মধ্যদুপুর থমকে গেলো, গগনজোড়া কাক!
এই কি মোদের ঢাকা শহর, জনতা নির্বাক!
অবিরত ফোনের ক্রিং ক্রিং ধ্বনি আকাশ-বাতাস স্তব্ধ করে রেখেছে। স্তব্ধতার রঙ বড্ড ধূসর! ধূসর পায়রার ডানা! হতে পারে এই স্তব্ধতা ভেঙে আলোর জোয়ার বইবে। আলোর রঙ আগুন; চারিদিকে জ্বলবে আলো। স্তব্ধতা হয়ে উঠবে ছাই! ধূসর রঙা ছাই! সেই সঙ্গে আরও একটি একটি করে কয়েকটি ক্ষণ আত্মহননের পথে পা বাড়াবে; এই ক্ষণে থাকতে পারে কোনো নিরীহ পথচারী; যে কিনা সন্তানের মুখে কিছু তুলে দেওয়ার আশায় এমন সংকটকালে প্রিয়জনদের ছেড়ে এসেছে। অথবা ডান্ডিখোর কোনো কিশোর; যে নিদারুণ অবহেলায় এ পর্যন্ত পৃথিবীর অক্সিজেন অপচয় করে চলেছে নির্দ্বিধায়; ওর আত্মহননে অবশ্য কিছু যায় আসে না এই সংসারের। ক্রান্তিতে ওরা আত্মহননের জন্যই মাঠে নামে। হয়ে ওঠে ক্রান্তিকারী।
একটা ছোট্ট বুলেট ফুলের ছোঁয়ায় ফ্যাকাশে হয়ে উঠবে ওদের মুখ। সেই মুখ দিয়ে গল গল করে রক্ত ঝরবে। রাস্তার পিচে জমাট বেঁধে অসহ্য কালো হয়ে উঠবে থকথকে রক্তের দলা। কালচে রক্ত নিথর হয়ে থাকবে পিচঢালা রাজপথে। সবাই বলে এই পিচের রঙ কালো অথচ শামসুল খেয়াল করে দেখেছে এই রঙ ধূসর! ধূসর রঙা রাজপথ! দেশের রাজনৈতিক পালাবদলের ক্রান্তিকালে গাঢ় রাজকীয় নীল রঙা চাদর গায়ে জড়িয়ে কাল্টনের মোড়ে বসে আছে শামসুল। সঙ্গে শামসুল সদৃশ আরও জনাবিশেক রাজসৈন্য। হাঁটু অবধি কালো সিল্ড জড়ানো। কয়েকজনের হাতে স্বচ্ছ ঢাল। তলোয়ারের ভূমিকায় কিছু রাইফেল আর পাইপগান। ক্রান্তি শুরু হবে যেকোনো সময়; যেকোনো দিক থেকে। রাত নেই, দিন নেই, নেই কোনো শুভ-অশুভ লগ্ন। শামসুল কাঠের পাটাতনে বসে ভাবে; যে ঈগলের কথায় আজ ওরা তেলাপোকা প্রাণ বাজি রেখেছে, ওরা এখন কী করে?
সামনের চিপা গলির ভেতর যে মতিনের চায়ের দোকান আছে, সেটা এই অসময়েও খোলা। মতিন পুলিশের ইনফরমার। তাই গরম গরম খবরের আশায় সিভিল ড্রেসে শামসুলের সহকর্মীরা ঘুর ঘুর করে মতিনের টি-স্টলের আশপাশে। কোনো খবর থাকলে চোখ টিপ মেরে ইশারা দেয় মতিন। এই ইশারা সাধারণত মহাখালীর দালালগুলো দেয়। মতিন কি তবে এককালে খারাপ বেটিছেলের দালাল ছিল? ভাবে শামসুল। ওর হাতে থাকা চায়ের কাপের ওপর ভনভন করে উড়তে থাকে মিউনিসিপ্যালটির নালার স্থানীয় মাছি। ফ্রিতে চিনি খেয়ে খেয়ে ঢাউস সাইজের ভুড়ি বানিয়ে রেখেছে শালা। শামসুল হাতের ঝাড়িতে পরাস্ত করতে চায় ওকে। ক্রান্তিকাল চলছে তাই হাতের ঝাড়ি, ডাঁটের ঝাড়ি, বেতের ঝাড়ি, বুটের ঝাড়ি বা মুখের ঝাড়ি দিয়েই সবাইকে দমিয়ে রাখতে হবে। বর্দিওয়ালাদের এমনই নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসক মহল।
নাদিরা রোজিনার কোলে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করে। মায়ের কোলে মাথা রেখে ভীতি কিছুটা পশম হয় মেয়েটার।
শামসুল জানে ওর ঝাড়িতে কুপোকাত হবে না কেউই। তবু তো প্র্যাকটিস বলে কিছু একটা আছে। মাছিটাকেই না হয় ঝাড়ির গিনিপিগ বানানো যাক। সুপ করে চায়ের কাপে ঠোঁট লাগিয়ে টান দেয় শামসুল। কড়কড়া চিনির দলা সমেত কিছু ব্রাউন কালারের শরবত সুরুত করে ঢুকে যায়। আকাশজুড়ে এখনো কাক! কা কা কা; এই বুঝি নেমে এলো একপশলা বৃষ্টি!
