বাংলা সাহিত্যে ওল্ড জেনারেশন যদি ধরা হয় গীতিকবিতাকে, তবে নিউ-জেনারেশন হিসেবে ছেড়ে দিতে হবে কথাসাহিত্য তথা গল্প-উপন্যাসকে। এই দুই জেনারেশনের বেশ ভাব-ভাবনার যেমন মিল আছে, তেমনি আছে জেনারেশন গ্যাপের আন্তঃকলহও। আবার যেই ঝর্ণার জল থেকে এই কাব্য-কথা স্রোতধারার জন্ম, সেই সুইটবয় সমাজ-রাজনীতির সঙ্গেও আছে কমবেশি স্বয়ম্ভু-রিপ্লেক্সের দ্বন্দ্ব। সমাজ-রাজনীতির ছায়ায় কাব্য-কথার বীজ থেকে বিশাল মহীরুহ হিসেবে জন্মলাভ ঘটেছে উপন্যাসের। কখনোবা কাব্য-কথাই সমাজ-রাজনীতিকে রোড ডিভাইডার, স্পিড ব্রেকার, রেড-সিন-ইয়োলো বাতি দেখিয়ে রাহবারি করেছে। এই কর্তৃত্ব ও করতালির সোহবত বুঝতে গেলে মজা-মাস্তির কোনো কমতি হবেন না।
বয়সে অতি নবীন কথাসাহিত্য এখনো তারুণ্যের স্পর্ধা আর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ভরপুর। সমাজকে থোড়াই কেয়ার করে প্রায়শই নতুন-নতুন জীবনাদর্শ, তত্ত্ব, মতবাদ-প্রতিবাদ পাঠকের সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে এই শাখায়। সমাজের প্রচলিত অনেক প্রথা-সংস্কারকে আত্মীকরণ করে আবার কোনোটাকে কেটে-ছেঁটে, কাস্টমাইজ করে রঙ-আকৃতি পাল্টে দেয়। পাঠক-সমালোচক গ্রহণ করলো তো গুড, না করলে নো-হ্যাডেক। ‘বাংলা উপন্যাসে বিধাবা: বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎ’ গবেষণা সাহিত্যকর্মটি পাঠকালে বাংলা ভাষার কয়েকটি বিখ্যাত ও আলোচিত উপন্যাসকে ‘ট্রায়াল’বা ‘কাঠগড়ায়’ তোলা দেখে ওপরের কথাগুলো মনে এলো। গবেষণাগ্রন্থটির লেখক কবি-কথাশিল্পী ও গবেষক মোহাম্মদ নূরুল হক। লেখককে একবাক্যে সূক্ষ্মদর্শী ও সাহসী না বললে সত্য গোপনের দায়ে পাঠক ও বিবেকের কাঠগায় দোষী হবো নিশ্চিত। বাংলা সাহিত্যে (উনিশ শতকীয় সমাজ-রাজনীতি ও রেনেসাঁ—এই বিগ বসেস) তিন-তিনজন বুজুর্গকে লেখক ‘বিধবা-বিবাহ’ ট্রিটমেন্টে রীতিমতো কট অ্যান্ড বোল্ড করে হ্যাট্রিক তুলে নেওয়ার মতো কাণ্ড ঘটিয়েছেন।
সামাজিক-নৈতিক-ধর্মীয় সংস্কার প্রশ্নে প্রায় শত মাইল বেগের ঝড়ো বাউন্সারে কট বিহাইন্ড করেন আধুনিক হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রাণপুরুষ বঙ্কিমকে ‘প্রাচীনপন্থী’ অভিধায়।
আশ্চর্যের লেখক এমন বাউন্স, ইয়র্কার, ফুলটস টাইপের যুক্তি-দৃষ্টান্ত ছুড়েছেন যে, কোনো রিভিউ বা থার্ড আম্প্যায়ারের দরকার হয় না। আবার যুক্তিতর্ক বহির্ভূত সিদ্ধান্ত বা হেইট স্পিচও উদগীরণ করেননি । তিন কিংবদন্তিকে তাঁদের টেক্সটের ভেতর দিয়েই ট্রায়াল করে দেখিয়েছেন, কোনো খ্যাতি মহত্বই টেক্সটকে অতিক্রম করে দেখতে নেই।
