সকাল বেলা চোখ খুলেই মানিক আরেকটা চোখ খোলার অপেক্ষায় থাকে। সেই চোখ খুলতেই আর এক মুহূর্ত দেরি করে না। সিঁড়ি দিয়ে তরতরিয়ে নেমে রেললাইনটা পেরিয়ে সোজা সেই চোখের সামনে পাতা বেঞ্চিতে বসে পড়ে। চাচামিয়ার দোকানের ঝাপ খোলা দেখলে সকালের ঘুম থেকে আধো চোখ খোলার মতোই মনে হয় মানিকের। চাচামিয়া দোকানেই ঘুমায়। ঘুম ভাঙলেই ভেতর থেকে ঝাপটা সামান্য ঠেলে বাঁশের ঠ্যাকনায় ঠ্যাকা দিয়ে পেছনের জানালা সাইজে কাটা দরজা দিয়ে বের হয়। অদূরে চাপকলে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে দুইটা মিনিড্রামে পানি ভর্তি করে। আগে নিজেই দোকান অব্দি নিয়ে আসতো ড্রাম দুটো। এক্সিডেন্টের পরে আর পারে না। ছোট সহকারী আসার অপেক্ষা করে। বটের ঝুরি আর বড়বড় শেকড় ডিঙিয়ে পানির ড্রাম নিয়ে আসাটা এখন তার জন্য একপ্রকার অসম্ভব।
-বহেন গো কাকু। ছ্যাড়াডায় আহুক।
দোকানের বেঞ্চিতে মানিককে বসতে দেখে আগে এই বাক্যটা বলতো চাচামিয়া। এখন আর বলে না। বালতিতে কাপ-পিরিচ-চামচ আর চা-ছাকনিটা ধুতে নিয়ে যাওয়ার সময় সঙ্গে করে কেটলিটাও নিয়ে যায়। আসার সময় কেটলিটা ভরে নিয়ে আসে। সামনে পাতা ছোট্ট চুলাটা যত্ন করে মোছে। টিনের ট্রেতে কাপ পিরিচ সাজায়। ছোট্ট কাচের শোকেসটা দোকানের ভেতর থেকে টেনেটুনে সামনে আনে। আগের দিনের পানগুলো ধুয়ে ফের ভেজা গামছা দিয়ে ঢেকে দেয়। চুন, জর্দা, কাঁচা সুপারি, সিগারেট, সাজিয়ে রাখার ফাঁকে চুলা জ্বালানোর আয়োজন চলে। এই চুলা যে স্রেফ মানিকের জন্যেই জ্বলে তা এতদিনে মানিক বুঝে গেছে। চাচামিয়া এখন মানিককে এই দোকানের একজন মনে করে। এই ‘মনে করাটা’ অর্জন করতে মানিকের মাস ছয়েক সময় লেগেছে। আগে মানিককে বসে থাকতে হত। দীর্ঘ সময় বসে থেকে চাচামিয়ার ‘ছ্যাড়াডা’ এলে তারপর চুলা ধরানো হতো। মোটামুটি এক থেকে দেড় ঘণ্টার মামলা। এই এক দেড় ঘণ্টায় চাচামিয়া দোকানের ঝাপ খুলে ধীরেসুস্থে সব গুছিয়ে নিতো, আড়চোখে মানিকের দিকে লক্ষ রাখতো। কলা, বিস্কুট, পাউরুটি, বাটারবান হুকে ঝুলিয়ে আয়েশ করে বসতো। তারপর ‘ছ্যাড়াডা’ এলে চাপকল থেকে পানি এনে চুলা ধরানো হতো। মানিকের ধৈর্য ধরতে কোনো অসুবিধা হতো না। কারণ নিজের অই এক কামড়ার খুপরির পর তার বসার জায়গা মূলত এটাই।
রেললাইনের কোলঘেঁষে এই চায়ের দোকানটায় সকাল থেকেই সন্ধ্যা নামে। তিন-তিনটা বটগাছের বুকের মধ্যে একটা চায়ের দোকান মূলত সন্ধ্যা আর সান্ত্বনার মিশেলে এক অন্যরকম রহস্যময় রূপকথা। এই গ্রামের পায়ের কাছে কোনোরকম টিকে থাকা এই চায়ের দোকানটাই মুরুব্বিদের একমাত্র আশ্রয়। এক মানিক ছাড়া আর কোনো জোয়ানমর্দকে এ দোকানে বসতে দেখা যায় না। গ্রামের ছেলে-ছোকরাদের সান্ত্বনা এই যে গ্রামময় হুল্লোড় করতে গিয়ে কোনো মুরুব্বির সামনে পড়তে হয় না। আর গ্রামের বুড়োদের সান্ত্বনা, তাদের একটা জায়গা অন্তত আছে যেখানে হুজুগে ছেলেছোকরা ভিড় করে না।
