আশির দশকে আমাদের সেই নবতারুণ্যে কবিতাযাত্রায় জিললুর রহমানের সঙ্গে পরিচয়। জিললুর রহমান আমার সহপাঠী। সে সময় ১৯৮৩/১৯৮৪ সালে আমরা উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র, চট্টগ্রাম শহরের আনাচে-কানাচে কবিতার অনুষ্ঠান করে বেড়াচ্ছি। সেই দলের বহু কবি আর কবিতার দমে থাকতে পারেননি। কিন্তু আমরা যারা রয়ে গেছি, জীবিকাজীবন জঙ্গমেও শিল্পসাহিত্য আমাদের ছেড়ে যায়নি, অথবা কোনো পরিস্থিতিতেই আমরা শিল্পসাহিত্য ছাড়িনি, এঁরা প্রত্যেকেই এখন স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। এর মধ্যে জীবনের বহু শ্বাস বেরিয়ে গেছে। জিললুর রহমান এখন অনন্য উচ্চতার কবি-লেখক। কবিতার পাশাপাশি তিনি প্রবন্ধ লিখছেন, অনুবাদ, চিকিৎসা শাস্ত্রে শিক্ষকতা ও গবেষণা করছেন।
চিকিৎসক হিসেবে তার গবেষণা কর্ম আন্তর্জাতিক সেরা সেরা জার্নালে প্রকাশিত হচ্ছে এবং একজন ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিতমহলে তার সুখ্যাতিও সুবিদিত ।শুরুর দিকে জিললুর রহমান কিছুদিন কবি এজাজ ইউসুফীর সহযোগী হয়ে ‘লিরিক’ সম্পাদনার সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন। বছর ৫/৬ আগে ‘যদিও উত্তরমেঘ’ নামে দারুণ একটি ঢাউস সাইজের ছোটপত্রিকা করে আমাদের অবাক করে দিয়েছেন! অবাক কেবল পত্রিকাটির আকারে নয়; প্রকারে, বিষয়বৈচিত্র্যে, লেখা ও লেখক নির্বাচনেও। লিটল ম্যাগাজিনটির ভূমিকাপ্রবন্ধ লিখলেন কবিসম্পাদক জিললুর রহমান। কবিতার আদ্যোপান্ত, নতুন কবিতা, বিশ্বকবিতা, কবিতা কার জন্যে, কেন, সময়, সমাজ রাজনীতি, কেন লিটলম্যাগ’; এসব জিজ্ঞাস্য নিয়ে। তিনি তাতে বলেন, ‘প্রকৃত কবিতার থাকে না কোনো বর্তমান ভবিষ্যৎ; সে যখনই পঠিত হবে,তখনই তা হয়ে উঠবে সে সময়ের। এভাবেই মহৎ কবিতা কালের আঁচড় এড়িয়ে মহাকালের পথে-ভূত-ভবিষ্যতে বিদ্যমান।’
জিললুর রহমান এক বোহেমিয়ান মানুষ। সময় সুযোগ পেলেই তার চিকিৎসক স্ত্রী-কন্যাসমেত বেরিয়ে পড়েন দিকবিদিক, গ্রাম-গঞ্জ-খানাখন্দ সব চষে বেড়িয়ে লিখে তবেই তার সুখ। এই যে একজন মানুষ,নিরবচ্ছিন্ন কর্মপ্রাণ,তার মুখের হাসিটি কোনোদিন কেউ ম্লান হতে দেখেনি। মানুষের যে-কোনো রোগে তাকে বিরক্ত করা যায়। একজন সৎ চিকিৎসক যে ব্রত নিয়ে চিকিৎসা করেন, জিললুর রহমানকে তার চেয়ে বেশি বৈ কম কেউ দেখেছে, এমন বলা অসম্ভব। কবিতাচর্চায়ও তিনি তেমনই একনিষ্ঠ। যারা জিললুর রহমানকে জানেন না,তারা লেখাটি পাঠ করে ভাববেন, দশটা পিঠ চুলকানিযুক্ত লেখার মতো এটিও একটি রচনা। কিন্তু যারা আমাকে চেনেন, এই এতদূর পৌঁছানো পর যে কারও পিঠ চুলকানোর দরকার আমার নেই, অথবা কখনো ছিল না, তা নিশ্চয়ই জানেন। এই ডামাডোলের রাজ্যে জিললুর রহমানের কোনো প্রচারণা নেই। লেখাটি যখন লিখছি, তখনই জানতে পেলাম বন্ধু জিললুর রহমান বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হয়েছেন।
