এক.
পোড়ামাটির কাজ জানা থাকলে খারাপ হয় না। রকমারি সব মৃত্তিকা দিয়ে গড়া যায় হরেক রকমের দ্রব্যসম্ভার। বানানো যায় পিদিম, সরা কিংবা সানকি, এমনকী আগুনে ঝলসানো বাহারে তৈজসও। একবার আমি খেলাচ্ছলে মিহি সিরামিকে তৈরি করি সুঠাম একটি ঘোড়া। প্রয়োজন দেখা দিলে বনানী-নিবিড় প্রান্তরের। কী আর করা যাবে, অশ্বটিকে লালন-পালনের জন্য গড়ে তুলি খামারবাড়ি, আস্তাবল ও দৌড়ের চক্র প্রভৃতি। রেসেও নিয়ে যাই তাজি সুদর্শন জন্তুটিকে। দৌড়ে গোটা সাতেক মেডেলও পেলো সে। তারপর দেখি, তাজ্জব ভারী, তার পিটে গজাচ্ছে ডানা। ভেটেনারিয়ানের সঙ্গে কথা বলি, জানতে পারি, ঘটনা স্বাভাবিক, এই প্রজাতিকে বলা হয় পঙ্খীরাজ। তা বেশ। মাঝেমধ্যে দেখি, বাজপড়া পাকুড় গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে পেল্লায় ডানা ঝাপটিয়ে তুরগটি চেষ্টা করছে ওড়াউড়ির।
দুই.
প্রতিবেশীদের দু-এক জন মাঝেমধ্যে আসে এখানে। দেখে বলে, বুঝলে হে—প্রজাতি পঙ্খীরাজ হলে খানিকটা উড়বেই তো। কখনো আমি যখন স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায়, প্রাণপণে চেষ্টা করছি—ভিজে কাঠে আগুন জ্বালানোর, লালচে মাটিতে আমি যে পানপাত্রগুলো তৈরি করেছি, তাতে ছিটানো হয়েছে অভ্রের গুঁড়ো। ভেসে যাওয়া মেঘের ঝড়ো-কালনীতে আকাশ ভারাক্রান্ত হয়ে আছে, কিন্তু না পোড়ালে তো চলছে না, ভেজাকাঠে আগুন জ্বালানোর যন্ত্রণা অশেষ। ধোঁয়ায় চোখ কান্নাপ্রতিম করে বসে আছে নিশ্চুপ। দেখি, আস্তাবল থেকে উড়াল দিয়ে এসে মাটি ছোঁয় ঘোড়াটি। ডানা ঝাপটিয়ে বাতাসও করে যৎসামান্য। দেখতে দেখতে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে অগ্নিকুণ্ড আর মৃৎপাত্রে রুপালি আভায় পুড়ে অভ্রচূর্ণ।
তিন.
কাটে দিন, বয়ে যায় সময়, ঘোড়াটিও সোমত্ত হয়। ঘোরাফেরা করতে বনানীতে যায় আজকাল, সহিস ছাড়া—সম্পূর্ণ একাকী। ফিরেও আসে নিয়মিত গোধূলি-সন্ধ্যায় আস্তাবলে। বসন্তের বাউরি বাতাসে তাবৎ কিছু বদলে গেলো। দেখি, উড্ডীন অশ্বটির পেছন পেছন হালফিল খামার অব্দি আসছে, তরুণ বয়সের মাদি এক বুনো মাসতাংও। প্রতিবেশীরা মৃদু হাসে। ফিঁয়াসে জোটানোর প্রয়োজন হয়েছে তরুণ তুরঙ্গমের, বিষয়টা প্রত্যাশিত। দেখতে দেখতে দেখনদারিতে মেতে ওঠে পাঙ্খীরাজ। খামারের চিলতে আকাশে বৃত্তাকারে উড়ে তার বুনো সাথীকে দেখায়, ডানার অভিনব কসরত। ভাবি, চলছে তো সব কিছু দিব্যি না’সিকে স্বাভাবিক।
চার.