০২.
নাদিরা তেজকুনিপাড়ার ছোট্ট টিন শেডের চিলেকোঠায় একা একা শুয়ে আছে। জানালা দিয়ে আকাশ দেখে। আকাশে ঘুড়ি ওড়ে। স্কুল-কলেজ বন্ধ; ছেলেদের মাঠ বন্ধ। তাতে কী! ঢাকা শহরে বিল্ডিংয়ে যেতে তো আর কেউ নিষেধ করেনি। দল বেঁধে দিনরাত এক করে পোনা-বাচ্চারা ঘুড়ি ওড়ায়। নাদিরা শুয়ে শুয়ে দেখে। পেটের ভেতর যে আছে, সে পৃথিবীর আলো দেখতে উদগ্রীব। যেন পেট ফুঁড়ে বের হয়ে আসবে। ও জানে না আলোর মাঝে কালোর বসবাস। সব আলো একদিন কালো হয়ে যায় এই পৃথিবীতে। জানলে সে বের হতেই চায়তো না হয়তো। নাদিরা পেটে হাত বুলিয়ে দেয়; অবুঝ শিশু শান্ত হয়ে মায়ের চোখে পৃথিবী দেখে; ঘুড়ি দেখে। নাদিরার মনে পড়ে শামসুলকে। এই সময়ে যদি একটু পাশে থাকতো; তবে নিশ্চয় চুলে মাথায় বিলি কেটে দিতো। ভাবনাতেই আরাম বোধ করে নাদিরা। আনমনে ভালোবাসা খুঁজে নেয়; শামসুল এই বুঝি একটু ঝুঁকে কপালে চুমু খেলো। নাদিরার ঠোঁট শিরশিরিয়ে ওঠে; কমলার কোঁয়া হয়ে ওঠে। লজ্জায় ঘুড়িগুলো গোত্তা খেতে থাকে। নাদিরা লজ্জায় অস্পষ্ট উচ্চারণ করে, ইস্!
০৩.
দূর থেকে কিছু প্রজাপতি উড়ে আসছে। শ’য়ে শ’য়ে হাজারে হাজারে লাখে লাখে! এত সুন্দর প্রজাপতি আগে কখনো দেখেনি শামসুল। উড়ে আসছে ঝিনুকচত্বর হয়ে কাল্টনে। কাছে আসতেই মুখ থুবড়ে পড়েছে সব। ধূসর রঙা প্রজাপতিগুলো যৌবনে কাগজ ছিল। ওয়্যারলেসে খবর এলো দুর্বৃত্তরা জ্বালিয়ে দিয়েছে নতুন বছরের ব বোঝায় ট্রাক। বইগুলো আগুনে পুড়ে প্রজাপতি হয়ে উড়ছিল আকাশে। যখন বুঝতে পারলো যে ওরা আসলে প্রজাপতি নয়, তখনই মুখ থুবড়ে পড়েছে ধূসর রাজপথে। সতর্ক হয়ে ওঠে মৃগ-পুলিশ। তেলাপোকা প্রাণ বাজি ধরেছে ওরা। পোড়া গন্ধ ছড়িয়েছে রাজধানীর বাতাসে। কুণ্ডলী পাকিয়ে প্রলয়ের নৃত্য করছে জ্বলন্ত ট্রাকের কালো কালো ধোঁয়া। শামসুল সটান দাঁড়িয়ে; সজাগ চোখ বুলিয়ে নিলো চারপাশ। নাহ্, কেউই তো নেই। কোথায় দুর্বৃত্ত! এই শহরে তো মানুষ থাকে।
সূর্যটা মধ্যগগন অতিক্রম করছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে পোড়া গন্ধ। শামসুলের মন ঘুরে বেড়ায় তেজকুনি পাড়ার চিলেকোঠায়। নাদিরাতে তার প্রসক্তি। মেয়েটার বুকে নেশা আছে; আফিমের নেশা। কনস্টেবলের চাকরির যোগদানপত্র যেদিন হাতে পেলো, সেদিন কোনো রাখঢাক না করেই নাদিরার বাবার কাছে হাত চেয়ে বসে। রেলওয়ের ওয়ার্কার হামিদ আলীর কাছে শামসুলকে কিছুটা পাগলই মনে হয়েছিল। নাদিরা সেদিন লজ্জায় লাল টুকটুকে টমেটো হয়ে উঠছিল বারবার; তবুও আড়চোখের চাহনিতে যে সম্মতি ছিল, সেটা বুঝতে