প্রথম অধ্যায়ে মোহাম্মদ নূরুল হক কেবল ফোকাস করেছেন, ‘বিধবা সমস্যা’ বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরতের চিন্তাসূত্রে কিভাবে বিস্তার লাভ করে। বুজুর্গত্রয় নিজ-নিজ সৃষ্টি বিধবাদের বেঁচে-বর্তে উঠতে কতটা টাইম অ্যান্ড স্পেস দিয়েছেন, বিধবাদের মানসিক-হৃদরবৃত্তি ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে কী নির্দয় হাতে দমন করেছেন, না কি সদয় সচেতন থেকে যথার্থ সুবিবেচকের কাজটি করেছেন, গবেষক নির্মোহ থেকে তা পাঠকের বিচারের জন্য চমৎকার ভাষায় আর্জি আকারে তুলে ধরেছেন। প্রথম অধ্যায়ে লেখক সনাতন ধমাবলম্বী বিধরাদের সহ-মরণ ও বিবাহের ইতিহাসটি অল্পকথায় আড্ডার ঢংয়ে বয়ান করেন। ইতিহাসের নিরস বর্ণনাও লেখকের ভাষাগুণে সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে। লেখক বলেছেন,
‘‘বাংলা উপন্যাসে বিধবা চরিত্র আলোচনার ক্ষেত্রে সতীদাহ প্রথা প্রসঙ্গ তোলার যৌক্তিক কারণ রয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দেবতা ব্রহ্মার মতো রাজা রামমোহন রায় বিধবাদের জীবন দিয়েছেন। কিন্তু বিষ্ণুর মতো লালন-পালনের ভার নেননি।…হিন্দু সমাজের বিধবাদের বৈধব্যযন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে এগিয়ে এলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১)। তিনি শাস্ত্রমন্থন করে লিখলেন ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ শীর্ষক প্রবন্ধ।…এদিক থেকে দেখলে রাজা রামমোহন রায় যদি ব্রহ্মার কাজটি করেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর করেছেন বিষ্ণুর কাজ।’’
বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎ ছাড়াও প্রথম অধ্যায়ে অল্প টানে রমেশচন্দ্র দত্তের ‘সংসার’ এবং ‘সমাজ’ উপন্যাস দুটির ভেতের টর্চ মেরে যেতে ভোলেননি। বিধবা-বিবাহের ভালো একটি ট্রিটমেন্ট রমেশচন্দ্রের চরিত্র হেমচন্দ্র-বিন্দু ও শরৎ-সুধা জুটিদ্বয় লাভ করে মর্মে আমরা স্বস্তিবোধ করি। অবশ্যই বুজুর্গত্রয়ীর বিধবাচরিত্র ট্রিটমেন্ট নিয়ে পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে ছোটখাটো সাইক্লোনের আভাস এই অধ্যায়ে দিয়ে লেখক সেই স্বস্তিতে কিঞ্চিৎ পেরেশানির উষ্ণ জল ঢালতে কমতি রাখেননি। লেখকের বিশ্লেষণের নির্যাস উঠে আসে ঠিক এই তিন কথায়:
ক. বঙ্কিমের বিধবারা দরিদ্র, অন্যের ওপর নির্ভরশীল
খ. রবীন্দ্রনাথের বিধাবার দরিদ্র, অন্যের ওপর নির্ভরশীল
গ. শরতের বিধবারা বিত্তশালী, জমিদার, আত্মনির্ভরশীল
গবেষণার দ্বিতীয় অধ্যায়ে এককভাবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ওপর ফোকাস করে তাঁর দুই খানি প্রধান উপন্যাসকে পোস্টমর্টেম করেছেন গবেষক। বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসও এই প্রসঙ্গে লেখক দুই এককথায় আলগোছে পরিবেশন করেছেন:
‘‘সাহিত্যের এই শাখাটির শুরু উনিশ শতকের মধ্যভাগে। সেই হিসাবে ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হানা ক্যাথেরিন মুলেন্সের ‘ফুলমনি ও করুণার বিবরণ’কে বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস হিসেবে অনেকেই উল্লেখ করেন।
