জীবন হলো আনন্দময় অমৃতরূপের দ্বারা উদ্ভাসিত এক বর্ণাঢ্য সময়সীমা। শিল্প-সাহিত্য হলো—সেই জীবনেরই সমালোচনা। জীবনকে নিয়ে নানা আঙ্গিকে, ব্যাপক অনুভবে—সমালোচনা করাই সাহিত্যের কাজ।
সাহিত্যের সার্থকতা হলো ভাষার পুনর্বিন্যাস ও ভাষার রসব্যঞ্জনা সহযোগে অতীত বর্তমান-ভবিষ্যৎ জীবনের সুখ-দুঃখের অন্তরঙ্গ সময়ের সংগীত রচনা করা। গদ্যে-পদ্যে ভাষার এমন অলৌকিক রসব্যঞ্জনা যারা সৃষ্টি করেন, তারা ভাষাশিল্পী। বাহুল্য বলা যে, তাদের হাতেই নির্মিত হয়েছে হাজার বছরের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের রূপ-রেখা। এই ধারাবাহিকতায় অনিবার্য এক নাম ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল।
১৯৩৬ সালের ১৩ মার্চের এক মাহেন্দ্রক্ষণে তিনি জন্মেছিলেন এই বাংলায়, পাবনা জেলার উল্লাপাড়ার গোবিন্দা গ্রামের জল-মাটি আলোকিত করে। ক্ষণজন্মা,বহুমাত্রিক প্রতিভাসম্পন্ন আবু হেনা মোস্তফা কামাল ছেলেবেলায় খুব রুগ্ণ ছিলেন বলেই কি ৫৩ বছরের বেশি তিনি আয়ু পেলেন না? এমন প্রশ্নও উঁকি দেয় মাঝে-মধ্যে। তবে একথাও অনস্বীকার্য যে ১৯৬৪ সালে যখন তাঁর বয়স মাত্র ২৮ বছর, তখন বাংলাদেশে ডায়েবেটিকসের চিকিৎসাও শুরু হয়নি। এরকম বয়সে এ-টাইপ ডায়েবেটিকস নিয়ে—প্রায় চিকিৎসাবিহীন অবস্থায়—সৃষ্টিশীল একজন মানুষ কিভাবেই বা আয়ষ্কাল ধরে রাখবেন!
জেনেটিক্যালি তার পিতাও ৫১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। আবার যখন ভাবি, এই ৫৩ বছর বয়সেই তিনি একাধারে কবি, গীতিকার, প্রাবন্ধিক, সমালোচক, গবেষক, প্রশাসক, বক্তা, গায়ক, কথক এবং কিংবদন্তীতূল্য শিক্ষক ও উপস্থাপকও বটে।
ভাবা যায়!
এই প্রতিভা ঈশ্বর নিজ হাতে সৃষ্টি করেছিলেন বৈকি। স্বর্ণগর্ভা তার মা মোসাম্মত খালেসুন্নেসা ভালো গান গাইতে জানতেন। ধারণা করি, মায়ের গান শুনেই সংগীতের প্রতি তার এত অনুরাগ ও ভালোবাসা জন্মেছিল সুদূর শৈশবে। পিতা মৌলভী শাহজাহান আলী ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা এবং এফ.এ.—উভয় পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯২২ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।
প্রথম জীবনে তিনি স্কুল শিক্ষক ও পরবর্তী সময়ে পাবনা জেলা বোর্ড অফিসের হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন। পাশাপাশি তিনি ব্যবসাও করতেন। তবে একজন অসাম্প্রদায়িক, সংস্কৃতিবান ব্যক্তি হিসেবে নিয়মিত গান শুনতেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। বলা যায়, গানপ্রীতির কারণেই তার সংগ্রহে বিখ্যাত শিল্পীদের অনেক রেকর্ড ছিল।
শাহজাহান আলী ও মোসাম্মৎ খালেসুন্নেসা দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে অত্যন্ত মেধাবী আবু হেনা মোস্তফা কামাল ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। আবু হেনা মোস্তফা কামালের শৈশব ও কৈশোরজীবন কেটেছে পাবনা শহরে। বাল্যকাল থেকেই সাহিত্য-সংগীত-চিত্রাঙ্কনে তিনি বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
১৯৫২ সালে পাবনা জেলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে সপ্তম স্থান অধিকার করে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে সপ্তম স্থান অর্জন করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রাবস্থায় ১৯৫৬ সালে ২৫ অক্টোবর তিনি হালিমা খাতুনের সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন।
১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্মান পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার কথা থাকলেও শারীরিক অসুস্থতার জন্যে তিনি পরীক্ষা দেন ১৯৫৮ সালে। প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে তিনি স্নাতক সম্মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় তিনি যথারীতি প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরীক্ষায় ভালো ফলের জন্যে তিনি রাষ্ট্রপতির পুরস্কার পেয়েছিলেন।
