যোজন যোজন দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেরা
এখনও কি ফেরে খড়ের গাদার গন্ধমাখা বিকেল
বউচি আর গোল্লাছুটে অস্থির গোধূলিনামা সন্ধ্যা;
ঘুড়ি-লাটাই হাতে তুমুল উচ্ছ্বাসে
. ক্ষেতের আইল মাড়ানো দিন?
এখনও কি বকধরা সকালে বাউথ নামে খোনকার বিলে;
তরমুজ আর বাঙ্গির টালে পিপাসার তপ্ত দুপুর
. কি এখনও ঝিমোয়?
সরবীর কাঁদি থেকে কলা ছিঁড়ে পালিয়ে যাওয়া
কিশোরের স্যান্ডো গেঞ্জিতে
. এখন কষ জমে কি না জানি না,
নদী থেকে আজলায় তোলা জলে
এখনও কি তার পিপাসা মেটে?
রাখালের নিঃসঙ্গ বাঁশি কি এখন
. গাছের ছায়ায় দুপুর নামায়?
এখনও কি দরদর করে ঘাম নামে কৃষকের শরীরে?
বর্ষার তুমুল বৃষ্টিতে ডুবসাঁতারে
. এখনও কি কাটা হয় স্বপ্নের ফসল?
কাইত্যানের দিনে হরি কাকার দোকানে
. আজকাল কি তাসের আসর জমে?
এখনও কি হোগলার বেড়া বেয়ে
. মালতীদের মুরগির বাচ্চা ধরতে আসে গুঁইসাপ?
মেঘ-বজ্রের ভয়ে গরুর পাল কি এখনও গোয়ালে ছোটে?
আলতা মাখা পায়ে গোবর জড়ানোর পরও
. চাড়িতে পানি দিত যে গেরস্ত বউ
যার নথ বেয়ে চুয়ে পড়ত ঘাম আর ভালোবাসা
তার কাছে নবান্ন ফেরে কি না জানি না;
তেল চুপচুপে মাথায় বেণী দোলাত যে কিশোরী
যার অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছিল বলে
চোখে দেখেছিলাম নাড়ার আগুন
সেই কিশোরী স্বামীর ঘর করেনি
সে কি আবার পরিণত বয়সে সংসারে ফিরেছে?
এই সব ফেরা না ফেরার অভিজ্ঞানে
শব্দজ্ঞানহীন এই আমার যে ফিরতে ইচ্ছে করে—
আমিতো ফিরতে চাই কুপির আলোর গ্রামে
যেখানে নাইট স্কুলে বসা কোরবান দাদার অস্পষ্ট উচ্চারণে
বর্ণমালা মুক্তি পাচ্ছে।
রাতের স্তব্ধতা ছিঁড়ে যে নদীতে জাগে বোয়ালের খলখলানি
সেই নদীর কোল জুড়ে বসাতে চাই হারিকেনের পাহারা
আর বড়শির মুখে তুলে দিতে চাই হারানো শৈশব।
মাছধরা মূলত একটা লোভের খেলা
চিতলের চিকন দেহ বেয়ে
সেই লোভ কবেই হারিয়ে গেছে জলে,
মাছের আঁশটের ঘ্রাণ নিয়ে কবেই পালিয়েছে ভোর;
মতিসাহেবের ঘাট থেকে ভেসে আসা
‘ঢাকা-টাঙ্গাইল-ভুঁয়াপুর’ লঞ্চের ডাক আর ফেরেনি,
ট্রেনের হুইসেল রাত্রির স্তব্ধতা ভেদ করে ফিরলেও
ফেরে না স্কুলপালানো দুপুরে স্টেশনের স্মৃতি।
সাইকেলে চড়ে মাতিয়ে দেওয়া সন্ধ্যার মতো ঘোরে আছি
বাবার সাদা পাঞ্জাবির মতো ধবধবে আলোয় রাত্রি ধরছি
মায়ের আদরের মতো ঘুমে স্বপ্ন দেখছি
হাসছি, কাঁদছি, আবার ভালোবেসে স্মৃতি মাখছি—
এইসব স্মৃতিমাখা ঘ্রাণ এখনও আমাকে নিঃশ্বাসে রাখে
এখনও যোজন যোজন দূরত্ব ঘুচিয়ে সেইসব ঘ্রাণ
আমাকে ছোটবেলার কুয়াশা আর রৌদ্রের কাছে ফেরায়।
সাময়িক বিরুদ্ধতা
প্রজ্ঞাপিত হারানো মুখটি খুঁজতে গিয়ে
চোখে উদ্যান মেখে ঘাসপাতায় খোঁজো বিস্তারিত দহন,
অথচ ভোরস্বপ্নে জলের দহন থেকে ফিরবে বলে
সেই কবেই শিশিরের ক্ষণস্থায়ী জীবন মাড়িয়ে এসেছ।
এবার বোধের ঘরে নপুংসক আত্মার ছবি দেখে
ফুটপাতের চলমান নাগরিককে প্রশ্ন কর—
‘কীভাবে একটা সম্পর্ক টেকানো যায় সময়ের বিরুদ্ধতায়?’
অথবা এটাও জিজ্ঞেস করতে পার—
কীভাবে উলট্ চলনে তাঁর ছায়াকঙ্কাল এসে দাঁড়িয়ে যায়
তোমার শূন্য করতলে?
মোড়ে দাঁড়ানো অন্ধ ভিখারিকে বল
সে ঠিক বলে দেবে তোমার গন্তব্য;
ইচ্ছে হলে তার থালায় কিছু আবেগী মুদ্রা ছেড়ে দিও
যা তোমার পাথেয়র পূর্ণতা দেবে।
এভাবে চলতে চলতে তুমিও একদিন
ঘাসপাতায় খুঁজে নেবে ফড়িংজীবন
বাঙ্ময় জীবনের কথকতা মেলে দেবে আগামীর ব্যস্ততা
আর আমি কেবল জেগে থাকব
দহনের ভেতর অবিরাম দহন নিয়ে সাময়িক বিরুদ্ধতায়।
ক্ষরণ এবং অতঃপর
শব্দের ভেতর তুমুল ক্ষরণ দেখে পূর্ণিমা ভিজে গেলে
আমাদের অবারিত সৌন্দর্য গিলে ফেলে চাঁদ,
আমরা তখন ঘুমোট অবহেলা তাতিয়ে তুলে
চিৎপাত শুয়ে থাকি পাললিক মাঠে।
অতীত বেলার সম্পর্ক ভুলে সে মাঠও জ্বলে যায় একদিন
শেষ মাড়াইয়ের চিহ্ন ঢেকে গড়ে ওঠে নোতুন বসতি
নোতুন লোকালয়, নোতুন সম্পর্ক—
নবান্নে ফেরে প্রান্তিক প্রেমিক,
প্রেমিকারা তখন হারানো গল্পের নায়িকা
অথবা গল্পের ভেতর ঘুমিয়ে পড়া শিল্পের হারানো শৈশব;
যে শৈশবের খোঁজে নিরন্তর পথ চলা চাঁদের ভেতর।
শব্দের মতো আমিও তুমুল ক্ষরণের স্বপ্ন দেখি,
দেখি গলানো জোছনার মিথ্যা বিলাসিতা এবং
অপেক্ষমাণ একটি বৃষ্টিভোর।
এভাবে দেখতে দেখতে
আমি আমার হাত গুটিয়ে ফেলি বেনামি শস্যের ভেতর।