ব্যাপারটা এমন ছিল, যেন হঠাৎ করে কোনো আপনজনকে হারিয়েছি আমি। আমার কাছে টাকা-পয়সার কোনো ব্যাপার ছিল না। যেটা ছিল অনাবিল ভালোবাসা—নদীর স্রোতের মতন। অনেকটা এমন মনে হয়েছিল, যেন হঠাৎ করে মাথার ওপর আপন-জনের যে মায়া; হঠাৎ ঝড়ে হারিয়ে গেল! বড্ড অসহায় সময়টা; ভেঙে পড়েছিলাম আমি। এ ব্যাপারটা আমি কাউকে বোঝাতে পারব না। কোনো গল্পের মতন নয়। এ আসলে হেসে-খেলে মুখোশের পৃথিবীর একটা অংশ।
মেহেরকে আমি পেটে ধরিনি, আত্মায় ধরেছি। আমার স্বামীর বড় ভাইয়ের মেয়ে মেহের। ও জন্ম নেওয়ার সময় ওর মা যতটা না খুশি হয়েছিল, তার চেয়ে খুব বেশি কম খুশি হয়েছি বলে মনে হয় না। অন্তত আমার মনে এমনই। ভালোবাসা নদীর স্রোতের মতন। মেহেরকে আমি ‘মা’ বলে ডাকতাম। ডাকতাম বলছি, খুব কষ্ট লাগছে, বুক ভেঙে যাচ্ছে এ কথা বলতে! আমার ছোট্ট সোনাটাকে এই হাত দিয়ে হাঁটা শিখিয়েছি। ছোট্ট-ছোট্ট পা। বাচ্চাটা কান্না করলে কাজের মেয়েটা পিঠে জোরে জোরে থাপ্পড় দিত। বাচ্চাটা ব্যথা না পাওয়ার ভয়ে কান্না থামাত। এটা দেখার পর আমার অনুধাবন হয় যে এ বাচ্চাটার আসলে আমাকে দরকার। প্রকৃতি নিজের প্রয়োজনে ছোট্ট ফেরেশতাটার কাছে টেনে এনেছিল আমাকে। বুকের সব ভালোবাসা দিয়ে বাচ্চাটাকে আগলে রাখি। মেহেরটাও আমাকে খুঁজতে থাকে। আমার এই হাতের আঙুল ধরে ধরে হাঁটতে শেখে। আমি হলাম ওর ‘ছোট মা’। সারা ঘর আমাদের হাসি-আনন্দে ভেসে যায়। সে এক রূপকথার সময়। আমার ছোট্ট সোনাটাকে নিয়ে আমি স্বপ্নের ঘর সাজাই।
আমার স্বামী বলে, যেভাবে তুমি ওকে ভালোবাসছ, আমার তো মনে হয় এভাবে থাকলে তুমি নিজের কোনো সন্তানই নেবে না।
আমি হেসে বলি, তুমি বেশি বোঝো। মেহেরতো আমাদেরই বাচ্চা।
বিশ্বাস করো মেহের আমি ওকে অনেক বেশি ভালোবাসি। আপনার ছোট বাবার চেয়েও বেশি মামুনি। আমি জানি আমার এই আকুতি কোনোদিনই মেহেরের কাছে পৌঁছাবে না। মেহের বড় হয়ে জানতে পারবে না কিছু। না জানুক। এতেই ওর ভালো।
মেহেরকে ওর মা ঠিকমতো সময় দিত না। বললাম না প্রকৃতি! প্রকৃতি ঠিক সে সময়টুকু তাকে দেওয়ার জন্য আমাকে ওর কাছাকাছি নিয়ে গেল। আমাকে মা ডাকে মেহের। প্রকৃতির এ নিষ্ঠুর ব্যাপারটা ওর মায়ের ভালো লাগেনি।
মেহেরের প্রথম জন্মদিনে আমি তাঁতীবাজারে গিয়ে স্বর্ণের ব্রেসলেট অর্ডার করে আনলাম, ছানার মালপোয়া আনালাম। মেহেরের বাবা-মায়ের ঔদাসীন্য দেখে ওর ছোট বাবা কেকের অর্ডার দিল। কিন্তু আপনার জন্য কোনো জন্মদিনের পোশাক কিনিনি মামুনি। সেজন্য সরি বাবু। সেদিন ওর ব্যস্ত বাবা-মা রাত এগারটায় বাসায় আসলেন। আমাদের স্বামী-স্ত্রীর কাণ্ড কারখানা দেখে এত্তটুকু মেহের বুঝতে পেরেছিল, সেদিন ওর জন্য বিশেষ কোনো দিন। বাবা-মা আসলে ও মুখ ভার করে রাখল। মেহেরের