এর দশ বছর পরে ১৯৬৯ সালে The Bengali press and Literary Writing (1818–1831) শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্যে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
কর্মজীবনের শুরু ১৯৫৯ সালে। আবু হেনা মোস্তফা কামালের কর্মময় জীবনও বিপুল বৈচিত্র্যের এক মিলিত স্রোতধারা। ১৯৫৯ সালে পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজে বাংলা বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর শিক্ষকতা পেশার এই চাকরির ধারাবাহিকতায় রাজশাহী জেলার নবাবগঞ্জ কলেজ, রাজশাহী সরকারি কলেজের চাকরি শেষে কিছুদিনের জন্যে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান সরকারের জনসংযোগ দপ্তরে সহকারী পরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন।
১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে আবু হেনা মোস্তফা কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে নবীন প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র লেকচারার পদে যোগ দেন। ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে রিডার পদে যোগদান করেন। পাঁচ বছর পরে ১৯৭৮ সালে আবু হেনা মোস্তফা কামাল পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপক পদে যোগ দেন।
এই সময়ে তিন বছরের জন্যে তিনি হাজী মুহম্মদ মুহসিন হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি শিল্পকলা অ্যাকাডেমির মহাপরিচালক পদে এবং ১৯৮৬ সালের ১২ মার্চ তিনি বাংলা অ্যাকাডেমির মহাপরিচালক পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। বাংলা অ্যাকাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালনকালে তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এরমধ্যে জীবনী গ্রন্থমালা প্রবর্তন স্যারের অন্যতম একটি কাজ।
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী আবু হেনা মোস্তফা কামাল সচেতনভাবে তিরিশের বাংলা কবিতার উত্তরাধিকারকে অঙ্গীকার করেই নির্মাণ করেছেন নিজস্ব এক কবিতাভুবনে,পৃথক কণ্ঠস্বর।
তিন বছরে (১৯৮৮–১৯৯০) শতাধিক জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হয় এই কর্মসূচির আওতায়। দ্বিতীয়ত উল্লেখ্য—রশীদ হায়দার সম্পাদিত স্মৃতি ‘৭১’ গ্রন্থমালার প্রকাশ। এছাড়া আনিসুজ্জামান সম্পাদিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রথম খণ্ড, বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থের সংযোজন খণ্ড, আহমদ শরীফ, শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আনিসুজ্জামান ও আবু হেনা মোস্তফা কামাল সম্পাদিত ‘বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ’ ইত্যাদি।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিষয়ের তিনি বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তার মধ্যে ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ সংকলনটির অধিকাংশ কাজ অসমাপ্ত রয়ে যায় তার আকস্মিক মৃত্যুতে। বাংলা অ্যাকাডেমির মহাপরিচালক পদে কর্মরত অবস্থায় ১৯৮৯ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। ঢাকার আজিমপুর গোরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। অনন্ত সময়ের অভিবাসী হয়ে ইতোমধ্যে কেটে গেছে ৩৫ বছর। ৩৫ বছর তিনি আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু বাংলাদেশের অন্যতম সৃষ্টিশীল লেখক হিসেবে তিনি আছেন পাঠকের হৃদয়ে হৃদয়ে। আমাদের জন্যে তিনি রেখে গেছেন অনন্য সাধারণ কিছু শিল্পশস্য।
কবিতা ও সাহিত্যকর্ম
কবিতা, প্রবন্ধ, গবেষণা ও সংগীত—এই চারটি শাখায় পরিভ্রমণরত আবু হেনা মোস্তফা কামাল অন্যদের মতো বহুপ্রজ ছিলেন না। এ বিষয়ে তার একটি কৌতুককর কথাও প্রচলিত ছিল—সম্ভবত, তিনি এক সাংবাদিকের এ রকম এক প্রশ্নের উত্তরে কথাটি বলেছিলেন।
স্যার, আপনার লেখা তেমন পাচ্ছি না, যে!
