পর্ব-৮
কোথাও একটা শব্দ হলো। ধুম্! যেন একটা বোমা ফাটলো। আমি উঠে বসলাম।
: কী হলো? সালিমা জানতে চাইলো।
: কিছু একটা!
: ভয় পেয়ো না। কোনো ছাদ ধসে পড়ার শব্দ। বলে সালিমা পাশ ফিরে শুলো।
: তুমি ভয় পাও না?
: পাই তো। তবে পেতে পেতে অভ্যাস হয়ে গেছে। প্রথম দিকে কী ভয় হতো! ‘দ’ হয়ে দাঁতে কামড়ে পড়ে থাকতাম। ভয় বা এসব অনুভূতি হচ্ছে প্রশ্রয়ের ব্যাপার। প্রতিনিয়ত এসবের মুখোমুখি হলে এসব অনুভূতির মাহাত্ম্য থাকে না। ভয় হচ্ছে অত্যন্ত সুখীদের ভূষণ। একদা আমারও ছিল। ভয় এখন বলতে গেলে আমার ভেতর কাজ করে না। তবে শীত লাগে। হাহাহাহা।
আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার ব্যাগ থেকে একটা মোটা কাপড় বের করে ওকে দিলাম। ও সেটা গায়ে জড়িয়ে নিলো। বললো, বাহ! বেশ ওম।
: এতদিন শীত কী করে কাটিয়েছ?
: এভাবেই। রকেট আর স্নাইপারকে দুপাশে রেখে মাঝে শুয়ে।
: এভাবে হয়?
: হবে না কেন? তুমি জানো কুকুরের শরীরে কত ওম।
: তুমি তো ইচ্ছে করলেই জোগাড় করতে পারতে। কত জায়গায় কত কিছু পড়ে আছে।
: কী হবে অতসব ঝামেলা বাড়িয়ে। নিজেকে শুধু পার করে নেওয়া তো। তাও পারে ভেড়া হলো কই?
: রাখো তো ওসব অলক্ষুণে কথা। আমি রাগ করে সালিমাকে শাসাই। কালকে আমরা বেশ কিছু কাপড়-চোপড় আর কম্বল খুঁজে আনবো।
: আচ্ছা। সালিমা খুশি খুশি সুরে বললো, আহা কী ওম! জানো আমি এককালে খুব শীতকাতুরে ছিলাম। মা ভালো করে শীতের কাপড় মুড়িয়ে দিতো। বলতো, একটা রাজপুত্র এনে দিতে হবে গো আমার সোনামণিকে। সে সব সময় শীতের কাপড় পরিয়ে দেবে তোকে। কেমন হবে বল তো? আমি বলতাম, খুব ভালো।
মূলবাড়ির লাগোয়া পেছন দিকে ইনসানের ছোট্ট খুপরিটা সদ্য বেরুনো বীর্যের গন্ধে মৌ মৌ করে। কেউ ঢুকলেই চট করে খেয়াল হয়, যেন টিকটিকি বা ইঁদুর মরে পচে উঠেছে।
সালিমা এসব বলছে আর আমি ভাবছি সেইসব নারীদের কথা যাদের শীত লাগে কিন্তু শীতের কাপড় পরে না। বলে, চলে যাচ্ছে তো। আমি তাদের সবাইকে মনে মনে আলিঙ্গন করি। ভালোবাসি। চুমু খাই।
: ঘুমিয়ে গেলে? সালিমা জিজ্ঞেস করে।
: উহু!
: এটা কি উলের?
: হ্যাঁ।
: হাতে বোনা?
: হু।
: কে?
: সালিমার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমি থমকে যাই। সালিমা আবার জিজ্ঞেস করে, কে বলার সঙ্গে সঙ্গে ওমন স্তব্ধ হয়ে গেলে কেন?
: সে এক মানুষ ছিল, তার হাতের।
: তাই বুঝি?
: হ্যাঁ।
: বলা যাবে?
: হ্যাঁ।
: বলো।
: এখন শুনবে?
