সুদর্শন বলে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁকে বলতেন ‘যুবরাজ’। হতে পারতেন তিনি সিনেমার অগণিত দর্শক অনুরাগীর স্বপ্নের নায়ক। কিন্তু হয়ে গেলেন জীবনকাব্যের নায়ক। সে-জীবন সিনেমার গল্পেরও অধিক লোমহর্ষক কিন্তু আনন্দদায়ক। এমনই এক সম্মোহনী সাহিত্য প্রতিভা তিনি নিজ দেশ ছেড়ে প্রথম জয় করেন ভিনদেশি এক রাজ্য।
বাংলাসাহিত্যের পাদপীঠ। তাঁর সাহিত্য জীবনের কলকাতা অধ্যায় তাই দারুন উপাদেয়। জগৎজোড়া খ্যাতির অধিকারী চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো একবার প্যারিসে সুন্দরী এক তরুণী চিত্রশিল্পীর প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছিলেন ‘ও কেন ছবি আঁকবে? ও তো নিজেই একটা শিল্প’। কবি বেলাল চৌধুরীর বর্ণাঢ্য জীবনকে সামনে রেখে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও একই ধরনের মন্তব্য করেন এই বলে যে, ‘বেলাল নিজেই লেখার এক বড় অধ্যায়।’ কলকাতায় বাংলা সাহিত্যের সুনীল অধ্যায়ে বেলাল চৌধুরীর ছায়াটা ছিল তাই অনেকখানি বিস্তৃত। তিনি সেখানে সমসাময়িক ও অগ্রজ সকল কবি ও সাহিত্যিকদের হৃদয়েই ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। কারণ, তিনি ছিলেন বোহেমিয়ান যাপনে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের চেয়েও একধাপ এগিয়ে। একথা অকপটে স্বীকারও করেন খোদ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
বাংলাদেশের ফেনী জেলার শর্শদির এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের বড় ছেলে কিভাবে সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলারে করে কলকাতায় পা রাখলেন এবং ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন সাহিত্য নক্ষত্র তথা জ্যোর্তিময় এক তারকা, সেদিকে আমরা যাবো না। ও পথে হাঁটবেন অনেকেই। শুধু বলবো, তাঁর মৃত্যু বাংলা সাহিত্যে এক বর্ণাঢ্য অধ্যায়ের সমাপ্তি, যা অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে। সে-আলোচনা হতে পারে তাঁর অনন্য সৃষ্টির যে কোনো দিক নিয়েই। যেমন কবিতা, উপন্যাস, আলোচনা, প্রবন্ধ, অনুবাদ এবং সাংবাদিকতা পর্ব। তাঁর সকল কর্মকান্ডই সাহিত্যনির্ভর, এমনকি সাংবাদিকতার মধ্যেও ছিল তাঁর সাহিত্যেরই পৃষ্টপোষকতা। ভারতীয় হাইকমিশনের সংস্কৃতি কেন্দ্রের মুখপত্র ‘ভারত বিচিত্রা’ ‘সম্পাদনায় সে-ভূমিকা সুদূর প্রসারী। এ ছাড়া এক সময়ের সাড়াজাগানো সাহিত্যপত্রিকা ‘সচিত্র সন্ধানী’-র সম্পাদনা পর্ষদে ছিলেন এবং ছিলেন সাপ্তাহিক ‘সন্দীপ’ পত্রিকার সম্পাদক।
কলকাতায় বন্ধুমহলের সংস্পর্শে সুনীলের ছদ্মবেশি রাজকুমার বেলাল চৌধুরীর কাছে আচমকাই ধরা দেয় কবিতা কুমারী, পরে তার প্রেমে সিরিয়াস হয়ে ওঠেন তিনি। সে কথা কোনে এক সাক্ষাৎকারে বলেও গেছেন।
সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনায় তাঁর বড় কৃতিত্ব সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত বিখ্যাত ‘কৃত্তিবাস’ সম্পাদনা। কবিতাচর্চার সাংগঠনিক ভূমিকায় তিনি ‘পদাবলী’ ও জাতীয় কবিতা পরিষদ এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ‘পদাবলী’ নামটাও তাঁরই দেয়া এবং এর মধ্য দিয়ে ঢাকায় দর্শনীর বিনিময়ে কবিতাপাঠ শুরু হয়। অনুবাদে তাঁর ভূমিকা ঈর্ষণীয়। কারণ, বিশ্বসাহিত্য পঠন-পাঠনে তাঁর জুড়ি বিরল। বিশ্বসাহিত্যের কোনো নক্ষত্র ঝরে গেলেই পত্রিকার পাতায় দেখা যেতো তাঁর অনুদিত লেখা। বইপাঠে তাঁর পরিচয় এতটাই কিংবদন্তিতুল্য যে, বেলাল চৌধুরী মানেই বই আর বই, সর্বজন স্বীকৃত। তাঁর আরও একটি বড় অর্জন তিনি স্বশিক্ষিত। এ জন্য স্টিফেন হকিংয়ের মতো তাঁরও কোনো আক্ষেপ ছিল না। কারণ, তিনি ঈশ্বর প্রদত্ত প্রতিভায় আলোকিত করে গেছেন জীবন ও জগৎ। তিনি ছিলেন সাহিত্য সজ্জন।
প্রতিভাকে শনাক্ত ও সুযোগ দিয়ে লেখক হয়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ফলে অতি-তরুণ থেকে সর্বমহলে ছিল তাঁর জনপ্রিয়তা। এ জন্য অনেকেই তাদের লেখায় গাঁথবেন স্মৃতিরমালা। রাজনৈতিক মতাদর্শেও তিনি কোনো প্রাচীর তোলেননি। যে-কারণে বেলাল চৌধুরী সর্বজন শ্রদ্ধেয় এক সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব। বেলাল চৌধুরী প্রথম ষাটের অন্যতম কবি। ফলে অগ্রজদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল নিবিড়। কবিতা. প্রবন্ধ. অনুবাদ. সম্পাদনা. শিশুসাহিত্য ও আত্মজীবনীসহ তাঁর গ্রন্থসংখ্যা অর্ধশত। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলি :
কবিতা : নিষাদ প্রদেশে (১৯৬৪), বেলাল চৌধুরীর কবিতা (১৯৭৩), আত্ম প্রতিকৃতি, স্থির জীবন ও নিসর্গ (১৯৭৫), স্বপ্নবন্দী (১৯৭৯), সেলাই করা ছায়া (১৯৮০), যাবজ্জীবন সশ্রম উল্লাসে (১৯৯৭), বত্রিশ নম্বর (১৯৯৭)।
প্রবন্ধ : কাগজে কলমে (১৯৯৭), পূর্ণ মণিজালে (২০১৪)।
আত্মজীবনী : নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায়, সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় ভেসে (২০১১)।
শিশুতোষ : সপ্তরতেœর কান্ডকারখানা (উপন্যাস, ১৯৮১), সবুজ ভাষার ছড়া (১৯৮৩), বত্রিশ দাঁত (১৯৮১)।
অনুবাদ : মৃত্যুর কড়ানাড়া (১৯৯৭)।
ভ্রমণ কাহিনী : সূর্য করোজ্জ্বল বনভূমি (১৯৬৪)।
পুরস্কার : বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৪), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৭), নীহাররঞ্জন পুরস্কার (১৯৯২), একুশে পদক (২০১৪)।
একজীবনে একজন লেখক বিচিত্র ধরণের লেখার জন্য সচেষ্ট থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। একজন লেখকের লেখার মধ্য দিয়েই তার সৃষ্টিশীল সত্তার উন্মোচন, তার জীবন ও অভিজ্ঞতার প্রতিফলন। জীবনভিজ্ঞতায় বেলাল চৌধুরী ছিলেন ঐশ^র্যবান। সৃজন সেখানে ধারা মাত্র। সৃজনধারায় বেলাল চৌধুরীও ছিলেন স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল। কলকাতায় বন্ধুমহলের সংস্পর্শে সুনীলের ছদ্মবেশি রাজকুমার বেলাল চৌধুরীর কাছে আচমকাই ধরা দেয় কবিতা কুমারী, পরে তার প্রেমে সিরিয়াস হয়ে ওঠেন তিনি। সে কথা কোনে এক সাক্ষাৎকারে বলেও গেছেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন বেলাল চৌধুরীকে ভৌগলিক সীমানার উর্ধ্বে ‘বিশ্বনাগরিক’ মর্যাদায় স্থান দেন তখন তাঁর উচ্চতা ও অনন্যতা সম্পর্কে আমাদের আর সন্দেহ থাকে কী?