ইতোপূর্বে তার ‘আত্মজার প্রতি’ ও ‘শতখণ্ড’ নামে ক্ষুদ্রায়তনিক দুটি দীর্ঘকবিতার বই বেরিয়েছে। আমার আলোচ্য গ্রন্থটি খণ্ড খণ্ড এক অখণ্ড দীর্ঘকবিতার বই । এছাড়া, জিললুর রহমানের অন্যান্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে: অন্যমন্ত্র (কবিতা, লিরিক, ১৯৯৫); শাদা অন্ধকার (কবিতা, লিরিক, ২০১০); উত্তর আধুনিকতা : এ সবুজ করুণ ডাঙায় (প্রবন্ধ, লিরিক, ২০০১); অমৃত কথা (প্রবন্ধ, লিরিক, ২০১০); আধুনিকোত্তরবাদের নন্দনতত্ত্ব : কয়েকটি অনুবাদ (অনুবাদ, লিরিক, ২০১০); ডায়োজিনিসের হারিকেন (কবিতা, ভিন্নচোখ)। নাজিম হিকমতের রুবাইয়াৎ (অনুবাদ,নাজিম হিকমতের রুবাইয়াৎ তিনিই প্রথম বাংলায় অনুবাদ করেন); হঠাৎ রাজেন্দ্রপুর (ফেব্রুয়ারি ২০২২); পপলার বন মরে পড়ে আছে (ফেব্রুয়ারি ২০২২); এক সে মেরাজের রাত্রে ঘুমিয়েছি (ডিসেম্বর ২০২২)। চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রকাশনা: 1.Pathology Tutorial (vol—1&2); 2. Original Research articles—67; 3. Scientific Editorial—3.
এবারে মূল কথায় আসি। একটু শানে নজুল দিলে ‘এক সে মেরাজের রাত্রে ঘুমিয়েছি’ কাব্যগ্রন্থ যে তার ওপর নাজেল হয়েছিল, সেটি পাঠান্তের অনুভূতি জানানো সহজ হয়।
কানাডায় আসার পর আমার বইহীন জীবন সবচেয়ে বেদনার হয়ে পড়েছে। জিললুর রহমান বাড়ি বয়ে গিয়ে তার বেশ কিছু বই উপহার দিয়েছিলেন। কিনেছিও বেশ ক’টি। কিন্তু ‘এক সে মেরাজের রাতে ঘুমিয়েছি’ আর পড়া হয়নি। মাত্র ক’দিন আগে পিডিএফ কপিটি পড়ে ভাবছি আমার কিছু বলার আছে। গুরু বোদলেয়ারকে স্মরণ করি, ‘একজন সমালোচক কবি হয়ে উঠলে আশ্চর্য হওয়ার কথা, কিন্তু একজন কবির মধ্যে যদি একজন সমালোচক জেগে না থাকে,সেটা আরও আশ্চর্যের।’
গ্রন্থটির কবিতাগুলো যখন লেখা হচ্ছে, তখন বিশ্বব্যাপী করোনার এক ভয়ঙ্কর অদৃশ্য অণুজীব চিকিৎসকসহ সব মানুষকে অসহায় বিপন্ন মৃত্যুআক্রান্ত করে ফেলেছে। এমন মাড়ি পৃথিবীর মানুষ আগে কখনো দেখেনি! সেই অসহায়ত্বের ভেতর একজন চিকিৎসকের সংকট আরও বেদনার। সেই ভয়াল মৃত্যুময় সময়ে ঘুমের মতো জাগরণে কবি স্বপ্ন দেখেন মেরাজের। তার মনোজাগতিক চিন্তায় জানা ছিল নবি মোহাম্মদের সপ্ত আসমান সফরের ঘটনা। তবে জিললুর রহমানের এই সফর কোনোভাবেই ধর্মীয় মেরাজের মতো ভাবার কারণ নেই। বিজ্ঞান বলে মানুষ তা-ই স্বপ্নে দেখে, যা তার অবচেতন মনে কাজ করে এবং মানুষ তখনই স্বপ্ন দেখে, যখন সে গভীর ঘুমে থাকে না। একথা কে না জানে, কবিরা সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি চাক্ষিক, সত্য ও জীবনের উপলব্ধক! জিললুর রহমানও তার ব্যতিক্রম নন। তিনি অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে, অনেক কালের কারিগরদের সঙ্গে দেখা করেন। সেইসব নাটকীয়তা নির্মাণের জন্যে যে শব্দ, বাক্যবুনন করেন, তা বিস্ময়কর! কবি এমন ম্যাটাফর তৈরি করেন, যা পাঠককে কাব্যের শেষ অব্দি টেনে নিয়ে যাবে। আসলে এমন রূপক তৈরি করতে না পারলে তো কবিকে মৃতই মনে করা হবে।
