‘মুসলমানীর গল্প’ নামে একটি ছোটগল্প অসংখ্যবার পড়েছি। বলা চলে, এটিই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের শেষ ছোটগল্প। এই গল্পের প্রতিপাদ্য ছিল— ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের ধরন নির্ণয়। এই গল্পে তিনি ভারতবর্ষের অসাম্প্রদায়িক চেতনা নির্মাণে মুসলমানদের অবদান অকুণ্ঠ চিত্তে স্বীকার করেছেন। আর জাতির সংকট মুহূর্তে এটি তুলে ধরাই ছিল তার লেখক দায়।
মাতৃপিতৃহীন অতিশয় সুন্দরী কমলা ব্রাহ্মণ পিতৃব্যের ঘরে প্রতিপালিত হয়ে আসছিল। বিয়ের পরে প্রতিগৃহে যাওয়ার সময় ডাকাত দলের কবলে পড়ে সে। সেখানে হবির খাঁ নামক এক প্রভাবশালী মুসলিম ধর্মপ্রাণ সমাজনেতার হস্তক্ষেপে ডাকাত দলের লাঞ্ছনা থেকে কমলা মুক্তি পায়। কিন্তু জাত খোয়ানোর অভিযোগে পিতৃব্য-গৃহে আশ্রয় জোটে না। তার কাকা-কাকি তাকে ঘরে ফিরে নিতে অস্বীকার করে বলে, ‘উপায় নেই মা! আমাদের যে হিন্দুর ঘর, এখানে তোমাকে কেউ ফিরে নেবে না, মাঝের থেকে আমাদেরও জাত যাবে।’ অগত্যা উপায় না দেখে কমলা হবির খাঁর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। প্রথমে কমলা ইতস্তত করলে হবির খাঁ বলেন, ‘বুঝেছি, তুমি হিন্দু ব্রাহ্মণের মেয়ে, মুসলমানের ঘরে যেতে সংকোচ হচ্ছে। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো—যারা যথার্থ মুসলমান, তারা ধর্মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণকে সম্মান করে, আমার ঘরে তুমি হিন্দুবাড়ির মেয়ের মতোই থাকবে।’ হবির খাঁর আট-মহলা বাড়ির এক মহলে আছে শিবের মন্দির আর হিন্দুয়ানির সমস্ত ব্যবস্থা। রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘এই বাড়ি সম্বন্ধে পূর্বকালের একটু ইতিহাস ছিল। এই মহলকে লোকে বলত রাজপুতানীর মহল। পূর্বকালের নবাব এনেছিলেন রাজপুতের মেয়েকে কিন্তু তাকে তার জাত বাঁচিয়ে আলাদা করে রেখেছিলেন। সে শিবপূজা করত, মাঝে মাঝে তীর্থভ্রমণেও যেত। তখনকার অভিজাত বংশীয় মুসলমানেরা ধর্মনিষ্ঠ হিন্দুকে শ্রদ্ধা করত। সেই রাজপুতানী এই মহল থেকে যত হিন্দু বেগমদের আশ্রয় দিত, তাদের আচার-বিচার থাকত অক্ষুণ্ন। শোনা যায় এই হবির খাঁ সেই রাজপুতানীর পুত্র।’
হবির খাঁ মায়ের ধর্ম না নিলেও মায়ের প্রতি তার ছিল অফুরন্ত শ্রদ্ধা। কমলা হবির খাঁর ছেলের প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করে মুসলমান হয়ে যায়। কমলা হবির খাঁকে বলে, ‘বাবা, আমার ধর্ম নেই, আমি যাকে ভালোবাসি সেই ভাগ্যবানই আমার ধর্ম। যে ধর্ম চিরদিন আমাকে জীবনের সব ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেছে, অবজ্ঞার আঁস্তাকুড়ের পাশে আমাকে ফেলে রেখে দিয়েছে, সে ধর্মের মধ্যে আমি তো দেবতার প্রসন্নতা কোনো দিন দেখতে পেলুম না।’ এই ঘটনার কিছুদিন পরে কমলার কাকার দ্বিতীয় মেয়ে সরলার বিয়ের পরে একই ঘটনা ঘটে। সেদিন হবির খাঁ ছিল না, কমলায় তার ভার তুলে নিয়েছিল কাঁধে। কন্যাপক্ষরা যখন কন্যাকে পালকির মধ্যে ফেলে রেখে যে যেখানে পেল দৌড় মারতে চায় তখন তাদের মাঝখানে দেখা দিল হবির খাঁয়ের অর্ধচন্দ্র আঁকা পতাকা বাঁধা বর্শার ফলক। সেই বর্শা নিয়ে দাঁড়িয়েছে নির্ভয়ে একটি রমণী।