: বললে।
: আচ্ছা… সে এক মেয়ে ছিল।
: এ যে দেখছি সেই এক রাজার গল্পের মতো শুরু করলে। ভালো, আমার খুব ভালো লাগে দুঃখী রাজাদের।
: তার মাথায় ছিল রাজান্ধার অমাবস্যার মতো একরাশ চুল। সেই চুলে দুটো চুড়ো খোপা করলে তিন মাথার মানুষ বলে মনে হতো। তার প্রেমে পড়েছিল এক ছেলে। যার ঘর নেই, দোর নেই, নেই বাবা-মা কেউ। মাঝারি উচ্চতার সেই ছেলের মান ছিল ইনসান। চুয়াল দুটো চোখে পড়ার মতো চওড়া আর খাড়া। নাকটা তলোয়ারের মতো বেঁকে উঠেছে। সেই চির অলস মানুষটা বলতে পারো আমি।
: তোমার চোয়াল তো অতটা চওড়া না!
: আরে শুনোই না। চোখ যেদিকে যায় বেরিয়ে পড়ার আগে আমার অবস্থা হয়েছিল কুঁড়ের বাদশার মতো। ঠিক কুঁড়ে বললে ভুল হবে। সে এক অবস্থা যেখানে নিউটনের মধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করে না। শরীর আছে, ওজনও আছে; কিন্তু ভার নেই। বিবেক-বুদ্ধির তাগা যেন অলক্ষ্যে কিছুর সঙ্গে আটকে গেছে। আমার কাছে আসতে পারছে না। বলা যায় একটা মাংসের পিণ্ড, যার হৃদয় শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে। ঘুমিয়ে গেলে? সালিমার কোনো সাড়া না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
: উহু। বলো না। সে উত্তর দেয়।
কিছুটা পড়াশোনা করেছি। ক্রিকেট খেলতাম ভালো। গ্রামে আলরাউন্ডার হিসেবে বেশ খ্যাতি। অর্থ সব অনর্থের মূল, এর সত্যতা আমি জানি। সেই অর্থ সংকট তো আমাদের নিত্যসঙ্গী। একদা বাধ্য হলাম, সব ফেলেফুলে শহরে চলে আসতে। রুটিরুজির সন্ধ্যানে। মার শরীরিক অবস্থাও ভালো না। মা বললেন, যাও তোমার মামার কাছে। আমি আর পারছি না বাবা। শহরে এসে যন্ত্রের ঘর ঘর শব্দের সঙ্গে থেকে হয়ে গেলাম একটা ভাঁড়। আত্মসম্মানহীন, হৃদয়হীন, বিবেকহীন কুঁড়ের বাদশা।
আদি
এমন হতো যে, কাজে না গেলে বাইরেও যাওয়া হতো না। ঘরে শুয়ে আছি তো শুয়েই আছি। মন চাচ্ছে বাইরে যাই। কিন্তু কোন ছুঁতোয় বাইরে যাই। সিগারেট খাবো? না, খেতে মন চাচ্ছে না। মুখ ঘামিয়ে ভিজে গেছে তবু ফেন ছাড়বো? উঠতে মন চাচ্ছে না। কাউকে ফোন দেবো, কাকে ফোন দেবো? কী বলবো। বরং এ যেন জবাই হয়ে যাওয়া।মাঝে মাঝে এমন এক সময় আসে, দিক-চিহ্নহীন ঝড়ের রাতের মতো। মেঘে কিছু দেখা যাচ্ছে না। যেন সব কিছু অস্তিত্ব হারিয়ে এই চিরদিনের অন্ধকারের জন্ম দিয়েছে। অথচ জোর হাওয়া বইছে; যার ফলে কাপড়- শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে, চুল যেন মাথা ছিড়ে উড়ে যেতে উদ্ধত। এই সবই আবার অস্তিত্বটাকে এমন প্রকট করে তুলে যে, না ভেবে উপায় থাকে না, এ কেমন জীবন আমার! তখন মনে হয়, সব ভেঙে ছিড়ে খুড়ে বেরিয়ে পড়ি। যেদিক চোখ যায় চয়ে যাই।