মা বাসায় এসেই আমার স্বামীর সঙ্গে রাগ করছিল। রাত সাড়ে এগারোটায় তার চাচাত বোন-বোনের স্বামীকে ডেকে নিয়ে এলো। এরপর কেক কাটার সময় পরিকল্পনা মাফিক আমাদের স্বামী-স্ত্রী দু’জনকে আমার স্বামীর বড় ভাই মানে মেহেরের বাবা গালাগাল শুরু করলেন। আমার স্বামীকে আমি বলেছিলাম, সেদিন যদি সে কিছু বলে, তবে আমি ঘর থেকে বের হয়ে যাব। ও কিছু বলেনি সেদিন, শুধু জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল। মেহের অবাক হয়ে ওর বাবার রূপ দেখছিল।
যাই হোক, ওর ছোট বাবা সেদিন একটা শব্দ করতে পারেনি—এটাই আমার শান্তি। মেহের বড় হয়ে জানবে না কোনোদিন, ওর প্রথম জন্মদিনটাকে ওর মা ছল করতে ছাড়েনি। সব বুঝতে পারছিলাম সোনা, কিন্তু তোর ছোট্ট হাত ধরে হাঁটতে শিখিয়েছি। আমাকে প্রথম তুই-ই মা ডেকেছিলি। এরপর আবার রাত সাড়ে বারোটায় ওর ব্যস্ত বাবা-মা বাসা থেকে বের হয়ে যায়। ফিরে রাত সাড়ে তিনটায়। সমাজের তথাকথিত সোসাইটিটা বড্ড বিচ্ছিরি রে মা! তোকে লোক দেখানো কত কিছুই দেখতে হবে সামনে!
আমি শুনেছি মামনি, আমার কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়ার পরও তুমি মা মা করেছ—কোনো মেয়েকে দেখলে মা বলে ডাকতে। আমি বুঝি রে সোনা, তুই তো আমার কাছ থেকেই মা ডাকটা শিখেছিলি।
এরপরও আমরা সেখানে আরও কিছুদিন ছিলাম। তোর বাবার আচরণে বুঝে গিয়েছিলাম আমাদের সেখানে থাকা উচিত নয়। কিন্তু তোর থেকে দূরে যেতে হবে ব্যাপারটা ভাবতে পারছিলাম না। খুব কেঁদেছি সোনামানিক। সে যে চুপচাপ সয়ে যাওয়া, সেটাকেও রঙ লাগানো হয়েছে অনেক। তোর ছোট বাবা ম্যাজিক দেখাল জানিস। এত্ত রাগি মানুষটা তোর ভালোবাসায় চুপ হয়ে রইল ক’টা মাস। এরপর তোকে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিল। আমরা দু’দিন-তিনদিন পর হয়ত দু’মিনিট কিংবা ভাগ্য ভালো হলে পাঁচ মিনিটের জন্য তোকে দেখার সুযোগ পেতাম। তোর ছোট বাবা আমাকে শক্ত হতে বলত। এরপর কী হত জানিস মা? তোর ছোট বাবা নিজেই কাঁদতে বসত। এসব কথা বলছি আর তোর ছোট্ট মুখটা চোখে ভাসছে ছোট্ট সোনা আমার।
আমরা আরো দুটো মাস ছিলাম সেখানে। শেষের দিকে তোর ছোট বাবাকে খাবার দেওয়া হতো ফকিরের মতো আর আমার জন্য তোর মা খাবার দিত না। আমরা এই অভাগী দুজন তোর জন্য থাকতে চেয়েছিলাম মামনি। কিন্তু পারলাম কই! চলে আসার দিন কেউ সামনে ছিল না। তোর ঘুম ভাঙা ফোলা ফোলা চোখ দুটো রেখে চলে এসেছি। আমরা আর কোনোদিন আসব না মা। এটাই ছিল শেষ দেখা। কারণ এরপর যদি দেখতে চাই, আমাদের তোর কাছে দোষী করে রাখবে সোনা। সে দৃশ্য দেখার চেয়ে তোকে কোলে নিয়ে যেসব স্মৃতি, সেগুলোকেই সুন্দর করে সাজিয়ে রাখব মানিক।
দূর থেকে দোয়া করি তুই বড় হ! ভালো থাকিস আমার ছোট্ট জানপাখি।