃস্বলা নেমে এসে ঋতুবতী হই।
কাম, ঘ্রাণ, স্পর্শের অতীত স্পর্শ, বিস্তারিত কুসুম
জীবনের অতল পলে-জলাগুনে জ্বলে জ্বলে
অনুভব আঁকশি হয়ে স্মৃতি টেনে ধরে!
সেইসব কাম জাগানিয়া ভোরে,
মধ্যদুপুরে, শরীরপদ্য পাঠে কেটেছে প্রহর।
এখন শীতের দুপুর।
কুয়াশার ঘেরাটোপে
না সকাল,না সন্ধ্যা! বন্ধ্যা কী সে!
আমারই মতোন?
রজঃস্বলা থেমে গেছে।
জীবন করেছে পার—অপার কুমারীবেলা
আমার সকল খেলা,উৎসের জীবনবীজ!
যদিও থেমেছে ঋতু,নদীর অমৃতস্বর
স্পর্শের গহীনঘোর,ঢেউএর ছলাৎকলা,
আজও শুনি ঋতুবৎ নিজের ভেতর!
আজও পুড়ি জলাগুনে, যেমন পুড়েছি
একুশে অগ্নিসাৎ দেহের ভেতর—
অক্ষয় রজঃস্বলা মনে!
দেহপৃষ্ঠায় লেখা কত গান!
ষড়রিপু ধরেছি পুষ্পে কাঁটায়
রজঃস্বলা থেমেছে শরীরে—
মনে তবু অথই রজঃপাত!
ঘ্রাণের অমল পালক, নীরব গোপন ঠোঁট
স্মৃতির বিছানা!
আমিই আমাকে গড়ি, ছিঁড়িখুঁড়ি
নবায়ন করি মনোত্বক
আমাকে কী চেনো তুমি?
এখনো চিনো না যদি—
তুমি তবে বৃথাই যুবক!
প্রিয় পাঠক, শিল্পের সুরভি বিভা আর নান্দনিকতা এমন, শব্দের অর্থের নানা মাত্রিকতা সত্ত্বেও ‘কবি’ অভিধার আড়ালে আবার পুরুষকবি, নারীকবিরা অনুভূতির প্রকাশে নির্ভেজাল জেন্ডারে বিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারেন! এই দুটি কবিতা পাঠককে স্তরে স্তরে সেই ভাবনাই ভাবায়! মানুষের কতগুলো অপ্রকাশিত শরীরীয় মূল্যবোধের সর্বজন মান্যতা থাকে। ফ্রয়েডীয় অবদমন সূত্রে তো তা আর নির্মূল হয়ে যায় না! শিল্পের নান্দনিকতাই এমন! সাধারণ মানুষ যে ভাবনাটির প্রকাশে সৌন্দর্য দিতে পারে না, শিল্প তার নানা অস্ত্র যেমন শব্দ, ছন্দ, সুরাঙ্ক, ভাবনাকল্প ইত্যাকারের সমন্বয়ে একটি মৌলিক সাংগঠনিক একক তৈরি করে—যা পাঠক তুচ্ছ করতে পারে না। উপরিউক্ত দুটি কবিতায় সেই নান্দনিকতা দিয়ে শব্দের একমেবাদ্বিতীয়ম বিন্যাস ঘটেছে, তাই এই দুটি কবিতা বৈপরীত্য এবং সমত্বচিন্তা ধারণ করে উত্তীর্ণ এবং পরিপূরক কবিতা হতে পেরেছে!