মনছুর। পুরো নাম মনছুর হাসান। তরুণ লেখক। মাঝে মাঝে পত্রিকায় তার গল্প ছাপা হয়। সে সাধারণত সিরিয়াস ধরনের গল্প লিখে থাকে। সে সিরিয়াস লেখক হতে চায়। আজ হঠাৎ তার মনে হল, মাঝে মাঝে হালকা হাস্য-রসের গল্পও লেখা উচিত। কারণ দেশে সিরিয়াস গল্পের পাঠক কম। সিরিয়াস লেখক হয়ে বসে থাকলে লাভ হবে না। প্রকাশকদের কাছে সিরিয়াস লেখকদের কদর নেই।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। মনছুর বসে গেল কাগজ-কলম নিয়ে। মনের মতো একটা লাইন খুঁজে পাওয়ার আগেই দরজা ঠেলে ঢুকলো মজনু। সে মনছুরদের বাড়িতে আছে অনেক দিন। কাজে-কর্মে ভালো। আচার-আচরণেও। সমস্যা শুধু সময়-অসময়ে যার-তার ঘরে ঢুকে পড়ে। একটু গলা খাকারিও দেয় না। মজনু বললো, ভাইজান, আপনার ঘর ঝাট দিতে এলাম।
: ঝটপট ঝাট দিয়ে চলে যা।
এ কথা বলার পর মনছুরের জিহ্বায় কামড় পড়লো। পাগলকে সাঁকো না নাড়াতে বলা হলো যে। মজনু হাতের ঝাড়ু ফেলে মনছুরের কাছে এসে বসলো। বললো, কী লেখেন ভাইজান?
: গল্প।
: কিসের গল্প?
: হাসির গল্প।
মজনুর মুখ শুকিয়ে গেলো। টাসকি খাওয়া কণ্ঠে বললো, ভাইজান, আইজ সাত বছর আপনাদের সাথে আছি। কোনোদিন আমারে নিয়া একটা গল্প লিখলেন না, আর হাসি আসতে না আসতেই।
: আরে এটা কাজের মেয়ে হাসির গল্প না। এই হাসি মানে লাফ। এ ধরনের গল্পকে বলে রম্যগল্প। যে গল্প পড়ে।
: ভাইজান, মজনু এত বোকা না যে শাক দিয়া মাছ ঢাকলেন আর মজনু কিছু টের পাইলো না। শাকের নিচ থিকা মাছ বার করার ক্ষমতা মজনুর আছে। আইজ থিকা আমি আর আপনার ঘরের কোনো কাজ করবো না। হাসিরে নিয়া গল্প লিখতেছেন হাসিই আপনার সব কাজ করবে।
মজনু ঝাড়ু ফেলে চলে গেলো। মনছুরের খুব হাসি পেলো। হাসির গল্প লেখার আগেই চমৎকার একটা হাসির কাণ্ড ঘটে গেলো। গল্পটা জমবে খুব। মিনিট পনেরো ভাবার পর মনছুর যুতসই একটা লাইন পেয়ে গেলো। যেই লাইনটা লিখতে যাবে, অমনি ঘরে এল হাসি। বললো, ভাইজান, পা-টা একটু বার করেন।
: পা বের করতে হবে না, তুই অন্য দিক দিয়ে ঝাড়ু দে’।
: আপনারে পা বার করতে বলছি, বার করেন।
মনছুর পা বের করতেই হাসি একটা সালাম করে বসলো। মনছুর বললো, হঠাৎ সালাম কেন?
: এখন থেকে আপনার ঘরের সব কাজ আমি করে দেবো।
: আমার কাজ তো করে মজনু।
: সে আর আপনার কাজ করবে না।
: কেন?
: মানুষ হইলো হিংসুটে জাত। অন্যের ভালো দেখতে পারে না, অন্যের সুনাম সহ্য করতে পারে না।
: হিংসার কী হলো?