উত্তরে স্যার বলেছিলেন, জানো তো,ইতর প্রাণীরাই ঘন ঘন প্রসব করে। যেমন ইঁদুর…
ধারণা করি এ কারণে জীবিতকালে তার মোট ৭টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তিনটি কবিতার বই, একটি গানের সংকলন, দুটি প্রবন্ধের বই এবং একটি গবেষণাগ্রন্থ।
কাব্যগ্রন্থ তিনটি যথাক্রমে—১। আপন যৌবন বৈরী (১৯৭৪); ২। যেহেতু জন্মান্ধ (১৯৮৪); ৩। আক্রান্ত গজল (১৯৮৮)। লক্ষণীয় যে, তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের পটভূমিতে।
উল্লেখ্য, এক জীবনেই তিনি তিন ধরনের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ভৌগলিক পরিচয় বহন করেছেন। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ, পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশ। ফলে তার মেধা-মনন ও শিল্পী সত্তা নিরন্তর রূপান্তরের বাঁকে বাঁকে কুড়িয়েছে যত অনুভব ও উপলব্ধির রসমূর্তি, সে তুলনায় প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা স্বল্পই বলা চলে।
অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তিনি পঞ্চাশের দশকের একজন কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠেন। বন্ধু মাহ্ফুজউল্লাহ্-এর সহযোগে তখনই তিনি সম্পাদনা করেন কবিতা সংকলন ‘পূর্ব বাংলার কবিতা’ (ঢাকা, ১৯৫৪); এই সময়ে তিনি ছিলেন রেডিওর তালিকাভুক্ত সংগীত শিল্পী। তার লেখা গান তখন অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর কণ্ঠে কণ্ঠে জনপ্রিয়তার মাধুরী ছড়ায়।
বহু পরিচয়ের মধ্যে তার কবি পরিচয়টি অগ্রগণ্য মনে করি আমি। কেননা, তার কবি পরিচিতি যতখানি প্রকাশিত, অন্যান্য পরিচিতি ঠিক সেভাবে নয়। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী আবু হেনা মোস্তফা কামাল সচেতনভাবে তিরিশের বাংলা কবিতার উত্তরাধিকারকে অঙ্গীকার করেই নির্মাণ করেছেন নিজস্ব এক কবিতাভুবনে,পৃথক কণ্ঠস্বর। রোমান্টিক প্রেমচেতনাজাত স্বদেশ প্রেম, প্রকৃতি প্রেমে জাড়িত তার শব্দশিল্প অনায়াসে জীবন জয়ের কথা বলে।
আমুণ্ডপদনখ স্বদেশপ্রেমে নিমজ্জিত কবি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থে সদ্য স্বাধীন দেশের ছবি আঁকেন অতুলনীয় এক শব্দতুলিতে। প্রদীপ্ত,অহঙ্কারী উচ্চারণে যখন বলেন—
আপনাদের সবার জন্যে এই উদার আমন্ত্রণ
ছবির মতো এই দেশে একবার বেড়িয়ে যান।
রঙের এমন ব্যবহার, বিষয়ের এমন তীব্রতা
আপনি কোনো শিল্পীর কাজে পাবেন না, বস্তুত শিল্প মানেই নকল নয় কি?
