দিনরাত খেটে একটার পর একটা অর্ডারি প্রতিমা তৈরি করতে করতে কখন পিতৃপক্ষের অবসান হয়েছে, খেয়াল রাখেননি তুলু পাল। মহালয়ার ঠিক আগ দিয়ে চারদিকে যখন পূজা পূজা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে, তখনই শরীরে ঘামের গন্ধ নিয়ে ষাটোর্ধ্ব তুলু কারিগর টের পেলেন মাতৃপক্ষের। এবার এই পোদ্দারপাড়ার কুমারটুলিতে প্রতিমার অর্ডার এত বেশি ছিল যে, কাজ করে তিনি কুলাতে পারেননি। তাঁর সঙ্গে প্রতিমা তৈয়ারের কাজ করেছে মাত্র তিনজন। চাইলেও এখন আর বেশি কারিগর পাওয়া যায় না। রোজগার কম, প্রতিমার কারিগররা তাই যোগ দিয়েছে অন্য পেশায়। সুতরাং এদের খাওয়া-খাদ্য, ভালো-মন্দের দিকটাতেও তো তাঁর খেয়াল রাখতে হয়েছে। ফলে যা হবার তাই হলো। মহালয়ার দিন পিতৃপুরুষের উদ্দেশে তর্পণটা তুলু পাল করার সময় পেলেন না। তার পরও দুঃখ ভোলা যেত, যদি বানানো প্রতিমাগুলোর একটাও ঠিকঠাক হতো এবার। শ্রম-ঘাম, বাঁশ-কাঠের ফ্রেম, খড়-বিচালিতে মাটি লেপা প্রতিমার কাঠামো তো দাঁড়িয়েছে, কিন্তু একটি দেবী মূর্তির মধ্যেও প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেন কই!
লোকে দেখেই হয়তো ধরে ফেলবে, এটা ফরমায়েশি কাজ। কে জানে, আবার নাও বুঝতে পারে। লোকে এখন আর প্রতিমা মাতৃরূপ কেমন পেল, তা খেয়াল করে না। জবড়জং অলংকার, লাল-নীল আলো আর থিমের ঠাটবাটের মধ্যেই দেবীর দেখনদারি ঢুকে গেছে। ভারতের দেখাদেখি এখানেও বারোয়ারি দুর্গা মা বেশ হুলস্থূল করে থিমের দলবদল করেছেন। যদিও তুলু পালের সাবেকি মগজ আজও প্রতিটি প্রতিমা তৈরির পর শুধু তার চেহারায় মায়াবী মাতৃরূপ ফুটল কিনা, সেটাই দেখতে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু এবার মহালয়ার দিনে নিজের তৈরি প্রতিমাগুলোর দিকে তাকিয়ে কেবল হতাশাই টের পাচ্ছেন তিনি। যতবার প্রতিমাগুলোর চেহারার দিকে তাকান ততবার কোথায় যেন একজন শিল্পীর কষ্ট অনুভব করেন বুকের একেবারে গভীরে।
বেশ কয়েকটি প্রতিমা ডেলিভারি হয়ে গেলেও তিনটি এখনো বাকি। মহালয়ায় আজ এখানেই প্রতিমাগুলোর চক্ষুদান হবে। তার আগে রঙের প্রলেপ ঠিক আছে কিনা; কোথাও কোন খুঁত থাকল কিনা তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিতে হবে। নইলে বায়নাদারেরা নেবে কেন!