করোনার মরণ ছোবলের বীভৎসতা থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্যে কবি তখন ১২৬টি কবিতা নিয়ে একটি সিরিজ লিখলেন, যা ১৪ পর্বে বিভক্ত অপৃথুল,বাকসংযমে ভরা। প্রতিটি কবিতা ৭ পঙ্ক্তিতে,৭ মাত্রার পর্ব আতিশয্যহীন কিন্তু ওজস্বী শব্দে বিশ্বসাহিত্য, শিল্প, সভ্যতা, ইতিহাস, পুরাণ এবং ধর্মের দিক-পালদের সমবায়ে এক আশ্চর্য মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি নিয়ে এগিয়েছে। যাদের উল্লিখিত বিষয়ে যথেষ্ট পাঠ নেই, তারা এই গ্রন্থের সবটুকু রস আস্বাদন করতে পারবেন না। কবির দিব্যকান,দিব্যচোখ ও দিব্যরথের সাথী হতে হলে বিশ্বকে শাসন করা সেই মহারথীদের কর্মকাণ্ড, পুরাণকথা জানা আবশ্যক। অসহায় কবি মেরাজের রাতে সাত আসমান ঘুরে মূলত মানবমুক্তির একটি সত্যে পৌঁছতে চেয়েছেন। এই দর্শনটি আমাদের বুঝতে হবে।
করোনার বীভৎসতায় যখন মক্কার তোয়াফও বন্ধ হয়ে গেলো, ধর্ম-বিজ্ঞান-চিকিৎসা সব এক গভীর আঁধারের গড্ডলে ডুবে যাচ্ছিল,তখন কবি চিকিৎসক জিললুর রহমান মূলত নিজের হতাশাকে মুক্ত করতে কলম তুলে নেন। ‘মৃত্যু কী,মানুষের আত্মা কোথায় যায়, কার পাপে বা সাজায় কী হয়, এই চিরপ্রশ্ন কবিকে আকুল করে তুললেও কবিতাগুলো ভাবাবেগে ভেসে যায়নি। ফরাসি কবিতার মতো বাক সংযমে আকুলতা আছে, ভাবালুতা নেই। তবে এখানে কবির যুক্তি আছে,কিন্তু মুক্তির নিদানপত্র কি আছে? তিনি কেবল সেই স্বস্তিতেই ফেরেন, পৃথিবীর চেয়ে সুন্দর কিছু নেই, আর সৃষ্টির ভেতরই স্রষ্টাকে পাওয়া যায়। কিন্তু তবু কি মানুষের প্রশ্নের মীমাংসা ঘটে? গ্রন্থটিতে কূটাভাস,উপমা, রূপকে,কোথাও কোথাও জিললুর রহমানের স্বভাবসুলভ উইটনেসের ভেতর মাত্রাবৃত্তের চমৎকার ধ্বনিচালে ১২৬টি কবিতার ভেতর দিয়ে পাঠককে সাত আসমান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আনেন এই মাটির পৃথিবীতে।
গ্রন্থটির পর্বভাগগুলো হচ্ছে: আদি পর্ব, উড্ডয়ন পর্ব, প্রথম আসমানে, দ্বিতীয় আসমানে, তৃতীয় আসমানে, চতুর্থ আসমানে,পঞ্চম আসমানে, ষষ্ঠ আসমানে, সপ্তম আসমান, স্বর্গলোকে, লাওহে মাহফুজে, নরক গুলজার, প্রত্যাবর্তন পর্ব, প্রত্যাগমনের ভোর।
করোনার বন্দি জীবনে নিজের হাতকে, শ্বাসকেও যখন মানুষ বিশ্বাস করতে পারছে না, যখন স্বাধীন মানুষ বন্দিঘরে অসহায়, তখন কবির সত্তা মহাকাল ও মহাকাশ পরিভ্রমণে বেরিয়েছে।
