—বলেছিলে আমাকে ছাড়া বাঁচবে না, এখন তো দেখছি আমাকে ছাড়াই দিব্যি বেঁচে আছ। ব্যাপারটা কী?
—কেমন আছ? অনেকদিন পর তোমার সাথে…
রহমান সাহেব এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে উঠলেন।
—আমার সাথে কী? বউ ঘরে থাকলে শব্দ হারিয়ে ফেল?
—না মানে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করো।
—কী বোঝার চেষ্টা করবো?
—সত্যিই কিছু বোঝো না? আমার কী আর সেই দিন আছে?
—সে তো তোমার কথা বলার ধরন দেখেই বুঝতে পারছি। শোনো, তোমার বউ ড্রয়িংরুমে জি-বাংলার সিরিয়ালে ডুবে আছে। সিরিয়াল শেষ না হওয়া পর্যন্ত এদিকে ভেসে উঠবে না। এবার বলো তো, আমাকে দেখে এমন বেঁকে যাচ্ছ কেন?
—পথের ধর্ম যেমন বেঁকে যাওয়া, জীবনের ধর্ম তেমনই বাঁক নেওয়া। সোজাসাপটা চলার মন্ত্রে জীবন বিশ্বাস করে না। বাঁক নিতে নিতে সে এগিয়ে চলে। চলতে চলতে পথ হারায়, আবার পথ ফিরেও পায়। জীবনের এই পঙ্কিল পথে চলতে গিয়ে কতকিছু যোগ হয়, আবার কতকিছুই না বিয়োগ হয়।
—ওরে বাবা, দু’চারটা গল্প, কবিতা ডেলিভারি দিতে না দিতেই দেখি বিশাল লেকচার ডেলিভারি দিতে শিখে গেছ! তা কবি, শুধু যোগ, বিয়োগই হয়? গুন, ভাগ হয় না?
যোগ-বিয়োগ হলে গুন-ভাগও তো হওয়ার কথা। নিচের ঠোঁটে দাঁত বসিয়ে ভাবনার জগতে ডুবে গেলেন রহমান সাহেব। সবার জীবনে অনেক কিছু হলেও রহমান সাহেবের জীবনে সবকিছুই একটা করে হলো। যে বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু সেই বিদ্যা আলয়েই ভালোয় ভালোয় স্কুল জীবন শেষ করে এক কলেজেই ইন্টার, ডিগ্রি কমপ্লিট। অবাক ব্যাপার হলো স্কুল কিংবা কলেজ জীবনের কোনো অধ্যায়েই অনেক টুকিয়ে টাকিয়েও একজনের বেশি বন্ধু জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। কলেজে উঠে কলজে-কাঁপানো বেশ কয়েকজন ললনাকে ফুচকা, আইসক্রিম খাওয়ালেও প্রেম, ভালোবাসা জোটেনি কপালে। ফুচকা, আইসক্রিম খাওয়া শেষ হতেই ললনারা নানা ছলনায় সটকে পড়েছে। মা-বাবার খোঁটা খেতে-খেতে তারপর চাকরির বাজারে ছোটা। চাকরি নামের সোনার হরিণের পেছনে সে কী ছোটাছুটি! একহালি নতুন জুতার শুকতলি খোয়ানোর পর ধরা গেলো সেই হরিণ। তবে সেটা সোনার হরিণ নাকি সিটিগোল্ড হরিণ সে নিয়ে তার ঢের সন্দেহ আছে!