সরলাকে তিনি বললেন, ‘বোন তোর ভয় নেই। তোর জন্য আমি তাঁর আশ্রয় নিয়ে এসেছি যিনি সকলকে আশ্রয় দেন। যিনি কারো জাত বিচার করেন না।’ কাকা-কাকির বাড়িতে বোন সরলাকে ফিরে দিয়ে কমলা তাদের স্মরণ করিয়ে দেন, ‘আমার বোন যদি কখন দুঃখে পড়ে তবে মনে থাকে যেন তার মুসলমান দিদি আছে, তাকে রক্ষা করার জন্য।’ রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে এই হলো ভারতবর্ষ, এই হলো হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক। মুসলমান দিদিও রক্তে যেমন হিন্দু বোনের রক্তের সম্পর্ক আছে, তেমন হিন্দু বোনের রক্ষায় মুসলমান বোনের ভূমিকা আছে। তাঁর মতে, হিন্দুর জাতপাতের ছোঁয়াছুঁয়ির বেড়া ভেঙে দিয়ে মুসলমানেরা এই ভারতকে মানবিক ভারতের দিকে অগ্রসরে ভূমিকা রেখেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু পরবর্তীকালে এ দেশের রাজনীতিতে প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িক বিভেদ আবারো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। সাহিত্যে তা খুব বেশি প্রকট না হলেও অনেক লেখকের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
মধ্যযুগে গৌরাঙ্গ শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণব আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাসের মতো অসংখ্য কবিরা বহু অমর পদ রচনা করেছেন। এটি হিন্দু ধর্মীয় ভাব আন্দোলন বলে মুসলমান কবিরা দূরে থাকেননি, তারাও রচনা করেছেন রাধা-কৃষ্ণকে নিয়ে অসংখ্য ভক্তি সংগীত। এদের মধ্যে আলাওল, আফজল, সৈয়দ সুলতান, সৈয়দ মুর্তজা, আলী রেজা প্রধান। তাদের রচনার ভাব ও বিষয়- হিন্দু রচিত পদ থেকে কোনো অংশে কম নয়। তাদের রাধা-কৃষ্ণের জীবাত্মা-পরমাত্মার ভাবরসের সঙ্গে ইসলামী সুফিতত্ত্বের দর্শন একাকার হয়ে গিয়েছিল। এটিই ছিল পরবর্তীকালে এদেশে বাউল-সুফি সাধনার সহজিয়া উপায়। যার পথ ধরে লালন, হাসন, রাধারমন, আব্দুল করিমের মতো অসংখ্য সাহিত্য সাধকের প্রকাশ। আর আধুনিকালে বৈষ্ণব ও শাক্ত পদাবলী রচনার ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলাম একাই এ ধারার সকল দীনতা ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর পদের বিষয় ভাব ও শিল্পের লালিত্বে হিন্দু ভক্তের প্রাণের সঙ্গে মুসলমান রসগ্রাহীর হৃদয়ও আন্দোলিত হয়।
বিশ শতকের সূচনালগ্নে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাবের আগে মীর মশাররফ হোসেন ছাড়া উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের পক্ষে শক্তিশালী সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। ফলে সাহিত্যে মুসলিম চরিত্র-চিত্রণে কিছুটা ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। শত শত বছর পাশাপাশি বসবাসের পরেও দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরকে জানার আগ্রহ তীব্রতর ছিল না। ফলে ভৌগোলিক উত্তরাধিকার অভিন্ন হলেও সংস্কৃতিক উত্তরাধিকারে নিঃসংশয় ছিল না। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে, তিনি শ্রীকান্ত উপন্যাসে গহর চরিত্র নির্মাণ করেন। রূপদক্ষ শিল্পীর কলমের টানে মুসলমান গহরের সঙ্গে বোষ্টমী কমললতার হার্দিক প্রেমময় সম্পর্ক গহরকেও গোঁসাই পদে উন্নীত করে। যদিও তাদের এই সম্পর্ক সমাজ মেনে নিতে পারে না। অসুস্থ গহরকে সেবা দানের অভিযোগে কমললতাকে আশ্রম ছেড়ে নিরুদ্দেশে চলে যেতে হয়। তবু তাঁর সৃষ্টির ফলে গোড়া হিন্দু ও মুসলমান কেউ খুশি হতে পারেননি। অনেকে বলেন, এর বিপরীতে শরৎকে ‘বিপ্রদাস’ লিখে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়।
