পর্ব-৪
কোন কথা কিসে লাগায় আর কিভাবে লাগায়? আপনার উর্বর ঘিলুতে দেখি অসম্ভব কিছু নেই। বলে সালিমা আমার দিকে চোখ পাকিয়ে চেয়ে হাসে।
আমি হাসি। সেও হাসে।
সালিমা আর কিছু বলল না। চলার নির্দিষ্ট কোনো সড়ক নেই। লোহলক্কর আর ইটের দঙ্গলে হরিণীর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে সে। তার পাশাপাশি চলেছে তার আদরের কুকুর রকেট। আমি তাদের অনুসরণ করছি।
বিচিত্রভাবে দালানগুলো ভেঙে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় কোনো ভাস্কর্যের নগরীতে এসে পড়েছি। বিস্রস্ত দৃষ্টির কারণে এখানে সেখানে হুচট খাচ্ছি। সালিমা একটি বারের জন্য পেছন ফিরছে না। যেন তার সঙ্গে কেউ নেই। এভাবে সে হেটে চলেছে। এদিকে আমার কবিত্ব কর্পুরে উড়ে যাচ্ছে প্রতিটি হুচটের সঙ্গে সঙ্গে। থেকে থেকে হুচট খেয়ে দিশা হারিয়ে ফেলছি।
কেউ যেন সাইবেরিয়ার সোদর বোন ইট-সুরকির মাঝ সমুদ্রে নামিয়ে দিয়ে গেছে, যা কোনো দিন আর শেষ হবে না। হাঁটছি, হেঁটে কোথায় যাচ্ছি জানি না। সালিমা হঠাৎ থেমে বললো,
: এই দৃষ্টিনন্দন মসজিদ স্থাপত্যে আগা খান পেয়েছিল। এর ছাদময় ছিল পারস্য স্টাইলের সব লতাপাতা, দেয়ালময় ছিল কোরানের সব কটি আয়াত। গম্বুজটা ছিল মদিনার মতো সবুজ। ছাদ ফুঁড়ে আসত আলো কিন্তু বৃষ্টি ভেতরে ঢুকতো না। এটা হলো গির্জার নেইভ। অনেক পুরনো এই গির্জা পর্তুগিজদের হাতে প্রতিষ্ঠিত আর এটা মোঘলদের দুর্গ—এটা ছিল মোঘলদের দুর্দান্ত সব জিনিসে পরিপূর্ণ। আজ যা প্রকৃতির এক ফুয়ে ধুলোয় মিশে গেছে। আর এই চত্বর—এটাকে আমরা বলতাম মিলনমেলা—মস্কো স্কয়ারের চেয়ে যা ছিল যাক-জমকপূর্ণ। এর ডানদিক ঘেষেই এই যে জঙ্গলটা—এটা ছিল পার্ক—এক সময় প্রেমিক-প্রেমিকাদের সেংচুয়ারি। এখন বন্য পশুপাশির অভয়ারণ্য—শিকারের চমৎকার জায়গা।
শিকারের জায়গায় এসে রকেট অদৃশ্য কিসের যেন গন্ধ নিচ্ছে আর এদিক-ওদিক ছুটে যেতে চাচ্ছে। একেই বলে নগর পুরিলে দেবালয় বাদ যায় না। আমি একটা গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে বললাম।
সেই টানে পা ফেলায় অতি সতর্ক আমি ছিটকে পড়লাম মাটিতে। পড়েই দেখলাম রকেট সালিমার হাতে। গলার দড়িটা ধরে আছে সে।
ভাবছিলাম, কত পুরনো নগর, আজ যার কোনো কিছুরই অস্তিত্বই নেই। এভাবেই পৃথিবীর কত শত শত নগরী যেন মানুষের অজ্ঞাতে বিলীন হয়ে গেছে। যার কোনো চিহ্নও মানুষ খুঁজে পায়নি। তখন মনে হচ্ছিল, আমি সম্মোহিত হয়ে হড়েছি।
ভাবছিলাম, বিধ্বস্ত নগরীতে পা ফেলছি টিপে টিপে আর শত শত বছরের ইতিহাস আমাকে জাপটে ধরছে। কত প্রেম, অহংকার, দম্ভ আর দুঃখের নাটকই না একদিন এখানে সমাপ্ত হয়েছে। দাঁতাল দানবের মতো যা এক চিবুনিতে হজম করে ফেলেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
কত স্বৈরাচার এসেছে, শোষণ করেছে—বিকৃতির পথে হেঁটেছে। ধর্ষণ করেছে শহরের প্রতিটি ধুলিকণা। যার পরিণতিতে এক ভয়াবহ দৃশ্যের অবতারণা করেছে প্রকৃতি। একেই বলে প্রকৃতির বিচার। অনুপুঙ্খ আদার করে নেওয়া।