স্লিপার পরায় অভ্যস্ত পায়ে হঠাৎ উঁচু হিল যেমন বেশ বেকায়দার অনেকটা এমন হয়ে গেছে জীবন। অথচ কত পরিচিত এই পা। শীতের রাতে মাটির চুলায় ওম নেওয়া বিড়ালের মতো আরামে চোখ মুদে বসে থাকা যেন। পরিবর্তে এই অপার নিঃসঙ্গতা। ছিড়ে ন্যাতা হয়ে যাওয়া কাথাটা গায়ে জড়াতে জড়াতে ভাবে ইনসান, ‘এ জীবন আমার না। আমার হতে পারে না। অন্য কারো ছাঁচে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে একপাখি, যে শুধু বেরিয়ে যেতে হাঁসফাঁস করছে।
মামার দোকানে থাকলে খাওয়া-পরার কোনো সমস্যা নেই। তাতে দুটো টাকাও মাকে দেওয়া যেতো। কিন্তু শালার মামার সুন্দরী মেয়েগুলো সামনে দিয়ে এমন ঢেং ঢেং করে হাঁটে, এমন চোস্ত পাজামা; নাভির নিচের দিকটা পর্যন্ত গেঞ্জির ফাঁকে বেরিয়ে থাকে। স্তনগুলো ময়দার তাড়ার মতো ঝুলে। কখনো কখনো মনে হয় ইনসান যেন আম পাড়ার কোটা, ঠিক নাঘাল পাচ্ছে না। নিজেকে তখন গিনিপিকের মতো মনে হয়।
মাহমুদার ছোট বোন ময়নার কানের টসটসে লতি দুটো ভেবেই কমপক্ষে চল্লিশবারের মতো হস্তমৈথুন হয়ে গেছে ইনসানের। মাহমুদা নিজেকে মূল্যবান রত্নের মতো ইনসানের থেকে দূরে রাখলেও ময়নাটার ইদানিং যেন কিছু হয়েছে। সে তো ডাক আসা মাদি তিমির মতো সমুদ্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ইনসানকে দেখলে বেহায়ার মতো হাসে, কাছে আসে, গা-ঘেঁষে। ‘মেয়ে হাসিস না, এই হাসিই তোর বিপদ ডেকে আনবে।’ ইনসান মনে মনে বলে।
এরপর কী আর করা, ময়নার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন লেগে পড়ে। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, দশ, বার, আঠার বার। রাতে দিনে যখন খুশি সময় পেলেই হলো, খেলা আর খেলা।
মূলবাড়ির লাগোয়া পেছন দিকে ইনসানের ছোট্ট খুপরিটা সদ্য বেরুনো বীর্যের গন্ধে মৌ মৌ করে। কেউ ঢুকলেই চট করে খেয়াল হয়, যেন টিকটিকি বা ইঁদুর মরে পচে উঠেছে।
বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে তিন মাথার (মাথায় এত চুল যে মাথা আর দুটো খোঁপায় মনে হবে যেন এক ঘাড়ে তিনমাথা) সেই মেয়েটার চোখে জল। কিন্তু কী করার থাকতে পারে এখানে ইনসানের।
বহুমূল্য রত্ন মাহমুদা যেন তার ছোটবোন আর ইনসানের মধ্যেকার কিছু একটা টের পায় বা পেতে চেষ্টা করে। ইনসানের দিকে তার তাকানো আর ছোক ছোক করা দেখেই সেটা টের পাওয়া যায়। এইসব চিজরা নিজেকে তো অমৃতের আস্বাদ থেকে দূরে রাখবেই, উপরন্তু কাউকে যদি দেখে ঈর্ষায় জ্বলবে। যেভাবে সম্ভব তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। ইদানিং সে ইনসানের সঙ্গে একদম কথা বলা ছেড়ে দিয়েছে। কখনো কোনো প্রয়োজনে কথা বলতে হলেও, এভাবে বলবে যেন চর মারছে।
এভাবে দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়। রাতভর খেলে, দিনের বেলা দোকানে গিয়ে ঝিমায়। দোকানের ম্যানেজার বলে, মামার বাড়ি ভালোমন্দ খাওয়া আর ঘুম! আজকা চালের ট্রাক আইব, নামায়া হিসাব মিলায় তার পর বাসায় ফেরার নাম করো।’ এ সময় মামা আসে দোকানে। ম্যানেজার ক্যাশের চেয়ার ছেড়ে ওঠে। কী কারণে যেন ক্যাশ চেয়ার ছাড়ার পর তার মেজাজ ভয়ানক খাপ্পা হয়ে যায়। সে এটা সেটার ভুলভাল ধরে আমাকে উত্যেক্ত করতে থাকে। কিন্তু ইদানিং আমার চিন্তা ক্ষেত্রটা পাল্টে গেছে। নিজেকে কেমন ভার ভার লাগে।