মানিককেও মেনে নিতে চায়নি প্রথমে। অনেক কষ্টে মানিককে বোঝাতে হয়েছে যে এই গ্রামের সে কেউ না। স্রেফ পেটের দায়ে পড়ে আছে। শখ বেকারির কারখানায় তার চাচাতো ভাই সিনিয়ার মিক্সারম্যান। তার সুপারিশেই চাকরিটা হয়েছে। তবে টেম্পোরারি বেসিসে। কাজ ঠিকঠাক করতে পারলে পার্মানেন্ট। উপজেলায় নিজের বাড়ি থেকে এসে কাজটা করা যায় কিন্তু প্রায় দিনই দেরি করে ফেলে। সবদিন ঘাটে এসে নৌকা পায় না। অপেক্ষা করতে হয়।
আর একটা বিষয়। শখ বেকারির মালিকই যে এই গ্রামের চেয়ারম্যান তা কিন্তু শুরুতেই বলে দেওয়া হয়েছে। শুধু আরেকবার মনে করিয়ে দেয়া আরকি।
-এত দেরি করলে মালিকে তিনমাসও রাখতো না। লোকের কিন্তু অভাব নাই। কয়া রাখলাম। সব চেয়ারম্যান সাবের পায়ের কাছে গড়াগড়ি খায়। পরে আমারে দুষ দিতি পারবা না।
এহেন শাসানির পরে মানিক সিদ্ধান্ত নেয় এখানেই থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। আর বাড়ি থেকে আলগা হওয়ার ইচ্ছেটাও ছিল। বাড়ি ফিরলেই তো বাপের অসহায় চোখ, মায়ের হাজারো অভিযোগ, শ্বশুর বাড়ি থেকে ফেরত আসা বোনের কান্না, বখে যাওয়া ছোট ভাইটার নামে বিবিধ নালিশ। এসব থেকে কিছুটা পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল সে।
-একটা ব্যবস্থা কইরা দেন এইহানে। তাইলে তো আওন-যাওনের ভেজাল থাইকা বাঁচি।
কথাটা কানে গিয়েছিলো মালিক ওরফে চেয়ারম্যান সাবের। সুযোগটা হাতছাড়া করেনি সে। পুরানো বাড়ির চৌচালা টিনের ঘরে উপরের পাটাতনে তাকে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। বিনা ভাড়ায়। মানিকও যেন রতনের সন্ধান পায়। বিনা ভাড়ায় থাকছে তো থাকছেই প্রায়ই খাবারটাও ফ্রি পায়। পরিত্যক্ত টিনের ঘরটার উল্টা দিকে আধপাকা ঘরটায় এক রমণী তারে মাঝেমধ্যেই খানাদানা পাঠায়। অকস্মাৎ সুবিধা মানুষের প্রশ্ন করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। মানিকেরও তাই। প্রশ্ন করে ঝামেলা পাকানোর চেয়ে পাকানো খানাদানা তার কাছে মহামূল্যবান। এই ল্যাড়ব্যাড়ে ঘর, ছেঁড়া তোষক, তেলচিটে বালিশ, রঙ জ্বলে যাওয়া চাঁদর সব তার কাঁছে মহামূল্যবান। দিনশেষে এটুকু তার নিজের, এখানে অধিকার একমাত্র তার। এই ভাবনাটুকু তাকে অপার আনন্দ দেয়। গ্রামের এদিকটায় আসাই হত না মানিকের। কারণ তার অবস্থান বরাবরই শখ বেকারির বিস্কুট, পাউরুটি, কেক, টোস্ট সাপ্লাইয়ের দোকান অবধি। অতএব নো শখ বেকারি ল্যান্ডে তার কোন চিনপরিচয় বা যোগাযোগ ছিলো না। যে রাতে চাচাতো ভাই তাকে এখানে রেখে যায় সে রাতে এতই ক্লান্ত ছিল যে, পাতা বিছানা দেখে শরীর এলিয়ে দিয়েছিল। সে কোথায়, জায়গাটা কোথায় কিছুই মাথায় নেয়নি। গভীর ও তৃপ্তির ঘুম এতটাই তলিয়ে দিয়েছিল যে, কোন দিকে তাকাবার অবসর তার ছিলো না। সকাল বেলা চোখ খুলেই সামনে তিন তিনটা বটের ছায়ায় ছোট্ট চায়ের দোকান দেখে তার মনে হতে লাগলো শখ বেকারির মালিক একজন ফেরেশতা জাতীয়। নইলে এমন দারুণ একটা ব্যবস্থা তার জন্যে বিনা ভাড়ায় কেন করে দেবে?
