উসখুস করলো অমিত। কথাটা কিভাবে যে উপস্থাপন করবে, বুঝতে পারছে না। ঘর ভর্তি লোক। সবার সামনে নিজ প্রয়োজনের কথা বলতেও সংকোচ লাগছে। বছর চারেক আগে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে অমিত। বিসিএস, ব্যাংক, প্রাইমারি স্কুল, বেসরকারি এমপিওভূক্ত স্কুল ও কলেজ সব জায়গায় চাকরির চেষ্টা করেছে ও।
হয়নি।
কোথাও ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি।
শেষে ঠিক করেছিল, কোনো কোম্পানিতে চাকরির চেষ্টা করবে।
করেও ছিল।
কিন্তু সেখানে আরও বেশি প্রতিযোগিতা।
একদিন হঠাৎ আলোর দিশা খুঁজে পেয়েছিল অমিত। একটা সেমিনারে গিয়ে চোখ খুলে গিয়েছিল ওর।
এক বক্তা সেদিন বলেছিলেন, ‘সবাই চাকরি করতে চায়। চাকরি দিতে চায় না কেউই। আপনি চাকরি দেওয়ার চেষ্টা করুন। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টান। জীবন পাল্টে যাবে।’
সত্যি পাল্টে গিয়েছিল সেদিন অমিত।
তুমি বরং সোহেলকে জিজ্ঞেস করতে নাও না। ও তো প্রতি কোরবানীর সময় চামড়ার ব্যবসা করে।’ শ্রাবণী, ওর স্ত্রী পরামর্শ দিলো।
ঢাকা শহর ছেড়েছিল তার পরদিনই। গ্রামে ফিরে এসেছিল। মনোযোগ দিয়েছিল কৃষিতে। সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছিল। ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন শুরু করল ও। প্রথমেই জায়গা বাছাই করল। ওদেরই একখন্ড জমি খালি ছিল। অমিত ঠিক করেছিল একটা স্কুল গড়ে তুলবে। সে লক্ষ্যে উঠে পড়ে লাগল ও। প্রথম প্রথম পরিশ্রম গেছে খুব। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রছাত্রী যোগাড় করতে হয়েছে। ছাত্রছাত্রী বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানের খরচও বেড়েছে। মাঝে মাঝে হতাশা চেপে ধরেছে ওকে।
শিক্ষকদের কয়েক মাসের বেতন পর্যন্ত দিতে পারেনি। কেউ কেউ চাকরি ছেড়েই চলে গেছে। দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল অমিত। স্কুল টিকে ছিল।
তখনই একজন বড় ভাই পরামর্শটা দিলেন।
‘সোবহান সাহেব এবার ইলেকশন করবে। তার কাছে যেতে পারিস।’
‘গিয়ে কী বলব?’ বুঝতে না পেরে বলল অমিত।
‘তোর প্রতিষ্ঠানের সমস্যার কথা বলবি। তুই তো ভালো উদ্যোগ নিয়েছিস। নেতারা সবসময় ভালো উদ্যোগের সাথে থাকতে চায়। উনি যদি একজন বা দুজন শিক্ষকের বেতনের দায়িত্ব নেন তাহলেও তো তোর বোঝা কমে যাবে।’
‘হ্যাঁ। যাওয়া কি ঠিক হবে?’
‘অবশ্যই যাবি। কার দ্বারা কোন উপকার হয়, কেউ বলতে পারে না।’
‘যাব?’ সন্দেহ করল অমিত।
‘তোর লেগেছে পিপাসা। পানি ভর্তি জগ কি তোর কাছে হেঁটে হেঁটে আসবে? তোকেই জগের কাছে যেতে হবে; বুঝেছিস?’
তাই অমিত নিজেই এসেছে সোবহান সাহেবের কাছে। এসে দেখছে অনেক ভিড়। অমিত ঠিক করল অপেক্ষা করবে।
অপেক্ষার পালা শেষ হলো একসময়।
খুক খুক করে কাশল অমিত।
‘আমি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানিয়েছি। প্রাইভেট স্কুল। আপনাকে পরিচালনা পরিষদে রাখতে চাই।’
‘কোন স্কুল?’