এরপর ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় প্যারিচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’। এই বইয়ে উপন্যাসের বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটে উঠেছে বলে মনে করেন সমালোচকরা। তবে, ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্রও চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪)-এর ‘দুর্গেশ নন্দিনী’কে বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক উপন্যাস হিসেবে গণ্য করা হয়।’’
ঔপন্যাসিক বঙ্কিমকে গবেষক স্ট্রেইটকাট পেস অ্যাটাক করেন তার নীতিবাদ ও মানবহৃদয়ের বিরুদ্ধে অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে। সামাজিক-নৈতিক-ধর্মীয় সংস্কার প্রশ্নে প্রায় শত মাইল বেগের ঝড়ো বাউন্সারে কট বিহাইন্ড করেন আধুনিক হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রাণপুরুষ বঙ্কিমকে ‘প্রাচীনপন্থী’ অভিধায়। বঙ্কিমের ব্যক্তি স্বরূপটি গবেষককে ভাবিত করে। বিশেষ করে যখন বঙ্কিম আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও যারা প্রাচীন প্রথা ভেঙে নতুন পথে চলতে চেয়েছেন, তাদের বক্রদৃষ্টিতে দেখা বঙ্কিমের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে, তখন। গবেষক বলছেন, ‘নিজের সৃষ্ট চরিত্রের ভেতর দেখিয়েছেন প্রথা ভাঙার করুণ পরিণতি। বলতে চেয়েছেন দ্বৈবাণী-প্রাচীনরীতি-বয়স্কদের ভবিষ্যদ্বাণী-সতর্কবাণী লঙ্ঘনকারীদের ভাগ্যে মৃত্যু-হত্যা-আত্মহত্যার মতো কঠিন দণ্ড অবধারিত থাকে।’
থারীতি ঐতিহাসিক পরম্পরা বর্ণনায় গবেষক বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথকে ‘প্রজ্ঞা-আদর্শবাদ-নীতিবাদ-ঋষিসুলভ’ ভাবের সাহিত্য স্রষ্টা হিসেবে শনাক্ত করে শরৎকে অভিধা দেন ‘ভিন্ন ধারার’ ঔপন্যাসিক হিসেবে।
নিজে উচ্চশিক্ষিত এবং ব্রিটিশ সরকারের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে হিন্দু বিধবা বিবাহ আইনের সরাসরি বিরোধিতা করার উপায় ছিল না বঙ্কিমের। তাই সাহিত্যকে তথা নিজের রচিত উপন্যাসের চরিত্রকে বেছে নিলেন বিধবাবিবাহের কুফল চিত্রিত করতে।
‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসের বিধবা কুন্দকে বঙ্কিম মুত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচেন। বলেন, ‘আমরা বিষবৃক্ষ সমাপ্ত করিলাম। ভরসা করি, ইহাতে গৃহে গৃহে অমৃত ফলিবে।’ গবেষক মোহাম্মদ নূরুল হক কয়েকটি পয়েন্টে বিষবৃক্ষের স্রষ্টা বঙ্কিমের চিন্তাসূত্রকে স্পষ্ট করেছেন।
ক. মানবিক প্রেমে পাপ ও রক্ষণশীলতায় ন্যায় দেখেছেন বঙ্কিম
খ. যথ দোষ বিধবার, পুরুষ নির্দোষ
গ. বিশেষ চরিত্রের প্রতি লেখকের পক্ষপাত