অবশ্য সেই সন্দেহ মন-দেহকে বেশিসময় ভোগায় না। কামাইয়ের জোগাড় হতেই জামাই সেজে বসে পড়ে বিয়ের পিঁড়িতে। একার সংসারে যোগ হয় একমাত্র বউ। বউ এসে শেখায় মানিব্যাগ থেকে ভ্যানিটিব্যাগে বিয়োগ আর বিনিয়োগের খেলা। এরই মাঝে বউয়ের অনবরত ঘ্যানঘ্যান, প্যানপ্যানে ঘরের কাজের ভাগ নিতে এক ছুটা বুয়াও যোগ হয় সংসারে। এতে অবশ্য লাভই হয়েছে রহমান সাহেবের। ঘরের কাজকর্ম নিয়ে বুয়ার সঙ্গে গিন্নির ঘ্যানঘ্যানানিই চলে দিনভর। সেই ঘ্যানাঘানির পর স্বামীর সঙ্গে প্যানপ্যানির এনার্জি পায় না তেমন। এভাবে এগিয়ে এসে গিন্নীর সঙ্গে হররোজ তর্কযুদ্ধের ভাগ নিজ কাঁখে তুলে নেওয়ায় বুয়ার ওপর ভীষণ খুশি রহমান সাহেব।
এ তো গেলো ভাগের ভাগাভাগির কথা। গুণের গুনগুনানিও কি কিছুই নেই? রহমান সাহেবের শখ যেমন একটাই—লেখালেখি করা, স্বপ্নও তেমন একটাই—অনেক বড় মাপের লেখক হওয়া। বয়সে কিংবা চেহারায় তরুণ না হলেই কী, মনটা যেমন চির তরুণ, লেখাও তারুণ্য নির্ভর। নিজেকে পঁচিশ বছরের ওপর ভাবাই হয়নি তার কখনো। সে কারণেই হয়তো লোকে যখন দেশসেরা পাঁচজন তরুণ লেখকের নাম নেয়, ‘যাদের লেখা দুই লাইন পড়লেই মাথায় রক্ত চড়ে যায়’ সেই পাঁচজনের মধ্যে রহমান সাহেবের নামটাও থাকে। রহমান সাহেব সেটা জানেন বলেই ড্রেসিং টেবিলের আয়নাকে বোঝান, তোমার লেখা পড়ে মানুষ সবচেয়ে বেশি গালি হয়তো তোমাকেই দেয়। তাতে তোমার মোটেও খারাপ লাগা উচিত না। গালি দিক আর কালি দিক, মানুষ তোমাকেই তো দেয় রহমান। নাকি অন্য কাউকে দেয়? কথায় আছে না, প্রচারেই প্রসার। যেভাবেই পৌঁছাক, তোমার নামটা তো পৌঁছায় ঘরে ঘরে।
—কী ব্যাপার, গুন, ভাগের কথা ভাবতে ভাবতে কবি কোথায় চলে গেলে?
—ইয়ে মানে বাদ দেওয়া যায় না পুরনো দিনের কথা? রহমান সাহেব মুখে কাতর ভাব এনে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করলেন।
—জানি তো, আমাকে তুমি ভুলেই গেছ। আগে দূর থেকে দেখলেই সুর করে ডাকতে। আমার শাড়ির ভাঁজ খুলতে খুলতে অস্থির হয়ে চোখের জল ফেলতে। কোথায় না খুঁজতে আমায়…বাসায়, হোটেলে, রেস্টুরেন্টে…আমাকে সামনে না পেলে নির্লজ্জের মতো সামনে যাকেই পেতে চিৎকার দিয়ে বলে উঠতে, এই, কে কোথায় আছিস, নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি। আমি যেন তোমার একান্ত সম্পদ। অধিকার নিয়ে চাইলেই হলো, ছুটে আসতে হবে আমাকে। আচ্ছা, সেদিনের ঘটনাটা তোমার মনে আছে? মনে পড়লে এখনো একা একাই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি।
ডাক্তার তোমার পেঁয়াজ খাওয়া বারণ করেছে বলে কি কাটতেও বারণ করেছে? এই অকম্মার ঢেঁকিকে নিয়ে কী যে করি? দাও তো, আমার কাছে দাও।
—কোন ঘটনাটা যেন? রহমান সাহেব চুলের খুশকি চুলকাতে চুলকাতে আপ্রাণ মনে করার চেষ্টা করলেন।
—আরে সেই ঘটনাটা গো, এরমধ্যেই ভুলে গেলে? চুপিচুপি একা একা হোটেলে ঢুকলে। এরপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে বেয়ারাকে অর্ডার দিলে তাড়াতাড়ি এনে দাও, কেটে দাও। বেশ কিছুক্ষণ পরে যখন পরোটা, কষা মাংসসহ সবকিছুই এলো, শুধু আমিই এলাম না। ক্ষেপে উঠলে তুমি। বেয়ারাকে বললে, তাড়াতাড়ি আনতে বললাম না? তাড়াতাড়ি মানে কী এই? এক ঘণ্টায়ও তো দিলে না! বেয়ারা মুখ কাঁচুমাচু করে উত্তর দিলো, ইয়ে মানে, কাটা তো হয়ে গেছে। রেগে গিয়ে বললে, কাটা হয়েছে কিন্তু আমাকে দেওয়া হলো না কেন? হে, হে, করে হেসে উঠে বেয়ারা বললো, তা নয়, ফুরিয়ে গেছে বলে অর্ডারের লিস্ট থেকে কেটে দেওয়া হয়েছে।
—আসলেই সেদিনের ঘটনাটা ভোলার নয়। পুরোপুরি বেকুব হয়ে গিয়েছিলাম বেয়ারার কথায়। তবে ঘটনাটা কী জানো, একটা বয়স থাকে, আনন্দ, ফুর্তি করে সময়টা উপভোগ করার। একটা সময় থাকে ভালো লাগার, ভালোবাসার। এরপর নিজেকে গুটিয়ে নিতে হয়। আমার ডাক্তার কপালে ভাঁজ তুলে বুকে স্টেথো চেপে বলে দিয়েছে, বয়স হয়ে গেছে সব গুটিয়ে নেওয়ার। নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছি তাই। এখন ওসব ভুলে যাওয়াই ভালো। কিছু মনে করো না। ভুলে যাও আমাকে। আর কখনো সামনে এসে দাঁড়িও না।
—আমার সঙ্গ এখন আর আর তোমার অঙ্গ দোলায় না। তাই নতুন সুখের আশায়, ছেড়ে যেতে চাও আমায়? নাকি, আমার মূল্য দেওয়ার মতো ক্ষমতা নেই বলে, এত বাহানা দেখাচ্ছ? আচ্ছা যাও, ছেড়ে দিলাম তোমায়। সুখে থাকো, নতুন ভালোবাসায় মজে থাকো। আর ডাকবো না তোমায়। শুধু দূর থেকে দেখবো।
—আহা, এভাবে বলছ কেন?