ঘোর কেটে গেলে প্রশ্ন মাথাচাড়া দেয়। এক সোমবার সন্ধ্যায় উঠানলাগোয়া আধপাকা বাড়িটায় থাকা রমণীকে কাপড় নাড়তে দেখে কলিজা ধড়াস করে ওঠে তার। এ তো আগুনের মতো উজ্জ্বল, খিদের মতো অসহ্য আর…আর কোনো উপমা খুঁজে পায় না মানিক। যা কিছু প্রতিদিনের চটজলদি, তাই মনে পড়ে। সপ্তাহ দুয়েক পরেই অকস্মাৎ চিন্তা আসে মানিকের। আচ্ছা, এই যে নারীটা একলা এইখানে থাকে তার কেউ নাই নাকি? থাকলে তারা কই? এই নিরিবিলি জায়গায় একলা থাকে তার কি কোন বিপদাপদের ডর নাই? তারে দেখাশোনা কে করে? বাজার সদায় কে কইরা দেয়? আরো হাজার খানেক জিজ্ঞাসা তার মনে অল্প জ্বালে ফোটা ভাতের মত ফুটতে থাকে। আশ্চর্যের বিষয় কেউ একটা কথাও বলে না এ বিষয়ে। না টি স্টলের চাচামিয়া, না বসে থাকা প্রবীনেরা। এই উঠান ঘেরা গোটা তিনেক বাড়ির কথা যেন কেউ জানেই না। জীবনে শোনেও নাই। দুই-একবার প্রবীণের আড্ডায় কথাটি তুলতে গেলে সবাই কেমন কাকের মতো চোখ বন্ধ করে নিজেকে আড়াল করতে চাইলো। মানিকও আর এগোলো না। তার দুবেলা খাবারের জোগাড় হয়েছে, রাতে ঘুমানোর ব্যবস্থা হয়েছে। মাত্রাধিক চিন্তা করে এই শান্তি বিনষ্ট হোক তা সে চায় না। আর গাঁও-গেরামের মুরুব্বিরা ‘সুখে থাকতে ভূতে কিলানো’ লোক পছন্দ করে না। সেই সোমবার সন্ধ্যা যে তাকে বেশ্যা নারীর মতো ইশারায় ডেকে নেবে তা কে জানতো। এরপর কয়েকদিন নারীটিকে আর খুঁজে পাওয়া গেলো না। বাড়িতেই আছে। টের পায় মানিক। একদিন মঙ্গলবার রাতে খুটখাট আওয়াজে ঘুম ভাঙে মানিকের। কান পাতে। এ আওয়াজ চাপা চিৎকার না শিৎকার ঠিক বোঝে না। আবার কান পাতে। আলগা দরজা ঠেলে এক পা দুই পা আগায়। কিছুটা ভয়, কিছুটা সংশয়। বেড়ার ফাঁকে যা দেখে তাতে হাত পা হিম হয়ে যায় তার। নারীটির সঙ্গে আদিম আনন্দে বুঁদ হয়ে আছে চা স্টলের এক মুরুব্বি। মানুষ যাকে মাথায় করে রাখে। শালিসি দরবারিতে যিনি অন্যতম। সে কি না, মঙ্গলবারের রাতে এমন অন্যমানুষ হয়ে যায়! পরের মঙ্গলবার সে দেখা পায় আরেক মুরুব্বির। তারপরে আরেকজন। তারপরে…প্রতি মঙ্গলবারের জন্য এখন সে অপেক্ষা করে। কিন্তু বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় না। এক মঙ্গলবার নারীটিকে সে নিজের ঘরে আবিষ্কার করে। তখন মানিক নারীর ভূমিকায় আর নারীটি মুরুব্বিদের ভূমিকায়।
