পর্ব-৬
এটা একটু পড়বেন। একটু বিবর্ণ হয়েছে। সালিমার কথার কিছুই আমি বুঝতে পারলাম না। অক্ষরিক অর্থে যা বোঝায়, আমি সেই অনুযায়ী কাজ করলাম। গেঞ্জিটা পরে নিলাম। গায়ের সঙ্গে সেঁটে বসে বুকের পেশী বেরিয়ে এলো। সালিমা আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখলো। যেন আমি মিকেলেঞ্জেলোর সেই ডেভিড। ওর চোখ বোধ হয় একটু সজল হয়ে ওঠল। ডেভিডকে দেখে!
একদম সেই স্বাস্থ্য, সেই চোখ, সেই নাক। একদম ওর মতো।
আমি এখনো তার কথার কোনো অর্থ ধরতে পারছি না। তবে কিছুটা বোধ হয় আনতান করতে পারছি। ও কারও সঙ্গে আমার তুলনা করছে, যিনি আবার ওর খুব প্রিয় হবেন হয়তো। তাই ওর ইচ্ছের কাছে নিজেকে সঁপে দিলাম। ও যেখাবে খুশি আমাকে দেখুক। চোখ ভরে দেখুক। আমার কেবল মনে হলো কোনো এক ঝর্ণার উৎসের সদ্ধান পেতে যাচ্ছি আমি। যেকোনো কিছুতেই সেটা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ভয়ে ভয়ে তাই চলতে হবে। সহজে কোনো কথা বলা যাবে। কী থেকে কী বলি আর পরিবেশ বিরুদ্ধবাদী হয়ে; তার কী দরকার। অপাদত মুখটা সেলাই করে রাখাই ভালো। আমি তার দিকে তাকালাম না পর্যন্ত। ইটের টুকরো নিয়ে খেলছি আমি। যেন খুব মনোযোগী তাও না বোঝা যায়, আবার একবারে অমনযোগী তাও মনে না হয়। পরিস্থিতিটাকে একটা টোপ বলা যায়, যাতে মাছ আপনি এসে ধরা দেয়, আসলে হয়েছে কী, আমি একজনকে ভালোবাসতাম, এখনোা বাসি। এটা তার বাড়ি।’ সালিমা চোখ মুছে বাড়িটার গায়ে তার আদরমাখা দৃষ্টি বুলিয়ে দিলো।
-খুব ভালোবাসতাম। আমাকে সে, তাকে আমি। আমার বাড়ির কেউ রাজি ছিল না। বাবার কথা, পড়াশুনা শেষ করো, আরও বড় হও, তার পর দেখা যাবে। পালিয়ে যাব আমরা এমন কথা হচ্ছিল আমাদের। এর মধ্যে রোড একসিডেন্ট হলো। পেছন থেকে আমার স্কুটিটাকে মেরে দিল ট্রাক। কোমায় চলে গেলাম। আমি হাসপাতালে মুমূর্ষু হয়ে পড়ে আছি। মনে হচ্ছিল, মৃত্যু আর জীবনের মাঝামাঝি একটা জায়গায় আমি একটুকরো কাপড়েরর মতো দুলছি। সে কাপড় কখনো লাল হচ্ছে, কখনো সবুজ হচ্ছে। বোধ বলতে আমার এইটুকোই।
এভাবে ধীরে ধীরে আমি একজন শিকারীতে পরিণত হলাম। সঙ্গে যুক্ত হলো রকেট আর স্নাইপার। তার মধ্যে আজকে রকেটকে হারালাম।
এভাবে কতদিন কেটে গেছে কিছুই জানি না। দিন, মাস, বছর কিংবা কোটি বছর কেটে গেছে। অতঃপর যখন সচেতভাবে প্রথম শ্বাস নিলাম, মনে হলো নাক দিয়ে একমুঠি বালু ঢুকছে। পৃথিবীর এই মুখ দেখে মনে হলো লোকটা বুড়িয়ে গেছে আর আমি একটা টেবিলের তলে পড়ে আছি। লোহার টেবিলটা বেকে আমার বুক থেকে এক বিঘত দূরে হাত বাড়িয়ে রেখেছে। মাথার দিকটা আধো উন্মুক্ত। সেখানে আলো-হাওয়া খেলছে। হঠাৎ খেয়াল হলো, ইট-সুরকির তলে অর্ধেকটা আমি ঢাকা পড়ে আছি। নিজেকে কোনো মতে টেনে তুললাম।
শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা করছিল। মনে হচ্ছিল কামানের গুলায় আমি লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া কোনো ভাস্কর্য। বেরিয়ে যে পৃথিবীর মুখোমুখি হলাম;তাতেই বললাম এককোটি বছর ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেছে। ধ্বংস, ধ্বংস আর ধ্বংস। শরীর পচে উঠার বিটকেল গন্ধ। মুহূর্তে আমার ভেতরটা যেন খালি হয়ে গেল। কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই; এ কোথায় এসে পড়লাম। মনে হচ্ছে, এখনো আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছি আর এসব স্বপ্ন দেখছি। নিচের মুখের চিরপরিচিত রেখাগুলো মুছে যাওয়ার মতো। যেন নিজেকেই চিনছি না। আমি পাগলের মতো কিছুক্ষণ ছুটলাম। কোথায় যাচ্ছি কিছুই জানি না। একটা অকূল সমুদ্রে পড়ে যাওয়ার চেয়ে এই আরও যন্ত্রণার। সমুদ্রে? মেঘে? বনে? কোথায় না? সব জায়গায় শুধু ধ্বংস, ধ্বংস!