‘ইচ্ছামতী উচ্চ বিদ্যালয়।’
‘স্কুলের অবস্থা কেমন? ছাত্রছাত্রী কতজন? কোথায় অবস্থিত?’ একসাথে কয়েকটি প্রশ্ন করলেন সোবহান সাহেব।
অমিত খুলে বলল সব।
‘বেশ। ভালো প্রস্তাব। আমি ভেবে দেখব। তবে জানেন কি স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে গেলে আপনার দরকার ‘স্কিন’ টিচার। আপনি স্কুলের জন্য ‘স্কিন’ টিচার যোগাড় করুন। বেতন ঠেকবে না আশা করি।’
বাসায় এসে চিন্তায় পড়ে গেল অমিত। স্কিন মানে চামড়া। চামড়া বিষয়ে স্পেশালিস্টের কথা শুনেছে ।
এমন শিক্ষকের কথা জীবনেও শোনেনি অমিত। নিজের স্কুলের প্রধান শিক্ষককের কাছে বিষয়টা জেনে নিলে কেমন হয়।
‘এখন যে কত রকম সাবজেক্ট বের হয়েছে। হয়তো স্কিন সায়েন্স নামে কোনো সাবজেক্ট চালু হয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখ।’
হতাশ হয়ে অমিত ভাবল আর কাকে ফোন করে জানা যায়। মোবাইল ঘেটে ডাক্তার বন্ধু মামুনের নাম্বারে ফোন করল ও।
‘বন্ধু, স্কিন বিষয়ে শিক্ষক কোথায় পাব বলতে পারিস?’
‘শিক্ষকতা করতে করতে তোর মাথাটা গেছে। শিক্ষক নয়, স্কিন ডক্টর খুঁজছিস? আমার একজন মেডিকেলের স্যার স্কিন স্পেশালিস্ট। মাসখানেকের আগে এ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায় না। তুই বললে আমি আগেই পাওয়ার চেষ্টা করে দেখতে পারি।’
হতাশ হয়ে ফোনটা নামিয়ে রাখল অমিত।
‘অত চিন্তা করছ কেন গো। তুমি বরং সোহেলকে জিজ্ঞেস করতে নাও না। ও তো প্রতি কোরবানীর সময় চামড়ার ব্যবসা করে।’ শ্রাবণী, ওর স্ত্রী পরামর্শ দিলো।
‘উনি স্কিন টিচার বলেননি। বলতে চেয়েছেন স্কিলড টিচার। মানে দক্ষ শিক্ষক, বুঝেছ আব্বু?’
অমিতের ইচ্ছে হলো স্ত্রীকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলে।
অনেক কষ্টে রাগ দমন করল ও। ফোন করল শ্যালককে।
‘সোহেল, স্কিন টিচার সম্পর্কে কিছু জানো?’
‘দুলাভাই, চামড়া সংরক্ষণ করার জন্য এই নামে একটা পাউডার আছে। তবে খুব কম পাওয়া যায়। আমরা লবণ দিয়েই কাজ চালাই।’
কল কেটে দিয়ে এক দৃষ্টিতে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে রইল অমিত।
অসহায়ভাবে।
‘আব্বু তুমি কী খুঁজছ?’ শিখা জানতে চাইল।
টেবিলে বসে একমনে প্রাকটিক্যাল খাতায় ছবি আঁকছিল ও।
‘কিছু না মা।’
‘নেটে খুঁজে দেখতে পার।’
এই একটা জিনিস এখনো কমই বোঝে অমিত।
‘তুই খুঁজে দে।’
শিখা এসে ওর হাত থেকে মোবাইলটা নিল।
‘বলো কী খুঁজছ?’
‘স্কিন টিচার।’
‘দেখ কীভাবে খুঁজতে হয়।’
শিখা সার্চ বারে স্কিন টিচার লিখলো। অমনি রেজাল্ট হিসেবে একগাদা স্কিন বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের নাম এসে হাজির হলো।
‘এগুলো তো সব ডাক্তারদের প্রতিষ্ঠান? তুমি ঠিক কী খুঁজছ বলো তো?’
অমিত সব খুলে বলল।
শিখা মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।
‘হাসির কী হলো? আমি কি হাসির কথা বলেছি?’
‘তুমি আসলে তোমার নেতার কথা বুঝতে পারনি?’ হাসতে হাসতে বলল মেয়ে।
‘মানে?’
‘উনি স্কিন টিচার বলেননি। বলতে চেয়েছেন স্কিলড টিচার। মানে দক্ষ শিক্ষক, বুঝেছ আব্বু?’
এক কথাতেই অমিতের দক্ষতার বেলুন ফুটো করে দিলো শিখা।