রহমান সাহেব সায়েদাবাদ থেকে বাসে উঠেছেন। ভাদ্র মাসের গরম। বাসটা বেশ ফাঁকা বলে একটু রক্ষা। অল্প ক’জন লোক আছে। তার বিপরীত দিকের সিটের যাত্রী আরামে দাঁত খিলাচ্ছেন। সপ্তাহের ছুটিতে রহমান সাহেব বাড়িতে যাবেন। তার বাড়ি বেশি দূরে না। ঘণ্টা দু’য়েকের পথ। তার পাশের সিটটা খালি। সেটাও আরামের। হাত-পা ছড়িয়ে বসেছেন। বাসের সিট এমন চাপা যে দুই জন বসা বেশ ঝামেলার। তিনি মনে প্রাণে আশা করছেন যেন কেউ না বসে। একটু আরামে যাওয়া যাবে! কিন্তু তিনি নিশ্চিত যে বাসটা ছাড়ার আগেই একজন তার সহযাত্রী হবে এবং সেই লোকটা হবে একটু মোটাসোটা। তাকে ধাক্কা দিয়ে একদিকে সরিয়ে দিবে লোকটা। কিন্তু বাসে কেউ উঠলো না। দু’একজন উঠেও তার পাশে বসলো না। তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বাসটা ছাড়ার পর তিনি ঘুমের চেষ্টা করলেন।
একটু যেতে না যেতেই হকার উঠলো। মলম বিক্রেতা। কাঁধে ঝোলানো কালো রঙের ব্যাগ। সেটার চেইন খুলে বের করে আনলেন কয়েকটা মলম। এই মলম নাকি চুলকানির যম। একবার লাগালেই ব্যস! চুলকানির কথা বলতেই রহমান সাহেবের নিজের চুলকানির কথা মনে পরে গেলো। তার কুঁচকিতে দুই পাশেই চুলকানি হয়েছে। সেই চুলকানির মাত্রা এমন ভয়াবহ যে যেখানে সেখানে চুলকাতে হয়। অথচ একটা ডাক্তারের কাছে যে যাবেন সেই সময়ও পাচ্ছেন না। অফিসের কাজের চাপে থাকেন সারাক্ষণ। এই তো সেদিন অফিসের মিটিংয়ে তিনি বসেছিলেন বসের পাশেই। এমন সময় চুলকানিটা শুরু হলো যে তিনি না চুলকে থাকতেই পারলেন না। তিনি মিটিং বাদ দিয়ে চুলকোতে লাগলেন। বস তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালেন। কিন্তু চুলকানি বন্ধ হলো না। মিটিং শেষে তাকে ডেকে পাঠালেন।
কী ব্যাপার রহমান সাহেব, আপনার কী চুলকানিটা একটু বেশি?
প্রথমটায় তিনি বুঝতেই পারলেন না। কারণ তখন কোনো চুলকানি নেই। তিনি সবিনয় চিত্তে জানতে চাইলেন, কিসের চুলকানি স্যার?
মনে পরছে না? মিটিংয়ের সময় তো বেশ চুলকালেন? অবশ্য বাঙালি মানেই চুলকানি! এই চুলকানির জন্যই কিচ্ছু হচ্ছে না! আপনারও কিছু হয়নি। গত বিশ বছর ধরে আপনি একই পোষ্টে আছেন। প্রমোশন হবে হবে করেও হয় নি। অথচ আপনার যারা জুনিয়র তারাও প্রমোশন পেয়ে উপরে উঠে গেচে। তা আপনার চুলকানির ঘটনা কি? এই বয়সে তো চুলকানি হওয়ার কথা না! চুলকানি হলো যৌবনের ব্যাপার!
স্যার মানে কয়েকদিন ধরেই প্রচুর চুলকায়।
কে যেন মুখে ঘুষি দিয়ে নাকটা ফাটিয়ে দিলো। তারপর আরও উত্তম মাধ্যম শেষে বাস থেকে নামিয়ে দিলো। রাস্তার লোকজন তাকে হাসপাতালে পাঠালো।
তাহলে মলম-টলম কিছু একটা লাগান। তাহলেই তো ল্যাটা চুকে যায়? আমি বসে থাকতে যেভাবে দুই হাত প্যান্টের ভেতর দিয়ে চুলকোলেন তা অতি বিশ্রী দৃশ্য! এভাবে পাবলিকলি চুলকান দেখতে বিশ্রী লাগে!