প্রথম কদিন না খেয়ে কেটে গেল। এক সময় আর যখন পারি না, তখন গাছ-পাতা খেতে শুরু করলাম। ধ্বংস স্তূপ ঘেটে চললাম, যদি কিছু মেলে। লাশ পচে ওঠার গন্ধে কোথায় টেকা দায়। হাটতে হাটতে মনে হলো এখন কোনো গন্ধ পাচ্ছি না। কারণ অনুসন্ধান করে দেখলাম, এটা সেই গার্মেন্টস এলাকা। সারাদিন কাজ করে রাতের বেলা যা একদম মানুষ শূন্য হয়ে যেতো। পরে এদিকেই আস্তানা গাড়লাম। খাবার চিন্তা ছিল, অতপর খাবারের ব্যবস্থাও হলো। কী হলো, সেটা বলি।
সালিমা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো, একদিন সকাল বেলা, ঘুম থেকে উঠে দেখি একটা সুন্দর পাখি, নাম জানি না, ছোট কালচে, গলার কাছে সাদা, ইটের স্তূপে উড়াউড়ি করছে। তার ওড়ার দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ মনে হলো, পাখিটা ওড়াল দিয়ে একহাত দূরে গিয়ে বসে কি যেন মনোযোগ দিয়ে ঠোট দিয়ে ঠুকরাচ্ছে। আবার উড়াল দিয়ে দুই হাত দূরে গিয়ে আবার ঠুকরাচ্ছে। বোধ হয় খাবার খাচ্ছে। আর তখনই যুগান্তকারী সেই চিন্তাটা আমার মাথায় খেলে গেল। এই তো আমার খাবার। এই সুন্দর পাখিটা মধুর খাবার হতে পারে আমার। এভাবে ধীরে ধীরে আমি একজন শিকারীতে পরিণত হলাম। সঙ্গে যুক্ত হলো রকেট আর স্নাইপার। তার মধ্যে আজকে রকেটকে হারালাম।
হাটার মধ্যেই একদিন রকেট আর স্নাইপারকে পেলাম। ওরা এক বন্ধ খাচায় ইটের নিচে প্রায় চাপা পড়ে ছিল। না খেয়ে প্রায় অর্ধমৃত। রকেট আর স্নাইপারকে উদ্ধার করে তাদের খাইয়ে-দাইয়ে বড় করে তুললাম। তখন ছিল ছুট্টটি। একদম এতোটুকো।
অন্তত তুমি আমাকে এইটুকো অধিকার দিয়েছ বলে ভেবে আনন্দ হচ্ছে। এর জন্য ধন্যবাদ। আর এই তুমি বলে ডাকলে আমি অত্যন্ত খুশি হবো।
দুটো হাত এক করে সারিমা দেখাল। তার মধ্যে একজনকে আজ হারালাম। স্নাইপার এখন একলা হয়ে গেল। গিয়ে ওকে কী বলবো? কেমন যেন লাগছে। সালিমা বুকে মৃদু চাপড় দিয়ে বললো।
: ওই ছেলেটার খবর কী?
