রাকিবুল আলমের ‘ট্রেসেস অব টাইম’ নামের বইটি একটি বাস্তবভিত্তিক তথ্যবহুল নন-ফিকশন প্রবন্ধের সংকলন, যা সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে লেখা একগুচ্ছ নিবন্ধের সমাহার, যেখানে আজকের দুনিয়ার যাপন জীবনের নানা চ্যালেঞ্জের কথা বিস্তারিত ভাবে বলা হয়েছে। লেখক নিজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর পদে আছেন। এটা তার লেখা প্রথম বই, যেটি এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলায় অ্যানভিল পাবলিকেশনস থেকে বের হয়েছে।
‘ট্রেসেস অব টাইম’ বইটি শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি আর জীবনের গভীর প্রশ্নগুলো নিয়ে গভীর আলোচনা করে। এই বইয়ে, লেখক আমাদের চারপাশের জগতের সঙ্গে আমাদের মনের ভেতরের দ্বন্দ্বগুলোকে বুঝার জন্য বিভিন্ন গল্প, উদাহরণ আর তুলনা দেখান। ‘ট্রেসেস অব টাইম’ বইটি পড়ে পাঠকরা নিজেদের জীবন আর পৃথিবীকে এক নতুন চোখে দেখতে শিখে যা সমাজ ও মানবতার বড় বড় প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে উৎসাহিত করে।
প্রত্যেক দেশের ভবিষ্যত উন্নতির জন্য শিক্ষার গুরুত্ব খুবই বেশি কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষা পদ্ধতি আশা করা মতো উন্নত হতে পারেনি। লেখক নিজের লেখায় ছাত্রছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্য, শিক্ষকদের দায়িত্ব এবং শিক্ষা নীতি নিয়ে গভীর আলোচনা করেছেন, যা পাঠকদের ভাবনায় গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। এই বই ভালো মানের শিক্ষা পাওয়ার পথে একটি উৎসাহ এবং ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য একটি প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
লেখক মানুষের মিডিয়া সচেতনতার ওপর জোর দিয়েছেন, যাতে মানুষ মিডিয়ার প্রতিবেদনগুলোকে অন্ধভাবে গ্রহণ না করে বরং সমালোচনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করে।
এছাড়া, কিছু প্রবন্ধে উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং ক্রমবর্ধমান প্রাযুক্তিক আগ্রাসনের মত সময়োপযোগী বিষয়গুলো। এই লেখাগুলো আমাদের আন্ত-সংযুক্ত বিশ্বের কথাই আরও একবার মনে করিয়ে দেয় এবং এর আসন্ন চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলা করার জন্য আমাদের যৌথ দায়িত্বের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। ‘Traces Of Time’ বইটির মাধ্যমে লেখক পাঠকদের প্রতি একটি উন্মুক্ত আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, যা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে উদ্দীপনাপূর্ণ এবং যা আমাদের সময়ের টানাপড়েনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত ধারণাগুলির সাথে আন্তঃসংযোগ তৈরি করার ব্যাপারে দারুণভাবে উৎসাহিত করে।
লেখক বিচক্ষণতার সঙ্গে ‘ট্রেসেস অব টাইম’ বইটিকে বেশ কিছু অংশে ভাগ করেছেন, যেখানে প্রতিটি অংশে একই ধরনের নিবন্ধগুলো রাখা হয়েছে। প্রথম অংশ ‘Educational, Cultural, and Global Perspectives’ নামে, যা শিক্ষা ও সমাজের গভীর অর্থ বুঝতে সাহায্য করে এবং শিক্ষা পদ্ধতিতে উন্নতির জন্য নতুন পথ দেখায়। এই অংশের একটি নিবন্ধ ‘বাংলাদেশে ছাত্র আত্মহত্যার দুঃখজনক প্রবণতা’ শীর্ষক, যেটা ছাত্র আত্মহত্যার বিষয়ে গভীর এবং সংবেদনশীলভাবে আলোচনা করে। এই নিবন্ধে লেখক একাডেমিক চাপ, মানসিক উদ্বেগ, সামাজিক প্রত্যাশা, ও সহপাঠীদের চাপের মতো আত্মহত্যার জটিল কারণগুলো তুলে ধরেছেন। এছাড়াও, লেখক শুধু অ্যাকাডেমিক সাফল্যের চেয়ে ছাত্রদের মানসিক স্বাস্থ্য ও মানবিক বিকাশকে গুরুত্ব দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন।