সকালে মানিকের ঘুম ভাঙলেই মনে হয় গত রাতে যা ঘটেছে তা স্বপ্ন। কারণ নারীটির চেহারায় কোনো ভাবান্তর নেই। আগের রাতের সঙ্গে তার যেন কোনোদিন দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। মঙ্গলবার রাত বলে কিছু নেই তার জীবনে। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে রাতের উদোম শরীরের নারীটি সকালে কলাগাছের মোচার মতো একের পর এক কাপড় চাপিয়ে নিজের কুঠুরিতে থাকে। চায়ের দোকানের মুরুব্বিদের কোনো চ্যাতব্যাত নেই, কোনো চোরা ভাবও নেই। মানিক অবাক হয়। চরম অবাক হয়। কাউকে কিছুই বলতে পারে না। মুরুব্বিদের দিনের বেলার চেহারার সঙ্গে রাতের চেহারা মেলাতে পারে না। দিনের বেলার নারীটির সঙ্গে রাতের নারীটিকে মেলাতে পারে না। এরই মাঝে এক রাতে সে ভয়ানক এক স্বপ্ন দেখে। দেখে শখ বেকারির মালিক একটা খুঁটিতে রক্তাক্ত ছাগল বেঁধে শিকারের অপেক্ষায় আছে। একটা বাঘ রক্তের গন্ধ শুঁকে এগোতে না এগোতেই অনেক বল্লম তার দিকে ছুটে আসে। রক্তাক্ত বাঘ কাতরাতে থাকে। তখন বাঘটাকে বাঁধা হয় শিকারের জন্য। এভাবে একের পর এক। এরপরেই সে দেখে শখ বেকারির মালিক তার আর নারীটির গায়ে তেল মাখছে। মানিকের পা জোড়া মালিকের হাতে। মানিককে ঝুলিয়ে তেল মাখছে সে যেন মানিক এক শিশু। আবার দেখে নারীটিকে উল্টো করে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। খুব বিক্ষিপ্ত আর বিছিন্ন স্বপ্ন। মানিক চিৎকার দিতে চাইছে কিন্তু গলা দিয়ে কোনো স্বরই বের করতে পারছে না। ধড়মর করে বিছানায় উঠতে গিয়ে টের পায় বিছানা ভিজে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। কেউ নেই তবু মানিক লজ্জা পায়। কেন যেন অকারণেই মায়ের কথা মনে হয় তার। মায়ের মুখটা মনে হতেই বুকের ভেতর একদলা কান্না টের পায় সে।
ক’দিন ধরেই গ্রামটা উত্তপ্ত। উত্তাপ এই ছায়াঘেরা চায়ের দোকানেও লাগে। কিছু একটা ঘটেছে নিশ্চিত। কিন্তু মানিকের কাছে কেউ কিছু খুলে বলছে না। আর মানিকও আগ্রহী না। এসব রাজনীতি সে কোনোকালেই বোঝে না। ইদানিং প্রায় রাতেই নারীটি তার ঘরে আসে। নেশায় পড়ে গেছে মানিকও। দিনে কী হচ্ছে না হচ্ছে, কিছুই তার মাথায় থাকে না। সে শুধু রাতের অপেক্ষা করে। দুঃস্বপ্নগুলো ভুলতে বসেছে সে। বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ আরও কমিয়ে দিয়েছে। একরাতে আচমকা নারীটির হাত ধরে মানিক, ‘আমারে বিয়া করবা? তোমারে বিয়া কইরা অনেক দূরে লইয়া যামু। কাকপক্ষীতেও জানতি পারবে না।’ নারীটির চোখ চকচক করে ওঠে। তাতে লোভ না জল সে অন্ধকারে ঠিক ঠাহর করতে পারে না। মানিক বুঝতে পারে নারীটিকে সে ভালোবেসে ফেলেছে।