ঘ. ঐশীবাণীর জয় ও মানুষের কর্মের পরাজয়
অন্যদিকে ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসেও গবেষক প্রাচীনপন্থী বিধবা বিয়ের বিরোধী, শাস্ত্রবাগীশ বঙ্কিমের সমালোচনায় অনঢ় থাকেন। উপন্যাসটির কাহিনী আলোচনা করে অত্যন্ত সুক্তিনিষ্ঠ কয়েকটি পয়েন্ট পাঠকের সামনে গরেষক হাজির করেছেন।
ক. লোভী হরলালের প্ররোচনায় উইলের সঙ্গে বিধা রোহিনীর সম্পৃক্ততা
খ. বিধবা রোহিনী লোভী, তাই সে প্রথমে হরললে, পরে গোবিন্দলালে, সবশেষে নিশাকরে আসক্ত
গ. বিধবা বিবাহ সব সময়ই সমাজের কুফল বয়ে আনে
ঘ. সনাতন ধর্মরীতি ও নৈতিকতার স্খলনই রোহিনীর মৃত্যু, গোবিন্দকে সর্বস্বান্ত করেছে।
উপন্যাস দুটির কাহিনি এবং বঙ্কিমের বিধবা বিবাহ বিরোধী মানসপট নিয়েই কেবল একচেটিয়া গবেষক আলোকপাত করেছেন, তা নয়। উপন্যাস দুটির আঙ্গিক-শৈলী নিয়েও দুই এক বাক্যে দারুণ কটি দিক তুলে ধরেন:
‘‘বঙ্কিম যে ধরনের শব্দ ব্যবহার করেছেন, তাঁর চরিত্রগুলোও টিক সেই সুর শব্দই উচ্চারণ করেছে। চরিত্রগুলোর নিজস্ব কোনো ভাষা নেই। অর্থাৎ উপন্যাস দুটিতে মানব সমাজের স্তরবিন্যাস ও শ্রেণী উপযোগী ভাষার প্রয়োগ হয়নি। বরং সবার মুখেই বঙ্কিম নিজের ব্যবহৃত মানভাষাই বসিয়ে দিয়েছেন।’’
শংসার রঙে রঙিনও করেন এই বলে:
বঙ্কিম বাংলা ভাষার প্রথম দিকের ঔপন্যাসিক হলেও অলঙ্কার প্রয়োগে তিনি সতর্ক ও সচেতন, বর্ণণা অংশে লেখখ বাক্যকে সালঙ্কৃত করেছেন। কখনো কখনো এমন মোচড়ময় বাক্যগঠন করেছেন, তাতে কী বার্তা রয়েছে, তার চেয়ে কিভাবে বক্তব্য পেশ করেছেন, সেটিই বড় হয়ে উঠেছে। বার্তা গৌণ হয়ে বার্তার রূপ-রসই মুখ্য হযে উঠছে। তাতে দীর্ঘ সময় ধরে পাঠকককে মুগ্ধতার রেশবন্দি হয়ে থাকতে হয়।’’
বঙ্কিমের রচনা থেকে গবেষক উদ্ধৃতি তুলে ধরেছেন।
‘‘আকাশে মেঘাড়ম্বর। কারণ রাত্রি প্রদোষকালেই ঘনান্ধতময়ী হইলো। গ্রাম, গৃহ, প্রান্তর, নদী, কিছু লক্ষ্যও হয় না। কেবল বনবিটপী সকল, সহস্র সহস্র খাদ্যোতমালা পরিমণ্ডিত হইয়া হীরকখচিত কৃত্রিম বৃক্ষের ন্যায় শোভা পাইতেছিল। কেবলমাত্র গর্জনবিরত শ্বেত কৃষ্ণাভ মেঘমালার মধ্যে হ্রস্বদীপ্তি সৌদামিনী মধ্যে ননবারিসমাগ প্রফুল্ল ভেকেরা উৎসব করিতেছিল।’’
দ্বিতীয় অধ্যায়ে গবেষক বাংলা সাহিত্যের বিগবস রবীন্দ্রনাথকে স্ট্রাইকিংয়ের রেখে ফিল্ডিং সাজান। সাহিত্যের ঐতিহাসিক পরম্পরার বয়ান গুছিয়ে দু’চার কথায় বলে নেওয়াটাই মোহাম্মদ নূরুল হকের ফিল্ড সাজানো। বঙ্কিমকেই দীক্ষাগুরু হিসেবে মেনে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস রচনার স্টার্টাপ। বঙ্কিমের ভাবাদর্শকেই বিধবা বিয়ে প্রচলন বিষয়ে নিজের উপন্যাসের জন্য যুৎসই ঠেকেছে রবীন্দ্রনাথের কাছে।