বইটিতে ‘Tackling Teacher Shortage Crisis in Secondary Education’ শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ আছে, যেখানে লেখক উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় যোগ্য শিক্ষকদের অভাবের পেছনের কারণগুলো যেমন খুবই কম বেতন এবং হতাশাজনক কাজের পরিবেশ উল্লেখ করেছেন। এই সমস্যাগুলি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মূলেই গভীর সমস্যা সৃষ্টি করছে। প্রবন্ধটি শিক্ষকতা পেশাকে অবমূল্যায়নের বিষয়ে আলোচনা করে এবং দক্ষ শিক্ষকদের আকর্ষণ করে রাখার জন্য সিস্টেমে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব দেয়। এটি বলে যে, সমস্যার মূলে না গিয়ে শুধু ওপরের দিকে মনোনিবেশ করলে তা কোনো লাভ নেই, তাই ছাত্রদের শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই যত্ন নিতে হবে। প্রবন্ধটি শিক্ষকদের যুব মনগুলো গড়ে তোলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং তাদের জীবন-গড়ার অবদানের প্রতি স্বীকৃতি এবং সমর্থন দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের দাবি জানায়।
‘‘Languages and their Translation: Manufacturing Our ‘Narrative Identity’,’’ নামের প্রবন্ধটি আলোচনা করে কিভাবে ভাষা আমাদের ধারণা ও পরিচিতি গড়ে তোলে, ব্যক্তিগত এবং সমগ্র উভয় পর্যায়ে। এটি ব্যাখ্যা করে যে ভাষা কিভাবে আমাদের বাস্তবতাকে আকার দেয় এবং সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনে অনুবাদের ভূমিকাকে উদঘাটন করে। পাশাপাশি, প্রবন্ধটি ভাষার দুইমুখী ব্যবহার নিয়ে কথা বলে—একদিকে এটি ক্ষমতা অর্জনের একটি মাধ্যম হিসাবে কাজ করে, অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণের একটি উপায় হিসেবে। প্রবন্ধটি দেখায় যে ভাষার ক্ষমতা এমনই প্রবল যে, একই বিষয়কে ভিন্ন শব্দে প্রকাশ করার মাধ্যমে সম্পূর্ণ অর্থবোধক বিষয়টির চেহারা বদলে দেয়।
‘Traces Of Time’ বইয়ের একই অংশে লেখক জলবায়ু পরিবর্তন এবং সীমান্ত সংঘাতের মতো বৈশ্বিক ইস্যুগুলি নিয়েও আলোচনা করেছেন। ‘Making Room for Rivers: Rising Waters, Rising Concerns’ নামে একটি প্রবন্ধে জলবায়ু পরিবর্তনের পরিবেশগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে গভীর আলোচনা করেছেন। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মোকাবিলা করতে বিশ্বজুড়ে সমন্বিত প্রচেষ্টা, সহযোগিতা এবং নতুন সমাধান খুঁজে বের করার গুরুত্ব তুলে ধরে। অন্য একটি প্রবন্ধ, ‘BRICS: Building Bridges or Barriers?’ বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক শক্তির গতিপ্রকৃতি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে। এই প্রবন্ধটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিলতা বুঝতে সাহায্য করে এবং আমাদের এই বহুমাত্রিক বিশ্বে শান্তি এবং স্থায়িত্বের ওপর জোর দেয়।
‘The Future of Human Nature’ প্রবন্ধটি পাঠকদের এক ভবিষ্যৎ বিশ্বের কল্পনা করার আমন্ত্রণ জানায়, যেখানে প্রযুক্তির উন্নতির পাশাপাশি উচ্চ নৈতিক মানদণ্ড এবং সামাজিক ন্যায়বিচার বজায় রাখার লক্ষ্যে মানুষ অধিক চেষ্টা করবে। ‘World Refugee Day: Human Dignities in Zones of Exception’ নামের অন্য একটি প্রবন্ধে, লেখক বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে শরণার্থী সমস্যার কারণগুলি বিশ্লেষণ করেন। এই প্রবন্ধে গৃহহীনদের দুরবস্থার ওপর আলোকপাত করা হয় এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের নৈতিক দায়বদ্ধতা নিয়ে যে ভূ-রাজনৈতিক কারণগুলো প্রভাব ফেলে তা উন্মোচন করে।
‘Media, propaganda and mass persuasion’ নামে প্রবন্ধে লেখক মিডিয়ার ক্ষমতা এবং প্রচারের কৌশলের ওপর আলোকপাত করেছেন। এই যুগে মিডিয়া ও সাংবাদিকতার নৈতিক দায়বদ্ধতা কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। লেখক মানুষের মিডিয়া সচেতনতার ওপর জোর দিয়েছেন, যাতে মানুষ মিডিয়ার প্রতিবেদনগুলোকে অন্ধভাবে গ্রহণ না করে বরং সমালোচনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করে।