মায়ের মুখ তৈরির সময় মনে রাখবি, বাঙালির দুর্গা শুধু ত্রিশূলধারী অসুরদলনী শক্তি না।
তুলু পাল তিন প্রতিমা খুঁটিয়ে দেখেন। একটি প্রতিমার মুখ বাঙালি পৃথুলা মা-মাসির মতো ভরাট গোলগাল লাগলেও কোথায় যেন একটা কমতি থেকে গেছে! নাক, কপালের গড়নও ঠিকঠাক। তাহলে কমতিটা কোথায়! দ্বিতীয় প্রতিমাটির মুখ অবশ্য তেমন হয়নি। মনে হচ্ছে, স্বাস্থ্য কমাতে আজকালকার মেয়েদের মতোই কৈলাসে দেবী কম খেয়ে থেকেছে। হারামজাদা টুসুকে এত করে বলেছে একটু খেয়াল রাখতে; কিন্তু সেটা হলো কই! শালা আছে খালি বিড়ির পাছায় বিড়ি ধরানো আর মোবাইলে এটা-সেটা দেখা নিয়ে। নাহ, তারই উচিত ছিল প্রতিমার মুখে মাটি লেপার চূড়ান্ত কাজটা করা। তাহলে অন্তত এমন হতো না।
তুলু পালকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিমা দেখতে দেখে সহকারী কারিগর টুসু হেসে ফেলে। পত্তিমা হয়ি গেছে। এখন আর বেশি দেখাদেখি করি লাভ নেই গো দাদা। যা বানায়েছ, সিটাই সই। টুসুর এমন হেঁয়ালিপনায় তুলু পালের মেজাজ আরও খারাপ হয়। তাই বলে তুই একটু দেখশুনে মুখে মাটি লাগাবি না! মাটি কি কম পড়েছিল? দেবীকে দেখে মনে হচ্ছে চাপা ভাঙা।
চ্যাংড়া টুসু তার ওস্তাদ তুলু পালের সামনেই বিড়ি ধরিয়ে ফেলে। আজকাল ওসব ওস্তাদ-টোস্তাদ, গুরু-শিষ্য কেউ মানে না। এখন সম্পর্ক খালি টাকার। যে ওস্তাদ যত টাকা দেয়, তার শিষ্য তত বেশি। এত কাজের মধ্যেও ধৈর্য ধরে যে সে প্রতিমার মুখ সুন্দর করে তৈয়ার করেছে; কোথায় তার প্রশংসা করবে; তা না উল্টো এসেছে খুঁত ধরতে! গালভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে খানিকটা বিরক্তি নিয়েই সে বলে, আরে দাদা, বায়নাদারদের ডিমান্ড তুমি শুনোনি? ওরা বোম্বের নায়িকার ছবি দিয়ে কয়িছে, এর মতো দেবীর মুখ হওয়া চাই। তালি পরে ক্যান আমি মুখ গোলগাল করতি যাব! সরস্বতী, লক্ষ্মীর মুখে কোনো খুঁত পায়িছ? কার্তিক ঠাকুরের মুখখান কেমন সুন্দর করিছি, দেখ না।
তুলু পাল দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। এ যুগের ছেলেপেলেদের তার চিন্তার জায়গাটা বোঝানো যাবে না। শিল্প তৈরিতে এরা শুধু একটা কিছুর কাঠামো দিতেই শিখেছে। এর শিল্পিত রূপটা ফুটিয়ে তোলা শেখেনি। মায়ের রূপে যদি মা না থাকেন, তাহলে শিল্পীর সার্থকতা কই! তৃতীয় প্রতিমাটির মুখ তিনি বানিয়েছেন। কিন্তু সেটিও তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তুলু পাল খুব করে চেষ্টা করেছেন প্রতিমার মুখটা যেন ভরাট হয়। চোখ দুটির আকার যেন হয় ডাগর। মাটি টিপে টিপে খাড়া নাক দিয়েছেন যত্ন করে। ঠোঁটটা এমনভাবে ভাগ করেছেন যাতে মনে হয়, মা মুচকি হাসছেন। তবু বুঝে আসে না- কোথায় প্রতিমার কমতি রয়ে গেল! বিড়িটা ঠোঁটে চেপে টুসু এগিয়ে আসে। দাদা, এইটেও কি পছন্দ হচ্ছে না? এইটে তো তুমিই করিছ; তালি পরে সমস্যা কী!