অবক্ষয়গ্রস্ত এই জগতের মানুষ, সভ্যতা, ধর্মাচারের ফাঁক ও ফাঁকিতে,চিরপ্রশ্ন ও দ্বিধাউত্তরের এক মানসিক অস্থিরতা তাকে আকুল করে তুলেছে। একজন সৃষ্টিশীল কবির এই আত্মজিজ্ঞাসা থাকবেই, থাকবে নিজকে এবং পাঠককে নবায়নের চেষ্টা। ফলে ‘ডিভাইন কমেডি’র সেই সিংহসদন থেকে যেমন দান্তে অনুসরণ করেছিলেন ভার্জিলকে,আমরাও জিললুর রহমানকে, হাঁটি তার পেছনে! কবি জিললুর রহমানের ‘এক সে মেরাজের রাতে ঘুমিয়েছি’ পড়া শেষ করে মনে হলো, এ কেমন দীর্ঘকাব্যযাত্রা! কেমন এপিফ্যানি? কেমন ফ্যান্টাসি? কালিদাসের যাত্রাপথের নগর, রাজ্য,নদী, নিসর্গের বর্ণনাও নয়,নয় ডিভাইন কমেডির মহাকাব্যিক পথচলা! ধর্মীয় মেরাজের মতোও নয়, যদিও সপ্ত আসমান পরিভ্রমণে কবি পেয়ে যান নবীদেরও কাউকে কাউকে এবং বেশ কিছু অনুষঙ্গে সেই ধর্মীয় মেরাজের ছায়াপাতও আমরা দেখতে পাই।
মেরাজের রাতে চরম হতাশায় ঘুমিয়ে পড়েন কবি। হঠাৎ দেবদূত তাকে মেরাজে যেতে বলেন। কবি তার বউকে জানিয়ে যেতে চান। কিন্তু দেবদূতের হাতে সময় নেই। নিছক এক করোনায় এত এত মৃত্যু দেখে হতাশায় তিনি বোররাকে চড়ে বসলেন।
সাত আসমান ভ্রমণ শেষে ভোরে ফিরে আসবেন কি না; সেই শঙ্কা নিয়েই তার যাত্রা শুরু।
কত কী ঘটে যায় মারীর খপ্পরে
তোয়াফ থেমে গেলো বন্ধ কাবা ঘরে
কোভিড যত বাড়ে মানষু যত মরে
জীবন দামে বাড়ে তীর্থ থামে ধীরে
তবু তো চলে যায় ঘণ্টা বেজে গেলে
কত যে আঁধারের ধাঁধার শোরগোলে
কেন যে চলে যায় কেন যে লোকে মরে।
কবি শুনেছেন, মানুষ মরে গেলেও আত্মা মরে না। সে কি তবে আকাশের তারা হয়? আকাশে তো অনেক তারা; তবু প্রিয়কে কেন চলে যেতে হলো? সূর্যের কি আরও আলো প্রয়োজন তবে?
তুমি কি সে আকাশ আলোয় ভরে দেবে
তুমি কি সূর্যকে আগুন ধার দেবে
কোটি তো আছে কেন নিয়েছে তোমাকেই
আত্মা কোথায় যায়, আত্মার স্বরূপ কী; বিজ্ঞান ও ধর্ম এই চিররহস্যের সমাধান কী দিতে পেরেছে? সে অনিঃশেষ প্রশ্ন চিকিৎসক কবিকেও প্রশ্নাকুল করে তোলে!
পড়েছি এনাটমি পড়েছি আলকেমি
আত্মা খুঁজে সারা করিনি আলসেমি
মরেছে নানিজান ছিলাম হাত ধরে
মরেছে কত লোক পাশেই ঘুরে ঘুরে
কোথাও দেখিনি তো আলোর ছিঁটে ফোটা
হঠাৎ ফুস করে আকাশে ভেসে ওঠা
ঠিকুজি আত্মার মেলে নি কোনো দিনই
পথে পথে কবির স্বভাবসুলভ কৌতুক হাস্যরস পাঠকের পাঠে গতি এনে দেয়।
চাঁদের বুড়িমাকে বলেছি সুতো কেটে
আমাকে দুটো জামা বানিয়ে এনে দিতে
কেবল ভয় ছিল কখন ব্ল্যাকহোলে
বাবাজী বোররাক আমাকে নিয়ে ফেলে
এ মহাশূন্যেতে কতো যে বিগ্রহ
উড্ডয়ন পর্বের এই যাত্রাপথটি বড় মনোরম।কিছু দূর যেতেই কবি দেখতে পান একজন পাহাড়ের চুড়োয় বিশাল পাথর তুলতে গিয়ে দরদর করে ঘামছে,তার পেশী ফুলে উঠছে, চুড়ো ছোঁয়ার আগেই পাথর আবার নিচে গড়িয়ে পড়ছে।
একটু বাকি আছে তবেই চূড়াটায়
পাথর তোলা হলে থামতে পারা যায়;
অমনি নিপতিত, হায় রে সিসিফাস!