: এই যে আপনে আমারে নিয়া গল্প লিখতেছেন, তাতে সে হিংসায় জ্বলে মরছে।
: আমি তোকে নিয়ে গল্প লিখছি না। এই হাসি মানে লাফ। এই গল্প পড়ে পাঠক হা-হা, হি-হি করে হাসবে।
: হাসবে তা জানি। গরিবের জীবন কাহিনি শুনে মানুষ শুধু হাসেই। তারপরও তো লেখকরা লেখে। ভাইজান, আমার জীবনে একটুখানি প্রেম আছে। কাহিনিটা আপনারে বলতে চাই। তাহলে গল্পটা আরও…
: তুই তোর কাজ করে চলে যা।
হাসি শুরু করলো তার ঘর ঝাট দেওয়ার কাজ। সে এমনভাবে ঝাড়ু চালাতে লাগলো যেন কোথাও একটা কুটোও রাখবে না। ধুলো ওড়া শুরু হলো। মনছুরের সাইনোসাইটসের সমস্যা আছে। শুরু হলো হাঁচি। মনছুরের মেজাজ ফোরটি নাইন। মানে অতিশয় গরম মেজাজ। তার ইচ্ছে হলো হাসি মেয়েটার গালে একটা থাপ্পড় মারতে। কিন্তু সে তা পারবে না। থাপ্পড় খেয়ে হাসি যদি চাকরি ছেড়ে চলে যায় মা তাকেও বাসা থেকে বের করে দেবে। হাসির যাওয়ার জায়গার অভাব নেই, কিন্তু তাড়িয়ে দিলে তার যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। এমতাবস্থায় এক টুকরো মাকড়সার ঝুল এসে পড়লো মনছুরের খাতার ওপর। আর তখনই তার মনে করা লাইনটা গেলো হারিয়ে। হাসি বললো, ভাইজান, যার সাথে আমার প্রেম ছিল তার নাম ফজা। পুরো নাম ফজর আলী মোল্লা। মোল্লা বংশ-ভালো বংশ। আমার প্রথম থিকাই ইচ্ছা ছিল, প্রেম যদি করিই তো ভালো বংশের ছেলের সাথে করবো।
: তুই থামবি?
: ওমা! ধমক দিচ্ছেন কেন? আমার প্রেম-আমার বিরহ না জানলে আমার জীবনের গল্প লিখবেন ক্যামনে?
মনছুর খাতা বন্ধ করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। গিয়ে বসলো মতি মিয়ার চায়ের দোকানে। এককাপ লেবু চা অর্ডার করলো। লেবু চা খাওয়ার পর সে দেখলো তার মেজাজ ফোরটি নাইন থেকে নেমে টোয়েন্টি ফোরে চলে এসেছে। টোয়েন্টি ফোর হলো মোটামুটি শান্ত মেজাজ। সে নিজেকে বোঝালো, হাসির গল্প লিখতে গিয়ে হাসির কাণ্ড ঘটছে এটা ভালো লক্ষণ।
এখন হাসি মেয়েটা নেই। এখন আর হাসির গল্প লিখতে কোনো বাধা নেই। এমন হাসির গল্প লিখবি যা পড়ে হাসতে হাসতে পাঠকের পেটে খিল লেগে যাবে।
মনছুর বাসায় ফিরে দেখে হাসি ঘরটা একেবারে ঝকঝকে-তকতকে করে ফেলেছে। বিছানা আর টেবিলটাও সুন্দরভাবে গুছিয়ে গেছে। মনছুরের মনে প্রশান্তি নেমে এলো। সে দরজাটায় খিল এঁটে নব উদ্যোমে গল্প লিখতে বসলো। হাসির গল্প। দম ফাটা হাসির গল্প লিখবে সে। যে গল্পের প্রতিটা শব্দের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকবে হাসি। হাসতে হাসতে পাঠকের পেটে খিল লেগে যাবে। পেট ব্যথা হয়ে যাবে। কাশি চলে আসবে। চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে আসবে।
কলমের মুখ খুলতে না খুলতেই দরজায় খটখট। ভীষণ জোরে। নিশ্চয় বাবা। হয়তো বাসার কোনো সুইচ বা পাখার রেগুলেটর নষ্ট হয়ে গেছে। বাসার কিছু নষ্ট হলেই বাবার মাথা খারাপ হয়ে যায়। কিনে আনো সুইচ, ডেকে আনো লোক এমনটি শুরু করে দেন।
মনছুর দরজা খুলে দেখে বাবা না, মা শাহিদা বেগম দাঁড়িয়ে। শাহিদা বেগম বাজখাই গলায় বললেন, কী হচ্ছে এসব?
: কী মা?
: দ্যাখ, বাংলা সিনেমার কাহিনি আমার বাসায় চলবে না।
: কিছু বুঝতে পারছি না মা।
: কাজের মেয়ের সাথে প্রেম-পিরিতি বাংলা সিনেমায় দেখা যায়।
: মা।
: তুই হাসিকে নিয়ে গল্প লিখছিস কেন?