রাকিবুল আলমের ‘Traces Of Time’ শুধু একগুচ্ছ প্রবন্ধের সংগ্রহ নয়, বরং একটি মননশীল ও আলোকপাতের মাধ্যম যা আমাদের আজকের জগতের বিভিন্ন দিক এবং মানব সম্পর্কের গভীর বিষয়গুলোকে বোঝার নতুন দৃষ্টিকোণ প্রদান করে।
বইটির শেষ অংশ ‘Societal and Political Reflections’’ আমাদের বর্তমান জটিল সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতাকে গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করে। এখানের প্রতিটি লেখা সামাজিক গঠন এবং এর জটিলতার ওপর গভীর সমালোচনা প্রদান করে, প্রচলিত ধারণা ও রীতিনীতিগুলোকে প্রশ্ন করে এবং চিন্তাশীল আলোচনাকে উদ্দীপিত করে। ‘The Pathways to Violence: Reflections on Our Identity Formation’ প্রবন্ধটি রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও এর ধারণাকে বিশ্লেষণ করে এবং ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের তত্ত্ব অনুসারে আইন ও শাসন কাঠামোর মধ্যে অন্তর্নিহিত সহিংসতাকে পরীক্ষা করে। লেখক বলেন যে, সহিংসতা এই কাঠামোগুলোর একটি মৌলিক অংশ এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের একটি অনিবার্য দিক। এই আলোচনায়, তিনি স্লাভোজ জিজেকের চিন্তাধারা অনুসরণ করে সহিংসতাকে ব্যক্তিগত, বস্তুগত এবং পদ্ধতিগতভাবে বিভক্ত করে আলোচনা করেছেন, এবং সামাজিক কাঠামোগুলিতে লুকানো সহিংসতার ব্যাপারে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন।
‘Confronting COVID-19: The Need for a Deep Change’ প্রবন্ধটি COVID-19 মহামারীটিকে শুধু একটি বৈশ্বিক সংকট হিসেবে না দেখে, এর মাধ্যমে উন্মোচিত হওয়া সামাজিক বৈষম্য এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করে। লেখক বলেন, এই মহামারী আমাদের সামাজিক অসমতা এবং প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের অস্বাস্থ্যকর সম্পর্কের বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট করেছে। তিনি একটি ‘নতুন নবজাগরণের’ আহ্বান জানিয়েছেন, যেখানে আমাদের সমাজ আরও আন্তঃসংযুক্ত, সহানুভূতিশীল এবং খাঁটি জীবনযাপনের দিকে অগ্রসর হতে পারে। এই পরিবর্তন আমাদের বৈষম্যের জগতকে অতিক্রম করে এক সুষ্ঠু ও সহযোগী সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।
‘The Politics of Scapegoating’ প্রবন্ধে লেখক সমাজের বিভিন্ন সমস্যা ও অপরাধের জন্য প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোকে দোষারোপ করার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে আলোচনা করেছেন। এই অভ্যাস, যেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সমাজের সব ধরনের বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয়, সেটির বিভাজনমূলক চরিত্র সম্পর্কে তিনি প্রশ্ন তোলেন। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে লেখক সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতার পথে অগ্রগতির জন্য আরও মানবিক ও সমবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন হাইলাইট করেন।
তাই, রাকিবুল আলমের ‘Traces Of Time’ শুধু একগুচ্ছ প্রবন্ধের সংগ্রহ নয়, বরং একটি মননশীল ও আলোকপাতের মাধ্যম যা আমাদের আজকের জগতের বিভিন্ন দিক এবং মানব সম্পর্কের গভীর বিষয়গুলোকে বোঝার নতুন দৃষ্টিকোণ প্রদান করে। এই বইটি বিদ্যমান বিশ্বব্যাপী অবস্থা এবং মানবিক সংকটের বিভিন্ন দিক উন্মোচন করে এবং আমাদের জীবনযাত্রা ও বিশ্ব দর্শনের সঙ্গে জড়িত দার্শনিক প্রশ্নাবলীর প্রতি গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।