একদিন ময়না এসে জানায় তার বমিভাবটা প্রবল হচ্ছে। কিছু খেতে পারছে না। কেমন গা গোলাচ্ছে শুধু। কথা শুনে ভয়ে হিম হয়ে আসে ইনসানের শরীর। হায়, মুশকিল! প্রভু দেহ দিলে, কাম দিলে, কিন্তু তার সঙ্গে এত শর্ত জুড়ে দিলে কেন? ইনসান ভেবে কুল পায়। মামার রাগের ব্যাপার বোধ হয় মঙ্গলগ্রহের এলিয়েনদের পর্যন্ত জানা। তার কথা আগে হাত চলে, তার আগে পা, তারও আগে তার মাথা বাগানো দা।
নিজের ভয়টা লুকিয়ে ময়নাকে সে সাহস দিতে চায়, আরে রাখো, পেটে হজম-টজমে কোনো গোলমাল হতে পারে। গ্যাসের টেবলেট খেয়ে দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। বলে ইনসান ময়নাকে টেনে তার খাটের ওপর নিয়ে বসায়। এরপর মৃতশীল্পের মতো খুব সুক্ষ্ম আর সুকৌশলে ময়নার মাংসের তালটাকে বৈপ্লবিক রূপ দেয়। ময়না তেতে ওঠা তাওয়ার মতো উতত্তপ্ত হয়ে ওঠে আর ইনসান তাতে পুড়ে যেতে থাকে। এই উত্তেজনার পারদের মধ্যেই ইনসানের শরীরে কিসের যেন একটা ঠাণ্ডা অনুভূতি জাগে। সাপের শরীরের মতো।
এ সময় এবাদাদ আলী অর্থাৎ ইনসানের মামা, ময়নার রাগী বাবা ঘরে ঢোকেন। তখন ইনসানের মনে হয়, এই হয়তো আমার জীবনের অপরিণত শেষ সঙ্গম।
মামা কখনোই এ ঘর মাড়ান না। সে এসেছিল তার বোন মানে ইনসানের মায়ের মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে। সাপে কেটে তিনি মারা গেছেন। এবাদত মামা ঘরে এসে এমন পরিস্থিতির সম্মুখিন হলেন, তাতে দুটো কষিয়ে কিল পড়ল ইনসানের পিঠে। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, দাঁড়া আসতাছি। কী করতে হবে আমি জানি।
রাগ হলে তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। কিন্তু এই এখন তিনি যেভাবে বেরিয়ে গেলেন, মুহূর্তের ব্যবধানে যেন তিনি রাক্ষস হয়ে গিয়েছেন। সে আবার তারছেঁড়া রাক্ষস। মুহূর্তের সাইক্লুনে যেন তার ছিঁড়ে গেছে আর সর্টসার্কিট থেকে আগুনের স্ফূলিঙ্গ উঠছে। ময়না তার বাবাকে আমার চেয়ে ভালো চেনে নিশ্চয়ই। সে ইনসানকে দ্রুত জানালা দিয়ে বের করে দিলো। মৃতের ফ্যাকাসেভাব সে বেচারির মুখে। বললো, যাও এইবেলা। কী হলো পরে জানতে পারবে। এখনই বেরিয়ে না গেলে খুন হয়ে যাবে। দ্রুত হাতে ঠেলে ইনসানকে জালনা পার করে দিলো ময়না। হাতে যা পেলো, তাই পরে নিলো ইনসান। তার মধ্যে ছিল, ময়নার হাতে বোনা ওই উইলের সোয়েটারটা।
ভাঙা জালনা দিয়ে বেরিয়ে এলাম বাড়ি থেকে। বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে তিন মাথার (মাথায় এত চুল যে মাথা আর দুটো খোঁপায় মনে হবে যেন এক ঘাড়ে তিনমাথা) সেই মেয়েটার চোখে জল। কিন্তু কী করার থাকতে পারে এখানে ইনসানের। এ তো পালে হাওয়া লাগা না, রীতিমতো ঝড় আসছে ধেয়ে। তাই দেরি না করে দ্রুত পগারপারের ধান্ধায় সে দৌঁড়াতে লাগলো।
চলছে…
বিধ্বস্ত নগরী: পর্ব-৭॥ রাশেদ সাদী