—শোনো, তুমিই আমার জীবনে একমাত্র নও। জীবন আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। কখনো কেউ ভালোবেসে আগলে রেখেছে, কখনো কেউ ভালোবেসে আমাকে নিঃশেষ করেছে। কখনো কারও মুখে হাসি ফুটিয়েছি, কখনো কারও চোখে জল এনেছি। দেনা পাওনার যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগের হিসাব এখন আর মিলাই না।
—তুমি কিন্তু আমাকে ভুল বুঝছ। দূর থেকেও ভালোবাসা যায়। কাউকে দূর থেকে ভালোবাসাই সব থেকে পবিত্র ভালোবাসা। কারণ, এ ভালোবাসায় কোনো রকম অপবিত্রতা থাকে না, কোনো শারীরিক চাহিদা থাকে না। শুধু নীরব কিছু অভিমান থাকে, যা কখনো কেউ ভাঙায় না। তোমার প্রতি ভালোবাসায় চিরজীবন আমার অশ্রুবিন্দু ছিল, আছে, থাকবে। চোখ জ্বালা করা সেই অশ্রুবিন্দু একা একাই মুছে ফেলি। মনে রেখো, যখন কেউ কারও জন্য কাঁদে, সেটা হলো আবেগ। যখন কেউ কাউকে ইচ্ছে করে কাঁদায়, সেটা হলো প্রতারণা। আর যখন কেউ কাউকে কাঁদিয়ে নিজেও কেঁদে ফেলে, সেটাই হলো প্রকৃত ভালোবাসা। সব জেনেও তুমি কষ্ট পাবে?
—আমার কোনো কষ্ট নেই তো। এই যে তোমার হাতে ধারালো ছুরি, এখনই বসিয়ে দেবে আমার বুকে, তারপরও এই পৃথিবীতে সব থেকে সুখী আমি। আর দেরি কেন? দাও, বসিয়ে দাও।
পরিষ্কার নীল আকাশ, দূরে সবুজ মাঠ, মাঠের ধারে মৃদুমন্দ বাতাসে দুলছে কাশফুল। ঋতুর রানি শরৎ এসে যেন ভিড় করেছে রহমান সাহেবের রান্নাঘরের জানালায়। কাশফুলের নরম ছোঁয়ায় গরম চুলার পাশে বসে কাটাকাটি করছিলেন রহমান সাহেব। বুয়া আসেনি বলে রান্নাঘরের কাটাকুটির দায়িত্বটা আজ তারই।
হঠাৎ ঝড়ের বেগে রান্নাঘরে ঢুকেই গিন্নি মুখ ঝামটা মেরে উঠলেন, আধাঘণ্টা আগে দিয়ে গেছি কয়টা পেঁয়াজ। সেই কখন থেকে দেখছি, পেঁয়াজের দিকে রোমান্টিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিড়বিড় করছ। সমস্যাটা কী, শুনি? এগুলো কাটতে এত সময় লাগে? চোখের জলে তো রান্নাঘর ভাসিয়ে দিচ্ছ! ডাক্তার তোমার পেঁয়াজ খাওয়া বারণ করেছে বলে কি কাটতেও বারণ করেছে? এই অকম্মার ঢেঁকিকে নিয়ে কী যে করি? দাও তো, আমার কাছে দাও।
মহা মূল্যবান পেঁয়াজের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে এলেন রহমান সাহেব।