আরে বাবা, সমস্যাটা যদি তোকে বুঝাতে পারতাম, তালে তো কাজই হতো। মায়ের মধ্যে এখনো কী যেন একটা নেইরে টুসু! এই প্রতিমা বানাতে বানাতে তর্পণটাও করতে পারলাম না। পিতৃপুরুষের স্বর্গ-শান্তির জন্যে বছরে একটা দিন জল উৎসর্গ করব, সেটাও হলো কই! অথচ আজই দেবীতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতি হবে। কথাগুলো বলতে বলতে তুলু পালের কপালে পূবাইল বিলের কাদামাটির মতো অমর্সণ অতৃপ্তির ভাঁজ ফুটে ওঠে। টুসু তাঁকে সান্ত্বনা দেয়, রাখো তো দাদা। মায়ের চক্ষুদান করলি দেখবা সুন্দর লাগবেনে। আর তুমি যে সুন্দর চক্ষু আঁকো; মনে হয়, মণিকার মনোযোগ দিয়ি অলংকার বানিতেছে।
টুসুর কথাতেই হোক বা অন্য কোনো ভাবনায়; তুলু পাল নিজের মধ্যে উত্তেজনা বোধ করেন। সাগরেদকে নির্দেশ দেন রঙের মালসা আর তুলিটা নিয়ে আসতে। এখনই নিজের হাতে তৈরি তৃতীয় প্রতিমার চক্ষুদান করতে চান তিনি। টুসু বলে, দাদা, ভালো করি ভাইবে নাও, কেমন চোখ আঁকবা। নালি কিন্তু আবার পস্তাতি হবে। টুসুকে এ কথা বলতে হতো না। কারণ তুলু পাল মায়ের চক্ষুদান করবে, আর সেটা ভালো হবে না- এমন কথা বিশ্বাস করে তেমন লোক আশপাশের দশ পাড়ায়ও নেই। সেই ১১ বছর বয়স থেকে বাপের সঙ্গে মাটি ছেনে ছেনে প্রতিমা গড়ার অভ্যাস তার। নানান কায়দায় নানান চেহারায় দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কালী, শীতলা, মনসা, গণপতিসহ কত যে দেব-দেবী বানাতে পারতেন তাঁর বাবা সুরেন পাল! দুর্গা পূজা এলে প্রতিমা বানাতে বানাতে বাবা বলতেন, এই যে বানাচ্ছি, এটা কিন্তু এক সময় আর মূর্তি থাকবি নারে। এটা হয়ি যাবে প্রতিমা। সব সময় মাথায় রাখবি- আমরা মাটির কারিগররা হলাম দ্বিতীয় ঈশ্বর। স্বর্গে বসি ঈশ্বর যেমন মাটি দিয়ে মানুষ বানায়েছে, তেমনি আমরা শিল্পীরা পৃথিবীতে বসি মাটি দিয়ে ঠাকুর বানাই। পার্থক্য হলো, ঈশ্বর আমাদের দেহে প্রাণ দিয়িছে; আমরা চলি-ফিরি খেতে পারি। আবার শিল্পীও তার বানানো প্রতিমায় প্রাণ দিতি পারে। সে হয়তো চলতি-ফিরতি পারে না, কিন্তু সমঝদারদের সঙ্গে চোখ দিয়ি নীরবে কথা কয়। তাই যখন দেবীর চোখ আঁকবি, তখন খুব সাবধান-সচেতন থাকবি। মায়ের মুখ তৈরির সময় মনে রাখবি, বাঙালির দুর্গা শুধু ত্রিশূলধারী অসুরদলনী শক্তি না। এখানে তিনি পূজিত হন নবকন্যা আর মাতৃরূপে। তাই বাবা, দেবীর মুখটা নিয়ি খুব সাবধান!