কোনো রকেট সায়েন্স পড়তে হয়নি যুবক ছেলেটার। ছেলেটা সেদিন নাদিরাকে পড়েছিল; নাদিরার চোখের ইশারা পড়েছিল; ঠোঁটের কোণে জমতে থাকা হাসি পড়েছিল; বুকের ভেতর ঢিপঢিপ তরঙ্গের সমীকরণ পড়েছিল আর তারপরই সংবিৎ হারিয়ে বসেছিল হবু শ্বশুরের সামনে। যখন চমক ফিরলো তখন হামিদ আলীর মুখে কী যে শুনেছিল এই কাঠফাটা রোদে কুরুক্ষেত্রের ময়দানে বসে মনে করতে পারলো না।
তবে ছেলেটার উমেদ ছিল; কেমন যেন আগ্রাসী হয়েই সেদিন যুদ্ধ জয় করে নাদিরার বুকে তার নামে নিশান উড়িয়েছিল। ভাবতে ভাবতে শামসুল কুরুক্ষেত্র হতে নন্দনকাননের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে; বিভোরে তার যাত্রাসঙ্গী প্রিয়তমা নাদিরা।
কিছু লাল পিঁপড়া বাতাবীপুরের দিকে জড়ো হয়েছে। সংঘবদ্ধ লাল পিঁপড়ার দল। রাজনীতিতে ওদের অবস্থা কোণঠাসা। প্রশাসনের হুকুম লাল পিঁপড়ে দেখলেই কুচলে দিতে হবে। সেদিন তো নেতা বলেই গেলেন, পিপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে। ওঁদের মতে এই লাল পিঁপড়াগুলোর পাখা গজিয়েছে তাই পাখা ছাটার নির্দেশ। লাল পিঁপড়ারা জড়ো হতে থাকে; এক এক্কে এক, দুই এক্কে দুই, তিন এক্কে তিন এভাবে প্রথমে শ এক্কে শ এরপর হাজার এক্কে হাজার। বাতাবীপুর থেকে ঝিনুকচত্বর শুধু লাল আর লাল যেন কোনো গোলাপের বাগিচা। সেদিন হুজুর বলেছিল বেহেস্তে এমন গোলাপের বাগান আছে, যেখানে মাইলের পর মাইল সুদৃশ্য কমল ফুটে আছে। শামসুল ভাবতে পারেনি এত তাড়াতাড়ি এমন বাগানের দেখা সে পাবে। জান্নাত বুঝি এই দেশে নেমে এসেছে। তবে যে কর্তারা বলেন লাল পিঁপড়াদের পাখা গজিয়েছে মরিবার তরে? তবে কি ওরা জান্নাতের খুশবু মেখে আসেনি? সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলতে শুরু করেছে। কিছু পিঁপড়া সত্যি সত্যি উড়তে শুরু করেছে ডানা মেলে। যেন এলাকায় টহল দিচ্ছে; হাতে হাতে লিফলেট। বড় বড় করে লেখা তাতে ক্রান্তির স্লোগান। এমন এক স্লোগান খচিত লিফলেট দেখে শিউরে ওঠে শামসুল। লেখা ‘ঠোল্লা মারো ইচ্ছা মতো, উড়বা তখন পাখির মতো’! এই ত্রিশ বছর বয়সেও ছেলেটা বুঝতে পারে না পুলিশের সঙ্গে ঠোল্লার সম্পর্ক কী? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাঠ-ঘাট কাঁপিয়ে সরগরম করে তুলছে লাল পিঁপড়ার দল। পরিস্থিতি ঠিক কোন দিকে যাবে শামসুল বুঝতে পারে না। সে অপেক্ষায় থাকে বৃষ্টির। তবেই সে যেতে পারবে নাদিরার কাছে; পিঁপড়া পানি দেখলে ভয় পায়। দৌড়ে পালায়। সে দু’হাত তুলে প্রার্থনা করে; একটু বৃষ্টির; শান্তির বৃষ্টির।
০৪.