অথচ দেখুন, এই বিশাল ছবির জন্যে ব্যবহৃত সব উপকরণ অকৃত্রিম,
আপনাকে আরো খুলে বলি: এটা, অর্থাৎ আমাদের এই দেশ,
এবং আমি যার পর্যটন দপ্তরের অন্যতম প্রধান, আপনাদের খুলেই বলি,
সম্পূর্ণ নতুন একটি ছবির মতো করে
. সম্প্রতি সাজানো হয়েছে।
খাঁটি আর্যবংশ সম্ভূত শিল্পীর কঠোর তত্ত্বাবধানে ত্রিশ লক্ষ কারিগর
দীর্ঘ নটি মাস দিনরাত পরিশ্রম করে বানিয়েছেন এই ছবি।
এখনো অনেক জায়গায় রঙ কাঁচা—কিন্তু কী আশ্চর্য গাঢ় দেখেছেন?
ভ্যান গগ্—যিনি আকাশ থেকে নীল আর শস্য থেকে সোনালি তুলে এনে
ব্যবহার করতেন—কখনো,
শপথ করে বলতে পারি,
এমন গাঢ়তা দ্যাখেননি!
আর দেখুন, এই যে নরমুণ্ডের ক্রমাগত ব্যবহার—ওর ভেতরেও
একটা গভীর সাজেশান আছে—আসলে ওটাই এই ছবির—অর্থাৎ এই ছবির মতো দেশের—থিম!
(আপন যৌবন বৈরী)
অথবা দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘যেহেতু জন্মান্ধ’-এ আমরা অনন্য সাধারণ এক পিতৃহৃদয়ের আকুতি শুনি, আন্দোলিত হতে থাকি হৃদয়ের ভাবতরঙ্গে।
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বাংলা গানের একজন অতুলনীয় গীতস্রষ্টা এবং হেমন্তকুমারের মতো একজন কৃতি সুরশিল্পীকে দেখছিলাম আর শুনছিলাম তার কণ্ঠের জাদু।
এই গ্রন্থের ‘আত্মজ’ কবিতায় চিরকালের পিতৃহৃদয়ের যে পরিচয়—বাৎসল্য রসের শাশ্বত আবেদন—কবিতার বক্তব্যকে ছাড়িয়ে নিঃসন্দেহে কবিতার অলৌকিক এক রসব্যঞ্জনায় বিমুগ্ধ করে পাঠককে।কবিতাটির শেষ কয়েকটি চরণ উল্লেখ করছি—যেমন
আমার আত্মজ তুমি, হে যুবক
তুমি চলে যাও দুঃসাহসী পর্যটনে নিঃসঙ্গ একাকী
দুর্গম শিখর থেকে অবারিত সমতলে
শ্রমে স্বেদবিন্দু ঝরে সুন্দর ললাটে।
অথচ তুমি কি জানতে একজন প্রৌঢ় তার নিদ্রহীন রাতে
মমতায় সর্বক্ষণ রাখে দুহাত বাড়িয়ে?
যন্ত্রণায় যতবার তুমি শোনিতাক্ত কেঁপে ওঠো,
ফিরে আসো পরাজিত অবসন্ন পায়
আমিও তো সহযাত্রী সহোদর তোমার,প্রত্যেক ঠিকানায়।
(যেহেতু জন্মান্ধ)
সর্বশেষ ‘আক্রান্ত গজল’ কাব্যগ্রন্থে জীবন দর্শনে পরিণত,অভিজ্ঞ, জীবন-মৃত্যুর উপলব্ধিজাত—জীবনবাদী এক কবির দেখা পাই—যেখানে প্রকৃতি, নারীপ্রেম, দেশপ্রেম—একাকার হয়ে মিশে আছে—কবিতার শব্দ-উপমা ও চিত্রকল্পে। এই পর্বেও তিনি পাঠকের চিত্তে জ্বেলে দেন প্রতিটি মুহূর্তে জীবন উদযাপনের আশাবাদ ও ভালোবাসা।
আবু হেনা মোস্তফা কামালের প্রবন্ধের সংখ্যা খুব বেশি নয়—মাত্র দুটি। অন্যটি গবেষণাগ্রন্থ। যথাক্রমে—
১। শিল্পীর রূপান্তর (১৯৭৫)
২।কথা ও কবিতা (১৯৮১)
৩। দ্য বেঙ্গলি প্রেস অ্যান্ড লিটারারি রাইটিং (১৯৭৭)
