ও প্রণম্য জীবন, ও অগ্নিযজ্ঞ
একবার সুশীতল হয়েছিল অনুগত চিতার আগুন। এই সত্য জেনে কালের করতলে জমা রাখি আজো প্রজ্জ্বলিত দিনের প্রসূন, রোদে পোড়া প্রজাপতি পাখার সারমর্ম আর সন্ধ্যাতারার নিচে নিভে যাওয়া স্মৃতির জোনাকি। গভীর রাত্রিতে কেউ বিশ্বাসের লণ্ঠন জ্বেলে আলোকিত করে নিচ্ছে নিজস্ব আঁধার। কারো চোখে অনিঃশেষ অশ্রু আর কেউ শরীরের অতল সমুদ্র থেকে তুলে আনছে জলের শীৎকার। কেউ কেউ নিধন করছে গাছ, কেউ ফের; ক্ষুধার্ত গার্হস্থ্যজ্ঞানে রন্ধনশালায় মহাসুখে পোড়াচ্ছে তার লাশ। তবুও কি ঠিকঠাক জানা হলো আজো অনুগত সেই আগুনের ইতিহাস?
বৃষ্টিবাহী মেঘেদের যানজটে এত বজ্রপাত, দিনান্তের হালখাতায় তবু হারানো গুপ্তধনের মতো অশনাক্ত থেকে যায় কিছু অশ্রুত ধ্বনির বিষাদ। রৌদ্রখচিত এমন সম্মোহিত দিনের ভাসানে এসে, ডানাপোড়া পতঙ্গের মতো আমিও জেনেছি শেষে— সমুদ্রমন্থিত এ জীবন বস্তুত অনতিক্রম্য এক বোধের আকাশ…
প্রপঞ্চ
যোজনগন্ধা স্মৃতির রোদ্দুরে বসে
খোপাখোলা চুল ও চিরুনিতে তুমি বুনছ উদারতা,
আর আমি; দৃষ্টি থেকে খসে পড়া শব্দকুচি
কুড়িয়ে এনে করপুটে জমাচ্ছি রূপকথা।
এ রকম স্মৃতিসিক্ত দিনে
তোমার বয়স ভেঙে বেরিয়ে এসেছে যে তম্বী হরিণী,
তার চোখে ঘনঘোর কথাবৃক্ষ দেখে আমি যত দিশেহারা
তত তুমি ডোরাকাটা দিনের মায়া, কস্তুরীঘ্রাণ ছড়িয়ে
আমাকে নিয়ে যেতে চাইছ হারানো অরণ্যের কাছে,
যেতে যেতে জোসনাস্নাত বনের পিপাসাকে বলি—
এবার সুস্থির হও বিচলিত স্মৃতির পাহারা।
যে পথে; পাতার মর্মরে, বাঘের পায়ের ছাপ,
সে পথে আমরা নই—
ফিরে যাবে আমাদের ছায়া ও সন্তাপ…
কায়াপ্রাকার
মানুষের মুঠি থেকে পায়রার মতো কত স্বপ্ন উড়ে যায়!
পূর্বপূরুষের হেঁটে যাওয়া পথের ধূলিতে
লুপ্ত হয়ে আছে কত উড্ডীন অভিপ্রায়।
আমরা জানিনা কেউ—
কীরূপে এই বোধিঢেউ বাষ্পরূপে মিশে যাচ্ছে বায়ুর অভিধানে।
আমাদের নিঃশ্বাসযানে অস্তিত্বের পুষ্পমুদ্রা খোলে প্রাণিতপবন।
রক্তের গোপন গীটারে ছিন্ন পাতার ন্যায়
রচিত হচ্ছে যে দেহগান বোধের বাগানে
প্রকৃতি কিভাবে যে উন্মোচন করে তার গূঢ় প্রকাশনা, কে জানে!
হয়তো স্বপ্নসূত্রমূলে লেখা আছে ছায়ারহস্যের ভেদ।
আর কিছু নই; মর্মমাঝে
আমরা শুধু মাটি ও মেঘ মিশ্রিত মৌসুমী দিনের আখ্যান।
জানিনা কিভাবে কোন চন্দ্রগ্রস্ত ঘোরে, শরীরে শরীরে
হৃদয়ের ধ্বনিমূর্ছনা গেঁথে রচিত হচ্ছে
শরীরাতীত এক মহাজীবনের গান…
যে সুরে উঠেছি বেজে; পঞ্চশাখে—পাতার মর্মরে
ভাবি—আমাকে যে রচনা করেছে;
সে কোথা বসত করে—কোন্ সে বোধের নগরে?
ধানশুমারি
তবু একদিন কান্তপ্রাণ কৃষিজীবী মানুষের দেশে
তেভাগা স্বপ্নের সাথে কর্ষণের দিন আসে হেঁটে
তখন বৃষ্টির গন্ধে ভেজা সবুজ ধানের চারা
ভাতের প্রাচুর্য নিয়ে বেড়ে ওঠে পৃথিবীর পেটে।
হেমন্তের পাকা ধানে সোনালি রৌদ্রের রঙ
নবান্নের সুগন্ধি শুশ্রূষার মতো
এবার মর্মে মেখে ভেবেছি আরোগ্য করে নেব
অগ্নিতুল্য অনাহারী দিনের ক্ষত।
অনেক রক্ত ও ঘামের মূল্যে ফলানো সে ধান
যথারীতি জমা হয় মহাজনি ঋণের নিকটে
আর ভূমিহীন কৃষকের নিরন্ন মুখের জমিনে
কেবলি দীর্ঘশ্বাস, কেবলি হতাশার ফুল ফোটে।
ফসল কাটার পর শস্যকণা খুটে খাওয়া
পরিতৃপ্ত পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত মাঠ
নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাওয়া পৃথিবীতে
আমাকে শেখায় সম বণ্টনের পাঠ।
নিক্তি
সত্যের আলোয় মরে যায় যে অলীক আঁধার
এ জীবন আজন্ম বয়ে যায় জানি সেই মৃত্যুর ভার…
যে বৃক্ষটি খুন হলো আজ, তার পাশে যদি
আরেকটি চারার সবুজ স্বপ্ন বুনে দাও,
যদি ঘৃণার দেয়াল ভেঙে বুকের ভেতরে
ভালোবাসার অনির্বাণ আগুন জ্বালাও,
যদি নিরাশ্রয়ী পথশিশু ও পাখিদের
ফিরিয়ে দাও তাদের হারানো ভুবন
আর, মৃতপ্রায় নদীকে তার লুপ্ত জলধারা
তবেই সমতা পাবে পৃথিবীর সকল ওজন।