নাদিরা এখনো অপলক চেয়ে আছে আছে আকাশে। কলঘরে রোজিনা দুপুরের এঁটো থালাবাসন ধোয়ায় ব্যস্ত। জলের কল কল ধ্বনি আর রোজিনার বাসন মাজার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ একধরনের ঐকতান সৃষ্টি করে। ঘুড়িগুলোও নিয়মহীন এদিক ওদিক ছুটে চলে। ঘুড়িদের কাটাকাটি উৎসব শুরু হয়েছে এরমধ্যে। একঘুড়ি অন্যঘুড়িকে কাটতে ভীষণ ক্ষীপ্র হয়ে উঠছে। কী নিদারুণ দৃশ্য। নিজের জাতকে মেরে আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠেছে যেন। এরমধ্যে একটা ঘুড়ি দূরে একাকী উড়ে চলে। কারো সাতেও নেই পাঁচেও নেই। নাদিরা একমনে ঘুড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে; মায়াবী সে ঘুড়ি। ঘুড়িটার সঙ্গে যেন মুহূর্তেই সখ্য গড়ে ওঠে। ঘুড়িটাও কি তার মতো শামসুলের অপেক্ষা করছে? অপলকে ঘুড়িকে আপন করে নিতে চায় নাদিরা; ঘুড়ির সঙ্গে সই পাতাতে চায়। বুকের মধ্যে জমানো সব গল্প যেন এক নিমেষে বলে ফেলতে পারবে ঘুড়িকে। ঘুড়ি কিছুক্ষণ বামে যায়, কিছুক্ষণ ডানে যায়। হঠাৎ যে কী হয়ে গেলো! একটা কালো ঘুড়ি বলা নেই কওয়া নেই নাদিরার সই ঘুড়ির সুতো কেটে দিলো! নাদিরা আর্ত চিৎকার দিলো, হায় আল্লাহ্! রোজিনার হাতে থাকা প্লেট ঝনঝনিয়ে মেঝেতে ঘুরতে থাকে। দৌড়ে এসে বসে নাদিরার পাশে। গর্ভবতী নাদিরা আজকাল অল্পতেই ভয় পেয়ে যায়; অজানা আশঙ্কা তাড়া করে। রোজিনা কাপড়ের আঁচল ভিজিয়ে নাদিরার মুখ মুছে দেয়। চোখ বন্ধ করে ‘আল্লাহুমা ইন্না নাজআলুকা ফি নুহুরিহিম, ওয়া নাউজুবিকা মিং শুরু রিহিম।’ বলে তিন বার মুখে ফুঁ দেয়। নাদিরা রোজিনার কোলে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করে। মায়ের কোলে মাথা রেখে ভীতি কিছুটা পশম হয় মেয়েটার।
সব আলো নিঃশেষিত হয়ে কালো হয়ে গেছে। ওপর তলার প্রশাসক নিশ্চয় এখন এসির বাতাসে ঘুমোচ্ছেন। এখন যে মধ্যরাত!