প্রথম আসমানেই তিনি লালন ফকির, সিরাজ সাঁই, কাঙ্গাল হরিনাথ, হাছন রাজাদের দেখা পান। কবি লালনকে আবার ছেঁউড়িয়া যাবেন কি না জিগ্যেস করতেই তিনি কেঁদে ওঠেন, কবির সঙ্গে তার কথোপকথন:
তিন সে পাগলের তত্ত্ব বলো গুরু
সৃষ্টি তত্ত্বের যেখানে হলো শুরু
লালন হেসে কহে , ‘মনুষ্য ভজে যা’।
স্বপ্নের কী মহিমা! কবিরা তাদের মনোশ্চক্ষুতে কত কী-ই না দেখে ফেলতে পারেন! এইসব পঙ্ক্তিতে মহারথীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও ভঙ্গিবচন কৌতুক রসের ও কৌতুহলের অবতারণা করে। পৃথিবীতে এখনো সুরের দিন গানের দিন শেষ হয়নি, এরও পরে আমরা দেখি লুত নবীকে তার কওমের লোকেরা ঘিরে আছে। তারা বলছে লুতনবী বলে দিলেই তো তাদের সাজা মাফ হয়ে যায়। তারাও স্বর্গে যেতে পারে! লুত কবিকে বলেন, এখনো তো পৃথিবীতে সমকাম শেষ হয়নি। তবু তার কওমের কেন এত সাজা?
দ্বিতীয় আসমানে কবি অনেক নবী পয়গম্বরের দেখা পান। তাঁরা তো প্রত্যেকে পৃথিবীর নানা অনাচার, অন্যায় পাপ দমন করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তবু আজ পৃথিবীতে এত পাপ, অন্যায়, অসত্য, অধর্ম কেন? কবির খুব ইচ্ছে জাগে মুসা নবীর অলৌকিক ক্ষমতার লাঠিটি পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনে সব পাপাচার, মহামারী দূর করেন। কিন্তু তাও তো সম্ভব নয়!
আসাটা হাতে আছে আশাটা কোন্খানে?
এভাবে একেকটি আসমান পেরিয়ে যাই আমরা, দেখা হয় গৌতম বুদ্ধ, বাল্মীকি, শরৎচন্দ্র, রাইকমল, রাবণ, সীতা, রাম, বিভীষণ, রবীন্দ্রনাথ আরও অনেকের সঙ্গেই। ‘কবিই থেকে যায় কবিরা মরে না (…) কবিই জানে শুধু কবিরা জাদুকর।’
কবির মনে হয় এটা যেন আত্মার এক ডাম্পিং স্টেশন। কবি-সাহিত্যিকদের সুখদুঃখ গাঁথা এই তৃতীয় আসমানে। আবার চতুর্থ-পঞ্চম আসমানেও অনেক বিজ্ঞানী ধর্মপ্রচারক, নাট্যজন, কবি-দার্শনিকের দেখা মেলে। আধুনিক মানুষ চিরদ্বান্দ্বিক, সংশয় আকুল। সেই দ্বন্দ্বের ধন্ধে পড়া মানুষের জিজ্ঞাসাই এখানে কবি উচ্চারণ করেন।
ঘুরিয়ে সূর্যকে বাধালে ঝামেলাটা।
ধকল গেলো কত ব্রুনো গ্যালিলিওর,
এখনও পৃথিবীতে মিথ্যা তোলে শোর!
কবি এখানে বিশ্বখ্যাত সোফিয়া লোরেন,মহাকবি রুমীর মতো অনেকের দেখা পান। নাট্যজন সেলিম আল দিন, বাদল সরকারের সঙ্গে আবার জীবিত মামুনুর রশীদ, রামেন্দু মজুমদারের সাক্ষাতে এক দারুণ ফ্যান্টাসি সৃষ্টি হয়। ষষ্ট আসমানেও কত যে শিল্পী, নাচের ঘুঙুর, বাদ্যবাজনা মুখরিত!