কোনো এক মঙ্গলবারে সে আবার শব্দ শুনতে পায়। ভালোবাসা এমন এক আগুন অদ্ভুত ভাবে সাহসী হতে শেখায়। বিদ্রোহী হয় সে। ধীর পায়ে নারীটির ঘরের দিকে আগায়। সহ্য হয় না মানিকের। এক লাথিতে দরজাটা ভেঙে ভিতরে ঢুকে মালিককে আবিষ্কার করে। মালিক মুহূর্তে বদলে যায়। মানিকের পা পেঁচিয়ে ধরে। মানিকও সুযোগটা কাজে লাগায়। ধূর্ত মালিক মুহূর্তেই রাজি হয় মানিকের কথায়। কাল সকালেই নারীটির সঙ্গে মানিকের বিয়ে দেবে। হুজুর ও ময়মুরুব্বি ডেকে ধর্মসম্মত বিয়ে।
মানিক সকালের অপেক্ষা নিয়ে তার নিজের ঘরে ফেরে। মালিকও সকালের অপেক্ষা নিয়ে নিজ ঘরে ফেরে। সকালে সবার সিদ্ধান্তে ঠিক হয় পরবর্তী মঙ্গলবার ওদের বিয়ে হবে। যে পাঠকেরা গল্পটি এ অব্দি পড়েছেন, তাদের এখন জানার অধিকার আছে এই গল্পে সব কেন মঙ্গলবারই হয়। মূলত এই গ্রামের হাঁটবার হলো মঙ্গলবার। সকাল বেলা হাঁট বসে আর বিকেল বেলা এই গ্রামের সকল সালিসি বৈঠক বসে। গ্রামের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয় এই মঙ্গলবারেই। এই গ্রামে কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করে না, হাঁটে যাবে কি না। জিজ্ঞেস করে মঙ্গলে যাবে কি না। সবাই সবকিছু মঙ্গলের আশায় রেখে দেয়। আহা রে মঙ্গল! ক্ষেতের ফসল, পুকুরের মাছ, গোয়ালের গরু থেকে শুরু করে ঘরের মানুষ সকলেই মঙ্গলের অপেক্ষায়। আর একটা বিষয়। শখ বেকারির মালিকই যে এই গ্রামের চেয়ারম্যান তা কিন্তু শুরুতেই বলে দেওয়া হয়েছে। শুধু আরেকবার মনে করিয়ে দেয়া আরকি।
পরবর্তী এক সপ্তাহ মানিক একটা ঘোরের মধ্যে কাটালো। শত হলেও বিয়ে নিয়ে কথা। বাড়িতে জানাবে, না কি জানাবে না; এটা নিয়ে চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ দরকার। এর মধ্যে রোজই মালিকের সঙ্গে দেখা হয়। মালিক কি কিছু বলেনি তার চাচাতো ভাইকে? কী জানি! চাচাতো ভাইকে বলবে কি না, এটা নিয়ে মালিকের সঙ্গে আলাপ করা যায়। বুধবারে এসব ভাবতে ভাবতে মালিকের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করে। মালিক বলে, ‘মিয়া, বিয়া সাদির ব্যাপারে আত্মীয়-স্বজন কইবা না, তা কী হয়? তয় নিজের পছন্দে বিয়া করতাছ, একটু ধৈর্য ধইরা কওন ভালা না? শ্যাষম্যাশ বাড়িতে কইয়া উলটা কোন ভেজাল না বাজায়। বিয়াডা হইয়া গেলে আর তো ভেজাল নাই। তাই আপাতত আমি, তুমি আর দু’একজন মুরুব্বি পর্যন্তই থাক। পরে না হয় জানাইলা। কী কও মিয়া?’ কথাটা মনে ধরে মানিকের। তবে মায়ের কথা ভেবে মনটা খারাপ হয়।
একজন একজন করে ময়মুরুব্বি চায়ের দোকানে ভিড় জমাতে থাকে। যেন বা গতকাল কিছুই হয়নি। যেন বা মঙ্গলবার বলে কিছু ছিলই না এ সপ্তাহে!