আবু হেনা মোস্তফা কামালের মধ্যে তার কবি সত্তাই জাগ্রত ছিল অমিত বৈভবে। ফলে গদ্য-পদ্য—দুটো ধারাতেই, বিশেষভাবে তার প্রবন্ধের ভাষায় যে প্রাঞ্জল কাব্যগুণ বর্তমান—প্রকৃত কবি ছাড়া এমন শিল্পিত গদ্য লেখা সম্ভব নয় বলেই মানি। তাঁর দুটো গ্রন্থের অধিকাংশ প্রবন্ধের বিষয় সমাজ ও সাহিত্য।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, মুনীর চৌধুরী—প্রমুখ সাহিত্যিকের সাহিত্য-সমালোচনায় আবু হেনা মোস্তফা কামাল বিশেষ নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। দ্য বেঙ্গলি প্রেস অ্যান্ড লিটারারি রাইটিং (১৯৭৭) এই অভিসন্দর্ভের জন্যে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। আলোচ্য গ্রন্থে ভবানীচরণ বন্দোপাধ্যায় ও তার সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আবু হেনা গভীরতর ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। এই অভিসন্দর্ভ সম্পর্কে আনিসুজ্জামান মন্তব্য করেছেন যে, ‘তাঁর অভিসন্দর্ভের মধ্যে রয়েছে সন্ধানী দৃষ্টি, জীবনরসরসিকতা, কৌতুকবোধ ও সহানুভূতির উল্লেখযোগ্য মিশ্রণ। সমাজের সঙ্গে সাহিত্যের সংযোগের বিষয়টি এখানে মুখ্য স্থান দখল করেছে।’
গীতিকবি
কবির মৃত্যুর পরে প্রকাশিত ‘আমি সাগরের নীলে’ শীর্ষক গানের সংকলনে শ’দুয়েক গান লিপিবদ্ধ আছে। অথচ তিনি লিখেছেন আরও অনেক। রবীন্দ্র-নজরুলের পরে তিন কবিসহ পঞ্চকবির গানের প্রভাব বা মোহজালে দীর্ঘকাল আটকে আছে সুরশ্রেষ্ঠ বাঙালির প্রাণ-মন। এই ধারায় গীতিকার হিসেবে আবু হেনা মোস্তফা কামালের কৃতিত্ব অপরিসীম। যৌবনের তিন বন্ধু সংগীতচর্চায় তাকে উদ্দীপ্ত করেছিলেন দারুণভাবে। তারা হলেন, সুরকার-কণ্ঠশিল্পী আবুবকর খান, আনোয়ারউদ্দিন খান ও কবি-শিল্পী আসাফউদ্দৌলা। পরবর্তী সময়ে গান পরিবেশনের চেয়ে গীত রচনায় তিনি অধিক মনোযোগী ছিলেন।
স্বদেশপ্রেম, মানবপ্রেম, হৃদয়ের অন্তরঙ্গ অনুভূতি, গভীর আবেগ সব মিলিয়ে আধুনিক শিল্পচর্চার এক পরিশীলিত রূপের দেখা মেলে তার গানে ও কবিতায়। ‘তুমি যে আমার কবিতা’, ‘অনেক বৃষ্টি ঝরে’, ‘অশ্রু দিয়ে লিখা এই গান ভুলে যেও না’, ‘নদীর মাঝি বলে’, ‘অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে সেদিন বর্ণমালা’, ‘এই বাংলার হিজল তমালে’র মতো অনন্য সৃষ্টি রয়েছে আবু হেনা মোস্তফা কামালের। বন্ধু আবু বকর খান, আনোয়ারউদ্দিন খান ও মো. আসাফদ্দৌলাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি আধুনিক গান চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মিলন গড়ে তুলেছিলেন।