ষষ্ঠ ছাদ তলে ভরতনাট্যম
ঘুঙরু নাড়ে মন তবলা গমগম
কোথাও জয়পুরি লখনু কত্থক
বাইজি পাড়া কেউ কাশছে খকখক
রুদ্র রোষে শিব প্রলয় নাচ দিলে
গঙ্গা নেমে পড়ে জটার বাঁধ খুলে
বিষ্ণু ভুলে থাকে মোহিনীঅট্টম।
এভাবে সপ্তম আসমানও পুরাণের দেবতা, প্রাচ্যপাশ্চাত্যের যশস্বী শিল্পীরা সংগীত মূর্ছনায় মাতিয়ে রাখেন। বিটোভেন থেকে মোৎজার্ট, আব্বাসউদ্দিন থেকে কালিকা প্রসাদ কিছুই বাদ পড়ে না সেখানে। তারপর কবির স্বর্গযাত্রা। স্বর্গ কবির ভালো লাগেনি। পৃথিবীর মতো কোনো সৌন্দর্য নেই, সংশয় নেই। নেই চাঁদ বা সূর্য এমনকি মাটিও মাদকতাও! পড়তে পড়তে কবি শাহিদ আনোয়ারের একটি কবিতার পঙ্ক্তি মনে পড়ে গেলো:
পৃথিবী নামের নীল গ্রহটায় স্বর্গের চেয়ে
কয়েকটি স্বাদ বেশি।
এখানে মায়ামমতায় শেকড়, কাণ্ড, ডালপালা
লতা, বৃক্ষরাজি, বন উপবন, বনস্থালীর আঁকশি জন্মায়।
আমার শিশুপুত্র এখন বড় হচ্ছে পৃথিবীতে
স্বর্গে কোনো শিশু জন্মায় না।
…
স্বর্গে শৈশবে ফেরার কোনো সিস্টেম নেই
আমার শিশুর হাত ধরে আমি আবার
যৌবনে ফিরে আসব
স্বর্গে সেরকম কোনো ব্যবস্থা নেই।
আমার কবর ফুলে ফুলে ঢেকে দেবে
আমার পুত্র আমার স্ত্রী
স্বর্গে সেরকম কোনো ব্যব্যস্থা নেই।
(স্বর্গকাতর নই আমি: দাঁড়াও আমার ক্ষতি, শাহিদ আনোয়ার)
কবি জিললুর রহমান যে স্বর্গ দেখতে পান, তার প্রতি কবির তেমন কোনো আগ্রহ জন্মায় না। স্বর্গে ইভ, কুমারি মাতা মেরী, একিলিস,আর্কিমিডিস, নিউটন, যুধিষ্ঠির, চাঁদ সওদাগর, ফেরদৌসীর মতো বহুজনের সাক্ষাৎ পান কবি। সেখানে অসংখ্য ঘর পড়ে আছে,অথচ এই পৃথিবীতে কত কত মানুষ বাস্তুহারা! যারা এ লোকে সান শওকতে দিন কাটায়, যারা মোল্লা-পুরুত; তারা স্বর্গেও ঘর পায়, এই লোকে যারা বাস্তুহারা, ওই লোকে তাদের ঘর কোথায়?
গড়েছ মাহফুজ সপ্ত আসমানে
তোমার এত ঘর তবুও পথে ঘাটে
সে ঘরে ঠাঁই নেই বাস্তুহীনেদের
ঘরের পাহাড়ায় মোল্লা পুরুতের
আস্ফালনে সব হারায় সম্বল
ভিক্ষা করে যত এতিম শিশুদল
তোমার দুনিয়ায় কতটা ঘর লাগে?
নরকগুলজারে এসে পড়েন কবি, কেননা মেরাজ যেহেতু ঘটেই গেছে, নরক না দেখে গেলে তো সাধ অপূর্ণ থেকে যাবে!