চিত্রকলার মতো আমাদের কবিতারও যাত্রা শুরু বিমূর্তে, পরাবাস্তবতার আবহে, পরে তা জীবনের দিকে ফিরে, কবিতা হয়ে ওঠে জীবনমুখি বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। কবিতা তাই মুহুর্তের, কবিতা তাই চিরকালের। কিন্তু কার এবং কোন কবিতাটি হবে চিরকালীন, কেউ জানে না। তবে প্রত্যেক কবিই এক সময় অনুভব করেন চিরকালের আবেদন। প্রতিটি লেখকের বেলায়ই এটা ঘটে থাকে। বাস্তবতার খোলস থেকে বেরিয়ে আসে প্রকৃত জীবন। অস্তপারের টানে শেষদিকে বেলাল চৌধুরীর মধ্যেও সেই অনুরণন বেজে উঠেছিল বৈকি।
নির্বাসনে মৃত্যুদণ্ড-ঠাণ্ডা চোখে দেখছি আমি
নীল কুয়াশায় ঢাকা পড়ছে আমার দেহ।
তাঁর এই অনন্য পঙ্ক্তি যুগলের প্রতিভাষ্যে আমরা বলতে পারি জীবনে নির্বাসন মৃত্যুদণ্ডেরই সমান। আর মৃত্যু চিরনির্বাসন। ফলে নীলকুয়াশায় নয় কবির দেহ ঢাকা পড়েছে মৃত্যুর ধবধবে সাদা চাদরে। তিনি আর আমাদের মাঝে, জোড়া তালির জীবনে ফিরে আসবেন না তাঁর ‘সেলাই করা ছায়া’ নিয়ে। দীর্ঘ সাড়ে তিন মাস ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে জটিল নানারোগে চিকিৎসাধীন থেকে গত ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। জন্ম ১৯৩৮ সালের ১২ নভেম্বর। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। ফলে এ বিদায় তাঁর আকস্মিক ছিল না। তার জন্য হয়তো তিনি প্রস্তুতই ছিলেন। যদিও জীবদ্দশায় শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তাঁর মধ্যে ছিল তারুণ্য, ছিল সমানভাবে মস্তিষ্কও সক্রিয়।
বেলাল চৌধুরীর মৃত্যু আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি এ জন্য যে, তাঁর মতো অসাম্প্রদায়িক চেতনার ও সাদা মনের সাহিত্য পৃষ্ঠপোষক দ্বিতীয়টি আর মিলবে না। শুধু ব্যক্তি মানুষ হিসেবেই তিনি অনন্য নন, সাহিত্য সংগঠক হিসেবেও অতুলনীয়। এপার ওপারÑ দুইপারের সাহিত্য আন্দোলনেই যুক্ত ছিলেন। তাঁর জন্যই আজ দুই বাংলার সাহিত্যের মেলবন্ধন। তিনি ছিলেন এর অনুঘটক। জীবনের অর্ধেক তথা পুরোটা যৌবনই কাটান তিনি কলকাতার আলো বাতাসে। ১৯৭৪ সালে দেশে ফেরেন। কিন্তু কখনই ছিন্ন হয়নি তাঁর ভারতবন্ধন।
তাঁর মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের মন্তব্যে সেটা আরও জীবন্ত। তিনি যখন বলেন ‘বেলালের সঙ্গে আমার স্মৃতি শিশিরের মতো সতেজ। ও আসলে কলকাতারই মানুষ। কৃত্তিবাস এর জয়নিশান নিয়ে চলে গেছে বাংলাদেশে। ওকে নিয়ে আমার কখনই মনে হয়নি আমাদের মধ্যে কোন ভৌগলিক ব্যবধান আছে।’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন বেলাল চৌধুরীকে ভৌগলিক সীমানার উর্ধ্বে ‘বিশ্বনাগরিক’ মর্যাদায় স্থান দেন তখন তাঁর উচ্চতা ও অনন্যতা সম্পর্কে আমাদের আর সন্দেহ থাকে কী?
বেলাল চৌধুরী বহুবিধ পরিচয়েই অনন্য। কিন্তু সব পরিচয় ছাপিয়ে কবি হিসেবেই তিনি খ্যাত ও চিহ্নিত। জীবন শুষে নেয়া কবিতার কাছেই তিনি খুঁজেছিলেন অস্থির জীবনের সুস্থির বন্ধন।