এক সময় বাংলাদেশের ফোক-ফ্যান্টাসি মুভির সমাদর ছিল। মোজাম্মেল হক বকুল পরিচালিত ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। স্বাধীনতাপূর্ব ষাটের দশকে সালাহউদ্দিনের ‘রূপবান’, দিলীপ সোমের ‘সাত ভাই চম্পা’, জহির রায়হানের ‘বেহুলা’, ‘রহিম ও রূপবান’, খান আতাউর রহমানের এর ‘অরুণ বরুণ কিরণমালা’, মহিউদ্দিনের ‘গাজী কালু চম্পাবতী’, সৈয়দ আউয়ালের ‘গুনাই বিবি’, রহিম নেওয়াজের ‘সুয়োরাণী দুয়োরাণী’, ইবনে মিজানের ‘পাতাল পুরীর রাজকন্যা’
মুভির ব্যবসায়িক সফলতার পরে ফোক-ফ্যান্টাসি মুভি নির্মাণের জোয়ার আসে।
এর ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা উত্তর রূপসনাতন পরিচালিত ‘দয়াল মুর্শিদ’, ইবনেমিজানের ‘আমির হামজা ও ভেলুয়া সুন্দরী’, কামাল আহমেদের ‘দাতা হাতেম তাঈ’, মাসুদ পারভেজের ‘নাগপূর্ণিমা’, শামসুদ্দিন টগরের ‘মহুয়া সুন্দরী’, কাজী কামালের ‘মৎস্য কুমারী’, এফ কবীর চৌধুরীর ‘রাজনন্দিনী’, ইবনে মিজানের ‘লাইলী মজনু’, ‘পাতাল বিজয়’, ইবনে মিজানের ‘চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা’, এম এ ‘মালেকের চাঁদ সওদাগর’, তোজাম্মেল হক বকুলের ‘গাড়িয়াল ভাই’সহ অনেক মুভি নির্মাণ করা হয়।
এই চলচ্চিত্রগুলো কি সবই ব্যবসায়িক সফলতা এনে দিয়েছিল? না, তা নয়। বরং কিছু সিনেমার ব্যবসা ভালো হয়নি। তবু সিনেমাগুলো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। ‘রূপবান’, ‘অরুন বরুণ কিরণমালা’, ‘আনারকলি’, ‘প্রাণ সজনী’, ‘সুজন সখি’সহ বেশ কয়েকটি মুভি বারবার নির্মিত হয়েছে। এখনো এই সিনেমাগুলোর কথা দর্শকদের মুখে মুখে ফেরে। সিনেমাগুলোতে নীতিকথা ও উপকথার সমন্বয়ে শিক্ষামূলক উপদেশ বাণী থাকতো। দর্শকদের মাঝে আজও ফোক-ফ্যান্টাসি মুভির আবেদন রয়ে গেছে।
গিয়াস উদ্দিন সেলিম ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ অবলম্বনে ‘কাজল রেখা’ নামের একটি গীতিনাট্যধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’য় যুক্ত হওয়া একমাত্র রূপকথা ‘কাজল রেখা’ পালা। এই পালার রচয়িতার নাম সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ‘ঠাকুরমার ঝুলিতে’, ‘কাজল রেখা’পালার সংক্ষিপ্ত রূপ সংকলিত হয়েছে।
ময়মনসিংহ গীতিকা একটি সংকলনগ্রন্থ যেন তৎকালীন পূর্ব-ময়মনসিংহ (বর্তমান নেত্রকোনা) অঞ্চলে প্রচলিত দশটি পালাগান লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। প্রথম খণ্ডের দশটি পালার রচয়িতা ভিন্ন ভিন্ন হলেও সংগ্রাহক ছিলেন চন্দ্রকুমার দে। এই গানগুলো প্রাচীনকাল থেকে মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে আসছে। তবে ১৯২৩-৩২ সালে ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন এই গানগুলো অন্যদের সহায়তায় সংগ্রহ করেন। নিজ সম্পাদনায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রকাশ করেন। বিশ্বের ২৩টি ভাষায় ময়মনসিংহ গীতিকা মুদ্রিত হয়।
চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ গল্পের শুরুতে জুয়ায় হেরে সাধু নিঃস্ব হয়। সোনা-রূপা, হাতি-ঘোড়া, দাস-দাসি সব জুয়াতে চলে যায়। সন্ন্যাসীর দেওয়া ধর্মমতি সুখপাখির কথামতো আংটি বিক্রি করে ব্যবসা করে ভাগ্য ফিরে। সুখ সাধুর কাছে ধরা দিলেও কাজল রেখার বিয়ে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। সুখপাখির কথা মতো সাধু মেয়েকে বনবাস দেয়। বনবাসে গিয়ে কাজল রেখা জানতে পারে, এক মৃতপ্রায় সুঁচ কুমারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। সন্ন্যাসী মৃতপ্রায় কুমারকে জীবন্ত করার কিছু নিয়ম বলে দেন। সন্ন্যাসীর কথা অমান্য করে কাজল রেখা হাতের কঙ্কন দিয়ে একজন দাসী ক্রয় করে। কাজল রেখা কঙ্কন দাসিকে মৃত কুমারের ঘুম ভাঙানোর উপায় বলে দিয়ে বিপদে পড়ে।
কঙ্কন দাসী সুযোগ বুঝে ঘুমিয়ে থাকা কুমারের চোখের সুঁচ তুলে ফেলে পাতার রস দিলে কুমার সুস্থ হয়ে যায়। প্রতিদান হিসেবে অগ্নিকে সাক্ষী রেখে কুমার কঙ্কন দাসীকে বিয়ে করে। কাজল রেখার আগমন ঘটলে, কঙ্কন দাসী কুমারের সঙ্গে কাজল রেখাকে দাসী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয় কঙ্কন। সন্ন্যাসীর শর্ত মতে, নিজের পরিচয় দিলে কাজল রেখা তার স্বামীকে হারাবে।
স্বামীর বাড়িতে দাসী হিসেবে কাজল রেখার কষ্টের দিন শুরু হয়। শত কষ্ট হলেও কাজল রেখা তার পরিচয় দেয় না। কিন্তু, রাজকুমার ও মন্ত্রীর সন্দেহ হয়, কাজল রেখা কোনো সাধারণ দাসী নয়। কাঞ্চনপুরের জমিদারপুত্রকে দাওয়াত দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া শুরু হয়। কাজল রেখা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও অপবাদ দিয়ে, তাকে গৃহচ্যুত করা হয়।
বাণিজ্য শেষে ফেরার পথে নদী থেকে অসুস্থ কাজল রেখাকে উদ্ধার করে তার ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফেরে। কাজল রেখা যখন বনবাসে, যখন তার বাবা-মা গত হয়েছে। ভাই চিনতে না পেরে বোন কাজল রেখাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কাজল রেখা চুপ থাকে! এক সময় ধর্মমতি সুখপাখির ভূমিকায় কাজল রেখার ছোট ভাই ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত হয়। এদিকে রাজকুমার খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত কাজল রেখাকে পেয়ে যায়, পেয়ে যায় কাজল রেখার আসল পরিচয়। এভাবে মিলনাত্মক গীতিনাট্যের সমাপ্তি ঘটে।
মুভিতে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারজনিত ত্রুটি লক্ষণীয়। কোথাও নেত্রকোনার ভাষা, আবার কোথায়ও অন্যান্য অঞ্চলের ভাষার ব্যবহার করা হয়েছে। সংলাপ আরও শানিত ও কাব্যিক হতে পারতো। হাতি-ঘোড়ার বদলে, গরু ব্যবহার বেশি করা হয়েছে। অথচ, ওই সময় হাতি ও ঘোড়ার প্রচলন ছিল। মুভিটির বিভিন্ন দৃশ্য আরও গহীন জঙ্গলে শ্যুট করা যেতো। রাজার বাড়ি বাঁশের হয়? রাজার আচরণ ও বাস্তবতা বোঝানোর জন্য একটা রাজবাড়িতেই শ্যুটিং করা উচিত ছিল। পরিচালক কাহিনির সময়কে ধরতে পারেননি, যদিও চেষ্টার কার্পণ্যও করেননি।