আলোচ্য গবেষক রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ ও ‘চতুরঙ্গ’ নিয়ে আলাপের শুরুতেই এটা পরিষ্কার করেছেন যে, ‘চোখের বালি’র বিষয় একান্ত বিধবা বিবাহ হলেও ‘চতুরঙ্গ’ শতভাগ তা নয়। ‘চোখের বালি’র কাহিনির বাচরে রবীন্দ্রমানস বিশ্লেষণ করে মোহাম্মদ নূরুল হক কয়েকটি দিকে বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
১. মহেন্দ্র-আশার দাম্পত্যে ফাটল ধরিয়ে অশান্তি সৃষ্টিই বিধবা বিনোদিনীর উদ্দেশ্য
২. পুরুষের মনেকামনা জ্বালিয়ে দিয়ে বিধবা নারীর ধরা না দেওয়া
৩. ভালোবাসায় দ্বিমুখিতা-একমুখিতার দ্বন্দ্ব
৪. ইচ্ছা করলেই কারও মন পাওয়া যায় না
৫. বিধবার জন্য বিয়ে নয়, বৈধব্যই শ্রেয়
আর ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ যে ফ্রেমটি এঁকেছেন, তা গবেষক তিন কথায় তুলে ধরেছেন।
১. সংসার-বৈরাগ্য. আস্তিক্য-নাস্তিক্যের দ্বন্দ্ব
২. প্রেমে-কামে বহুগামিতা
৩. বিধবাবিবাহ শেষ পর্যন্ত মঙ্গলজনক হয় না, তাদের মনে বহুর বসত বেজে ওঠে
বঙ্কিমের মতো রবীন্দ্রনাথও বিধবা বিবাহকে দেখেছেন সামাজিক সমস্যা হিসেবে। আগের হাল যেদিকে লাঙ্গল চালিয়েছে, পেছনের হালও প্রায় সেদিকতায় অনুসরণ করে গেছে। পার্থক্য শুধু পূর্বসূরি বঙ্কিমের মতো রবীন্দ্রনাথ বিধবাদের ‘হত্যা-আত্মহত্যা’য় সায় দেননি। তিনি কায়দা হিসবে বেছে নেন বিধবা কামনা দমনে অসম্মান-মানসিক যন্ত্রণা এবং তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া। ‘চোখের বালি’তে বিধবাবিবাহকে রবীন্দ্রনাথ ভালো চোখে না দেখার বিষয়টি লেখক এভাবে তুলে ধরেছেন,
‘‘বিনোদিনীকে রূপ দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়ছেন, রুচি দিয়েছেন, তার বিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু সেই বিয়ে দীর্ঘস্থায়ী করেননি। অকাকে তাকে বিধবা বানিয়েছেন। সেই বিধবার মনে প্রেম দিয়েছেন। ঈর্ষা দিয়েছেন। …অন্যের স্বামীকে কেড়ে নিতে চেয়েছে বিনোদিনী। …সংসারের সাধজাগার পরও স্বপ্নপূরণ হলো না। তাকে শেষপর্যন্ত বৈরাগ্যের পথেই যেতে হলো।’’
গবেষক রবীন্দ্রনাথকেও বিধবা বিবাহ প্রশ্নে বড় ইনিংসের আগেই মানবিকতার ইন-সুইংয়ে কট অ্যান্ড বোল্ড করে উইকেট তুলে নেন।
চতুর্থ অধ্যায়ে বাংলা কথাসাহিত্যের মুকুটহীন রাজা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে কাঠগড়ায় তশরিফে আনেন গবেষক। যথারীতি ঐতিহাসিক পরম্পরা বর্ণনায় গবেষক বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথকে ‘প্রজ্ঞা-আদর্শবাদ-নীতিবাদ-ঋষিসুলভ’ ভাবের সাহিত্য স্রষ্টা হিসেবে শনাক্ত করে শরৎকে অভিধা দেন ‘ভিন্ন ধারার’ ঔপন্যাসিক হিসেবে। শরতের সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক-রাজনৈতিক-রোমান্টিক প্রণোয়োপাখ্যান বিষয়কে ৩০টি উপন্যাস থেকে গবেষক বিধবা প্রধান ২টি উপন্যাস বেছে নিয়েছেন। এগুলো হলো, ‘বড়দিদি’ ও ‘পল্লী সমাজ’।
