০১.
তার তীব্র চাউনি আমাকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে ফেলে। ঝড়ো মেঘ তছনছ করে ফেলে পরিপার্শ্ব। আমি বুঝে উঠতে পারি না, কী এমন অন্যায় আমার! আমার অন্যায় ছিল এটুকুই, দীর্ঘদিন তাকে আমি সময় দিতে পারিনি। তাকে বুঝিয়ে লিখেছি বারবার। লিখেছি এই মুহূর্তে আমি ভীষণ অসহায় মিতু, তুমি আমার অনিচ্ছাকৃত ত্রুটিটুকু ক্ষমার চোখে দেখো। সে আমার অনিচ্ছাকৃত ত্রুটিটুকু ক্ষমার চোখে দেখেনি। সে চোখ দেখে সাত বছর আগে এক তরুণ তার সমস্ত সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে স্বপ্নের উত্তাল ঢেউয়ে নাও ভাসিয়ে ছিল, আজ কম্পনহীন সেই স্থির জলে তার হাত কাঁপছে। কী অদ্ভুত ব্যাপার! এমনই হয়? হতে পারে? হয় বোধ হয়। আমি তো অন্তত এই মুহূর্তে বুঝতে পারছি, কিছু একটা হয়ে গেছে আমার। কিংবা এমনও হতে পারে, সাত বছর আগের সীমাবদ্ধ গণ্ডিতে ফিরে গেছি। হয়তো বা।
০২.
সে কিছুই বলে না। আমিও না। কী বলবো? কিছু কিছু মুহূর্ত আছে মানুষ নির্বাক হয়ে যায়। গরম বালিতে বালায় ধান অনবরত ফুটে ফুটে যখন খই হয়। তার অদ্ভুত ছন্দের মতো মানুষের মুখেও কথা ফুটে। সেই একই মুখ যখন মনের সঙ্গে আঁড়ি দিয়ে ছিপিবদ্ধ করে রাখে, তখন আর কে কাকে কী বলবে? না-বলা মুহূর্তগুলো কেটে যাচ্ছে ক্রমাগত। আমরা দুজন স্থির, নিষ্কম্প। মিতু তার তীব্র তীক্ষ্ম দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে আমার চোখ থেকে। তার দৃষ্টি এখন নকশি কাঁথা আঁকা ক্যালেন্ডারের পাতায়। ওর চোখ এখন খুটিয়ে দেখছে ক্যালেনডারের রঙ রূপ আর আমি চেষ্টা করছি পরিক্রমণরত সময়ে নিরাকার টুকরোগুলোকে অতিক্রম করে যেতে, একটু সহজবাধ্য সময়ের মুখ দেখতে। অন্তত মিতু যেন একটু খানি আগের ফর্মে ফিরে আসে এই মুহূর্তের একান্ত চাওয়া আমার শুধু এটুকু।
০৩.
আমার বাধ্যতার কথা স্বীকার করতে আমার দ্বিধা নেই, একফোঁটা কোন মানুষ কি কখনো নিজে ব্যর্থ হতে চায়? চায় না। অন্তত আমি চাইনি। আমার কৈশোর অন্য দশটা ছেলের মতো খেলার মাঠ আর স্কুলের গণ্ডিতে কাটেনি। আমার খেলার মাঠ, বন্ধুদের আড্ডা বলতে কিছু ছিল না। স্কুলের কঠোর সময়টুকুর পর আমাকে একপাল গরুর পেছনে ছুটতে হয়েছে। একরাশ কান্তির মেঘ শরীরে মেখে সন্ধ্যা বাড়ি ফিরে আমি নিরুদ্বিগ্ন বসে থাকতে পারিনি। বাজারের বিশাল হলে, তেলের টিন, কেরোসিনের পাত্র নিয়ে ছুটে যেতে হয়েছে বাজারে। রাতে বাড়ি ফিরে বই খুলতেই চোখের সামনে ক্লান্ত প্রজাপতির ডানা মেলা। গভীর ঘুমেই কেটেছে রাত। স্বপ্ন দেখার সময় কোথায়? তারপর দিন কেটেছে রাত কেটেছে। শত প্রতিকূলতার মাঝে স্কুল তার গণ্ডিতে আটকে রাখতে পারেনি আমাকে। কলেজের স্বাধীন চত্বর স্বাগত জানালেও আমি তাকে সঙ্গ দিতে পারিনি। আমার রঙিন বান্ধবীরা কষ্টের সলতে বাড়িয়ে দিতে জিজ্ঞেস করেছে, তপু তুই এত চুপচাপ থাকিস কেন?
০৪.
সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারি। কামাল ভাইয়ের সম্পাদনায় একুশে সংকলনে আমার প্রথম লেখা ছাপার অরে প্রকাশ হওয়ার কথা। ভোর পাঁচটায় উঠে ফুলের গুচ্ছ নিয়ে ছুটে যাচ্ছি চার কিলোমিটার দূরের আমার প্রিয় শহরে। আমি একা গ্রামের মানুষ একুশ বুঝে না। তাদের ফুল দেওয়ার তাড়না নেই। শেষ বাড়িটার নীল গেটে সে কিশোরী লাল গোলাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে দেখে প্রথম বারের মতো চমকে যাই আমি। কিশোরীর চোখের চাহনি আমাকে সমুদ্রের গভীরে ছুড়ে দেয়। ওরও সাথী নেই। ওর চোখ বলে দেয় ও সাথী হবে। আমার চোখও বুঝি অজান্তেই বলে ফেলে এসো। ও আমার সঙ্গেই পা বাড়ায়। নাম জানা হয়ে যায়। মিতু।
ওর চোখের ভাষা পড়তে পারি সহজেই। সবাইকে ছেড়ে ছুড়ে বেরিয়ে এসেছে মিতু। সারা জীবনের জন্য। আমার চুম্বন ফিরিয়ে দেওয়ার সময় এখন।
চৌরাস্তার মোড়ে প্রভাতফেরীর মিছিলে পাশাপাশি হাঁটি দুজন। মিতুর চোখ বড্ড টানে। শহীদ মিনারের পাদদেশে ফুল দিয়ে ফিরে আসার সময় মিতুকে পাই না। শুধু ওর চোখ আর হাসি বুকের গভীরে ডানা মেলে ওড়াউড়ি করে। তপুর বুকের গভীরে এক গোলাপ কুড়ি পূর্ণ হতে থাকে দিন দিন।
০৫.