: রুকন? জানি না। করো খবরই তো জানি না। হয়তো দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে মরে গেছে।
: আমরা যে থাকি, ওখানে দেয়ালে যে ছটিটা। উনি কি তোমার মা? আচমকা আমার মুখ থেকে বেরিয়ে যায় প্রশ্ন। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে সালিমা আমাকে দেখে, আপনি জানলেন কী করে? তাছাড়া ছবিটা তো ঝাপসা। কিচ্ছু বুঝার উপায় নেই।
আমি শুধু একটু মাথা নাড়রাম, চলুন বেরুনো যাক। সালিমা আমার হাত ধরে টান দিল। আমি তার পাশে হাটছি। হাতে নুন-মশলার বয়ামগুলো ধরা।
: একদম ওর মতো। সঙ্গে সঙ্গে ফের আমি রক্ষণভাবে চলে এলাম। সব রকম প্রশ্ন করা থেকে সতর্ক হয়ে গেলাম। মাছ যেহেতু ভিড়েছে, সে আমারই হবে। তাছাড়া ছেলেটার কথাও আমার শুনা উচিত; আবার সালিমাকে কোনো রকম অস্বস্তিতে না ফেলে। তাছাড়া সেই ছেলের কথা আবার ওঠেছে যেহেতু, যেকোনো কিছুতেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে উৎসের মুখ। কারণ মেয়েরা মনে করে, এক ছেলে অন্য ছেলেকে ঈর্ষার চোখে দেখে। দেখে বৈকি। তবে একজন মৃত মানুষকে নিয়ে আমি কেন ঈর্ষা করবো? সালিমা অবশ্য একবার বোধ হয় আড়চোখে আমাকে দেখে নিল আর আমি যতটা সম্ভব নির্বিকার থাকার চেষ্টা করলাম।
: আপনার অনেক কিছুই তার সঙ্গে মিলে যায়, জানেন। রুকনের মতো করে হাটেন আপনি। কেমন ধুলো উড়ি চলার মতো সে পা মাটিতে ঘষে ঘষে হাটত। এমন কিছু করে অথবা এমন কিছু বলে আমাকে হতবাক করে দিত।’
হাটা থামিয়ে একটা স্তুপের পাশে দাঁড়াল সালিমা,
: এই যে দেখছ এলুমিনিয়ামের স্তুপ, এটা ছিল এই নগরের সবচেয়ে বড় হোটেল। পাঁচতারা। এখানে পৃথিবীর বিচিত্র নারী-পুরুষরা মিলিত হতো। এই যে এখানে ছিল বারটা। পৃথিবীর বড় বড় শিল্পীরা এসে গাইত। আমি এসেছিলাম ওর সঙ্গে। আমি আসতে চাইনি, রুকন বলল, সব কিছুর অভিজ্ঞতার দরকার আছে। মানা না করে চলো। এলাম। সত্যি কথা হলো, আমার ভালো লাগেনি। তার চেয়ে বাসায় নিজের রুমে বসে খেতে আমার বেশ লাগে। ঢুকে বেরুনোর জন্য তাগাদা করছিলাম।
আমি দেখলাম মেঝেতে একটা গর্ত। পানি জমেছে। মৃদু কাঁপছে। কতগুলো অবরুদ্ধ গলা যেন ওখানে আটকে আছে। কতগুলো চিৎকার টানটান মোটা কাছির মতো কেপে কেপে বেরিয়ে এসে পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়বে।
: কী হলো, আবার সাংসারিক চিন্তায় ডুবে গেলে নাকি? হাহাহাহা। চলো এইবার যাওয়া যাক। ওফ! দুঃখিত আপনাকে আমি তুমি বলছি। কিছুতেই এমন ভুল হওয়া উচিত না। স্যরি।
হঠাৎ খেয়াল হলো সালিমা আমাকে ‘তুমি’ বলে ডাকছে। মনে হলো এই প্রথম। নাকি আগেও ডেকেছে? আগে আর কবে? আগে এক হাজার বছর, এক লক্ষ বছরও তো আছে। হয়তো একলক্ষ বছর আগে থেকেই ডাকছে। আমি সালিমাকে বললাম, চলো। আর ওই তুমি বলার জন্য নিজে আমি কৃতজ্ঞ মনে করছি। অন্তত তুমি আমাকে এইটুকো অধিকার দিয়েছ বলে ভেবে আনন্দ হচ্ছে। এর জন্য ধন্যবাদ। আর এই তুমি বলে ডাকলে আমি অত্যন্ত খুশি হবো।
চলবে…
বিধ্বস্ত নগরী: পর্ব-৫ ॥ রাশেদ সাদী