আবু বকর খানের গাওয়া বিখ্যাত গান ‘সেই চম্পা নদীর তীরে’ আবু হেনার লেখা জনপ্রিয় গানের অন্যতম একটি। তিনি ঢাকা বেতারের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। এছাড়াও ফেরদৌসী রহমানে কণ্ঠে ‘আমি সাগরের নীল/ নয়নে মেখেছি/ এই চৈতালি রাতে’ একদা বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছির। এই গানের স্মৃতিমেদুরতা আজও শ্রোতার মনকে গভীরভাবে আবিষ্ট করে রাখে।
অন্তরঙ্গ অনুভব, গাঢ় আবেগ, রোমান্টিক আর্তি এবং কখনো কখনো স্বদেশবোধের শিল্পিত ধ্যান তাঁর কবিতা এবং গানগুলোকে একইভাবে জারিত করেছে। আবু হেনা মোস্তফা কামাল বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের নানা অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন নিয়মিত উপস্থাপক-আলোচক-পরিকল্পক। চমৎকারভাবে কথা বলতেন তিনি—যেন ঝিনুকের ভেতরে মুক্তোর গান। অসম্ভব জনপ্রিয় এই শিল্পী সহজ কথাকে শিল্পে রূপান্তর করতে পারতেন। এটি সম্ভব হয়েছিল তাঁর কথা বলার অপূর্ব ভঙ্গির জন্যে।
মনে পড়ছে, ১৯৮৯ সালের ১৭ সেপ্টম্বর, তখনো তিনি বাংলা অ্যাকাডেমির মহাপরিচালক। বাংলাদেশ টেলিভিশনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আবু হেনা মোস্তফা কামালের মুখোমুখি আলাপচারিতায় একটা সাক্ষাৎকারমূলক অনুষ্ঠান প্রচার হওয়ার কথা। আজও মনে আছে, সেদিন টেলিভিশনের সামনে আমরা তাঁর প্রতিটি সরস হৃদয়গ্রাহী নতুন কিছু কথা শুনবো বলে উন্মুখ হয়ে বসেছিলাম। শ্রবণধন্য সেই প্রশ্ন-উত্তর পর্ব আমাদের বিমোহিত করে রেখেছিল সর্বক্ষণ। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বাংলা গানের একজন অতুলনীয় গীতস্রষ্টা এবং হেমন্তকুমারের মতো একজন কৃতি সুরশিল্পীকে দেখছিলাম আর শুনছিলাম তার কণ্ঠের জাদু। এই অনুষ্ঠানটি ছিলো হেনার জীবনের সর্বশেষ সাক্ষাৎকার।
একজন সৃষ্টিশীল খেয়ালি কবি-মানুষকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন অল্প বয়সে। আমৃত্যু প্রেমে প্রত্যয়ে তিনি তাকে লালন করে গেছেন গভীর মমতায়।
এর তিন দিন পরে ২৩ সেপ্টেম্বর আবু হেনা মাটির বন্ধন ছিন্ন করে চলে গেলেন। পরবর্তী তিন দিন পরে ২৬ সেপ্টেম্বর অন্য কিংবদন্তীতূল্য সংগীতশিল্পী হেমন্তকুমার মুখোপাধ্যায় অনন্তের পথে দেহ সপে দিলেন। এ যেন কাকতালীয় মৃত্যুভার। সুরপাগল দুজন মানুষের এই প্রস্থানের কোনো যোগসূত্র ছিল কি না—কে জানে!