এই সেই শহর—যেখানে শত বছর আগের খুনির কঙ্কাল তুলে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল। চার দিকে থুথু ছিটিয়েছে জনগণ। থুথুতে গোছল করে আবার এই শহরের পাজরেই আশ্রয় নিয়েছে এক বিশ্বাসঘাতক। তার থেকে জন্ম নিয়েছে শত শত বিশ্বাসঘাতক। অতঃপর তারাও বাদ যায়নি; যারা এই বিশ্বাসঘাতকদের বিচার করেছিল। যে পাঁজরে ক্রমে ক্রমে সবাই তলিয়ে গেছে।
এই দৈত্যের একদিন সময় হয়েছে, মনে হয়েছে অনেক দেখিয়েছ মানুষ, আর না, এবার আমারটা দেখ। তখন ভালো-মন্দো নির্বিশেষে নির্বিবাদে গ্রাস করেছে এবং সেই দৈত্যেরও একদিন মৃত্যু হয়েছে। ফলে ধ্বংস দানবের বুক চিরে প্রবাহিত হয়েছে নদী, বৃক্ষ, লতা, পশু, পাখি।
কী হলো। অমন উদাস দার্শনিক হয়ে বসে থাকলে খাবার মিলবে? চলুন নেমে পড়ি। সালিমার কথা শুনে অনন্ত জল ঘেটে আমি যেন জেগে উঠলাম।
হ্যা, হ্যা। চলো শুরু করা যাক। বলে আমি জিমকর বেটের ব্যাখ্যায় চলে গেলাম। সালিমা বললো—
এখানে বই পড়া জিমকর বেটের চেয়ে আমার কথা শুনেন, কাজে দেবে। নয় শেয়ার বাজারের বিশ্লেষকের কথা শুনার মতো অবস্থা হবে। শিকার তো পাবেনই না; আম-ছালা দুটোই হারানোর আশঙ্কা আছে।
আচ্ছা বলো। তুমি যা বলবে তাই হবে।
কিন্তু গাছের ছায়ায় বসে আয়েস করে জিম করবেট কপচালে হবে?
আলসেমি আমার মজ্জগত। অথচ সালিমা তার উল্টো। সে যেন বসেই থাকতে পারে না। কিছু একটাতে তাকে লেগে থাকতেই হবে। সুপার লেভের তৎপর যাকে বলে সে তাই। অবশ্য আমার মতো কুড়ের জাহাজের পক্ষেতো বটেই, আমি মনে করি, একজন কর্মঠ লোকও তাকে দেখে ঘাবড়ে যাবেন।
সালিমা রকেটের দড়িটা আমার হাতে দিয়ে বললো, সাবধানে, নিঃশব্দে এগোন। শব্দ যাতে না হয় তাই জুতা খুলে ফেললাম। সালিমা তো এমনিতেই খালি পা।
সে বা রকেট এতো নিখুঁতভাবে এগুচ্ছে যে একটা পিঁপড়েও টের পাচ্ছে না। কিন্তু মাঝে মাঝে অনিচ্ছায় আমার পায়ের তলায় পাতা পড়ে মুড়মুড় করে উঠছে। সঙ্গে সঙ্গে সালিমা আমার দিকে অস্বস্তি নিয়ে তাকাচ্ছে। সেখানে লেখা—আরও সতর্ক, আরও সতর্ক! রকেট তার মালকিনের কথা বুঝে ঘন ঘন কান নাড়াচ্ছে। বিধস্ত নগরীর কুকুর তক বুঝে গেছে, শিকার না হলে পেটে কিছু যাবে না। ফলে যে করেই হোক শিকার করতেই হবে।
বিক্ষিপ্ত পদক্ষেপের মধ্যেই হঠাৎ মনে হলো একটা সাদা কানের মতো কিছু একটা নড়ছে। আমি আরও সতর্ক হতে চেষ্টা করলাম। যাতে কিছুতেই পায়ের তলে পাতা পড়ে মুড়মুড় করে না ওঠে।
কিন্তু সহসা এমন এক ঘটনা ঘটে গেল, যার জন্য আমি কিছুতেই প্রস্তুত ছিলাম না। আতকা দৌড় দিয়ে আমার হাত থেকে রকেট ছুটে গেল। সেই টানে পা ফেলায় অতি সতর্ক আমি ছিটকে পড়লাম মাটিতে। পড়েই দেখলাম রকেট সালিমার হাতে। গলার দড়িটা ধরে আছে সে।
রকেট সমস্ত শক্তি এক করে সামনের দিকে ঝুকে আছে। ছুটে যেতে চাচ্ছে সামানের দিকে। আমার এই আকস্মিক পতনে সালিমা হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো করে রকেটকে ছেড়ে দিলো।
অবশ্য প্রেমে আমি আগেই পড়েছি তার, তবে তা হয়তো শুধু ছিল শরীর কেন্দ্রিক, এবার মনের দোয়ার খুলে গেলো। আমার চোখও ভিজে উঠলো জলে।