গবেষক মোহাম্মদ নূরুল হক কিঞ্চিৎ সাইড বেঞ্চে বসিয়ে রেখে সমাজকে টর্চের আলোয় আনেন, রমেশচন্দ্রের বরাত দিয়ে জানান সমাজ বিধাবাকে পুনঃবিবাহ দেওয়ার বিরুদ্ধে যতই বাইরে থেকে চাপ দিক, প্রকৃতপক্ষে ঠেকাতে পারে না। সমাজে বিধবার বিয়ের মাধ্যমে অশান্তি নয়, শান্তি হয়।
গবেষক দেখিয়েছেন, পূর্বসূরিদের রচনায় যেখানে বিধবাদের কাতরতা ও অসহায়তা প্রকট করে তোলা হয়েছে, শরৎচন্দ্রের উপন্যাস সে-পথ মাড়ায়নি। বড় দিদি উপন্যাসের বিধবা মাধবীর বৈধব্য যেন শরতের ট্রিটমেন্টে লক্ষ্য বা উপলক্ষ হয়ে ওঠেনি। মাধবীর বৈধব্যকে যন্ত্রণা আকারে ফুটিয়ে তোলেননি এই মহান কথাকার। এমনকি তিনি মাধবীকে ‘প্রেম কাতর’ রূপে আবেদন করতে পর্যন্ত দেননি। দিয়েছেন কঠিন পুরুষালী পাঞ্জায় সংসারের লাগা কষে ধরার কাজ। শরৎ কি তবে বিধবাদের স্বাবলম্ভী করতে গিয়ে তাদের হৃদয়-শরীরের দাবিকে পাশ কাটিয়ে গেছেন?
যথারীতি বড়দিদি উপন্যাসকেও ছোটবাক্যে তুলে এনেছেন গবেষক।
১. জমিদার পুত্রসন্তান শৈশব থেকে পরনির্ভরশীল হয়।
২. ধনী পরিবারের বিধবারা অবদমনকে আভিজাত্য জানে।
৩. কাউকে ভালো লাগলে কিংবা ভালোবাসলেও ধনী পরিবারের বিধবারা লোকনিন্দার ভয়ে বলতে পারে না।
৪. শরৎ সাহিত্যে অর্থবিত্তের চেয়ে মানবিক সম্পর্ক বড়।
৫. নিতান্তই ব্যক্তিগত-পারিবারিক ঘটনাবলি থেকে সামাজিক জীবনে উত্তরণ।
‘পল্লী সমাজ’ উপন্যাসেরও একই রকম পোস্টমর্টেম করা হলো। যেখানে দুই বিধবা চরিত্র রমা ও বিশ্বেশ্বরীর তিনটি বিষয়কে বোল্ড করে তুরে ধরা হয়েছে। এগুলো হলো:
১. রমা যেমন দয়া-মায়া-ভালোবাসার পাশাপাশি নিষ্ঠুরতা-কুটিল স্বভাবের অধিকারী, তেমনি জমিদারি রক্ষায়ও পারদর্শী।
২ রমা নিজের আভিজাত্য-জমিদারি রক্ষার স্বার্থে ভালোবাসা বিসর্জন দিতেও অকুণ্ঠ।
৩. পুরো উপন্যাসের সবচেয়ে দৃঢ়তাপূর্ণ চরিত্র বিশ্বেশ্বরী। তার সেঙ্গ কেবল তুলনা চলে মহাভারতের ভীষ্মের।
কালজয়ী কথাকার শরতেরও অবশ্যই উইকেটটি শেষপর্যন্ত ছক্কা হাঁকানোর শর্টে প্রায় বাউন্ডারির কাছে ‘কট’ ধরা পড়ে। বিধবাদের জন্য অর্থনৈতিক মুক্তি আর সামাজিক প্রতিপত্তির বন্দোবস্তো করেও যেন শেষতক রক্ষা মেলেনি বাক্যবাণে সিদ্ধহস্ত গবেষকের তীর থেকে। তিনি বলেন,
‘‘বড়দিদিতে মাধবী সুরেন্দ্রের মনের অসমতা এবং পল্লী সমাজ-এ রমা-রমেশের নীতিগত সংঘাত বিধবার প্রেম-বিয়ের পথে মস্তবড় বিস্ময়সূচক চিহ্নের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। যে চিহ্নের দেয়াল টপকে কারও পক্ষেই বিপরীত পক্ষের হৃদয়ের গভীরের খোঁজটুকু পাওয়া সম্ভব হয় না। ফলে বিধবারা বৈধব্য যন্ত্রণা নিয়েই বেঁচে থাকে।’’
গবেষকের মতে, কাউকে সংসারে রেখে, কাউকে তীর্থে পাঠিয়ে উভয়ের প্রতিই স্রষ্টা শরৎ নির্দয় আচরণ করেছেন। মানুষের মনোদৈহিক চাহিদার স্বাভাবিক প্রবণতা তিনি স্বীকার করেননি। যাকে মানবতার প্রতিও চরম অবমাননা ও বাস্তবতাবিরোধী হিসেবেই দেখেছেন গবেষক।
