যখন তোমার সন্তানের মা আমি
সপ্তাহের সাতটি দিন কতভাবে ফুরায় আমার
১টা দিন আমি তুলে রাখি তোমার জন্যে
সকাল থেকে কেটলিতে জল চাপিয়ে
অনর্গল আমি ফুটতে থাকি,
জলীয় বাষ্পধারা আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়
দ্বিধার চূড়ায়,অভিমানের শতরঞ্জি বিছিয়ে
শুয়ে থাকি—পোয়াতি যেমন!
৫০ বছর পুরোনো আফটার সেভের সুগন্ধ
আমাকে আজও উদাস করে দেয়,
যেদিন প্রকাশ্যে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে
নিরাপদে রাস্তা পার করেছিলে ঢাকার রাজপথ
আমার গর্ভাশয়ে ছয়মাসের ভবিষ্যৎ
ভেতর থেকে নড়ে উঠেছিল…
আমি তখন সবে ২৭ আর তুমি ৩৮
অভিভূত আমি তোমার নির্লজ্জ সাহস দেখে
লজ্জাবতীর মতো চারুস্বপ্নে ঢুকে যাচ্ছিলাম…
আর ভাবছিলাম, নিজের সন্তানের মাকে বুঝি
এভাবেই লোকে পরম যত্নে ভালোবাসায় রাখে?
যে পথে হাঁটি আমি,
(আমার প্রাণের ধ্বনি অহম-অবনীকে)
যে পথে হাঁটি আমি, সে আমার সন্তানের বাড়ির পথ,
সোনালি রোদ্দুরে আঁকা ভবিষ্যৎ অব্যয়-সড়ক
এই দূর প্রবাসে হেঁটে যায় আমার দুই দুরন্ত সুন্দর—
ঘর ছেড়ে তারা পথে বেরুলে ঝমঝম আনন্দে
আকাশ ফেটে ঝরে পড়ে শীলা বৃষ্টির উচ্ছ্বাস
শীতের পাখিরা ফিরে পায় চির-বসন্তের ভোর,
শত খেলনার ভিড়ে আমিও হয়ে উঠি প্রিয় পকিমন
দিদি-দিম্মার হৃদয়-ঝড় নিয়ে খেলা করে দুজনেই…
ভাবি,এই পথে একদিন হেঁটে যাবে অষ্টাদশী অবনী
আহা,আমি থাকবো না…
হয়তো তার পিতা কিংবা দাদুর মতো কোনো যুবকের
বুকে মাথা রেখে বলবে, জানো তো,
‘ভালোবাসা মানে দুজনার পাগলামী’
এই কবিতা আমার কবি দাদুর লেখা।
প্রণয় গভীর দৃষ্টিতে পরস্পর তাকাবে যখন,
প্রজাপতি আনন্দে পৃথিবীর রূপ খুলে যাবে শতগুণ…
আহা,আমি থাকবো না,
একুশ পার করা তরুণ যুবক আমাদের অহমসোনা,
স্বর্গীয় ভাষায় তারা পরস্পর কথা বলবে প্রণয়-ওষ্ঠে
আহা,আমি থাকবো না…
পরিচয় পর্বের কোনো এক দুর্বল মুহূর্ত-ঘোরে হয়তো
বলবে,আমিও প্রণয়োন্ধ এক কবি-দম্পতির
আরাদ্ধ উত্তরাধিকার,
হে প্রিয়তমা ,তোমার-আমার মতোই একদিন তারাও
পরস্পরের ডানা হয়ে বেঁচেছিল এই পৃথিবীর পথে।
আহা,আমি থাকবো না…
আমরা দুজন পৃথিবীর বাইরে ভাসমান স্মৃতির শাম্পান…
সম্পর্ক-সম্পদ
আমি তো গায়ে গায়ে লেপটে থাকা সুতোয় গাঁথা মানুষ,
ভালোবাসি যাদের—আঘাতে ও অপমানে,
শত বেদনায়—তাদের ছেড়ে যেতে পারিনি স্বপ্নেও।
বাস্তভিটার বিশ্বস্তায় পড়ে থাকি মমতাবিহীন,
ভাবি,এই মানুষই তো ভালোবাসা দেয়,
লতায়-পাতায় কাছে ডাকে আলোর ইশারায়।
দরকারে ঠেলে দেয় অচ্ছুৎ দূরে…
কখনো কোলে তুলে নেয় বেড়ালের ছানা যেমন।
মানুষের মতো বিস্ময় জাগানো অন্য কোনো
প্রাণী আমি দেখিনি অনিত্য এই জীবনে।
শাদা-কালো-বাদামি—যাই বলো—
মানুষের হৃদয়ের কাছে মূলত ঋণী হয়ে আছি
প্রতিপলে রেখে যাই প্রণয়ের প্রণতি।
মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক-সম্পদের চেয়ে
অন্য কোনো অর্জন নেই যে আমার!
নিদয়াল তুমি
দয়াল,চোখে জল আসে তোমার নামে,
যে দিকে ফেরাই চোখ
তোমাকেই দেখি নয়নে নয়ন,
সব পথ শেষ হয় তবু তোমারই বুকের গানে।
স্মৃতির ঝর্ণাতলায় আজো তো
বিরহে অচঞ্চল,ভিজে যাচ্ছি
পুড়ে যাচ্ছি, নিভে ভিজে যাচ্ছি রোজ
দহনেও একি অপরূপ তুমি
প্রেমে ও পূজোয়।
মৃত্যুর আগে প্রেম এলো
(কবি জালাল উদ্দিন রুমী স্মরণে)
মৃত্যুর আগে ঐ প্রেম এসে
বললো: আমাকে রাখো…
আমি হেসে বললাম—কী—বলছ এসব তুমি?
সে বললো: জানোই তো তুমি,আমি খুব ইনোসেন্ট!
হও ইনোসেন্ট, ইতিউতি কিছুতে যে, নেই আমি—
এখন আমি দয়াল-সাধিকা,ভক্তি রসে অধরা
তার কাছে যেতেই পুলসিরাতের পথ খুঁজছি…
সে বললো : আমি হলাম বিরহিনীর মায়া-সাঁকো,
আমাতেই ভর করে,যেতে হবে ঐ দূরের পথ—
দেখো না, শত সহস্র পথচারীর এ-পদচ্ছাপ
আমার হৃদয় তরঙ্গে বয়ে যাচ্ছে যে—ঢেউ তুলে।
আমি বললাম—এখন আমার অনেক বয়স,
তোমাকে আমার জানি নেই আর কোনো প্রয়োজন?
দৃঢ়কণ্ঠে এবার বললো: তুমি অনিত্য,অনিতা
নশ্বর ও নাশশীল—সহজে ভঙ্গুর দেহলতা…
আমি না থাকলে,পৃথিবী উন্মাদ —কেউ নও তুমি।
আমি আছি বলে,সর্বভূতে উত্তাল—তুমিই হও
ঈশ্বর প্রণয়ে ছোঁয়া চিরন্তন ভাটিয়ালি গান॥