রেললাইনের পাশে পড়ে থাকা পরিত্যক্ত বগিগুলোর একটা কামরা বেছে নিয়েছিল সে। রাত কাটানোর জন্য তার কাছে এটাই যথেষ্ট। অন্তত পাইপের জীবন থেকে ঢের ভালো! অবশ্য রেলের কর্তাবাবু ও স্টেশনের রাত্রির প্রহরীকে মাসিক কিছু টাকা ভাড়া হিসেবে দিতে হবে। সেটা ঠিক ম্যানেজ করে নেবে আতাউর। সে তো আর বসে থাকবে না! কিছু না কিছু কাজ তো জোগাড় করতেই হবে।
আতাউর। একটা চরিত্র। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের চরাঞ্চল থেকে যিনি শহরে এসেছেন। ভাঙন কবলিত মানুষ। ধানের জমি যাবার পরে পৈতৃক যে ভিটেটুকু অবশিষ্ট ছিল, এক ঝড়তুফানের রাতে সেটুকুও গিলে খেয়েছে নদী। ঘুমিয়ে থাকা বউ, আঠারো মাসের সন্তানসহ মধ্যরাতে ঝুপ করে হারিয়ে গেলো নদীর স্রোতে! হ্যাঁ, এটা সেই আতাউর। ছয় বছর বয়স থেকেই ভোরবেলা বাবার জন্য পান্তা ভাত নিয়ে মাঠে যেত। তারও বছর খানেক পর থেকে বাবার সঙ্গে লাঙ্গল ঠেলতে শুরু করেছিল। সেই যে জীবনের জোয়াল কাঁধে উঠলো, তারপর বাবা-বউ-সন্তান সবাই চলে গেলেও আতাউরের কাঁধ থেকে জোয়াল আর নামেনি!
তাই পাইপের বাসস্থান ত্যাগ করে পরিত্যক্ত রেলবগীর এই কামরাটা ভাড়া নেয় আতাউর।
আতাউর। গ্রাম থেকে সব হারিয়ে একসময় শহরে এলো। ফকিরাপুলের একটা ছাপাখানার কর্মচারী নওয়াবের কাছে আশ্রয় পেলো। নওয়াব তাদের গ্রামেরই ছেলে। সে আতাউরকে ছাপাখানায় একটা অস্থায়ী কাজও জুটিয়ে দিলো। তিন বেলা খাবার আর থাকার জায়গার বিনিময়ে ভোর থেকে মধ্যরাত অবধি কাজ করতো। এরপর একদিন সেই চাকরিটাও অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হারায় আতাউর। নওয়াব হত্যার দায়ে তাকে জেলে নেওয়া হয়। তিন বছর কারাভোগের পর নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় মুক্তি পায় আতাউর। তবে, নওয়াবের বিষপানে আত্যহত্যার বিষয়টা আজো রহস্যময় তার কাছে।
আতাউর। জেল থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তাঘাটে কয়েকদিন ঘুরেফিরে কাটালো। গ্যারান্টির ছাড়া কেউ কাজ দিতে চায় না এ শহরে। কিছু দৈনন্দিন শ্রমিকের সঙ্গে তার পরিচয় হলো। উদ্যানের কাছে রাখা নগর কর্তৃপক্ষের পাইপের মধ্যে তার থাকার জায়গা হলো। এরপর ওই শ্রমিকদের সঙ্গে কাজে যেত আতাউর। তিন বেলা খেয়ে, পাইপের ভাড়া দিয়েও কিছু টাকা থাকতো। ওই টাকা দিয়ে সে গাঁজা কিনতো, নেশায় চূড় হয়ে সস্তা পতিতা খুঁজতো, ভিক্ষা দিতো, মাজার-মসজিদ-মন্দিরের দানবাক্সেও কিছু পয়সা ফেলতো।
একসময় হঠাৎ শহরের রাজনীতির মাঠ সরগরম হয়ে ওঠে। বিভিন্ন দলের কাছে আতাউরদের চাহিদা বাড়ে। আয় বাড়ে শহরের ভাসমান আতাউরদের। মিছিল-মিটিং হলেই ডাক পড়ে ওদের। একবেলা খাবারের সঙ্গে কিছু টাকাও মেলে! তাই আতাউররা কোনো কিছু না ভেবেই মিছিলে গা ভাসায়। স্লোগানে তাল মিলায়। শহরে মিছিল-মিটিংয়ের তোড়জোর থাকায় আতাউরের প্রতিদিন ভালো ইনকাম হয়! তাই পাইপের বাসস্থান ত্যাগ করে পরিত্যক্ত রেলবগীর এই কামরাটা ভাড়া নেয় আতাউর।
একজন বৃদ্ধ পুরুষের ছবি। লাল শাড়ি পড়া একটা বউয়ের ছবি। একটা আঠারো মাসের শিশুর ছবি ইত্যাদি।
আতাউর। এখন বেশ শান্তিতে থাকা একজন মানুষ। সারাদিন মিছিল-মিটিং, রেলের কামরায় রাত্রিযাপন, সব মিলিয়ে ভালো আছে সে। কিন্তু এরকম বেশিদিন চললো না। শহরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ক্রমেই বাড়তে লাগলো। আতাউররা এবার ভিন্ন কাজ পেলো। ইনকাম বেশি। এখন আর তাদের মিছিলে যেতে হয় না। ককটেল ফাটিয়ে মিছিলে গণ্ডগোল বাধানোই তাদের কাজ। রোজ তিন-চার হাজার টাকা ইনকাম!
আতাউর। একদিন খুব ভোরে বেরিয়ে পরলো তার রেলবগীর বাসস্থান থেকে। আতাউরের হাতে একটা মিষ্টির প্যাকেট। প্যাকেটে অনেকগুলো ককটেল। আজকে আতাউরের ডিউটি প্রেসক্লাব-হাইকোর্ট এলাকায়। তাই সকাল থেকেই সে ওই এলাকায় অবস্থান নিলো। সেদিন প্রেসক্লাব-হাইকোর্ট এলাকায় ব্যাপক গণ্ডগোল হলো। পুলিশ গুলি ছুড়লো। বেশ ক’জন মারা পড়লো। কয়েকটা বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধার হলো।
আতাউর। তার পরিত্যক্ত রেল কামরার বাসস্থানে আর কখনো ফিরলো না। স্টেশনের রাতের প্রহরী বেশ কয়েকটা রাত আতাউরের জন্য অপেক্ষা করলো। তারপর ভেবে নিলো পালিয়ে গেছে। প্রহরী কৌতূহল বসত আতাউরের কামরাটা সার্চ করলো। সেখান থেকে পাওয়া গেলো কিছু কাপড়। একটা মিষ্টির প্যাকেটে কয়েকটি ককটেল। একটা কাগজে মোড়ানো কিছু গাঁজা। সতেরো হাজার চারশো ত্রিশ টাকা। একজন বৃদ্ধ পুরুষের ছবি। লাল শাড়ি পড়া একটা বউয়ের ছবি। একটা আঠারো মাসের শিশুর ছবি ইত্যাদি।