বৃহস্পতিবার রাতে এক ভয়াবহ স্বপ্ন দেখে মানিক। স্বপ্নে সে খুব তৃষ্ণা নিয়ে ছোটাছুটি করে। অনেক চেষ্টায় একটা কুয়া মতন পেয়ে সেখান থেকে পানি তুলতে গেলে তার মা হাত টেনে ধরে। কিছুতেই হাত ছাড়ে না মা। মায়ের নিষ্ঠুরতা তাকে আরও কষ্ট দেয়। মা কিছুতেই কুয়া থেকে পানি তুলতে দিতে চায় না। এক ঝটকায় মাকে সরিয়ে বালতি ফেলে পানি তুলতেই টের পায় এটা পানি নয়, রক্ত। ভয়ে বালতি ফেলে দিতে গিয়ে টের পায় বালতির সঙ্গে সে নিজেও পড়ে যাচ্ছে কুয়ায়। মা বলে চিৎকার দিতে গেলে গোঙ্গানি মতন বের হয় কণ্ঠ থেকে। এক ঝটকায় বিছানায় উঠে বসে মানিক।
শুক্র-শনিবার ক্ষণে ক্ষণে মায়ের কথা মনে হলেও কাজের চাপে ভুলেও যায়। বিয়ের আগে এমন খাটুনিও খাটাচ্ছে মালিক। পারলে এক বছরের কাজ সব করিয়ে রাখে। মালিকও উপজেলায় মিটিং নিয়ে ভয়াবহ রকম দৌড়ের ওপর আছে। কী হচ্ছে কে জানে। মানিক শুধু দেখে মালিক আর মুরব্বিদের ফুসুরফাসুর। ওকে চায়ের দোকানের কাছাকাছি দেখলেই সব চুপ।
রবিবারে চেয়ারম্যান তাকে কাছে ডেকে বেশ কিছু টাকা দেয়। গ্রামে মায়ের কাছে পাঠাবে ও বিয়ের প্রয়োজনীয় সদায়পাতি কিনবে। চাচাতো ভাইকেও আগামীকাল জানাতে বলে। সোমবার গ্রাম উত্তপ্ত। দুই দলের একই মাঠে মিটিং ডাকার ফল। মারামারি চরম আকার ধারণ করার আগে পুলিশ ও মুরব্বিরা মাঝখনে পড়ে সামাল দেয়। মানিক এসবের ধারেকাছেও ঘেঁষে না। তার মাথায় এখন বিয়ে আর নারীটির চিন্তা। দেশ, গ্রাম মারামারি করে উচ্ছন্নে যাক। তার কী? তার জন্যে এই ভাঙাচোরা বাড়ি আর সামনের চায়ের দোকানই দুনিয়া।
মঙ্গলবার হাট থেকে খুব সুন্দর লাল টুকটুকে একটা কাতান শাড়ি কেনে। চুড়ি-ফিতাও কেনে। ঠিক তার আধাঘণ্টা পরেই শুরু হয় দুই দিক থেকে সড়কি আর বল্লম নিয়ে ছোটাছুটি। গতকালের জের। মানুষ জান নিয়ে যে যেদিকে পারে দৌড়াচ্ছে। পুরো হাঁট মুহূর্তেই এক রণক্ষেত্র যেন। মানিকের চোখের সামনে বল্লমের আঘাতে এক যুবককে পড়ে যেতে দেখে। মারামারি, ভাঙচুর, চিৎকার, কান্নাকাটি, ভয়ার্ত মানুষের হুটোপুটি। মানিক কোনমতে হাটের এলাকা ছেড়ে ধান ক্ষেতের আইলে উঠে ভোঁ-দৌড়। কিন্তু দৌড়ানোর আগেই একটা বল্লম মানিকের বুকটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়। ধান ক্ষেতে লুকিয়ে থাকা দুই সন্ত্রাসী একের পর এক কোপে মানিকের শরীর টুকরো টুকরো করে। সবুজ ধান ক্ষেতে লাল রক্ত লেগে যাচ্ছে ছিটকে ছিটকে। অনুভূতিহীন মানিক চোখের সামনে মাকে দেখতে পায়। মা তার হাতটা ধরার কী প্রাণপণ চেষ্টা করছে!
পরদিন চায়ের দোকানের ছ্যাড়াডা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আস্তে করে চাচা মিয়াকে বলে, ‘দেখিছেন, আমার কতাই হয়েছে। আপনারা তো বিশ্বাস যাননি। আমি জানতাম গতবারের মতো এবারও একটা লাশ চেয়ারম্যান দেবেই দেবে। খেলা খতম। এরেই কয় রাজনীতির পলিটিক্স। বুঝলেন?
চাচামিয়া এক ধমক দেয় ছ্যাড়াডারে। একজন একজন করে ময়মুরুব্বি চায়ের দোকানে ভিড় জমাতে থাকে। যেন বা গতকাল কিছুই হয়নি। যেন বা মঙ্গলবার বলে কিছু ছিলই না এ সপ্তাহে!