সন্ধ্যা তারারা আজকের যাত্রাপালা দেখার জন্য তৈরি হতে শুরু করেছে। কিছু দিগভ্রষ্ট চঞ্চুরী এদিক ওদিক উড়ে বেড়িয়ে একটা পুরনো বিল্ডিংয়ের কার্নিশে নিজেদের আসন থিতু করে নিয়েছে। ওই দূরে কিছু লাল পিঁপড়া মশাল হাতে বেড়িয়েছে। ওদের দেখে ওসি সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দিলো। রাইফেল হাতে প্রস্তুত শামসুল। কোনো গড়বড় হলেই ঠাঁই-ঠাঁই শব্দ তুলে ছোঁড়া হবে কিছু বুলেট ফুল। ফুলের সুবাসে হয়তো লাল পিঁপড়ারা চলে যাবে। বুলেটের গায়ে যে পিঁপড়া তাড়ানোর বিষ দেওয়া আছে। তবে তার আগে ছোড়া হবে টিয়ার শেল। সেটা ছুড়বে আলমগীরের দল। এরপরও সামলাতে না পারলে তো কয়েকটা পিঁপড়াকে ওড়ার স্বাদ মিটিয়ে দিতেই হবে। এমনটাই নির্দেশ। মশাল হাতে পিঁপড়ারা চলে যাচ্ছে । মশাল মিছিল ওদের উদ্দেশ করে স্লোগান দেয় ‘ঠোল্লা মারো ইচ্ছা মতো, উড়বা তখন পাখির মতো; ওই দুশমন ঠোল্লা, কাটবো তগো কল্লা!’ ওদের সাহস দেখে অবাক হয় শামসুল। ওসি স্যারের ধৈর্য দেখেও কম অবাক হয়নি। কত্তবড় সাহস লাল পিঁপড়ার ওসির সামনে কল্লা ফেলার কথা বলে! শুনেই তো ওর রক্ত টগবগ করতে থাকে। শুধু একবার বললেই কয়েকটা লাল পিঁপড়াকে বুলেট ফুলের শুভেচ্ছা জানিয়ে দিতে পারতো সে। ওয়্যারলেসে খবর এসেছে যেকোনো সময় শুরু হবে তাণ্ডব! ক্রান্তির তাণ্ডব! ক্ষমতার লড়াই! যে জিতবে ক্ষমতা তার। শামসুল লড়ছে ক্ষমতাসীনদের হয়ে।
০৫.
গভীররাতে যখন সবাই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে; নাদিরা তখনো নির্ঘুম তারাদের সঙ্গে নিয়ে অপেক্ষার পথ চেয়ে আছে। এই বুঝি শামসুল এসে জড়িয়ে ধরে বলবে, আর দেরি হবে না কখনো। তখন নাদিরা নাক ফুলিয়ে অভিমান করবে, শামসুল অভিমান ভোলাতে মরিয়া হয়ে উঠবে। টিভির পর্দায় খবর স্ক্রল হচ্ছে। ঝিনুকচত্বরে থাকবে না কোনো পিঁপড়া; লাল, কালো কোনো পিঁপড়াই যেন না থাকে; এমনই নির্দেশ প্রশাসনের। অতঃপর শুরু হলো চিরুণী অভিযান। শুরু হলো যুদ্ধ; কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। কৌরবদের শত মহারথী; পাণ্ডবদেরও তাই। কোণঠাসা কৌরবদের রচিত চক্রব্যূহতে চলে পরাক্রমশালী অভিমন্যুদের করুণ যাত্রাপালা। লাল পিঁপড়াদের রচিত চক্রব্যূহতে আটকে গেলো শামসুল। ঝিনুকচত্বর হয়ে উঠেছে কুরুক্ষেত্র। সবার মুখে এক স্লোগান ‘ঠোল্লা মারো, যত পারো’। বুলেটের ফুল ফোটানোর সেই রাইফেল যে কোথায় হারালো বুঝতে পারে না শামসুল। লাল পিঁপড়ার দল একে একে ছিঁড়তে শুরু করেছে ওকে; যেন ও কোনো মানুষ নয়; যেন ও এক কাগজের টুকরো; যেন এক প্রজাপতির ডানা; ইচ্ছে করলেই ছিঁড়ে ফেলা যায়। শামসুল বুঝতে পারে, মুখ দিয়ে তার রক্ত ঝরছে গলগল করে। সে রক্ত জমাট বাঁধছে কালো পিচে; যদিও পিচের রঙ ধূসর; তবু এখন খুব কালো ঠেকছে। নাদিরা সামনে এসে দুহাত বাড়িয়ে ডাকে তাকে। বুকে জড়িয়ে আদর করতে চায় মেয়েটা। কিন্তু শামসুলের খুব উড়তে ইচ্ছে করছে। সেই সুতো কাটা ঘুড়ির মতো উড়তে উড়তে উড়তে বহুদূরে যেতে ইচ্ছে করছে। নাদিরা ডাকছে ওকে; নাদিরার বুকে কে শুয়ে আছে এতটা নিশ্চিন্তে? তবে কি ও এসে গেছে? নাদিরাকে খুব মা মা লাগছে। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। কে যেন হঠাৎ খুব জোরে লাথি মেরে বললো, ‘শালা ঠোল্লা!’ শামসুলের চোখের সামনে সব ধূসর কালো কালো হয়ে ওঠে। কোথাও আর আলো অবশিষ্ট নেই। সব আলো নিঃশেষিত হয়ে কালো হয়ে গেছে। ওপর তলার প্রশাসক নিশ্চয় এখন এসির বাতাসে ঘুমোচ্ছেন। এখন যে মধ্যরাত!