বঙ্কিমের শক্তিশালী কলম মুসলমান সাহিত্যিক সমাজের জার্ড্যতা ভাঙার ক্ষেত্রে কাজে লাগলেও তিনি মুলমানদের দুর্দিনে আরো কিছুটা হৃদয়বান হতে পারতেন বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু তাঁর জন্যও বিষয়টা ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। ইংরেজ জামানার উষালগ্নে পরাজিত রাজার নিন্দা এবং বিজয়ী রাজার গুণগান, একই সঙ্গে রাজা ও প্রজার উচিতকর্ম হিসাবে বিবেচিত। সাধারণ হিন্দু ও সাধারণ মুসলমানের ভাগ্য যদিও একই সুতায় বাঁধা ছিল, তবু পূর্বরাজা মুসলমান হওয়ার ফলে মুসলমান প্রজাদের দুঃখের কারণ একটু বেশি ঘটেছিল। আবার উনিশ শতকেই নবীনচন্দ্র সেন, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়’র মতো হৃদয়বান অনেক কবি-সাহিত্যিক জাতীয়তাবাদী নায়কের খোঁজে সিরাজউদ্দৌলাকে পুনরুদ্ধার করেছিলেন। বিশ শতকের প্রথমার্ধে কাজী নজরুল তাঁর সাহিত্যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতার পাশাপাশি ব্যাপকভাবে হিন্দু-মুসলিম মিলনে কাজ করেছিলেন। এমনকি ধর্মের ভিত্তিতে ভারতভাগ তিনি সমর্থন করেননি। তাঁর নিজের জীবনে তিনি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করেও জাতধর্ম অক্ষুণ্ন রেখে হিন্দু মেয়ের পাণিগ্রহণ করেছিলেন। নিজের পুত্রদের নাম হিন্দু মুসলমানের মিলিত ধারার সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছিলেন। মুসলমানের ধর্মকে নিয়ে তিনি যত গান-কবিতা লিখেছেন, হিন্দুর দেবতাকে নিয়ে তারচেয়ে কম লেখেন নি। তাঁর পরবর্তীকালের কবি সাহিত্যিকগণের মধ্যেও এ ধারা অব্যাহত থাকে।
করোনার সময় পত্রিকায় প্রকাশিত এই ঘটনা অনেকের জানা।২০২০ সালের এপ্রিলে মে মাসে যখন করোনার ডামাডোল। তখন আমলাপাড়া নিবাসী কৌলাশ বনিক নামে একজন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক করোনা সিনটম নিয়ে মৃত্যু বরণ করেন। মৃতের তিনটি মাত্র কন্যা সন্তান।এক পুত্র বাবার আগেই চলে গেছে পরপারে। মৃতের মরদেহ সৎকারেকর জন্য নিয়ে যাওয়া হয় শশ্মানে। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সকল কার্যক্রম শেষ করে মুখাগ্নীর সময় উপস্থিত। মুখাগ্নী করার কেউ নেই।কারন মৃতের পুত্র সন্তান নেই।করোনার ভয়ে মৃতের কোন পুরুষ স্বজনও আসেনি শশ্মানে। শুধু তার দুই মেয়ে উপস্থিত। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী পুত্র বা ভাতিস্পুত্র প্রয়োজন।
এই অবস্থায় মৃতের বড় মেয়ে নিয়তি বনিক আমাকে বলেন,দাদা তুমি তো আমার বাবাকে বাড়ী থেকে নিয়ে এলে তুমিই আমার ভাই,তুমি মুখাগ্নী করো।এরপর নিয়তি দিদি আমার এক হাত ধরেন,আমি আরেক হাতে কাকা বাবুর মুখাগ্নী করি।
এভাবেই আমাদের পরিচয়। ঘটনার পর থেকে আজ প্রায় দুই বছর হতে চলছে। নিয়তি দিদি আমার নিয়মিত খোজ খবর রাখেন।পূজায় মিষ্টি,নাড়ু নিয়ে আসেন।আমি ভাই হিসাবে যতটুকু সামর্থ্যে কুলায় বোনের খোজ খবর রাখি।অটুট আমাদের ভাই বোনের সম্পর্ক।
২৭ জানুয়ারি ছিল নিয়তি দিদির একমাত্র ছেলের বিয়ে।খাওয়া দাওয়া শেষে ভাগিনা ও ভাগিনা বৌ এর সাথে ছবি তুলে তারপরে ছাড়লেন নিয়তি দিদি। মৃত্যু শুধু কারো চলে যাওয়া নয়,অনেক মৃত্যু নতুন সম্পর্কও সৃষ্টি করে।ভালো থাকুন বোন আমার নিয়তি বনিক।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল অসাম্প্রদায়িকতা। পাকিস্তান সরকারের উগ্র সাম্প্রদায়িক নীতির বিরুদ্ধে বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান-পর্বের তেইশ বছরের আন্দোলন যেমন ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তেমন ছিল বাঙালির বিভেদ নীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পরবর্তীকালে এ দেশের রাজনীতিতে প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িক বিভেদ আবারো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। সাহিত্যে তা খুব বেশি প্রকট না হলেও অনেক লেখকের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
ফলে মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাসের মতো এখনো কবি-সাহিত্যিকদের অনেক দিন গাইতে হবে—‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’