পঞ্চম অধ্যায় অর্থাৎ শেষ অধ্যায়ে একই সমান্তরালে রেখে বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎ—এই তিন মহারথীর নিজ নিজ চিন্তার সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য নির্মোহ বাটখারার তুলে মেপে-মেলে দুর্দান্ত সিদ্ধান্তের পথ তৈরি করেছেন, গবেষক কোনো মনগড়া সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেননি। বরং টেক্সটকে অনবরত দৃষ্টির বিভিন্ন ভঙ্গিতে রেখে কনটেক্সট-আর্গুমেন্ট নির্গত সামারিকে পরিবেশন করেছেন। দরকার মতো রেফারেন্স-সূত্রের কমতি রাখেননি।
এখানে দুটি রেফারেন্স তুলে ধরা হলো।
০১. শরৎচন্দ্র কোনো আদর্শের ব্যাখ্যাকার হিসেবে কল ধরেননি। জীবনে নরনারীর যে ব্যথা ও যে সুখ তিনি নিজে উপলব্ধি করেছেন, তাদের জীবনের সেই স্বাভাবিক সুখ-দুঃখকে অপরিসীম সহানুভূতি ও দরদে রাঙিয়ে তাঁর সাহিত্যে রূপায়িত করছেন। (বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত: মুহাম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান)।
০২.
‘বিষবৃক্ষ’ , ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ ও ‘রজনী’ উপন্যঅসের মনোবিশ্লেষণের যে দ্বারপ্রান্তে এসে বঙ্কিমচন্দ্র থেমেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ সেই বন্ধ দরজা খুলে দিয়েছেন। অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টির আলোতে দেখিয়ে দিয়েছেন ভিতরের নানা মহল। এই কারণে ‘চেখের বালি’ অভূতপূর্ণ বাস্তব রচনা হয়ে উঠেছে। এই ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য প্রকরণগত এবং দৃষ্টিভঙ্গির। (রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের নবমূল্যায়ন: ড. অমরেশ দাশ)।
উপসংসারের গবেষক মোহাম্মদ নূরুল হক কিঞ্চিৎ সাইড বেঞ্চে বসিয়ে রেখে সমাজকে টর্চের আলোয় আনেন, রমেশচন্দ্রের বরাত দিয়ে জানান সমাজ বিধাবাকে পুনঃবিবাহ দেওয়ার বিরুদ্ধে যতই বাইরে থেকে চাপ দিক, প্রকৃতপক্ষে ঠেকাতে পারে না। সমাজে বিধবার বিয়ের মাধ্যমে অশান্তি নয়, শান্তি হয়।
গবেষণাপত্রে গবেষক রেফারেন্স হিসেবে সমালোচকদের বিভিন্ন রচিত নানান গ্রন্থের উদ্ধৃতি সহায়তা নিয়েছেন। তাতে গবেষকের বক্তব্য জোরালো হয়েছে। তার গবেষণাপত্রও আরও ভারবাহী হয়েছে।
‘বাংলা উপন্যাসে বিধবা: বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎ’ বাংলা গবেষণা-সমালোচনা সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন। মোহাম্মদ নূরুল হকের কাছে এমন আরও অকর্ষিত ভূঁইয়ের চাষাবাদধর্মী গ্রন্থ আশা করলে সম্ভবত পাঠককে আশাহত হতে হবে না। অসাধারণ বাইন্ডিং এবং চমৎকার কাগজে ছাপ বইটি প্রকাশ করেছে বাংলানামা। প্রচ্ছদটিও দারুণ নান্দনিক।