কর্মবহুল জীবনের নানা প্রান্তে বিচিত্র কর্মরসে আবু হেনা মোস্তফা কামাল নিমজ্জিত থেকেছেন। একসময় সাময়িক পত্রিকায় সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক সরস কলাম লিখে প্রশংসিত হন। সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৫), সুহৃদ সাহিত্য স্বর্ণপদক (১৯৮৬), একুশের পদক (১৯৮৭), আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ স্বর্ণপদক (১৯৮৯), সাদত আলী আকন্দ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯১)-এ ভূষিত হন।
জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবেও তিনি অদ্বিতীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবে তার পাণ্ডিত্য-জ্ঞান ও বহু পঠন-পাঠানের কথা শিক্ষার্থী মাত্রই জানতেন। ফলে তার যারা সরাসরি ছাত্র নয়, তারাও তাকে একনজর দেখতে উদগ্রীব ছিলেন।
এ রকম অগণিত শিক্ষার্থীর মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন তিনি। তার শিক্ষার্থীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের মধ্যে আছেন——কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, সারওয়ার জাহান, রশীদ হায়দার, আসাদ চৌধুরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, ভীষ্মদেব চৌধুরী, ড.শামসুজ্জামান খান।
বাংলা অ্যাকাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার সরাসরি শিক্ষক না হলেও তার মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। এক লেখায় তিনি বলেছেন,‘তিনি সরাসরি আমার শিক্ষক ছিলেন না। তবুও তিনি আমার মাঝে শিক্ষকের মর্যাদায় আসীন ছিলেন। তিনি ছিলেন আমার সর্বশেষ রেনেসাঁ পুরুষ।’
বলাবাহুল্য আমিও তার এমনই একজন ছাত্রী। তিনি যখন ৭৮ সালে দ্বিতীয় বার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যোগদান করেন। সাময়িক বাসস্থান টিএসসির শিক্ষক লাউঞ্জে। আমাদের এমএ ফাইনাল শেষ হয়েছে, তখনো শামসুন্নাহার হলের আবাসিক। লিলি, সাইদাকে নিয়ে আমরা তিন বান্ধবীরা সময়ে অসময়ে মটিএসসিতে ঘুরে বেড়াতাম। হাতে অঢেল সময় খাতা ভরে ফেলি কবিতা লিখে লিখে।
এরকম একদিন হঠাৎ তার সঙ্গে টিএসসির বারান্দায় দেখা। আমরা বাংলার ছাত্রী জেনে স্যার আমাদের সঙ্গে বেশ গুরুত্ব দিয়ে কথা বলেছিলেন। বাংলা বিভাগের জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও আবু হেনা সম্পর্কে আমাদেরও কিছু পূর্বধারণা সৃষ্টি হয়েছিল অগ্রজ শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে। আবু হেনার পাণ্ডিত্য সম্পর্কে ড. আহমদ শরীফও মাঝে মধ্যে আমাদের ক্লাসে কথা বলেছেন। সঙ্গত কারণেই সেদিন তার সঙ্গে পরিচিত হয়ে, কথা বলে ভীষণভাবে আপ্লুত হয়েছিলাম আমরা তিনবন্ধু।
আমি কবিতা লিখি—শুনেই তিনি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের ব্যাপারে। এই কবিতা সূত্রেই হেনা ও তার পরিবারের সঙ্গে আমার যোগসূত্র আত্মীয়তায় পরিণত হয়েছিল। তখন আমি কাছ থেকে দেখেছি পারিবারিক জীবনেও সর্বদা আনতমুখী সবুজাভ এক মহিয়সী নারী হালিমা খাতুন অর্থাৎ আমাদের টুলু ভাবির সযত্নে, ভালোবাসায় ও সমর্থনে আবু হেনা স্যার আমৃত্যু কিভাবে উজ্জীবিত ছিলেন।
টুলু ভাবিকে আমি দেখেছি অসামান্য এক নারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে। তিনি নিজে হাট-বাজার, সংসারের সকল কেনা-কাটা, রান্না-বান্না থেকে শুরু করে সংসারের সমূহ দায়িত্ব নিজের কাঁধে বহন করেছেন হাসিমুখ। একজন সৃষ্টিশীল খেয়ালি কবি-মানুষকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন অল্প বয়সে। আমৃত্যু প্রেমে প্রত্যয়ে তিনি তাকে লালন করে গেছেন গভীর মমতায়। শিক্ষকদের স্বল্প আয়ের সংসারে টুলুভাবি খুবই টেনে-টুলে চলতেন।
কাঁচাবাজারে গুনে গুনে টাকা খরচ করতেন তিনি। এরমধ্যেই সন্তানদের সকল চাহিদা মেটাতে চাইতেন সর্বংসহা মাতৃরূপে। এই দিনে তার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জ্ঞাপন করছি।