প্রসঙ্গত, সত্তর দশকে সফদর আলী ভূঁইয়া পরিচালিত ‘কাজল রেখা’ নামের আরেকটা চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিল। যা ফোক-ফ্যান্টাসি নির্ভর, ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বন করে নির্মিত। এছাড়াও ‘কাজল রেখা’ লোকজ সংস্কৃতিতে একটা জনপ্রিয় যাত্রা পালার নাম। ‘কাজল রেখা’ যাত্রাপালার নাম গ্রাম বাংলায় সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে।
‘কাজল রেখা’ কাল্পনিক পালা নাট্যধর্মী চলচ্চিত্র। বাংলাদেশের খুব কম পরিচালক গীতিপালা নিয়ে প্রকৃত চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। গীতিপালা নিয়ে চলচ্চিত্র হলেও তা গীতিপালা থাকেনি। বেশি ক্ষেত্রে দেওয়া হয়েছে বাণিজ্যিক রূপ। গিয়াস উদ্দিন সেলিম তার ‘কাজল রেখা’তে গীতের ব্যবহার করেছেন যথার্থ; বাণিজ্যিক রূপ দেওয়ার চেষ্টার চেয়ে গানের মাধ্যমে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। যা মুভিকে অলঙ্কৃত করেছে। ‘কাজল রেখা’ মুভিতে গল্পের ধারাবাহিকতা রয়েছে; আলোক প্রক্ষেপণ, সেট ডিজাইন, শব্দ ও পোশাক পরিকল্পনা বেশ ভালো মানের। লোকজ সংস্কৃতির বিন্যাসে কলাকুশলীরাও সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। গিয়াউদ্দিন সেলিম দেশীয় গানের যন্ত্র ব্যবহার করেছেন। যা তিনি ‘মনপুরা’ চলচ্চিত্রে প্রয়োগ ঘটিয়ে অত্যন্ত সফল হন। মনপুরার গান দিয়ে মানুষের মন জয় করলেও ‘কাজল রেখা’র গান এখনো পর্যবেক্ষণে রয়েছে।
‘কাজল রেখা’তে গানের অতি ব্যবহার দর্শকদের বিরক্তির কারণ নয়, বরং ভালোলাগার কারণ। গানগুলো প্রাসঙ্গিক এবং গানের তালে তালে এগিয়ে যায় মুভির গল্প। গানের মাধ্যমে মুভির বিভিন্ন প্লটকে তুলে ধরা হয়েছে। গীতি ‘কাজল রেখা’র প্রাণ। গীতিপালা আমাদের সংস্কৃতিকে শানিত করেছে। পরিচালক ফ্যান্টাসি ব্যবহার করেছেন, যা গল্পকে আরও গ্রহণযোগ্য ও বেগবান করেছে। গল্পে ফ্যান্টাসি ব্যবহারে পরিচালক মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।
সফদর আলী ভূঁইয়া পরিচালিত ‘কাজল রেখা’ ফোক-ফ্যান্টাসি নির্ভর একটা বাণিজ্যিক মুভি। গিয়াস উদ্দিন সেলিম পরিচালিত ‘কাজল রেখা’ ময়মনসিংহ গীতিকার প্রকৃত রূপ ফ্যান্টাসির মাধ্যমে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। বর্তমান চলচ্চিত্রের দুঃসময়ে ‘কাজল রেখা’র চিত্রায়ণ সাহসী পদক্ষেপ বটে। এক্ষেত্রে পরিচালক কৃতিত্বের দাবিদার।
একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিমের কাছ থেকে দর্শকদের যে প্রত্যাশা ছিল, তা’ পূরণের জন্য চেষ্টায় ঘাটতি রাখা হয়নি। গল্প নির্বাচনে বাঙালিয়ানা ও দেশাত্মবোধের ছাপ লক্ষণীয়। এক সময়ে বাংলাদেশে ফোক-ফ্যান্টাসি মুভির জয়-জয়াকার ছিল। ‘কাজল রেখা’ সিনেমার মাধ্যমে ফোক-ফ্যান্টাসি মুভির সুদিন ফিরে আসুক। ফিরে আসুক চলচ্চিত্রের বসন্ত-যৌবন।
নন্দিত নির্মাণ ও চিত্রনাট্য ‘কাজল রেখা’ দর্শক টানুক সিনেমা হলে; নতুন বাংলা বছরে এই প্রত্যাশা।