অপরাহ্ণে ওড়াউড়ির অনুশীলন জারি থাকে আরও কিছু দিন। বুনো-মাদি বোধ করি কাঠের ক্রাল ডিঙিয়ে খামারে ঢুকতে লজ্জা পায়। ঝোপঝাড়ের ফাঁকফোঁকর থেকে চোরা-চাহুনিতে অবলোকন করে অ্যাক্রোবেটস্। আসকারার প্রয়াসে আমিও জোগান দেই প্রিয় ছোলা, গাজর ও ওটমিল। গামলা ভর্তি জলে খনিজ লবণের ছিটেও। ভাবি, পড়শী ডেকে এক অপরাহ্ণে জমাতে হয় মজলিস। অভ্রের বিচ্ছুরণ ছড়ানো পানপাত্রগুলো তো তৈরি হয়ে আছেই, না হয়, পরিবেশন করা গেল তরমুজের তরল গোধূলি। আর পঙ্খীরাজটি ডানায় নীলিমা ছুঁয়ে দেখালে কিঞ্চিত জারিজুরি, বিষয়টা নির্ঘাৎ হয়ে উঠবে—টক অব দ্য টাউন।
পাঁচ.
কিন্তু গোল বাঁধালো—কতিপয় পরিযায়ী পাখি উড়ে আসলে পর। কতদূর থেকে উড়ে এসেছে—পথে হয়তো পাড়ি দিয়েছে তুন্দ্রা,হিমবাহ কিংবা বিষবাষ্পের মরিচীকায় আচ্ছন্ন হ্রদ। কে জানে দানাপানি জুটেছে কী তাদের? বেচারিরা শিরিষের প্রসারিত ডানায় বসে ঝিমাচ্ছিল। ভাবি, বিশ্রাম নিক না দিন দুই, তারপর হয়তো উড়ে যাবে কাছাকাছি কোনো বৃষ্টিবন নিশানা করে। হঠাৎ করে খেপে—তেড়েফুড়ে উড়ে যায় পঙ্খীরাজ। বিচিত্র এক তুরঙ্গ-ব্লিজার্ডের মতো—পরিব্রাজক খেচরদের তাড়া করে নিয়ে যায়, কে জানে কী খেয়ালে শিরিষ থেকে শিরিষে কোথায়—কোন দিকচক্রবালে।
ছয়.
কিন্তু ফিরে আসেনা আর আমার ডানাবহুল তুরগ কুমার। দিন যায়, কাটে রাত, উদ্বেগ হয় খানিক। জ্যোতিষ পড়শীর সঙ্গে কথা বলি। অনুরোধে তিনি ঘোড়ার জন্মতারিখ, মায় ঠিকুজি…আতশি কাঁচে গ্রহণক্ষত্র অব্দি তাবৎ শাস্ত্র বিছরান। তারপর ঝুপসি ভৃরুর যমজ সেতু তুলে বলেন, উড়ে উড়ে পৌঁছে গেছে হে ছায়াপথে, তবে ও নিয়ে ভাবনা কিছু নেই, নীলিমায় হারায় তো না কোনো কিছু, রূপান্তরের জ্যোতির্ময় আভায় বেঁচে থাকে অনন্তকাল, না জতিস্মর হওয়ার সম্ভাবনা নেই একেবারে, তবে সঠিক লগ্নে নেত্রপাত করে দ্যাখো—চোখে পড়লেও পড়তে পারে কদাচিৎ।
সাত.
হালফিল ভুগি অনিদ্রায় বিগতভাবে। নিশিরাতে কখনো-বা চেলাকাঠ জড়ো করে সাজাই ক্যাম্পফায়ারের অগ্নিকুণ্ড। আচে দগ্ধ হতে হতে… চুপচাপ বসে থাকি…কৃষ্ণপক্ষের কুয়াশা নিবিড় নিশীথে। নিমজ্জিত হই লগ্ন নির্ণয়ের মানসাঙ্কে। দাখিনা বাতাসে উড়ে যায় মেঘমালা, ছায়াপথও দৃশ্যমান হয়। দেখি—আকাশগঙ্গার আধোন্ধকার উপত্যকায়—স্থির ডানায় গ্লাইড করছে আমার তুরগ কুমার। তার গর্দানের দীর্ঘ কেশদামে পানপাত্রে প্রোথিত অভ্রের কুচির মতো লেগে আছে—খানিক স্বর্ণাভ…ঈষৎ রুপালি নক্ষত্র ধুলি।