মেরাজ প্রতিদিন হয় কি কারো ভাবো
ভাবছি নরকও একটু দেখে যাবো
এই নরকপাঠ বা দর্শন কবির ভয়াল মনে হলো না। সেখানে ক্লিওপেট্রা, রাজাকার, মোনালিসা, কামাখ্যা দেবী, জুলেখার মতো বহুজনের সঙ্গে কবির দেখা হয়। নরককে তার মনে হয় আগুনের ঋতু।
এই স্বর্গ নরক চিত্র কবিকে খুব আগ্রহী করে তোলে না। বরং জানলেন ‘স্রষ্টা সৃষ্টিরই ভেতরে থাকে গুঁজে’। পৃথিবীর মায়া, আলোছায়া, ভালোবাসা,যন্ত্রণা যেখানে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই চলে-তা ই কবিকে আগ্রহী করে তোলে এবং কবি ফিরে আসেন। তার আগে তিনি দেখেন, মানবিক বিপ্লবী, মানুষের শ্রমের ঘামের অধিকারের নেতা চেগেভারা,কার্ল মার্ক্স,কারখানার শ্রমিক পাভেল, ফিদেল, লেনিন, মায়াকোভস্কিদের স্বর্গ অথবা নরক কোথায় যে নেয়া যায়; এই সিদ্ধান্ত না হওয়ায় এখনো তারা কবরে শুয়ে আছেন।
আত্মার জন্মমৃত্যু আসা যাওয়ার এক অমীমাংসিত উত্তরে কবি পৃথিবীতে ফিরে আসেন। এই পৃথিবীই সবচেয়ে সুন্দর মনে হয় তার।
যখন ভাঙে ঘুম যখন টের পাই
সত্যি না কি সব স্বপ্নে তড়পাই
বধূটি শুয়ে ছিল শিশুরা ঘুমে কাদা
আস্তে বলি ডেকে মেরাজ কথকতা
বধূয়া শুনে বলে ঘটনা ছিল ঠিকই
নামটা তাই তার হয়েছে সিদ্দিকী
ক্লান্তি বোধ হয়, আবার শুয়ে যাই।
কবি পত্নীর নাম ‘সিদ্দিকী’ যার অর্থ নীতিবাদী। খুব চমৎকার কৌতুকের সঙ্গে এখানে নামটির সংযোজন ঘটিয়েছেন কবি। তারপর:
যখন ঘুমঘোর ভাঙলে দেখি ভোর
পৃথিবী স্বর্গের চেয়েও সুন্দর
যখন হিমালয় সূর্য রঙে লাল
আস্ত কমলাটা উঠলো মেরে ফাল
(…)
মায়ার পৃথিবীতে থাকুক মায়া ঘোর
তখন এই পৃথিবী ছাড়া আর কী হতে পারে এত আনন্দের!
তবে গ্রন্থটি পাঠ করতে গিয়ে মনে হয়েছে জিললুর রহমান কি চিন্ময় গুহের ‘ঘুমের দরজা ঠেলে’ পড়েছিলেন! যে বইটি ২০১৯ সালে ভারতে একাদেমি পুরস্কার পেয়েছে? যেখানেও রয়েছে অচেতনের ভেতর চেতন,গভীর উদ্বেগ, স্বপ্ন,আশা-নিরাশা? যেখানে চিন্ময় আমাদের একটা ভীষণ ঘোরের ভেতর, অপূর্ব কাব্যিক ভাষাব্যঞ্জনায় আলো অন্ধকারের পর্দা সরিয়ে পাঠককে নিয়ে আসেন এমন শ্রদ্ধামুগ্ধ প্রায় ষাটের অধিক ব্যক্তিত্বের সামনে যারা কথা বলেন, না দূর না কাছ থেকে বোঝা মুশকিল। তাঁরা সত্য কী মিথ্যে, ঘোরগ্রস্ত পাঠক সেই বোধের সীমার ধোঁয়াশায় আটকে থাকেন! সেখানেও বিশ্বসাহিত্য শিল্প রাজনীতির রথীমহারথী যেমন সিলভিয়া প্লাথ,পল এলুয়ার, শেক্সপিয়র, মার্লো,পাসকাল, নিৎশে, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব, এলিয়ট, শেলী এরকম মানুষেরা কথা বলেন। জিললুর রহমান গ্রন্থেও এঁদের কেউ কেউ আছেন, তাঁরাও কথা বলেন।
তবে দুটো বই সম্পূর্ণ আলাদা। চিন্ময় গুহের গ্রন্থ গদ্যে লেখা। চিন্ময় গুহ সেখানে বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিবর্গের লেখা কবিতাংশ, চিঠি, সংলাপ, ছড়া, সাক্ষাৎকার, তাদের নাটক ও মনের ভেতরকার নানা কথা এসব তুলে এনেছেন। যেমন, ‘এক তুষারমথিত নিস্তব্ধতার ভেতর এক অসহায় নিষ্প্রদীপ আলপথ দিয়ে প্রদীপ হাতে ধীর পদক্ষেপে হেঁটে চলেছেন ওঁরা কারা?’ ‘ভালো করে দেখলে ওদের কাউকে কাউকে চেনা যাচ্ছে! ওই তো বেদব্যাস,বাল্মীকি, হোমার, সক্রেতেস, প্লাতো, জীবনানন্দ।’