জি স্যার।
তিনি বসের সামনে থেকে সেদিনের মতো উঠে আসেন। এভাবে বেইজ্জত হলে তো চাকরিটাই চলে যাবে! কিন্তু তার মলম কেনা হয়ে ওঠে না। মনেই থাকে না। বেশিরভাগ সময়ই চুলকানিটা থাকে না। বিশেষ বিশেষ সময়েই শুরু হয়। তার ধারণা এর সাথে মনেরও কোনো যোগাযোগ রয়েছে। মলমের সাথে সাথে তার একটা মানসিক ডাক্তারের কাছেও যাওয়া দরকার। কেন বিশেষ বিশেষ সময় চুলকায় তা জানতে হবে। এই তো কয়েকদিন আগে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছেন। তার সাথে অল্প বয়সী দুটো মেয়েও দাড়িয়ে আছে। কাঁধে ব্যাগ। মনে হয় ভার্সিটিতে পড়ে। হঠাৎ তার চুলকানি শুরু হয়ে গেলো। তিনি জায়গা ভুলে চুলকাতে লাগলেন। এই অবস্থা দেখে মেয়ে দুটো হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। এবং আশ্চর্য ব্যাপার হলো ঠিক তখনি তার চুলকানিটা থেমে গেলো। যাওয়ার সময় বলে গেলো, ভাই মলম টলম কিছু একটা লাগান! তার মেয়ের বয়সী মেয়ে তাকে বলছে, ভাই! এই চুলকানিটাই যত নষ্টের মূলে।
এদিকে বাড়িতে তার বউয়ের কাছেও মুখ ঝামটা শুনতে হয় এই চুলকানির জন্য। টেবিলে খেতে বসে চুলকানিটা ওঠে। তিনি খাওয়া রেখে চুলকাতে গেলে বউটা খেপে যায় তার উপর। দশটা কথা শুনিয়ে দেয়। সেও তাকে মলম কেনার উপদেশ দিয়ে ঝগড়া শেষ করে।
আজ বাসে সেই মলম দেখে সুযোগটা হাতছাড়া করতে চান না রহমান সাহেব। মলম বিক্রেতাকে ডেকে নিয়ে দশ টাকা দিয়ে একটা মলম কিনে নেয়। তারপর হাতের মধ্যে রেখেই হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে যায়। ততক্ষণে বাসও এগিয়ে চলে। কখন যে তার পাশের সিটে একজন ভদ্রলোক বসেছেন তিনি জানতেই পারেন না।
চোখ খুলে তাকে দেখে তিনি বেশ বিরক্ত হন। তারপরই তার মনে পরে মলমটার কথা। এখন চুলকাচ্ছে। বিক্রেতা বলেছিল একবার লাগালেই আরাম। সেটা প্রয়োগ করে দেখা যায়। এখানে কেউ দেখার নেই। তিনি মুঠো থেকে মলমটা বের করেন। তারপর তা খুলে আঙুলে লাগান। ঠিক এই সময় পাশের যাত্রীটা চিৎকার দিয়ে ওঠে। মলম পার্টি, মলম পার্র্টি , আমাকে মেরে ফেললো। বাঁচা বাঁচাও করে চিৎকার করে ওঠেন। এদিকে রহমান সাহেব সবেমাত্র মলমটা লাগাতে যাচ্ছিলেন কিন্তু পাশের যাত্রীর এই চিৎকারে তিনি বেশ ভয় পেয়ে যান। তিনি ভয়ার্ত কণ্ঠে জানতে চান, কোথায় মলম পার্টি?
রহমত সাহেব ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি তার সহযাত্রীটি তাকেই মলম পার্টির সদস্য ভেবে বসেছে। ততক্ষণে আরও লোক তার কাছে জড়ো হয়েছে। সহযাত্রীটি রহমান সাহেবকে হাত দিয়ে মলম পার্টির সদস্য হিসেবে দেখিয়ে দেয়। তার হাতে তখনো মলমটা ধরা আছে। আর যায় কোথায়! কে যেন মুখে ঘুষি দিয়ে নাকটা ফাটিয়ে দিলো। তারপর আরও উত্তম মাধ্যম শেষে বাস থেকে নামিয়ে দিলো। রাস্তার লোকজন তাকে হাসপাতালে পাঠালো। যখন তাকে গাড়িতে তোরা হচ্ছিল তিনি ক্ষতবিক্ষত মুখে বলছিলেন, ভাই আমার মলমটা একটু খুঁজে দেন! দশ টাকা দিয়ে কিনেছি। আমার চুলকানি!