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নম নম।
তুলু পাল বাবার সে কথা অক্ষরে অক্ষরে মনে রেখেছে। কিন্তু এবার কাজের চাপে দেবীর মুখ পছন্দসই না হওয়ার কাঁটা তাঁর বুকে খচখচ করে। সাগরেদ টুসু বলে, চক্ষুখান কার মতো দিবে, ভাবিছ কিছু দাদা? সিনেমার কোন নায়িকার ছবি বার করব? নায়িকাগের মতো হলি বায়নাদাররা খুশিই হবি। তুলু বিরক্ত হন, কিন্তু অবুঝ শিষ্যকে কিছু বলেন না। দেবীর চক্ষু তিনি দেবেন অন্য ভাবনায়। দুর্গার মুখে যে কমতি অধরা ছিল, তা তিনি পূরণ করতে চান চোখ এঁকে। তুলু পাল কল্পনার দৃষ্টিতে প্রতিমাটি দেখার চেষ্টা করেন। তুলির টানের নিখুঁত রেখায় দেবীর ভরাট মুখের সঙ্গে মিল রেখে টানা টানা দুটি চোখ। তাতে জ্বলজ্বল করছে কালো মণি। না না, আরও নিখুঁত হতে হবে। তুলু পাল এমন কোনো নারীমুখ মনে করার চেষ্টা করেন, যার চোখের সঙ্গে তিনি দুর্গার চোখ মেলাতে পারবেন। তুলু পালের জীবনে পরিচিত নারী বলতে তিনজন। মা ননী বালা, বউ জাহ্নবী আর দীর্ঘদিন ধরে তাঁর ঘরের টুকটাক কাজ করে দেওয়া হালিমা। এর মধ্যে মা ননী বালা আর জাহ্নবী তো তাঁকে ছেড়ে কবেই বিদায় নিয়েছে। এখন তাঁর কাছে নারী বলতে শুধুই হালিমা। তুলু পালের কাছে হালিমা শুধু ফাইফরমাশ খাটার মানুষ নয়। মুসলমান হয়েও ও তার যেন মেয়েই হয়ে উঠেছে। তুলু পাল স্মৃতির জমিনে জোর লাঙ্গল চালান, কার মুখ মনে আসে তাই ভেবে। তিনি অবাক হন, মা আর জাহ্নবীর মুখ তাঁর মনে পড়ে না। মা না হয় মারা গেছে অনেক আগে, কিন্তু জাহ্নবীর চেহারাও সে এভাবে ভুলে যাবে! চোখ বন্ধ করলে মনে পড়ে দেবল শ্যামলা বরণ হাসি-খুশি হালিমার মুখ। বড় একটা শ্বাস নিয়ে তুলু পাল ঠিক করলেন, হালিমার চোখের আদলই দেবেন প্রতিমার চক্ষু দুটিতে। কালো রঙে চিকন তুলি ভিজিয়ে শুরুতে অভিজ্ঞ হাতে আলগোছে টানলেন তৃতীয় অক্ষির খাড়া বাঁকা রেখা। তুলিটা এত সাবলীলভাবে চলল যে, টুসু দেখে অবাক। সত্যি, ওস্তাদের কাছ থেকে এখনো কত কিছুই না শেখার বাকি! কিন্তু কার চোখ মনে করে আঁকতিছ এইটে?
তুলু পাল হেসে জবাব দেন- হালিমা। ওস্তাদের কথা শুনে যেন টুসুর মাথায় বাজ পড়ল। কতক্ষণ কী বলবে, ঠিক বুঝে পেল না। ততক্ষণে তুলু পাল দেবী-চোখের আরেক টান এঁকে ফেলেছেন সযতনে। তাই বলে, একটা মোসলমান মেয়ের মুখ কল্পনা করি তুমি দুর্গা মায়ের চোখ আঁকবে দাদা! এই বয়সে পাপের কথা একটুও ভাবলে না? আর বায়নাদাররা যদি জানে, তালি পরে এই প্রতিমা নিবি?