জিললুর রহমানের এই গ্রন্থেও চিন্ময়ের মতো ব্যক্তিবর্গের চিন্তাভাবনা ও লঘু হাস্যরস, অসামান্য কৌতুকের সঙ্গে একটি দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক ভাবনায় কিন্তু নির্বিকারভাবে উপস্থাপন করতে দেখি। ‘এক সে মেরাজের রাতে ঘুমিয়েছি’ কাব্যগ্রন্থটির শব্দবন্ধ, লিরিক্যাল ফ্যান্টাসিতে সাত মাত্রার দোলাচলে যে বিশালতাকে ধারণ করেছে, আধুনিক বাংলা কাব্যে তা একেবারেই নতুন, কাব্যে আর কেউ লিখেছেন কি না, অন্তত আমার জানা নেই।
স্পষ্টতই গ্রন্থশিরোনামে কবি ঘুমিয়ে পড়ার কথা বলেছেন। দীর্ঘ এই কবিতা অনেকটা নাটকীয়,সংলাপ ও দৃশ্যকাব্যের গুণে নির্মিত হলেও সমিল ছন্দে ও অন্তে; ছোট ছোট পরিমিতি, বাক্-সংযম দেখে মনে হয়, মহাকাব্যের যুগের দাবি ফুরিয়েছে,কবি জানেন; বর্তমানের স্বরেই তাই অতীতের সুর বাঁধতে হবে। পাশাপাশি, আমাদের বোধকাল থেকে যে মেরাজের কাহিনি মগজে ও মননে গেঁথে আছে, তা থেকে অতি সাবধানে সরে এসে একটি ফ্যান্টাসির ভেতর দিয়ে কবি আমাদের ঘুরিয়ে আনেন কাল- মহাকাল, বিশ্ব-শাসনের শিল্প সাহিত্য, ধর্ম বিজ্ঞানের ব্যক্তি-মহাব্যক্তির সম্মিলনে, ধর্মীয় পুরাণকথার মিশেলে, ঘুম অথবা জাগরণে এবং উপলব্ধি করেন; সৃষ্টিতেই স্রষ্টা বিরাজে, আর বিশ্বের চেয়ে সুন্দর কিছু নেই,আর আত্মা এক চিররহস্যের নাম!
ইংরেজ রোমান্টিক কবি কোলরিজ সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করেছেন। কোলরিজর আগে ‘ফেন্সি’ আর ‘ইমাজিনেশন’র মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না । কোলরিজ এই দুটোর ভিন্নতা প্রথম আমাদের দেখালেন। তিনি বলেন– ‘ফেন্সি’ হচ্ছে সব জিনিসপত্রকে একত্রিত করা আর ইমাজিনেশন সংগৃহীত জিনিসগুলোকে একটি নতুন রূপ দান করে। ফেন্সির কাজ সংগ্রহ পর্যন্ত, নতুন সৃষ্টির কাজ কেবলই ইমাজিনেশনের। সমালোচনা সাহিত্যে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাত আসমান, সাত পঙক্তি, সাত মাত্রা, সাত দিয়ে বিভাজ্য ১৪ পর্ব এবং ১২৬টি কবিতাও সাত দিয়ে বিভাজ্য, এই নির্মাণশৈলী বিষয়ের আলোকে এক বিরল কাঠামো!কবিতায় নতুন চিন্তাবর্গের দুয়ারও খুলে দেবে এই গ্রন্থপাঠের অভিজ্ঞতা, আমি বিশ্বাস করি। জিললুর এই গ্রন্থে চিন্তারাজ্যে, আঙ্গিকে, ছন্দে যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন, বিশ্বের সভ্যতা তৈরির কারিগরদের ছোট্ট অথচ গভীর যেসব বিষয়ে ছিপ ফেলেছেন, কেবল প্রচুর পড়াশোনা করা, গভীর বোধসম্পন্ন পাঠকের পক্ষেই সেই ছিপ তুলে এনে মহামহিম প্রাপ্তিযোগ সম্ভব, অন্যথায় নয়।
তবে এই যে ‘এক সে মেরাজের রাত্রে ঘুমিয়েছি’ কাব্যগ্রন্থখানার নৈশপরিভ্রমণ, কবি এখানে অনেক কথা বললেও বহু উপলব্ধ সত্য অনুক্ত রেখেছেন, কেবল উসকানিটুকু রয়েছে। প্রকৃতপাঠক তা তার মতো করে বুঝে নেবেন। কেননা, সত্যের স্বরূপ, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব জনে জনে আলাদা। তবে কবি যে ধ্যান-জ্ঞানে বেড়ে ওঠেন, তার নিক্তিতেই তিনি জীবন জগতের বয়ান করেন। এই দীর্ঘ কবিতার যাত্রাপথে কবির অসামান্য কৌতুক, কৌতূহল, অমীমাংসিত প্রশ্ন মিলে বুদ্ধিদীপ্ত দার্শনিক মনস্তাত্ত্বিক বাক্যবুনন পাঠকের দম ধরে রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।