: ও এই কথা।
মনছুর হেসে উঠলো। শাহিদা বেগমের হাত ধরে বললো, বসো মা, বলছি আসল কথা।
শাহিদা বেগম বসলেন না। বললেন, আসল-নকল বুঝি না। আবার যদি শুনি তুই ওকে নিয়ে…
: মা এই হাসি মানে ও না, এই হাসি মানে লাফ। এই গল্প পড়ে…
: আমাকে মদন ভাবিস না। চৌত্রিশ বছর আমার মা আমার বাবাকে মদন বানিয়ে রেখেছিল। আমি সেই মায়ের মেয়ে। আটাশ বছর ধরে তোর বাবাকে মদন বানিয়ে রেখেছি আর তুই…
: মা, আমি আমার মতো গল্প লিখবো অথচ তোমরা…
: তোর মতো গল্প লিখবি তাই বলে কাজের মেয়ে নিয়ে? তোর লেখক হওয়া বন্ধ। লেখক হওয়ার কোনো দরকার নাই। লেখক মানেই আওলা-ঝাওলা জাতের মানুষ। তোর ছোট খালা যদি শোনে তুই এই মেয়ের সাথে…আমার মুখ থাকবে?
: মা।
: চুপ! করে বসে থাক।
সব নষ্টের মূল ব্যাটা মজনু। আর মজনুর দোষ দিয়েই বা কী হবে। সে অশিক্ষিত মানুষ। মা তো নাইন পর্যন্ত পড়েছে। ছাত্রী হিসাবে নাকি অতিশয় ভালো ছিল। তখন দাদার চোখে পড়ে না গেলে আজ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার থাকতো। স্টুডেন্ট লাইফ-এ মা নাকি মুজতবা আলী আর জসিমউদ্দিনের হাসির গল্প পড়ে দিন-রাত হাসত। সেই মা এখন হাসির গল্প বুঝতে পারছে না। কিন্তু থামলে চলবে না। একটা হাসির গল্প লিখতেই হবে।
রাত দশটা। মনছুর জানালার পাশে বসে মনে মনে হাসির গল্প বানাচ্ছিল। এমন সময় হাসি এলো। হাতে এক কাপ চা। মনছুর রাগি কণ্ঠে বললো, আমি তোর কাছে চা চেয়েছি?
: সব সময় কি সবকিছু চাওন লাগে? না চাইলেও মাঝে মাঝে কিছু দিতে হয়।
মনছুর চায়ের কাপ হাতে নিলো। হাসি বসে পড়লো ফ্লোরে। বসেই শুরু করলো, ভাইজান, রাতের মধ্যে কি আমার গল্পটা লেখা শেষ করবেন? তায়লে আমার প্রেম কাহিনিটা শুনায়া যাই। ওই যে বলেছিলাম প্রেম যদি করতেই হয় তো ভালো বংশের ছেলের সাথে করব। ফজর আলীর বংশ ভারেঅ ছিল। মোল্লা বংশ। সে দেখতে-শুনতেও খারাপ ছিল না। নায়ক সাকিব খান টাইপের চেহারা। ঝামেলা বাধালো তার বাপ ফখরুদ্দিন মোল্লা। তারও আমারে পছন্দ। সবাই রূপ নিয়া গর্ব করে। আমি তা করি না ভাইজান। তয় এই রূপ আমারে পদে পদে ঝামেলায় ফেলেছে। যে বাসায় কাজ করতে গেছি…
: তুই যাবি এখান থেকে? তুই আর কোনোদিন আমার ঘরে আসবি না।
: রূপের জন্য প্রেম আমার পিছ ছাড়ে না। আল্লারে ডাইকা বলি, এত রূপ আমারে ক্যান…
হঠাৎ ঝটকা দিয়ে দরজা খুলে গেলো। শাহিদা বেগম হাজির। চিৎকার করে উঠলো, ও আমার রূপের রানিরে! শয়তান মেয়ে, আমার ছেলের লেখক আবেগ নিয়ে…
শাহিদা বেগম হাসিকে হিড়হিড় করে টেনে বের করে নিয়ে গেলেন।
একটু পর বাড়ান্দায় শাহিদা বেগমের উচ্চকণ্ঠ। তিনি মোবাইলফোনে মনছুরের ছোট খালাকে বলছেন, তুই কাল সকালে এই হাসি মেয়েকে নিয়ে যাবি। এরপর তুই এমন মেয়ে দিবি, যে মেয়ের গায়ের রঙ আলকাতরার মতো। মুখে গভীর বসন্তের দাগ। চোখ থাকবে ট্যারা। তারপরও ছেলে নিয়ে শান্তি পাবো কি না, জানি না। পোড়া কপাল আমার। মানুষের ছেলেরা হয় ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, জজ-ব্যারিস্টার আর আমার ছেলে হয়েছে লেখক। লেখক মানেই আওলা-ঝাওলা পাবলিক।