একদিন কলেজ চত্বর আমাকে বিদায় জানায়। বন্ধু বান্ধবীরাও। আমি ভার্সিটির বিপুলায়তন ক্যাম্পাসে নিজেকে ছুড়ে দেই। মিতুও ভীষণ খুশি। আমার বুকের গভীরে বেড়ে ওঠা গোলাপ কুঁড়ি তত দিনে পূর্ণ গোলাপ। আমার হাতে হাত রেখে মিতু প্রতিজ্ঞা করে, ‘তোমার জন্য অপেক্ষায় আছি, থাকবো আমি।’ বাড়ির আর্থিক সহযোগিতা পাই না। কারণ আমি বুঝি। আর সেজন্যই বিকল্প রাস্তা খুঁজে নিতে হয়। পুরনো বন্ধুরা ধীরে-ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। টিউশানির প্রচণ্ড চাপ, পড়ার চাপ; সব সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাই। তবু প্রায় প্রতি সপ্তাহে মিতুর চিঠি অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে ভরে রাখে আমাকে। বাড়ি যাই খুব কম। ছাত্র-ছাত্রী, নিজের পড়াশোনা সময় দেয় না আমাকে। মাস্টার্স ফাইনাল হয়ে যায়। মুক্তির শ্বাস ফেলি। মিতুরও গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট। দরখাস্তের পর দরখাস্ত চলে। মামা-চাচাহীন রাজধানী বিট্রে করে বারবার। তবুও একসময় ফুল ফোটে, ফল ধরে। বাড়ি যাই। সবাইকে জানাই। একান্তে মিতুকেও। মিতু প্রথম চুম্বনে আমাকে প্রকম্পিত করে। মাত্র তিন মাসের মধ্যেই মিতুও একটা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মী হয়ে ওঠে। চুম্বন ফেরত দেওয়ার পালা আমার। কিন্তু ট্যুর আমাকে মিতু থেকে দূরে ঠেলে দেয়।
০৬.
মিতুর কষ্টছোঁয়া চিঠি পাই। বুকের ভেতর কান্নার বরফ জমে। জমতেই থাকে। অনেক দায়িত্ব ঘাড়ে আমার ইচ্ছে করলেই সান্নিধ্য পেতে পারি না। এক শীতের দুপুরে মিতুর চিঠি আসে। সামান্য ‘ক’ লাইন। পড়ে আমার বুক কাঁপে। কিন্তু বিশেষ তদন্ত কাজে পাঁচ দিনের ট্যুরে দিনাজপুর যেতেই হবে। জমানো বরফ কঠিন শীলা হয়ে ওঠে। সংক্ষেপে অবস্থা জানাই। তারপর যাত্রা করি ইচ্ছার বিরুদ্ধেই। যথাসময়ে রাজধানীতে ফিরি। যাত্রাবিরতি না রেখেই ছুটি মিতুর কাছে। ওর অফিসে পৌঁছাই ঝড়ো কাকের মতো চেহারা নিয়ে। মিতুর কলিগ দেখে চমকায়। ও সব কিছু জানে। আমার অবস্থা বুঝে নেয়। একটা ঠিকানা লেখা কার্ড মেলে ধরে। ওখানেই আছে। পৌঁছাই। মিতুই দরোজা খুলে দেয়। আমাকে দেখে। দরোজা ছেড়ে সরে দাঁড়ায়। ভেতরে ঢুকি। সোফায় গা এলিয়ে দেই। দীর্ঘ জার্নির ক্লান্তি আমার শরীরে। মিতু দাঁড়িয়েই থাকে। ওর তীব্র চাহনি আমাকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে ফেলে। তছনছ করে ফেলে পারিপার্শ্ব।
০৭.
ক্যালেন্ডার থেকে চোখ সরায় মিতু। আমার চোখে ওর চোখ। আগের তীব্রতা নেই চোখে। আমি উঠে দাঁড়াই। হত-বিহ্বল ভেঙে পড়া মনে হয় ওকে। ওর হাত দুটো তুলে নেই হাতে। কী হয়েছে মিতু? ওর মুখ থেকে একটা কথাও বের হয় না। শুধু আমার প্রিয় দুটো চোখ থেকে জলধারা নেমে আসে। বুকের কাছে টেনে নেই ওকে। মিতু অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়ে। কান্নার গমকে কেঁপে ওঠে বারবার। আমি বুঝে নেই এই কান্নার অর্থ। পাওয়া আর না পাওয়ার সন্ধিস্থলে দাঁড়ালে এই রকম কান্না ছুঁয়ে যাবেই। ধীরে মিতু স্থির হয়ে আসে। ওকে হাত ধরে বসাই। বসি। মাটির দিক থেকে চোখ তুলে তাকায় মিতু। জলের দাগ মুছিয়ে দেই। ওর চোখের ভাষা পড়তে পারি সহজেই। সবাইকে ছেড়ে ছুড়ে বেরিয়ে এসেছে মিতু। সারা জীবনের জন্য। আমার চুম্বন ফিরিয়ে দেওয়ার সময় এখন।