পাপ কি না, তা জানি নারে টুসু! আমি শুধু দেবী প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতি চাচ্ছি, যাতে ভক্তের সঙ্গে কথা কইতে পারে। আর এইটে করতি হলে তো আমার কল্পনায় যার চোখ সবচেয়ে ভালো লাগিছে সেইটেই আঁকতি হবে, নাকি? হালিমাকে এতদিন আমি খেয়াল করিনি ভালো করে। আজ যখন ওর মুখটা মনে হলো, তখন দেখতি পেলাম কী মায়াভরা টানা টানা চোখ ওর! ওর চোখের মধ্যি সত্যি মা মা একটা ছাপ আছে। হালিমা মোসলমান হয়িছে তো কী হয়েছে! মানুষ তো। জানিসনে যে, নবকন্যা যেমন এক রূপে ঋতুমতী, বৃহন্নলা, কৃষ্ণকলি; তেমনি সে নর্তকী, কাপালিকা, গোয়ালিনী, ধোপানী, নাপ্তেনি, ব্রাহ্মণী, শূদ্রানী, মালিনী, পতিতাও। মায়ের প্রতিমা গড়ার সময় আজও গরুর চনা, গোবর, বেশ্যাপাড়ার মাটি লাগে। মা দুর্গা যদি একজন পতিতারে নিজ অঙ্গে ধারণ করতে পারেন, তাহলে হালিমা দোষ করিছে কোথায়? হালিমা আগে মানুষ, পরে মোসলমান। ও না হয় ছোটকাল থেকে কলমা-নামাজই পড়িছে; তুই পড়িছিস গীতা চণ্ডী। আল্লা নামে ডাকিছে বলে তো ঈশ্বরের প্রতি হালিমার ভক্তি মিথ্যা হয়ি যায়নি। এই যে ও আমারে রান্নাবান্না করি খাওয়ায়; ঘরের কাজকর্ম করি দেয়; তাতে কি আমার জাত গেছে? ঠাকুর কি আমার পূজার অর্ঘ্য নেয় না? প্রতিমায় আমি হালিমারেই ফুটায়ে তুলব।
কিন্তু দাদা, বায়নাদাররা যদি জানতি পারে, তালি কিন্তু হৈ- হট্টগোল হয়ি যেতে পারে। চিন্তিত টুসু কথাগুলো বলে তুলু পালের পাশে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু ওস্তাদের তার কোনোদিকে খেয়াল নেই। কখনও চোখ বন্ধ করে তিনি ভাবছেন; কখনও তুলির রেখা টানছেন প্রতিমার মুখে। পরম যত্নে ধীরে ধীরে দেবী-মুখে ফুটে উঠছে ত্রিনয়নী রূপ। টুসু অবাক হয়ে যায়- সত্যিই তো! দেবীকে দেখতে এখন পুরো হালিমার মতোই লাগছে! অথচ চোখ যখন ছিল না তখন নাকি ওস্তাদের প্রতিমাটা মনমতো হচ্ছিল না! তুলু পালের হাতে আসলেই জাদু আছে। নইলে শুধু চোখ এঁকেই কীভাবে এই প্রতিমার মুখের আদল জীবন্ত একজন মানুষের মতো করে তুলল! যেন দেবী দুর্গা নয়; ওদের সামনে মিটিমিটি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে হালিমা। শেষ অক্ষিকোটরে কালো বিন্দুর মণিটা ফুটিয়ে তুলে হাঁপ ছাড়লেন তুলু পাল। একটু দূরে সরে গোটা প্রতিমা দেখলেন ভালো করে। ফিরে গিয়ে আবার তুলির কাজ করলেন সামান্য। অতঃপর তাঁর মুখে হাসি ফুটল। তুলিটা রেখে তুলু পাল তাঁর সাগরেদকে বললেন, বায়নাদাররা নিবে কি নিবে না, তা জানি না। তবে আমার মন যেইটে বলিছে, আমি সেভাবেই মায়ের প্রতিচ্ছবি তৈয়ার করিছি। শোন, সবার আগে আমি হলাম শিল্পী। আর শিল্পী হলো ঈশ্বরের প্রতিরূপ। ঈশ্বরকে যদি তার খেয়ালমতো সৃষ্টি করতি না দেস, তালি পরে তো জগতে একটা বিশৃঙ্খলা হবেরে। আমার সঙ্গে কতদিন ধরি আছে হালিমা! ওকে মেয়ের মতো জানলেও কোনোদিন আদর করে কিছু বলিনি। কইনি যে, তোর চেহারায় একটা মা মা ভাব আছে। বিশেষ করে তোর চোখ দুটো মায়ের মমতামাখা। আজ যখন ওর মাতৃরূপকে বানিয়েই ফেললাম, চল ওকে তুই আর আমি প্রথম নমস্কারটা করি।
টুসু তার ওস্তাদের কথার ভাবার্থ বুঝতে পারল কিনা কে জানে! কিন্তু সত্যি তুলু পালের সঙ্গে সেও হাত জোড় করে প্রণামে দাঁড়ায় হালিমা খাতুনের প্রতিচ্ছবিতে তৈরি দুর্গা প্রতিমার সামনে। টুসু শোনে, ওস্তাদ তার বিড়বিড় করে বলছেন, ইয়া দেবী সর্বভূতেষু কান্তিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নম নম। ইয়া দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নম নম।