মনছুরের অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম এলো না। একটা দমফাটা হাসির গল্প লিখতে গিয়ে কি বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপারই না ঘটে যাচ্ছে। সে শেষ রাতে স্বপ্ন দেখে কে যেন তাকে ঠেলে কুয়োর মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করেও নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না। ঠিক যখন কুয়োয় পড়ে যাবে, তখন ধড়পড়িয়ে মনছুরের ঘুম ভেঙে যায়। দেখে ছোট খালা তাকে ঠেলছে। সে জেগে উঠতেই ছোট খালা রোশনারা বেগম চিৎকার শুরু করে দিলো, কিরে, ঘটনা কী? তুইও তো বাপের মতো হয়েছিস। তোর বাপের জন্য তোর মা কাজের মেয়ে রাখতে পারেনি। একবার একটা কাজের মেয়ে রেখেছিল। তোর বাপ জোড়ায় জোড়ায় শাড়ি আনতো। তোর মা’র জন্য একটা আর….। এখন তোর বাপ বুড়া হয়েছে বলে একটা কাজের মেয়ে দিলাম আর তুই।
মনছুর বাবার নামে অপবাদ হজম করতে পারলো না। সে প্রতিবাদ করে বললো, জোড়ায় জোড়ায় কাপড় কেনার সাথে খারাপ কোনো সম্পর্ক খোঁজা ঠিক না। নিয়ম হলো, তোমরা যা খাবে বাড়ির চাকরদেরও তা খাওয়াবে, তোমরা যা পরবে…
: ওরে আমার নিয়মওয়ালা! তোদের মত লেখকদের সব নিয়ম প্রেম-পিরিতির বেলায়। এতখানি বয়সে কোনো ব্যাটারে তো দেখলাম না বউ আর কাজের মেয়ের জন্য একই কাপড় আনলো।
: তারা মানবিক না।
: তুই আর তোর বাপ গ্রেট মানবিক। আমার মেয়ে ফ্যান্সিকে তোর জন্য ঠিক করে রেখেছি। এমন রূপবতী মেয়ে রেখে তুই কিনা ছিঃ ছিঃ!
মনছুর বলতে চেয়েছিল, খালা, হাতির মতো মোটা মেয়ে বুঝি রূপবতী হয়? আপনার মেয়ে তো এক খাওয়া ছাড়া আর কিছুই ভালো করে শেখেনি। কিন্তু বললো না। মনছুর মানুষের দুর্বল পয়েন্টে টাচ করতে পারে না। ছোট খালা হাসিকে নিয়ে চলে গেলো।
রাতে বাবা মোর্শেদ হাসান এলেন মনছুরের ঘরে। বললেন, কিছু কিছু ব্যাপার মাথায় রেখে গল্প লিখতে হবে। বাসায় হাসি নামের কোনো কাজের সহায়ক মেয়ে থাকলে হাসির গল্প লেখার কথা প্রচার করা যাবে না। তোর জন্মের পর করুণা নামের একটা মেয়েকে আনা হলো বাসার কাজের সহায়ত হিসেবে। মেয়েটা শতেক তালি দেওয়া কাপড় পরে থাকে, তাই দেখে…
: বাবা প্লিজ, আমি অতীত শুনতে চাচ্ছি না।
: যাকগে, এখন হাসি মেয়েটা নেই। এখন আর হাসির গল্প লিখতে কোনো বাধা নেই। এমন হাসির গল্প লিখবি যা পড়ে হাসতে হাসতে পাঠকের পেটে খিল লেগে যাবে।
মনছুর লিখতে শুরু করলো, মেয়েটার নাম হাসি। খুব চটপটে। মুখের ডান পাশে একটা তিল। হাসলে বাম গালে টোল পড়ে। কপালে একটা কাটা দাগ। কাটা দাগ যে মানুষকে এতটা সুন্দর….
মনছুর সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখলো, সে কী লিখছে এসব? ধুর! এ কি দম ফাটা হাসির গল্প? মনছুর খাতা বন্ধ করলো। তার চোখে ভেসে উঠলো হাসির মুখ। মেয়েটার সঙ্গে ছোট খালা নিশ্চয় খুব খারাপ ব্যবহার করতেছে।