দিলেন সব শেষ করে। সালিমা আমার দিক আসতে আসতে বললল। আমি লজ্জিত হয়ে বললাম—অতি মাত্রায় সতর্ক ছিলাম কি-না। একটু রসিকতা করে বিষয়টাকে হালকা করতে চাইলাম।
যা হোক, সালিমা সমাধান দেওয়ার মতো করে বললো, আজকে তা হলে না খেয়েই আপনাকে কষ্ট করতে হবে। যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে। পুকুর পাড়ে আমি আর যেতে পারব না।
তাহলে তোমারও তো না খেয়ে থাকতে হবে।
আমার চলে যাবে। খেলেও যা, না খেলেও তা।
কিন্তু হাল ছেড়ে দিলে হবে? আমার তো চলবে না।
হেসে বললাম।
কী বললেন, হাল! যতই হাল, পথ ধরুন—এখানে আর আজ শিকার করতে হচ্ছে না। যা চালাক ওরা। একবার মিস হয়েছে মানে সারাদিন ধরেও আর শিকারের দেখা মিলবে না। তাও এক সপ্তাহ পর এলাম এ তল্লাটে। কারণ শিকারের জায়গা আমি ক্রমাগত পাল্টাই। এতে শিকার পেতেও সুবিধা হয়, আমার নিজেরও ভালো লাগে।
যে পালিয়েছে তার টিকিটি আমরা খুঁজবো না তো। যদি একটা গুইসাপ মিলে তাও তো মেলা। আমাদের মাংস খাওয়ার ইচ্ছেটা পূরণ হয়। সালিমার বোধ হয় কথাটা পছন্দ হলো।
হ্যাঁ, আমাদের শুধু খরগোস খেতে হবে—সে দিব্যি কে দিলো? চলুন তাহলে। রকেট, রকেট কোথায়?
সালিমার মধ্যে ফের শিকারের আগ্রহ ফিরে এলো।
ওই তো…।
আমরা বিস্ময় নিয়ে দেখলাম, রকেট হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরছে। দৌড়ানোর জন্য ঘন ঘন পেট ওঠা-নামা করছে। মুখে তার একটা সাপ কিলবিল করছে।
সালিমা চিৎকার দিয়ে উঠলো—কালকেউটে!
দাঁতের ভেতর থেকে মুচড়িয়ে মুচড়িয়ে রকেটের মুখে চোখে ছোবল দিচ্ছে। সালিমার আকুলতা দেখেই বুঝলাম বিপদ ঘনিয়ে আসছে। সে যেই দৌড় দেওয়ার উদ্যোগ করছে, ওমনি আমি তাকে চেপে ধরলাম।
পাগল নাকি, হ্যাঁ, ওটা তো সাপ! কাছে গেলে তোমাকেও ছোবল দেবে। তাকে ঠেলে দূরে নিয়ে যেতে যেতে আমি বললাম।
রকেট আমাদের আর দিকে দুটো কি তিনটা পা ফেলে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। মুখ থেকে ফেনা বেরিয়ে এলো। আহত সাপটার মেরুদণ্ডের হাড়টা কয়েক জায়গায় ভেঙে যাওয়ায় সে নড়তে পারছে না।
রকেট তার লোমশ কান নাড়ছে, পাগুলো ওপরের দিকে ছুড়ছে। মনে হচ্ছে হাত-পা ছুড়ে কাকে যেন শাসাচ্ছে। এক সময় তার শাসানি স্তব্ধ হয়ে গেলো। ওদিকে আহত সাপ জায়গাতেই পড়ে আছে, ওপরের অর্ধেক চলে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
আমি সালিমার হাত শক্ত করে ধরে দূরে দাঁড়িয়ে আছি। সালিমা তাকিয়ে তাকিয়ে তার প্রিয় সঙ্গীর মৃত্যু দেখছে। চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে সালিমা।
এই প্রথম বোধ হয় কারও প্রতি পূর্ণ মমত্ব বোধ হলো আমার। আমি জানি না মমতাই প্রেম কি না। যদি হয়—তাহলে আমি জীবনে এই প্রথম কারও প্রেমে পড়েছি বলে অনুমান করা যায়। অবশ্য প্রেমে আমি আগেই পড়েছি তার, তবে তা হয়তো শুধু ছিল শরীর কেন্দ্রিক, এবার মনের দোয়ার খুলে গেলো। আমার চোখও ভিজে উঠলো জলে।
চলবে…
বিধ্বস্ত নগরী: পর্ব-৩ ॥ রাশেদ সাদী